আমাদের ভাষা আন্দোলন নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, সচেতন মানুষ মাত্রই জানেন (তবে এটাও সত্য, একুশের বইমেলায় গিয়েও যদি জিজ্ঞেস করা হয় তাহলে, কেউ কেউ নাও পারতে পারেন সেই মহান ৫২ র কথা এবং এর সফলতার কথা বলতে)!

বাংলা ৯ই (পুরনো পঞ্জিকা অনুযায়ী ৮ই) ফাল্গুন ১৩৫৮, ইং ২১শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ তে আন্দোলন শুরু হয় (বলা ভালো পূর্ন গতি পায়) এবং বাংলা ৪ই ফাল্গুন, ১৩৬২, ইং ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৬ সালেই উর্দুর সাথে বাংলাকেও রাষ্ট্র ভাষা করার মধ্য দিয়ে তাতে বিজয় হয়। ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙ্গালী হিসেবে আমাদের আত্ম-উপলব্ধির অন্যতম প্রধান ঘটনা।

“ভাষার জন্য আন্দোলন” কিংবা “আন্দোলনের অন্যতম উপলক্ষ ভাষা” – এমন আন্দোলন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই কম বেশি হয়েছে – কোথাও অহিংস আবার অবস্থার প্রেক্ষিতে, হয়তো কোথাও সহিংস। ২১শে ফেব্রুয়ারি এখন দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক দিবসে পরিণত হয়েছে – সে প্রেক্ষিত থেকেই এই নোটের প্রয়াস।

ভারত

দক্ষিণ ভারতে ভাষার জন্য প্রথম রাজনৈতিক প্রতিবাদ হয় ১৯৩৭ সালে, তৎকালীন ভারতের কেন্দ্রীয় “ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস” এর মদদে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির স্থানীয় কংগ্রেস সরকার কর্তৃক স্কুলে হিন্দি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার কারণে। ওই সময়ের আন্দোলনে প্রায় দুইজন প্রাণ হারায় এবং কয়েক হাজার লোক গ্রেপ্তার হয়। ১৯৪০ সালে আইনটি তৎকালীন মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির ব্রিটিশ গভর্নরের হস্তক্ষেপে তুলে নেয়া হয়। এতে ভারতীয় কেন্দ্রীয় কংগ্রেস সরকার নাখোশ হলেও স্থানীয় আন্দোলন শেষ হয়।

এর চেয়ে বড় আন্দোলন হয় ১৯৬৫ সালে, যখন হিন্দিকে একমাত্র সরকারী ভাষা করা হয় কিংবা স্বয়ংক্রিয় ভাবে হয়ে যায় তারও ১৫ বছর আগের ১৯৫০ সালের আইনের কারণে (লক্ষণীয়, হিন্দিকে একমাত্র সরকারী ভাষা বানানোর সিদ্ধান্ত ১৯৪৬ এর পর বিভিন্ন আলোচনায় প্রস্তাবনা করা হয় এবং তা ১৯৫০ সালেই আইন হিসেবে গৃহীত হয় যে ১৫ বছর পর ৬৫ তে কার্যকর হবে এবং মজার ব্যাপার হল আইন কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত এটা নিয়ে উচ্চবাচ্য হয়নি। উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা করার আলোচনা ১৯৪৮ সালে শুরু হলেও এটাকে ১৯৫৬ সালের আগে আইন করা যায়নি এবং করা হয়েছিল বাংলাকে নিয়েই)। হিন্দিকে একমাত্র সরকারী ভাষা করা রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত তথা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর ইচ্ছা। জোর করে নৃতাত্ত্বিক এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়কে রাষ্ট্রের সাথে মিশিয়ে রাষ্ট্রকে লিঙ্গুইস্টিক কিংবা কালচারাল হোমজেন্যাস বানানোর তাঁর এবং তাঁর সহযোগীদের একরকম সংকীর্ণ সাম্রাজ্যবাদী চিন্তা-চেতনা । এমন চেষ্টা, জোর করে ধর্মের সাথে রাষ্ট্রকে মেশানোর চেয়ে কোন অংশে কম নয়। (আইরনি! প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর ব্রিটিশ ভারতীয় আমলের সহকর্মী পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল জিন্নাহ এবং তাঁর সহযোগীরা একই কাজ করেছিলেন ।

সেই বছর, ২৬শে জানুয়ারি, ১৯৬৫ তে এর বিরুদ্ধে তীব্রভাবে আন্দোলন শুরু হয়, মানুষ রাস্তায় নেমে আসে দলে দলে। প্রায় দুইমাস যাবত দাঙ্গা হয় দক্ষিণে, বিশেষ ভাবে মাদ্রাজে। প্রায় ১০০-৫০০ লোকের মৃত্যু হয়। সারা দক্ষিণ ভারত বিশেষভাবে তামিলনাড়ু উত্তপ্ত হয়ে উঠে। এর প্রতিবাদে আত্মাহুতির ঘটনাও ঘটে। আন্দোলনের পক্ষাবলম্বনকারী রাজনৈতিক দল গুলো বিজয়ী হয় তাদের ১৯৬৭ বিধানসভা নির্বাচনে। বিজয়ী রাজনৈতিক দলগুলো হতে তাদের রাজ্যকে গণতান্ত্রিক ভাবে ভারত ইউনিয়ন ত্যাগ করারও হুমকি দেয়া হয়।

শেষ পর্যন্ত ১৯৬৭ সালে হিন্দির সাথে ইংরেজিকেও ব্যবহারিক সরকারী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয় আন্দোলনটা হয়েছিল হিন্দিকে একমাত্র সরকারী ভাষা হিসেবে ঘোষণা করার বিরুদ্ধে কেননা তাহলে হিন্দি মাতৃভাষা ভাষীরা সুবিধা পেত এবং অন্যান্য সবার নিজ মাতৃভাষা এবং ইংরেজির সাথে সাথে হিন্দিটাও শিখতে হত এবং স্বাভাবিক ভাবেই পিছিয়ে পরত। সবচাইতে প্রত্যক্ষ প্রভাব পরত আইসিএস পরীক্ষায় যা শুধু হিন্দিতে দিতে হত এর ফলে। এই ৬৫র আন্দোলনের ছিল মূল কেন্দ্র ছিল তামিলনাড়ু রাজ্যর মাদ্রাজ (বর্তমান চেন্নাই)। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশেষকরে মাদ্রাজ এবং আন্নামালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

উল্লেখ্য ভারতে আইনগত ভাবে “রাষ্ট্র ভাষা” কিংবা “জাতীয় ভাষা” পরিভাষাটি ব্যবহার করা হয়না। বর্তমানে ভারতে ২২টি ভাষাকে সরকারীভাবে তালিকাভুক্ত ভাষা এবং ৪টি ভাষাকে ঐতিহ্যবাহী/ধ্রুপদী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ইংরেজিকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে ব্যবহারিক কারণে। কেন্দ্রীয় ভাবে অফিস আদালতে হিন্দি এবং ইংরেজি ব্যবহৃত হয়। প্রতিটি রাজ্যেও নিজস্ব ভাষা ব্যবহার করে নিজেদের আভ্যন্তরিক দাপ্তরিক কাজের জন্য। যদিও ভারতে মোট ভাষার সংখ্যা ১০০ রো উপর।

আমার মাঝে মাঝে মনে হয় বাংলা ভাষা রক্ষা করার দায়িত্ব বোধয় বাংলাদেশীদেরই কেননা যেহারে পশ্চিমবঙ্গের শহুরে সমাজের হিন্দি প্রেম দেখা যায় মনে হয় কিছুদিন পর সেখানে “হিংলা” নামে উপভাষা চালু হয়ে যাবে। আর তাদের চ্যানেলে যেহারে হিন্দি গানের প্রতিযোগিতা হয় তা খুব দৃষ্টিকটু সবচাইতে হাস্যকর লেগেছে যখন কলকাতার অনেক সভ্য বাবু কলকাতার বানান ক্যালকাটা থেকে কলকাতায় পরিবর্তনের প্রতিবাদ করেন। দক্ষিণের কোন চ্যানেলে হিন্দি কিছুই দেখা যায়না এমনকি মুম্বাইয়া মিডিয়ার প্রতি তাদের আগ্রহ অনেকটা কম ।

এছাড়া আসামেও ভাষার প্রশ্নে আন্দোলন হয়েছিল ১৯৬১ সালে এবং মজার ব্যাপার হল ওটা ছিল বাংলা ভাষা নিয়ে আন্দোলন। ততকালীন প্রাদেশিক সরকার কেবল অহমীয় ভাষাকে আসামের একমাত্র সরকারী ভাষা করার বিরুদ্ধে আন্দোলনটি হয়েছিল। পরে অবশ্য বাঙলাকেও স্বীকৃতি দেয় প্রাদেশিক সরকার।

দক্ষিন আফ্রিকা

দক্ষিণ আফ্রিকার আন্দোলনের সাথে আমাদের দেশের আন্দোলনের খানিকটা মিল আছে – দুটোতেই আন্দোলনের মূলে ছিল ছাত্রগণ। তবে পার্থক্য হল আমাদেরটার নেতৃত্বে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ছাত্র এবং ওটার নেতৃত্বে ছিল স্কুল পর্যায়ের ছাত্র। গাউটাং এর (তৎকালীন ট্রান্সভাল প্রদেশ) জোহানসবার্গ শহরের সোয়েটোতে সঙ্ঘটিত আন্দোলনটি হয়েছিল জুন ১৬, ১৯৭৬ সালে । উক্ত অঞ্চলের কর্তৃপক্ষ আফ্রিকানার ভাষায় (দক্ষিন আফ্রিকায় বসবাসরত শ্বেতাঙ্গ ডাচদের জার্মান-ডাচ ভাষার মিশ্রণ) শিক্ষাদান স্কুলে বাধ্যতামূলক করলে স্কুলের কিশোর – শিশুরা এর প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নেমে আসে – কারণ তারা তাদের মাতৃভাষা জুলু এবং ব্যবহারিক লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা ইংরেজিতে শিক্ষা নিতে বেশি আগ্রহী ছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবাদ সভা ডাকা হয়।

তৎকালীন বর্ণবাদী সরকার প্রতিবাদ সভায় গমনরত ছাত্রদের মিছিলে গুলি করতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। প্রায় ২০০ জনেরও অধিক মানুষ নিহত হয়েছিল গুলিতে – যাদের প্রায় সবাই শিশু-কিশোর! এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের কার্যক্রম আরও বেগবান হয়। দক্ষিন আফ্রিকায় দিনটি বিশেষ স্মৃতির মধ্যদিয়ে পালন করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্র

আমেরিকায় সুদীর্ঘকাল যাবত বিভিন্ন নেটিভ আমেরিকান ভাষা সু-দীর্ঘকালব্যাপী ইউরোপীয় কলোনিয়াল শাসকদের জাঁতাকলে পিষ্ট ছিল। অনেক নেটিভ আমেরিকান ভাষার মৃত্যু হয়েছে। গত শতাব্দীর ষাট-সত্তরের দশকে নাগরিক অধিকার আন্দোলনের সময় এই নেটিভ আমেরিকান ভাষা রক্ষার ব্যাপারটিও আসে। মূল প্রস্তাবনার দীর্ঘ ২০ বছর আন্দোলন এবং আলোচনার পর অক্টোবর ৩০, ১৯৯০ সালে আমেরিকার বিভিন্ন নেটিভ/আদি/স্থানীয় ভাষা রক্ষা এবং সংরক্ষণের জন্য একটি আইন পাশ হয়। মজার ব্যাপার যুক্তরাষ্ট্রে, ইংরেজি ভাষা সরকারী কিংবা রাষ্ট্র ভাষা কোনটিই নয়। দক্ষিণের অঙ্গরাজ্য গুলোতে স্প্যানিশ ভাষার প্রভাব দিন দিন বেড়ে চলছে। তাই এখন আবার নতুন করে ইংরেজিকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদানের বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে।

কানাডা

কানাডাতে, বিশেষত কানাডার পুর্ব অংশের অংগরাজ্য কুইবেকে ভাষা একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ন ফ্যাক্টর। এই অঞ্চল এক সময় সংস্কৃতি এবং ভাষার প্রশ্নে স্বাধীনতা চেয়েছিল।

লাটভিয়া

সর্বশেষ লাটভিয়াতে লাতভিয়ান-রাশিয়ান ভাষার মনোমালিন্যর কারণে, রাশিয়ান ভাষার স্বীকৃতির বিষয়ে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। গণভোটে লাতভিয়ানরা কয়েকশ বছরের প্রধান ভাষা (রাশিয়ান সাম্রাজ্য এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ থাকা সময়) রুশ ভাষাকে সরকারী ভাষা হিসেবে প্রত্যাখ্যান করে।

অন্যান্য দেশ

ভিন্ন প্রেক্ষাপটে তবুও অনেক আন্দোলনের অন্যতম নিমিত্ত ছিল ভাষা…… বেলজিয়ামে ফ্রেঞ্চ-জার্মান-ডাচ তাছাড়া ইউরোপের বলকান অঞ্চল, স্পেনের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য, আফ্রিকার গোল্ড কোস্ট অঞ্চলের বিভিন্ন ভাষার মধ্য। উনবিংশ শতাব্দীতে গোটা মধ্যপ্রাচ্য আরবি-ফারসি-তুর্কি কিংবা তৎকালীন মেক্সিকোর উত্তরাংশে স্প্যানিশ-ইংরেজি। সপ্তদশ-অস্টদশ শতাব্দীতে চীনে ম্যান্ডারিন-মাঞ্ছুরিয়ান বিরোধ সর্বজনবিদিত।

সমসাময়িক কালে আমাদের প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা এবং মিয়ানমারের বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী (জাতীয় এবং প্রাদেশিক) আন্দোলনের অন্যতম কারন ভাষা এবং সংস্কৃতি ।

সর্বশেষে, বাংলাদেশের কথাটি না বললেই নয় – বলতে দ্বিধা নেই আমরা – বাঙ্গালীরা নিজ ভাষা রক্ষার আন্দোলন করলেও – ভাষা এবং সংস্কৃতি সম্পর্কিত হেজেমনিক জাতীয়তাবোধ থেকে বের হয়ে আসতে পারিনি। আমাদের দেশে বসবাসরত অন্যান্য ভাষা ভাষী মানুষজন দীর্ঘদিন তাদের নিজ ভাষা চর্চা (জাতীয় ভাবে) এবং উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত। তাদের অনেকে নিজ ভাষায় ঠিক মত কথাই বলতে পারেননা এখন!! অনেকেরই জানা নেই – আমাদের দেশে বসবাসরত অন্যান্য ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী দীর্ঘদীন যাবত আন্দোলন যাচ্ছেন তাদের মাতৃ ভাষার অধিকার এবং মর্যাদা রক্ষার জন্য এবং তারা তাদের অকাট্য যুক্তি তুলে ধরছেন তাদের দাবীর পেছনে। বাংলাদেশে বসবাসরত বাঙ্গালীদের একটি নৈতিক দায়িত্ববোধ থেকেই দেশের অন্যান্য বৈচিত্রময় ভাষার উন্নয়নে আমাদের কাজ করা উচিত।

আমি মনে করি – ধর্মকে যে প্রশ্নে সংবিধানের অংশ করা উচিত নয় সে প্রশ্নে কোন নির্দিস্ট একটি ভাষাকেও স্থান দেওয়া উচিত নয় যদি আরও স্থানীয় ভাষা থাকে – যদি দিতেই হয় সবগুলোকেই দিতে হবে।

প্রায় সমানুপাতিক বহুভাষী রাষ্ট্রের মধ্য, রাজনৈতিক ভাবে জোড় করে ভাষা চাপিয়ে দিয়ে অধুনালুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নেই বোধয় একমাত্র সফলতা পাওয়া গিয়েছে, সেখানে সবাইকে রুশ ভাষা শিখতে হত। চীন কিংবা যুক্তরাষ্ট্রেও কিংবা আমাদের বাংলাদেশে অনেক ভাষা থাকলেও নির্দিষ্ট একটির অনুপাত পঁচানব্বই শতাংশেরও বেশি। ভারত কিংবা নাইজেরিয়া এদিক হতে ব্যতিক্রম; বিভিন্ন প্রধান ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর অনুপাত প্রায় সমান কিংবা আনুপাতিক পার্থক্য অনেক কম তাই তারা বাস্তবতার নিরিখে ইংরেজিকে বিশেষ মর্যাদা দিতে বাধ্য হয়েছে। তবে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সব ভাষার মর্যাদা যেন সমভাবে রক্ষা করা হয় তা অবশ্যই লক্ষ রাখতে হবে।

মজার ব্যাপার ভাষাগত বিরোধের জের ধরে ইউরোপে আভ্যন্তরিক যোগাযোগের জন্য উনবিংশ শতাব্দীতে কতগুলো কৃত্রিম সহায়ক ভাষার আবিষ্কার করা হয় যার মধ্য “এসপেরান্ত” এবং “ভোলাপাক” উল্লেখযোগ্য। এসব সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। গত শতাব্দীর পূর্বে ইউরোপে আন্তর্জাতিক কূটনীতি কিংবা বাণিজ্যিক ভাষা ছিল ফ্রেঞ্চ এবং শিক্ষা তথা জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভাষা ছিল ল্যাটিন। এখন তো দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজির গ্রহণযোগ্যতা বিশ্বব্যাপী।

যে হারে ভাষান্তর সফটওয়্যারের উন্নয়ন হচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে একসময় তৃতীয় ভাষা শেখার গুরুত্ব কমে আসবে। সেই সঙ্গে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ক্ষুদ্র কম্পিউটার প্রসেসরের দাম কমে আসলে এক সময় দ্বিতীয় ভাষা শেখাটাও কেবল শখের ব্যাপার হতে পারে; যেমন ডিজিটাল ক্যালকুলেটর থাকতে কে এখন আর সাইড রুল এবং লগারিদমিক পেপার পাশে নিয়ে হিসাব করে।

পুনশ্চ

আধুনিক টেকনিক্যাল জগতে কেউ যদি চাইনিজ, জার্মান, রাশিয়ান কিংবা জাপানী ইঞ্জিনিয়ারদের সাথে কাজ করেন তাহলে এক অনন্য অভিজ্ঞতা হবে…… তারা যেন ইংরেজি বুঝতেই চায়না যদিনা সেখানে ব্যবসায়িক স্বার্থ না থাকে…… এইমুহুর্তেই আমরা তাদের মত এমন করতে পারবনা কেননা আমরা বিজ্ঞানে ততটা অগ্রগামী না। আশা রাখি খুব তারাতারি আমরা বিজ্ঞানে এমন উন্নতি করব যে একদিন চিকিৎসা কিংবা প্রকৌশলবিদ্যা বাংলাতেই শিক্ষালাভ করেত পারব। তবে আমরা এখনই যা করতে পারি তাওতো করছিনা…. আদালতে এখনো ইংরেজির এহেন ব্যবহার আমাদের মানসিক দীনতা ব্যতীত আর কিছু নয়…… অন্তত রায় ঘোষণা বাংলায় দেওয়া উচিত। এর চেয়েও বড় ব্যাপার, আমাদের দেশে অন্যান্য যেসব ভাষা আছে তা সযত্নে লালন করার ব্যাপারে আমরা যেন মোটেও কার্পণ্য না করি সেই ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখা।

সর্বশেষ

এই লেখার মূল উদ্দেশ্য সামান্য কিছু বিষয় সামনে নিয়ে আসা – বিস্তারিত আলোচনা নয়। সব ব্যাপারে লেখাও হয়নি আবার তা আসলে সম্ভবও নয় ক্ষুদ্র পরিসরে। পাঠক আরও বিভিন্ন দেশের আন্দোলন নিয়ে (যেসব আন্দোলনে ভাষা মূল কিংবা অন্যতম নিয়ামক) নিয়ে যদি কিছু বলেন তাহলে আমরা সবাই আরও কিছু জানতে পারব।