কনকনে শীতের সকালে আগের বিকেলে জমিয়ে রাখা খড়কুটোতে লাগানো আগুনের তাপ নিতে বসা অনিককে বড্ড বিষণ্ণ দেখায়। না, কাকডাকা ভোরে ঘুম ভাঙাতে মায়ের বকুনির জন্য নয়। এত্তোভোরে জাগতে তার মন চায়না ঠিকই, কিন্তু বাসিমুখে পুকুরপাড়ের শিউলী গাছের তলায় আসলেই মনটা ভরে যায় প্রবল স্নিগ্ধতায়! শিশির ভেজা ফুলগুলো তুলতে বেশ লাগে তার। কী মিষ্টি-স্নিগ্ধ-ধবধবে সাদা শিউলী ফুল!!

অনিকের অবচেতন মনে ঝড় তুলে স্কুলের ছুটাছুটি, বন্ধুদের দুষ্টুমি, মোস্তাক স্যারের বকুনি, রহমান স্যারের পিটুনি, খোরশেদ হুজুরের ধর্ম ক্লাস……। খোরশেদ হুজুরের কথা মনে আসতেই অন্য স্মৃতি জটপাকায় মাথায়। উনি এত্তোভালো রামায়ন জানলেন কীভাবে? গজারিয়া আদর্শ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোন হিন্দু শিক্ষক নেই, তাই ইসলাম ধর্মের নিয়মিত শিক্ষক খোরশেদ মোল্লা হিন্দু ধর্মের ক্লাসটি নেন। খুব যত্ন করেই পড়ান উনি। বিবেকানন্দ কিংবা বাল্মিকী মুনির কাহিনীটা বেশ লাগে হুজুরের দরাজ গলায়! এজন্য অবশ্য সানাউল্লাহ স্যার ওনাকে খোরশেদ মুখপাধ্যায় বলে খেপান।

অনিকের মনে আছে তাদের গজারিয়া আদর্শ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে যে মাটির মসজিদটা আছে, যেখানে স্কুলের সবাই নামায পড়ে, ওখানে একবার খুব গণ্ডগোল হয়েছিল। টিফিনের পর স্কুল ছুটি হয়ে যায় গণ্ডগোলের কারণে। পরে রাশেদের কাছে শুনেছে ঐ মসজিদের ইমাম হুজুর নাকি সেইদিন ছিলোনা, খোরশেদ হুজুর ইমামতি করতে দাঁড়ালে সানাউল্লাহ স্যার গণ্ডগোল শুরু করেন। বলেন- উনাকে মালাউনদের পূজায় ভালো মানায়, ইমামতিতে নয়। উনার পেছনে নামায পড়লে গুনাহ হবে, শিরিক! অতোবুঝে নাই অনিক। তবে এটুকু বুঝেছে তাদের ধর্ম ক্লাসের সঙ্গে এটার একটা যোগসূত্র আছে।

সানাউল্লাহ স্যার বরাবরই ওইরকম। উনিই স্কুলের একমাত্র শিক্ষক যিনি মোটর সাইকেলে করে স্কুলে আসেন। সবাই কেমন ভয়ার্ত সমীহ করে চলে ওনাকে। রোজ স্কুল ছুটির পর উনি হামিদিয়া আলীয়া মাদ্রাসার হুজুরদের সাথে আরোকিছু বাইরের লোকজন নিয়ে কী সব মিটিং করেন।

গত শীতের শেষদিকে, ফেব্রুয়ারি মাসে অনিকের মামা বাড়িতে আগুন দেয়ার পর যখন মামা-মামীরা তাদের বাড়িতে থাকতে এসেছিলো তখন বড়দের আলাপে সে শুনেছে মামা বাড়িতে আগুন দেয়ার সময় সানাউল্লাহ স্যার তার মোটর সাইকেল নিয়ে উপস্থিত ছিলেন।

-কী’রে উঠ! খেয়ে পড়তে বসবি চল! নিভে যাওয়া আগুনের পাশে মুখগুঁজে থাকা অনিককে তাড়াদেয় ব্যস্ত মল্লিকা দেবী।

-কিরে, কী হলো তোর? সবাই পড়তে বসে গেছে, তুই এখনো……কতো কাজ পড়ে আছে আমার- বলে সামনে এগোন নিপাট গৃহিণী মল্লিকা দেবী। অনিকের মা।

-ম..মা!

হঠাৎ কেমন জানি ঠেকে গলাটা। খোকন হঠাৎ এতো বিষণ্ণ গলায় ডাকল কেন? তড়িৎ পেছন ফিরে অসীম মমতায় ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বলে- কি হয়েছে খোকন?
মায়ের আটপৌরে শাড়ীতে মুখ গুঁজে ঢুকরে উঠে অনিক- মা আমাদের স্কুল যে পুড়িয়ে দিয়েছে!

দুইঃ
অনিককে সামলিয়ে গৃহস্থালী সেরে মল্লিকা দেবী ফোন দেন অমরনাথ সাহাকে। মল্লিকার স্বামী। কৃষি বিভাগের উপ-সহকারী কর্মকর্তা। প্রবল অনিচ্ছায় যিনি চাকুরী বাঁচাতে নির্বাচনী দায় সামলাতে বেরিয়েছেন সকাল বেলা।
-ঝামেলায় আছি, পরে ফোন দাও মল্লিকা। আজ ফিরবনা, ঠাকুর চায়তো ভোটের পর ফিরব।

-ভোটতো কাল, আজ রাতে বাসায় ফিরবা না?

-না। তোমরা সাবধানে থাইকো।

ফোন কেটে যায়।

কেমন একটা অস্বস্তি ঘুরে ফিরে মল্লিকার, কেমন একটা খচখচানি। বিকেলে আবার ফোন দেন স্বামীকে। সন্ধ্যায় আবার। অমরনাথ ফোন ধরেন না। মল্লিকার অস্বস্তি বেড়ে চলে।

-“ভোট কেন্দ্রে ঝামেলা হচ্ছে। তোমাদের ভোট দিতে যাবার দরকার নাই। অনিক, মা ওদের নিয়ে সাবধানে থাইকো“। রাত দশটায় ফোনে সাবধান করেন স্ত্রীকে। এড়িয়ে যান সন্ধ্যার ঘটনা। সাড়ে সাতটার দিকে হঠাৎই বিকট শব্দে ককটেল ফাটে পাইলট স্কুলের পতাকা স্ট্যান্ডের পাশে। মুহূর্তেই দ্বিগ্বিদিক ছুটাছুটি। আত্মচিৎকার। সবাই এতো ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে যে বাজারে গিয়ে রাতের খাবার খেতেও কেউ সাহস পায়না। এদিকে কেন্দ্র ফেলে একসাথে যাওয়াও দায়। পরে দায়িত্বরত আনসার সদস্যের মাধ্যমে খাবার আনিয়ে খেলেন সবাই। বাকী রাতটা চরম ঠাণ্ডায়, মশার উৎপাতে অনেকটা নির্ঘুম কাটে। সামান্য শব্দে তীব্র ভয়ে কেঁপে উঠে ভেতরটা। সকালে শুরু হয় ভোটের ডিউটি। বেলা না গড়াতেই প্রিসাইডিং অফিসারের হাঁকডাক।
-অমরনাথ বাবু, কটা ব্যালট দেন, সইটা কইরে দিয়েন। মুণ্ডিতে বাদ দিয়েননা আবার!

-স্যার, ভোটার কই? ব্যালট কারে দিতাম?

-আরে আমারে দিবেন, সিল দিব।

সন্ত্রস্ত চোখে আশপাশ তাকান অমরনাথ বাবু, সমর্থনের বৃথা আশায়। নাহ! কেউ আপত্তি করছেন না। মাথা নিচু করে ব্যালটে সই করছেন বাকী সহকারী প্রিসাইডিং অফিসাররা।
-ছামাদ ভাই? কাজটা ঠিক হইব? পাশের পোলিং অফিসারকে জিজ্ঞেস করেন বিড়বিড় করে।

-কী বিড়বিড় করছেন মশাই! আপনি যুদ্ধাপরাধীর বিচার চাননা? জামাত আসলে আপনাদের বাড়ি ঘর থাকব? প্রিসাইডিং অফিসারের ধমক।

-তাতো ঠিকই, তাতো ঠিকই। আবার বিড়বিড় করেন অমরনাথ সাহা।

তিনঃ
স্বামীর নিষেধ উপেক্ষা করে মল্লিকা দেবীর আর ভোট কেন্দ্রে যাওয়া হয়না। দুপুরের পর অনিকও সমবয়সীদের সাথে মন্দিরের কথা বলে বেরিয়েছে, । উৎকন্ঠার কারণে সন্ধ্যা না নামতেই ছেলের খোজে বেরিয়ে পড়েন মল্লিকা। পরম মমতায় পানি ভর্তি পলিথিন সাজাচ্ছে পাড়ার মন্দিরে। সাথে আরো অনেকে। এই রকম শত শত পানি ভর্তি পলিথিন মন্দিরের ফল্‌স সিলিং-এ রাখা হবে। রাতে দুষ্কৃতীকারীর আগুন থেকে ধর্মালয় বাঁচানোর অগ্রিম প্রাণান্ত প্রচেষ্টা। চারিদিক কেমন থমথমে, ভীত সন্ত্রস্ত পরিবেশ। গা ছমছম করে।

বাড়ী ফিরে অনিককে নিয়ে নিত্য প্রয়োজনাতিরিক্ত কাপড়, কম্বল, শীতবস্ত্র শক্ত করে কয়েকটা বস্তায় ঢুকান মল্লিকা দেবী। লন্ঠন হাতে অনিককে নিয়ে এগোন পুকুর পাড়ের দিকে। আপাত গভীর গর্ত খুঁড়ে পুরু পলিথিন বিছিয়ে একের পর এক বস্তা গুলো রাখেন শিউলি তলায়, উপরে আরেকটা মোটা রেক্সিন বিছিয়ে চাপা দেন নারিকেল পাতা ইত্যাদি। অনিক বেশ কবার তাড়া দিচ্ছিলো তার সদ্য পাওয়া বই গুলো নেয়ার জন্য, মা এড়িয়ে যান, স্থানাভাবে।

অমরনাথ বাড়ী ফেরার আগেই ঘুমিয়ে পড়ে অনিক। মাঝরাতে কিছু বুঝে উঠার আগেই হ্যাসক্যা টানে ধরমড়িয়ে উঠে সে ছুটতে থাকে বাবা-মার সাথে। বৃথা বার বার পেছন ফিরে তাকায় বইগুলোর আশায়। শুধু মনে হয় স্কুল নাই, বইও পুড়ে যাচ্ছে। সে কি পারবে পরের ক্লাসে পড়তে? নিজের বলতে সে শুধু বাঁচাতে পেরেছে গতমাসে কিনে দেয়া নুতন জুতা জোড়া। যেগুলো সে পরে ঘুমিয়েছিলো অজানা আশঙ্কায়। আর কিছুনা, কিচ্ছুনা।

অমরনাথকে বড্ড বিমর্ষ দেখায়। দিকভ্রান্ত। সারা জীবনই তিনি পতিত, উত্থানের লেশ নেই কোথাও। জীবনের বাঁকে বাঁকে উনি কেবল ভেসে বেড়িয়েছন, সাঁতারের কৌশল জেনে ডাঙায় ঘেঁষতে পারেননি।
রাষ্ট্র তাঁকে নিরাপত্তা দেয়নি; সমাজ তাঁকে উপেক্ষা করেনি ঠিকই, ধারণও করেনি। হয়তো মেনে নিয়েছে, মনে নেয়নি।