ধরা যাক শিশুশ্রমের কথা। ইউরোপের মানবতাবাদীগণ শিশুশ্রমের বিষয়কে ভয়ংকর অপরাধ বলেই গণ্য করেন। আমি নিজেও তাদের সাথে একমত, একজন শিশুর জন্য প্রয়োজন খেলাধুলা, খেলাধুলার মাধ্যমে শিক্ষা এবং তার মানসিক বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত পরিবেশ। এতে আমার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই, বরঞ্চ সমর্থন রয়েছে। শিশু বয়সেই একজনকে কাজ করতে হলে তার শৈশবের সুন্দর দিনগুলো, ঠিকভাবে বেড়ে ওঠার সম্ভাবনাগুলো অনেকাংশেই নষ্ট হয়ে যায়। যেই শিশুটি ছোটবেলা থেকেই টাকা পয়সা উপার্জনের জন্য পরিশ্রম করতে বাধ্য হয়, সে শর্টকাট পদ্ধতিতে ধনী হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারে, সেই স্বপ্ন থেকে অপরাধীতে পরিণত হতে পারে। শিশুর মানসিক বিকাশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, একে খাটো করে দেখার বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই।

কিন্তু ইউরোপ আর দক্ষিণ এশিয়ার বাস্তবতা ভিন্ন, একেবারেই আলাদা চেহারা। ইউরোপে রাষ্ট্র একটি শিশুর প্রতি কতটা যত্নশীল তা কল্পনা করা যায় না। গর্ভবতী মা থেকে শুরু করে শিশুটির বেড়ে ওঠা, স্কুলে আনন্দের সাথে পড়ালেখা, খেলার মাঠ, রাস্তা পার হওয়া থেকে শুরু করে এমন কিছু নেই রাষ্ট্র যা নিয়ে মাথা ঘামায় না। সে কী খাচ্ছে, কী পান করছে সবকিছুই কঠোরভাবে পরীক্ষা করা হয়। আর আমাদের দেশে সেই সময়গুলো শিশুদের ইট ভাঙতে হয়, মাথায় এত বড় বোঝা নিয়ে কাজ করতে হয়। স্কুল কী তারা জানে না, খেলার মাঠ তারা হয়তো কোনদিন চোখেও দেখেনি। আর খাবার দাবার, তা তারা যা পায় সেটাই খেয়ে নেয়। খাদ্যবস্তুর মান বিচার তো বহু দুরের ব্যাপার, ডাস্টবিনে একবেলা খাবার পাওয়া গেলেই অনেক বড় ব্যাপার।

আমাদের শিশুদের এই অবস্থার কারণ অনুসন্ধান না করে শুধুমাত্র “শিশুশ্রম বন্ধ করো” টাইপের স্লোগান ইউরোপের অধিকাংশ মানবাধিকার সংগঠনের অন্যতম দাবী। কিন্তু এই শিশুগুলো কাজ না করলে তাদের কী অবস্থা হবে? ইউরোপের মানবাধিকার সংগঠন গুলো কী তাদের ভরণ পোষণের দায় নেবে? আমি শিশুশ্রমের পক্ষে কোনভাবেই নই, কিন্তু বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। মানবাধিকার রক্ষা করতে হয়ে শিশুদের খেয়ে পরে বেঁচে থাকার অধিকার ক্ষুণ্ণ হলে সে মানবাধিকার দিয়ে কী হবে?

দীর্ঘ সময় ধরে অ্যামনেস্টির কর্তাব্যক্তিদের সাথে যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড দেয়ার ব্যাপারে প্রচুর তর্ক বিতর্ক হয়ে যাচ্ছিল। আমি নিজেও মৃত্যুদণ্ড প্রথার বিরুদ্ধে। কিন্তু বাঙলাদেশের পরিস্থিতি এবং ইউরোপের মানবাধিকার পরিস্থিতি এক রকম নয়। যেই দেশে ধর্ষিতাকেই বিচার চাইতে গেলে দোররা মেরে হত্যা করা হয়, যেই দেশে অসংখ্য মানুষ একজন উকিল যোগার করতে না পারায় আদালতে শাস্তি পেয়ে যায়, যেই দেশে ৩ বছর ধরে একজন জেল খাটে অথচ কেউ জানে না সে কী অপরাধে জেলে আছে, যেই দেশে লক্ষ লক্ষ্য মানুষ হত্যার পরেও রাজাকাররা গাড়িতে বাঙলাদেশের পতাকা লাগিয়ে ঘোরে, আমাদের নেতা বনে যায়, এরকম পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড নিয়ে অ্যামনেস্টি এত বেশি সোচ্চার কেন? যেখানে হাজার হাজার মানুষ টাকার অভাবে বা রাজনৈতিক কারণে মৃত্যুদণ্ড পাচ্ছে, সেখানে অ্যামনেস্টি কোথায়? তারা কেন শুধু গণহত্যাকারী ইসলামী মৌলবাদী রাজাকারদের মৃত্যুদণ্ডের সময়ই বিশাল বিশাল বিবৃতি দেয়? আর এই রাজাকাররা ক্ষমতা হাতে পেলে, শরীয়া আইন কায়েম করে প্রকাশ্যে কল্লা কেটে মৃত্যুদণ্ড চালু করলে তখন তারা কী করবে? তাদের দেশ পাকিস্তান আর সৌদি আরবে মানবাধিকার পরিস্থিতি কেমন?

এসব খুব কড়া সুরে অ্যামনেস্টির অফিসে গিয়ে বলছিলাম। তারা আমাকে বারবার বলছিল, তারা সকল মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধেই সোচ্চার। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় তারা সোচ্চার? ১৫২ জন বিডিআর সদস্যকে যখন মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো, যাকে আমি বলেছিলাম রাষ্ট্রীয় গণহত্যা, তার চাইতে অনেক বেশি সোচ্চার তারা ছিল শুধুমাত্র কাদের মোল্লা ইস্যুতে। মৃত্যুদণ্ড প্রথা অবশ্যই অমানবিক, অবশ্যই আধুনিক মানবিক রাষ্ট্রের ধারণা থেকে বহু দূরে। রাষ্ট্র কখনই প্রতিহিংসা পরায়ণ হতে পারে না। মানুষ হত্যার কিংবা রাষ্ট্রীয় খুনের কোন মানবিক পদ্ধতি থাকতে পারে না। সকল হত্যাকাণ্ডই বর্বর এবং অমানবিক, তা একজন খুনির দ্বারা হোক কিংবা রাষ্ট্রের দ্বারা। আধুনিক বিচার পদ্ধতি এবং শাস্তি প্রদান করার মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে অপরাধীকে অপরাধ সংশোধনের সুযোগ দেয়া, কিন্তু এই মৃত্যুদণ্ড কোন অপরাধীকে অপরাধ সংশোধনের সুযোগও দেয় না। এই ১৫২ জন মানুষের বিচার হয়েছে মানুষেরই আদালতে, এবং পৃথিবীর কোন বিচার ব্যবস্থা কিংবা আদালতই ত্রুটিমুক্ত নয়, এবং এদের বিচারের পুরো প্রক্রিয়াই হয়েছে সেনাবাহিনীর অদৃশ্য নির্দেশে। পরবর্তীতে যদি জানা যায় এদের মধ্যে একজনও নির্দোষ ছিল, তাদের জীবন কী এই রাষ্ট্র ফিরিয়ে দিতে পারবে? বিডিআর বিদ্রোহে আসামীদের মধ্যে ১৫২ জনকে ফাঁসি, ১৫৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড সহ ২৩৫ জনের বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। এরকম রায় শুধু যুদ্ধপরবর্তী দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে দেয়ারই নজির রয়েছে, কোন স্বাধীন দেশে এরকম নজির খুব একটা নেই। ১৫২ জনের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলে বাঙলাদেশ মৃত্যুদণ্ড দেয়ার ব্যাপারে এমনকি সৌদি আরবকেও টেক্কা দিয়ে পৃথিবীর তৃতীয় বর্বর রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য হবে।

কিছুদিন আগেও আমি জেলে ছিলাম, সেখানে শুধুমাত্র ৫৪ ধারায় আটক হওয়া অসংখ্য মানুষ বিনাবিচারে বছরের পর বছর বন্দী। এরা কেউ গ্রাম থেকে শহরে আসছিল, সেদিন হরতাল হওয়ায় তারা পুলিশের গণগ্রেফতারের মুখে পরেছে। র‍্যাব ডিবি সহ আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রতিদিন ক্রসফায়ারের নামে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালায়, গোয়েন্দা অফিসে যারা ঢোকে তাদের অনেকেরই আর কোন খোঁজ পাওয়া যায় না; কিন্তু যখন সবাইকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র চিহ্নিত কিছু প্রমাণিত যুদ্ধাপরাধী, নারী ধর্ষক, খুনি, সংখ্যালঘু নির্যাতনকারী, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করা, ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করা কুলাঙারের মানবাধিকার রক্ষা মুখ্য হয়ে ওঠে, তখন তাদের সততা নিয়ে প্রশ্ন জাগতেই পারে।

এই নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ তাদের সাথে তর্ক বিতর্কের পরে এখানকার অ্যামনেস্টি প্রধান বিডিআর বিদ্রোহে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া ১৫২ জনার মৃত্যুদণ্ড রোধের ব্যাপারে আবারো অফিশিয়াল চিঠি দেয়ার অঙ্গীকার করেছেন। এবং সেই সাথে একটি অফিশিয়াল চিঠি বাঙলাদেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সেই সাথে এই নিয়ে তারা আরো কিছু কাজ করবেন বলেও জানিয়েছেন। বিডিআর বিদ্রোহে আসামী কয়েকজনার সাথে জেলে থাকতে কথা হয়েছিল। ৬ হাজার বিডিআর সদস্যকে সেনা আদালতে শাস্তি প্রদানের পরে ৮২৩ জনকে আবারো বিচার করা হয় সিভিলিয়ান কোর্টে। একই অপরাধের জন্য দুটি পৃথক আদালতে দু বার শাস্তি দেয়া কীভাবে সম্ভব আমার জানা নেই। বিদ্রোহের পরবর্তী এক দেড় বছর সেনাক্যাম্পে তাদের পায়ের মধ্যে রড ঢুকিয়ে ঝুলিয়ে বছরের পর বছর নির্যাতন করা হয়েছে, অসংখ্য বিডিআরকে তখন প্রতিশোধ নেয়ার নামে হত্যা করা হয়েছে। সেনা আদালতে বিচারের সময় বন্দী ৫০ জনারও অধিক বিডিআর সদস্যের মৃত্যুর রিপোর্ট পাওয়া গেছে। বিদ্রোহের পরে কয়েকদিন অনেক নদীতে ভেসে উঠেছিল বিডিআর সদস্যদের লাশ। অনেক বিডিআর সদস্যকে আর্মী তুলে নিয়ে গেছে, যাদের পরে আর কোন হদিসই পাওয়া যায় না। সরকারও যেন প্রকাশ্য হত্যার লাইসেন্স দিয়ে দিয়েছে, ভাবখানা এমন যে, আর্মী কিছু বিডিআর হত্যা করে, তাদের প্রতিশোধ নিয়ে অন্তত ঠাণ্ডা থাকুক! আর তাদের বিচারের নামে যা হচ্ছে তা নিতান্তই কোন কোন পক্ষের মন জোগানো ছাড়া আর কিছুই নয়। যারা সত্যিকারের দায়ী ছিল, তারা অনেকেই এখন নাকি অনেক ক্ষমতাবান! বিডিআর সদস্য অধিকাংশ তরুণই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি, এতগুলো বছর ধরে জেলে থাকায় তাদের পরিবারগুলো আর ধ্বংসে মুখে। তাদের পিতামাতা আর দারুণ অভাবে মৃতপ্রায়, তাদের স্ত্রী আজ পেটের টানে দেহব্যবসা করতে বাধ্য, তাদের সন্তানরা আজ নানা অপরাধে জড়িয়ে গেছে। তাদের অনেকেরই একমাত্র দোষ ছিল তারা সেই বিদ্রোহের দিন ঘটনাস্থলে শুধুমাত্র উপস্থিত ছিল। তারা অনেকেই জানিয়েছে, আদালতে এমনকি তাদের বক্তব্য ঠিকমত রেকর্ডও করা হতো না। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ৮২৩ জন বিডিআর জওয়ান কারাবন্দী রয়েছে। প্রতিবার পুরো ৮২৩ জন বন্দীকে আদালতে উপস্থিত করা হয়, মুরগীর খোয়ারের মত ছোট কয়েকটা গাড়িতে করে তাদের নিয়ে আসা হয়। সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রেখে তাদের সামান্য পানি পানের সুযোগটুকু দেয়া হয় না। আর ডান্ডাবেড়ির কথা আর কী বলবো? অসংখ্য মানুষকে চিড়িয়াখানায় বন্দী পশুর মত ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে আদালতে নেয়া হচ্ছে, এই দৃশ্য কোন সভ্য দৃশ্য হতে পারে না।

জেলে থাকবার সময় কয়েকজনার সাথে পরিচয় হয়েছিল, একজন বিডিআর সদস্য মাত্র ১৫ দিন হয় বিডিআরে যোগ দিয়ে সেদিনের অনুষ্ঠানে গিয়েছিল। সেখানে গিয়ে সে ঘটনার মধ্যে ফেঁসে গিয়েছে। সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে থাকবার সময় তাদের উপরে যেই অকথ্য নির্যাতন হয়, তারা বলেছিল সাধারণ মানুষ হলে সেই নির্যাতন তারা কেউই সহ্য করতে পারতো না। বিডিআর ট্রেনিং এর কারণেই অনেকেই এখনো মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারে। জেলের সেই মানুষগুলোর জন্য আমি কিছুই করতে পারি নি। আমার সাধ্য নেই। সান্ত্বনা এইটুকুই যে অন্তত একটা চিঠি পাঠাবার ব্যবস্থা করতে পারলাম, তারা হয়তো এই নিয়ে কিছু করবেন। এতে হয়তো কাজ হবে না, কিন্তু আমার ব্যক্তিগত দুঃস্বপ্নের, কষ্টের কিছুটা লাঘব হতে পারে।

আমাদের দেশের সংবিধানে সকল নাগরিকের সমান অধিকারের কথা লেখা থাকলেও কার্যত আমাদের রাষ্ট্র, আমাদের আইন এবং বিচার বিভাগ সর্বদাই সাধারণ মানুষকে নাগরিক হিসেবে বিবেচনাই করে না। আমাদের আদালতে আসামী পক্ষ থেকে আসামীর শিক্ষাগত যোগ্যতা, তার আর্থিক অবস্থা, তার রাজনৈতিক অবস্থার কাগজপত্র আদালতে পেশ করে থাকেন। এগুলো দেখার পরে আদালত সিদ্ধান্ত নেন আসামীকে জামিন দেয়া হবে কিনা। বিচারের রায়ও অনেকাংশে সেসবের উপরেই নির্ভর করে। কিন্তু যার শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই, যার রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ততা নেই, তাদের কী জামিন পাওয়ার অধিকার নেই? তারা কী রাষ্ট্রের নাগরিক নয়? রাষ্ট্রের নাগরিকদের প্রতি এই বৈষম্যমূলক নীতি সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই চালু রয়েছে, যা আজো বলবত রয়েছে। অথচ কারো কোন বিকার নেই এতে। একজনার অর্থনৈতিক কিংবা রাজনৈতিক ক্ষমতা কেন আদালতের ধর্তব্য বিষয় হবে? একজন সাধারণ শ্রমিক যে ঢাকা শহরে গভীর রাতে শুধুমাত্র রাস্তায় ঘোরাঘুরির জন্য ৫৪ ধারায় গ্রেফতার হয়েছে, একজন দেহব্যবসায়ী নারী যে শুধুমাত্র পেটের টানে রাস্তায় নেমে পুলিশের হাতে ধরা পরেছে, তাদের জামিন পাওয়ার যেন কোন অধিকার নেই। অন্যদিকে খুন ধর্ষণের আসামীও নানান অজুহাতে জামিন পায়। তবে তারা কী নিজেরাই সংবিধান লঙ্ঘন করছেন না? বিশেষ করে নিম্ন আদালতের প্রতিটি বিচারই হয় এভাবেই, নিম্ন আদালত যেন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলেরই একটা শাখা অফিস। উচ্চ আদালতে যেটুকু সুবিচার আশা করা যায়, সেটাও যদি ধ্বংস হয় তাহলে মানুষের দাঁড়াবার আর কোন পথ থাকবে না।

আমি আর্মীর পক্ষে ছিলাম না, বিডিআরের পক্ষেও নই। তাদের উভয়কেই আমি দুর্নীতির আখড়া মনে করি। যাদের অস্ত্র হাতে মানুষ হত্যার ট্রেনিং দেয়া হয় আমি তাদের পক্ষে থাকতে পারি না। কিন্তু আমি মানুষের পক্ষে। সেই সব নিহত সেনাসদস্যের পক্ষেও, এখন নির্যাতিত এবং নিহত বিডিআর সদস্যদের পক্ষেও। লক্ষ লক্ষ বাঙালি নিধনের জন্য দায়ী গোলাম আজম এদেশে ৯০ বছরের জন্য রাষ্ট্রীয় অতিথি হয়, প্রিজন সেলে বিলাস বহুল জীবন যাপন করে, আর কয়েকজন সেনাসদস্য হত্যার জন্য অসংখ্য বিডিআর মেরে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়, বছরের পর বছর তাদের নির্যাতন করে ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। নিহত সেনাসদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেই বলছি, আমাদের রাষ্ট্রের চোখে এক একজন সেনাসদস্য সম্ভবত লক্ষ লক্ষ “ব্লাডি সিভিলিয়ান” -এর চাইতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ, অনেক মূল্যবান! দুর্ঘটনায় নিহত একজন গার্মেন্টস শ্রমিক যেখানে অভাবের কারণে আত্মহত্যা করে, সেই দেশে একজন সেনাসদস্য যাদের লেফট রাইট আর ঝোপ বুঝে কোপ মারা ছাড়া আর কিছু করতে দেখা যায় না, তারা কীভাবে এত মূল্যবান হয়ে ওঠে? কেন সানগ্লাস নেতা আর লম্পট স্বৈরাচাররা আমাদের এত বেশি পছন্দের? তারা কী উন্নত প্রজাতির মানুষ? তাদের হাতে রাখা ক্ষমতা বলবতের জন্য জরুরী? সবকিছুর চাইতে তারা দামী? এই বিচারের মাধ্যমে আসলে কী জানান দেয়া হলো?

১৫২ জনার এই রাষ্ট্রীয় গণহত্যা বন্ধ হোক। আমরা প্রতিহিংসা পরায়ণ রাষ্ট্র চাই না। বিডিআর বিদ্রোহে এতগুলো বছর ধরে জেলে থাকা আসামীদের প্রতি প্রতিহিংসা বা প্রতিশোধ মনোবৃত্তি বাদ দিয়ে সুষ্ঠু বিচার করা হোক। এই ধরণের ঘটনা কেন ঘটেছিল তা অনুসন্ধান না করে, তার মূলসূত্র অনুসন্ধান না করে শুধুমাত্র আসামীদের হত্যা করে এধরণের ঘটনা বন্ধ করা সম্ভব হবে না, বিষবৃক্ষের গোঁড়া না কেটে দিলে এরকম বিদ্রোহ আরো অসংখ্যবার হতেই থাকবে। আমরা যদি আসলেই চাই যে এরকম ঘটনা আর না ঘটুক, তাহলে আমাদের জানা প্রয়োজন কেন এই ঘটনা ঘটেছিল। জনগণের জানবার অধিকার রয়েছে সেদিন সেখানে আসলে কী হয়েছিল, কাদের উস্কানিতে এমন ঘটনা ঘটেছিল? মূল পরিকল্পনা কাদের ছিল? এরকম বিদ্রোহের কারণই বা কি ছিল। এসবই এখন ধামাচাপা পরে গেল। কেউ এখন আর বিডিআরের পক্ষে টুঁশব্দটিও করে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্মীর বর্বর আক্রমণ এবং ছাত্রদের উপরে নির্মম নির্যাতনের পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক, অনেক ছাত্রকেই সেনাক্যাম্পে নিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন করে বোঝানো হয়েছিল, এই দেশে আর্মীই সবচাইতে ক্ষমতাশালী। মেধায় মননে সংস্কৃতিতে শিক্ষিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্ভাবনাময় ছাত্রদের চাইতে অস্ত্রধারী লেফট রাইট বিশেষজ্ঞ আর্মী ক্ষমতাসীনদের কাছে অনেক বেশী প্রিয়। এবারে কয়েকদফায় বিডিআরের উপরে সব দিক থেকে নির্যাতন চালিয়ে আবারো যেন বোঝানো হল, এদেশে ক্ষমতায় থাকতে হলে আর্মীকে ঠাণ্ডা করেই থাকতে হবে, তাদের হাতে রাখতে হবে। নিহত আর্মী সদস্যদের প্রতি প্রতিটি মানুষেরই সহানুভূতি ছিল এবং আছে, তা থাকবেও সবসময়। কিন্তু সেই সহানুভূতি যদি বিচার প্রক্রিয়ায় প্রতিহিংসায় রূপ নেয়, তা আর বিচার থাকে না। প্রতিশোধ হয়ে যায়। আর আধুনিক বিচার প্রক্রিয়া কোনভাবে প্রতিশোধমূলক হতে পারে না, তা হলে সেটা সেই বিচার বিভাগের এবং রাষ্ট্রের ভিত্তি দুর্বল করে দেয়। চোখের বদলা চোখ, রক্তের বদলা রক্ত, এই চেতনা, এই মধ্যযুগীয় বর্বরতার চর্চা আধুনিক সমাজের উপযোগী নয়। প্রতিশোধ স্পৃহায় উম্মত্ত হয়ে আর যাই হোক, ন্যায় বিচার কখনই সম্ভব নয়।