২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়। কাদের মোল্লা সহ সকল যুদ্ধাপরাধীদের সঠিক বিচারের প্রত্যাশায় শাহবাগ তখন উত্তাল। শুরুটা হয়েছিল কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার রায়কে কেন্দ্র করে।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত আব্দুল কাদের মোল্লার রায় ঘোষণা করেছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। শতাধিক হত্যা ও ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী ছয়টি অভিযোগে কাদের মোল্লার জড়িত থাকার বিষয়গুলো ‘সন্দেহাতীত’ভাবে প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও মাননীয় আদালত ফাঁসি না দিয়ে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করেন। সাধারণ জনগণ, বিশেষত তারুন্যোদীপ্ত ছাত্র এবং অ্যাক্টিভিস্টরা মেনে নেয়নি সেই রায়। কাদের মোল্লার এ রায়ের খবর মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে ফেসবুক ও ব্লগসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ফুঁসে ওঠে অনলাইন ব্লগার এবং অ্যাক্টিভিস্টরা। তাদের মাধ্যমেই সূচনা হয় এক অবিস্মরণীয় মহাজাগরণের।

কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবি নিয়ে ‘ব্লগার এন্ড অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নেটওয়ার্ক’র ব্যানারে ওইদিন বিকেলেই শাহবাগে জড়ো হয় একদল তরুণ। আর এ খবর ছড়িয়ে পড়লে তাদের দাবির সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করতে বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ জড়ো হতে শুরু করে শাহবাগে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে ছাত্ররা দলে দলে যোগ দিতে থাকেন শাহবাগে। আশেপাশের বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও শিক্ষার্থীরা ছুটে যান শাহবাগে। ছুটে যান নারীরা। ধীরে ধীরে এই আন্দোলনের জোয়ার ঢাকা শহরকে অতিক্রম করে যায়। কাদের মোল্লাসহ সকল যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে ছাত্রজনতাসহ সর্বস্তরের মানুষের টানা গণ অবস্থান শুরু হয় সেখানে।

সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে সে খবর ছড়িয়ে পড়ে সব জায়গায়। দ্রুতই শাহবাগের জনসমাবেশ পরিণত হয় এক বিশাল জনসমুদ্রে। সকল শ্রেণির মানুষের পাশাপাশি এ আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন দেশের প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবী মহল সহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং দেশের স্বাধীনতাকামী প্রতিটি মানুষ।

 

চিত্র: শাহবাগ আন্দোলন : কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডের দাবীতে অনলাইন ব্লগার এবং  অ্যাক্টিভিস্টরা সূচনা করেছিল এক অভূতপূর্ব গণজাগরণের।

একাত্তরের জীবিত মুক্তিযোদ্ধারা ও বুদ্ধিজীবী মহল শাহবাগের এ আন্দোলনকে আখ্যায়িত করেন ‘২য় মুক্তিযুদ্ধ’ হিসেবে এবং তরুণদের আখ্যায়িত করেন, ‘২য় প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে। শাহবাগ নামাঙ্কিত হয় ‘প্রজন্ম চত্বর’ হিসেবে। ৮ ফেব্রুয়ারি তরুণদের এ অবস্থানের নাম দেওয়া হয় ‘গণজাগরণ মঞ্চ’। দেশীয় মিডিয়াগুলো সহ আন্তর্জাতিক সকল মিডিয়াও ফলাও করে প্রচার করে শাহবাগের এই ‘গণজোয়ার’-এর খবর।

এদিকে কয়েক লাখ লোকের এ আন্দোলন শুরু হওয়ার পর সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেওয়া হয়। কিন্তু সমস্যা তৈরি হয় ট্রাইব্যুনালের আইন নিয়ে। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনে আদালতের দণ্ডাদেশের পর আসামি পক্ষের আপিলের সুযোগ থাকলেও বাদীপক্ষ বা সরকারের আপিলের সুযোগ ছিল না। আইনের এই ত্রুটি বিচ্যুতিগুলো পরিবর্তন করার দাবি জানায় গণজাগরণ মঞ্চ।

দুর্নিবার আন্দোলন থেকেই তৈরি হয় সুগঠিত নেতৃত্ব। গণজাগরণ মঞ্চের নেতারা সে সময় প্রমাণ করে দেখিয়েছিলেন কীভাবে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে প্রাণের দাবীকে বাস্তবে রূপ দেয়া যায়। রাজপথে আন্দোলনের পাশাপাশি তারা রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও স্পিকারের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করেন। সরকারও এ আইন সংশোধনে উদ্যোগী হয়। দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে সরকারের আপিলের সুযোগ রেখে ১৭ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস সংশোধন বিল ২০১৩ জাতীয় সংসদে পাস হয়।এ আইন পাস হওয়ায় কাদের মোল্লার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ পায় রাষ্ট্রপক্ষ।  আপিলের ধারাবাহিকতায় ১৭ সেপ্টেম্বর প্রধান বিচারপতি মোঃ মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে (৪:১) আবদুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসির দণ্ডাদেশ দেন।

তবে ফাঁসির দণ্ডাদেশ হলেও এর বাস্তবায়ন নিয়ে কম নাটক হয়নি। আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৩ সালের ৫ই ডিসেম্বর।  এই রায়ের অনুলিপি সুপ্রিম কোর্ট থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়। গত ৮ ডিসেম্বর বিকেলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ থেকে কাদের মোল্লার মৃত্যু পরোয়ানা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারা কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়। কিন্তু ঘোষিত সময়ের দেড় ঘণ্টা আগে হঠাৎ করেই কাদের মোল্লার ফাঁসির কার্যক্রম স্থগিত করেন চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। তিনি ১১ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত ফাঁসির কার্যক্রম স্থগিত করে বিষয়টি আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠান। এভাবে ফাঁসি শেষ মুহূর্তে স্থগিত করে শুনানির জন্য পাঠানোর ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে একেবারেই ‘তুলনারহিত’ বলা চলে। অনেকের হৃদয়েই বাজছিল দুরাশার অশনি সংকেত।

কিন্তু সেই অশনি সংকেতকে মিথ্যে প্রমাণ করে শুনানি শেষে বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজ করে দেন। এর ফলে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে আইনগত আর কোনো বাধা থাকলো না ।

বৃহস্পতিবার রাত ১০টা এক মিনিটে কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়। শাহবাগ আন্দোলনের সূচনা না হলে কাদের মোল্লার ফাঁসি আমরা দেখতে পেতাম না, এ কথা আজ নির্দ্বিধায় বলা যায়। সেই শাহবাগ আন্দোলনেরই এক উদ্দীপিত তরুণ ছিলেন রাজীব হায়দার, অনলাইনে যার পরিচয় ছিল ‘থাবা বাবা’ নামে। থাবা বাবাদের মত তরুণদের কারণেই শাহবাগ আন্দোলন সফল হতে পেরেছে এটা বোধ হয় অতিশয়োক্তি নয়।

আজকের এই দিনে,থাবা তোমায় মনে পড়ে:

কাদের মোল্লার ফাঁসির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্মের যে বিজয় অর্জিত হয়েছে, তা থাবা বাবা দেখে যেতে পারেননি। তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল ১৫ই ফেব্রুয়ারি। আগেই বলেছি, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে শাহবাগের গণজাগরণ চত্বরের গণআন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন ব্লগার রাজীব হায়দার শোভন। তিনি শুধু একজন ব্লগারই ছিলেন না, পেশাগত জীবনে ছিলেন স্থপতি। তার অপরিসীম মেধার স্বাক্ষর হয়ে থাকবে ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধের নকশা’ যা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেয়েছে । রাজীবকে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি পল্লবী থানার পলাশনগরের বাড়ির অদূরে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

 

 
চিত্র:
রাজীব হায়দার, যার মত অ্যাক্টিভিস্টদের কারণে শাহবাগ আন্দোলন সফলতার মুখ দেখেছে।

 কারা খুন করেছিল রাজীবকে? কেন? অনেকেরই বোধ হয় সে সময়কার কথা মনে আছে। রাজীবকে হত্যার চার দিন আগে জামাতি ব্লগ বলে পরিচিত (অধুনা বিলুপ্ত) ‘সোনার বাংলা’ ব্লগে ‘থাবা বাবা’ তথা রাজীবের নামে উস্কানিমূলক পোস্ট দেয়া হয়েছিল। এমনকি রাজীব মারা যাবার পরেও শাফিউর রহমান ফারাবী নামে এক হিযবুত তাহরীরের প্রাক্তন সদস্য ফেসবুকে তার স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন এই বলে, ‘যেই ইমাম থাবা বাবার (রাজীব) জানাজা পড়াবে, সেই ইমামকেও হত্যা করা হবে।’ পুলিশ তাকে গ্রেফতারও করেছিল সে সময় (নিউজ এখানে)।  তবে থাবা বাবা হত্যার পেছনে কারা ছিল এর পরিষ্কার উত্তর পাওয়া গেল মার্চ মাসের ২ তারিখে যখন রাজীব হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে প্রখ্যাত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ জন ছাত্র – ফয়সাল বিন নাঈম ওরফে দ্বীপ, মাকসুদুল হাসান অনিক, এহসান রেজা রুম্মন, নাঈম সিকদার ইরাদ  ও নাফিজ ইমতিয়াজকে আটক করা হল। তারা পাঁচজনই এই হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেয়ার কথা স্বীকার করেছিলেন।  নর্থ সাউথের আরেক ছাত্র সাদমান ইয়াছির মাহমুদকে গ্রেফতার করা হয় ১৪ অগাস্ট রাজধানীর ধানমণ্ডি থেকে। তিনিও রাজীব হত্যায় জড়িত ছিলেন বলে পুলিশ দাবী করেছে। আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে ব্লগার রাজীবকে হত্যা করেছে বলে পত্রিকায় এসেছে। এদের নির্দেশদাতা ছিলেন শিবেরের ‘বড় ভাই’ রেজওয়ানুল আজাদ রানা। তিনি অবশ্য এখনো পলাতক। সম্প্রতি (এ বছরের জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে) ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। (নিউজ এখানে কিংবা এখানে)। অভিযোগপত্রে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান জসীমউদ্দিন ও নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সাত শিক্ষার্থীসহ মোট আটজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।  পুলিশের অভিযোগে বলা হয়েছে –

“আটক থাকা সাতজনসহ মোট আটজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে চার্জশিটে । এর মধ্যে অভিযুক্ত মুফতি মো: জসিমউদ্দিন রহমানী জঙ্গী এবং উগ্র তৎপরতার সাথে জড়িত ছিলেন। এই জসিমউদ্দিন রহমানী ঢাকার মোহাম্মদপুরে দু’টি মসজিদে জুম্মার নামাজের আগে খুতবা দিতেন এবং তিনি ধর্মের বিরুদ্ধে লেখে, এমন ব্লগারদের হত্যার ফতোয়াও দিতেন। অন্য আসামীরা সবাই নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং তারা ঐ খুতবা শুনতে যেতো। এভাবে তাদের মধ্যে একটা যোগাযোগ তৈরি হয়েছিল।”

 

বছর ঘুরে আবার সেই ১৫ই ফেব্রুয়ারি। অনেকেই রাজীবকে স্মরণ করে লিখছেন। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। ব্লগেও লিখেছেন অনেকে।  মুক্তমনাতেও বাউন্ডুলে বাতাস, আসিফ মহিউদ্দীন, সৈকত চৌধুরী, তামান্না ঝুমু, রায়হান আবীর সহ অনেকেই রাজীব ওরফে থাবা বাবাকে স্মরণ করেছেন। তাদের এ লেখাগুলো রাখা আছে আমাদের আর্কাইভের ‘রাজীব হায়দার শোভন (থাবা বাবা)’ ক্যাটাগরিতে।  অনেক টকশোজীবী সেলিব্রিটি ব্লগার অবশ্য ‘বিতর্ক এড়ানোর’ ভয়ে রাজীবের নামোল্লেখ থেকে বিরত থাকলেও  প্রিয় লেখক ড.মুহম্মদ জাফর ইকবাল ঠিকই রাজীবের উল্লেখ করেছেন গণজাগরণ মঞ্চ নিয়ে লিখতে গিয়ে

“আমি হেঁটে হেঁটে ট্রাকের পিছনে গিয়েছি, তখন লম্বা একটা ছেলের সঙ্গে কথা হল। মাথায় হলুদ ফিতা, তাই সেও নিশ্চয়ই একজন ব্লগার, আমাকে বলল, “স্যার, একটা বিষয় জানেন?’

আমি বললাম, “কী?”

সে বলল, “এই পুরো ব্যাপারটি শুরু করেছি আমরা ব্লগাররা, কিন্তু এখন কেউ আর আমাদের কথা বলে না!”

কথা শেষ করে ছেলেটি হেসে ফেলল।

আমি তখনও জানতাম না যে এই ছেলেটি রাজীব এবং আর কয়েকদিন পরেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে একত্র হওয়া এই তরুণদের ‘নাস্তিক’ অপবাদ দিয়ে বিশাল একটা প্রচারণা শুরু হবে, আর সেই ষড়যন্ত্রের প্রথম বলি হবে এই তরুণটি।…”

রাজীবের নাস্তিকতার কারণে রাজাকারবিরোধী আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত যে সব অ্যাক্টিভিস্টরা তার নামোল্লেখ এড়িয়ে চলেন, ‘দেশোদ্ধার’ করতে যারা রাজীবকে নির্বাসনে পাঠিয়েছেন, ড.মুহম্মদ জাফর ইকবালের সাম্প্রতিক লেখাটি তাদের জন্য শিক্ষনীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে।

না, রাজীবের সাথে আমার সেভাবে পরিচয় ছিল না। ফেসবুকেও কখনো যেচে আলাপ করা হয়নি, যদিও তিনি আমার বন্ধু তালিকায় ছিলেন প্রথম থেকেই। রাজীবকে নিয়ে আমি প্রথম লিখেছিলাম তিনি মারা যাবার পর । লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল একটি অনলাইন পত্রিকায়, ‘কেন কেবল তারাই আক্রান্ত হচ্ছেন?’ শিরোনামে। সে লেখায় আমি অনুমান করেছিলাম যে মুক্তবুদ্ধির চর্চা এবং মুক্তমত প্রকাশের কারণেই রাজীব ধর্মান্ধ শক্তির উষ্মার কারণ হয়েছেন, তিনি আক্রান্ত হয়েছেন এবং তাকে অকালে প্রাণ দিতে হয়েছে, ঠিক যেমনিভাবে ঘাতকাহত হয়ে প্রলম্বিত মৃত্যুর দিকে চলে যেতে হয়েছিল প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদকে। আমার অনুমান যে মিথ্যা ছিল না তা ধরা পড়ার পর অভিযুক্তদের স্বীকারোক্তিতে প্রমাণ পাওয়া যায়। অভিযুক্ত আততায়ীদের বিভিন্ন ব্লগের ঠিকানা এবং ব্লগ থেকে ডাউনলোড করে তথ্য দিয়ে প্ররোচিত করেন জসিমউদ্দিন রহমানীর জঙ্গী তৎপরতা দিয়ে আক্রান্ত শিবিরের সেই বড় ভাই রানা। রাজীবের লেখা তাদের ‘ধর্মানুভূতি’কে আহত করেছিল, তাই ‘ঈমানী দায়িত্ব পালনের জন্য এই হত্যাকাণ্ড’ তারা ঘটিয়েছে ।

চিত্র: রাজীব হত্যায় গ্রেফতারকৃত আসামীরা। ‘ঈমানী দায়িত্ব পালনের জন্য এই হত্যাকাণ্ড’ তারা ঘটিয়েছে বলে তারা স্বীকার করেছিল পত্রিকায়।

 রাজীব হত্যাকারী এই যুবকদের নূরানী চেহারাগুলোর দিকে তাকান। আশা করি  ‘নুরানী চাপার’ মাহাত্ম্য বুঝতে অসুবিধা হবে না আর কখনো।

রাজীব হত্যার কিছুদিন আগে আরেকটি প্রাসঙ্গিক খবর পত্রিকার শিরোনাম হয়েছিল। নিউ ইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ভবন বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনার অভিযোগে নর্থ সাউথের কামেল প্রাক্তন ছাত্র কাজী মোহাম্মদ রেজওয়ানুল আহসান গ্রেফতার হয়েছিলেন আমেরিকায়। কাজী মোহাম্মদ রেজওয়ানুল আহসান কিংবা রাজীব হত্যায় জড়িত নর্থ সাউথের ছাত্রদের মুখগুলোর দিকে তাকালে আমরা বুঝতে পারি ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ কত প্রকটভাবে মস্তিষ্ককে অধিকার করে ফেলতে পারে, যার ফলে একজনকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে নির্মমভাবে খুন করতেও তাদের বাধে না, বরং এটাকে তারা ‘ঈমানী দায়িত্ব’ বলে মনে করে।

বিশ্বাসের ভাইরাস:

‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ ব্যাপারটা এই সুযোগে একটু পরিষ্কার করে নেয়া যাক। এ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে  একটা মজার উদাহরণ আমি প্রায়ই দেই ড্যানিয়েল ডেনেটের ‘ব্রেকিং দ্য স্পেল’ বইটি থেকে। খুব মজার উদাহরণ এটি। আপনি নিশ্চয়ই ঘাসের ঝোপে কিংবা পাথরের উপরে কোন কোন পিপড়াকে দেখেছেন – সারাদিন ধরে ঘাসের নীচ থেকে ঘাসের গা বেয়ে কিংবা পাথরের গা বেয়ে উপরে উঠে যায়, তারপর আবার ঝুপ করে পড়ে যায় নিচে, তারপর আবারো গা বেয়ে উপরে উঠতে থাকে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে – এই বেআক্কেলে কলুর বলদের মত পণ্ডশ্রম করে পিপড়াটি কি এমন বাড়তি উপযোগিতা পাচ্ছে, যে এই অভ্যাসটা টিকে আছে? কোন বাড়তি উপযোগিতা না পেলে সারাদিন ধরে সে এই অর্থহীন কাজ করে সময় এবং শক্তি ব্যয় করার তো কোন মানে হয় না। আসলে সত্যি বলতে কি – এই কাজের মাধ্যমে পিপড়াটি বাড়তি কোন উপযোগিতা তো পাচ্ছেই না, বরং ব্যাপারটি সম্পূর্ণ উলটো। গবেষণায় দেখা গেছে পিপড়ার মগজে থাকা ল্যাংসেট ফ্লুক নামে এক ধরনের প্যারাসাইট এর জন্য দায়ী। এই প্যারাসাইট বংশবৃদ্ধি করতে পারে শুধুমাত্র তখনই যখন কোন গরু বা ছাগল একে ঘাসের সাথে চিবিয়ে খেয়ে ফেলে। ফলে প্যারাসাইট টা নিরাপদে সেই গরুর পেটে গিয়ে বংশবৃদ্ধি করতে পারে। পুরো ব্যাপারটাই এখন জলের মত পরিষ্কার – যাতে পিপড়াটা কোন ভাবে গরুর পেটে ঢুকতে পারে সেই দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ঘাস বেয়ে তার উঠা নামা। আসলে ঘাস বেয়ে উঠা নামা পিঁপড়ের জন্য কোন উপকার করছে না বরং ল্যাংসেট ফ্লুক কাজ করছে এক ধরনের ভাইরাস হিসবে – যার ফলশ্রুতিতে পিঁপড়ে বুঝে হোক, না বুঝে তার দ্বারা অজান্তেই চালিত হচ্ছে।

চিত্র: ল্যাংসেট ফ্লুক নামের প্যারাসাইটের কারণে পিঁপড়ের মস্তিষ্ক আক্রান্ত হয়ে পড়ে, তখন পিঁপড়ে কেবল চোখ বন্ধ করে পাথরের গা বেয়ে উঠা নামা করে। ধর্মীয় বিশ্বাসগুলোও কি মানুষের জন্য একেকটি প্যারাসাইট?

 

এ ধরণের আরো কিছু উদাহরণ জীববিজ্ঞান থেকে হাজির করা যায়। নেমাটোমর্ফ হেয়ারওয়ার্ম (বৈজ্ঞানিক নাম Spinochordodes tellinii) নামে এক ফিতাকৃমি সদৃশ প্যারাসাইট আছে যা ঘাস ফড়িং-এর মস্তিষ্ককে সংক্রমিত করে ফেললে ঘাস ফড়িং পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে। এর ফলশ্রুতিতে নেমাটোমর্ফ হেয়ার-ওয়ার্মের প্রজননে সুবিধা হয়। অর্থাৎ নিজের প্রজননগত সুবিধা পেতে নেমাটোমর্ফ হেয়ারওয়ার্ম বেচারা ঘাস ফড়িংকে আত্মহত্যায় পরিচালিত করে। এ ছাড়া জলাতঙ্ক রোগের সাথেও আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। পাগলা কুকুর কামড়ালে আর উপযুক্ত চিকিৎসা না পেলে জলাতঙ্ক রোগের জীবাণু মস্তিষ্ক অধিকার করে ফেলে। ফলে আক্রান্ত মস্তিষ্কের আচরণও পাগলা কুকুরের মতোই হয়ে উঠে। আক্রান্ত ব্যক্তি অপরকেও কামড়াতে যায়। অর্থাৎ, ভাইরাসের সংক্রমণে মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে।

আমাদের দীর্ঘদিনের জমে থাকা প্রথাগত বিশ্বাসের ‘ভাইরাসগুলোও’ কি আমাদের সময় সময় এভাবে আমাদের অজান্তেই বিপথে চালিত করে? আমরা আমাদের বিশ্বাস রক্ষার জন্য প্রাণ দেই, বিধর্মীদের হত্যা করি, টুইন টাওয়ারের উপর হামলে পড়ি, সতী নারীদের পুড়িয়ে আত্মতৃপ্তি পাই, বেগানা মেয়েদের পাত্থর মারি…। মনোবিজ্ঞানী ডেরেল রে তার ‘The God Virus: How religion infects our lives and culture’ বইয়ে বলেন, জলাতঙ্কের জীবাণু দেহের ভিতরে ঢুকলে যেমন মানুষের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র বিকল হয়ে যায়, ঠিক তেমনি ধর্মীয় বিশ্বাসগুলোও মানুষের চিন্তা চেতনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে, তৈরি হয় ভাইরাস আক্রান্ত মননের।

নেমাটোমর্ফ হেয়ারওয়ার্ম যেমনি ভাবে ঘাস ফড়িংকে আত্মহত্যায় পরিচালিত করে, ঠিক তেমনি ধর্মের বিভিন্ন বাণী এবং জিহাদি শিক্ষা মানব সমাজে অনেকসময়ই ভাইরাস কিংবা প্যারাসাইটের মত সংক্রমণ ঘটিয়ে আত্মঘাতী করে তুলে। ফলে আক্রান্ত সন্ত্রাসী মনন বিমান নিয়ে আছড়ে পড়ে টুইন টাওয়ারের উপর। নাইন-ইলেভেনের বিমান হামলায় উনিশ জন ভাইরাস আক্রান্ত মনন ‘ঈশ্বরের কাজ করছি’ এই প্যারাসাইটিক ধারণা মাথায় নিয়ে হত্যা করেছিলো প্রায় তিন হাজার জন সাধারণ মানুষকে। ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগোর অধ্যাপক ব্রুস লিংকন, তার বই ‘হলি টেররস: থিংকিং এবাউট রিলিজিয়ন আফটার সেপ্টেম্বর ইলেভেন’ বইয়ে বিষয়টির উপর আলোকপাত করে বলেন, ‘ধর্মই, মুহাম্মদ আত্তা সহ আঠারজনকে প্ররোচিত করেছিল এই বলে যে, সংগঠিত বিশাল হত্যাযজ্ঞ শুধুমাত্র তাদের কর্তব্য নয়, বরং স্বর্গ থেকে আগত পবিত্র দায়িত্ব’। হিন্দু মৌলবাবাদীরাও একসময় ভারতে রাম-জন্মভূমি অতিকথনের ভাইরাস বুকে লালন করে ধ্বংস করেছে শতাব্দী প্রাচীন বাবরি মসজিদ। বিগত শতকের আশির দশকে মাইকেল ব্রে নামের কুখ্যাত এক খ্রিস্টান সন্ত্রাসী ওয়াশিংটন ডিসি, মেরিল্যান্ড এবং ভার্জিনিয়ার গর্ভপাত ক্লিনিকগুলোতে উপর বোমা হামলার পর বাইবেলের বানীকে রক্ষাকবচ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন আদালতে। এধরণের অসংখ্য দৃষ্টান্ত ইতিহাস থেকে হাজির করা যাবে, ভাইরাস আক্রান্ত মনন কিভাবে কারণ হয়েছিল সভ্যতা ধ্বংসের।

 

চিত্র: বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, নেমাটোমর্ফ হেয়ারওয়ার্ম নামে এক প্যারাসাইটের সংক্রমণে ঘাস ফড়িং পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে (বামে), ঠিক একইভাবে বিশ্বাসের ভাইরাসের সংক্রমণে আক্রান্ত আল-কায়দার ১৯ জন সন্ত্রাসী যাত্রীবাহী বিমান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো টুইন টাওয়ারের উপর ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর (ডানে)। বিশ্বাসের ভাইরাসের বাস্তব উদাহরণ।

সাম্প্রতিককালে বেশ কিছু গবেষক, বিজ্ঞানী এবং লেখক উগ্র ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে ‘ভাইরাস’ এবং ‘মেমপ্লেক্স’ এর সাযুজ্য খুঁজে পেয়েছেন। শুরুটা করেছিলেন রিচার্ড ডকিন্স তার ১৯৭৬ সালে লেখা বিখ্যাত ‘সেলফিশ জিন’ বইটির মাধ্যমে। তারপর এ লাইনে গবেষণা সুসান ব্ল্যাকমোরের   ‘মিম মেশিন’ হয়ে  রিচার্ড ব্রডির ‘ভাইরাস অব মাইন্ড’ কিংবা ডেরেক রে’র ‘দ্য গড ভাইরাস’ কিংবা ক্রেগ জেমসের ‘দ্য রিলিজিয়ন ভাইরাস’ শিরোনামের জনপ্রিয়ধারার বইগুলোতে এসে থেমেছে। এ বইগুলো থেকে বোঝা যায় ভাইরাস আক্রান্ত মস্তিষ্ক কি শান্তভাবে রবোটের মত ধর্মের আচার আচরণগুলো নির্দ্বিধায় পালন করে যায় দিনের পর দিন, আর কখনো সখনো বিধর্মী নিধনে উন্মত্ত হয়ে উঠে; একসময় দেখা দেয় আত্মঘাতী হামলা, জিহাদ  কিংবা ক্রুসেডের মহামারী।

চিত্র: সাম্প্রতিককালে বেশ কিছু গবেষক, বিজ্ঞানী এবং লেখক উগ্র ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে ‘ভাইরাস’ এবং ‘মেমপ্লেক্স’ এর সাযুজ্য খুঁজে পেয়েছেন।

রাজীবকে হত্যার বিবরণ পড়লে হতবাক হতে হয়, কিভাবে তাদের মস্তিষ্ক ‘ব্রেন ওয়াশড’ হয়েছে প্যারাসাইটিক জিহাদি ধারণা দিয়ে। তারা রাজীবকে হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে ‘ইনটেল গ্রুপ’ গঠন করেছিল। এই দলের কাজ ছিল ব্লগ ও ফেসবুক থেকে তাঁর সম্পর্কে নানা তথ্য সংগ্রহ করা ও তাঁর পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া। আর রাজীবকে হত্যার জন্য তারা তৈরি করেছিল ‘এক্সিকিউশন গ্রুপ’ । প্রায় এক মাস তাঁরা রাজীবকে অনুসরণ করেছেন। দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, ইনটেল গ্রুপের সদস্যরা গত ৯ ফেব্রুয়ারি শাহবাগে যায় এবং ব্লগার রাজীবকে খোঁজা শুরু করে। এর এক থেকে দুই দিনের মধ্যে রাজীবের বন্ধুদের চিহ্নিত করার মাধ্যমে তারা রাজীবকে চিনতে পারে। এরপর এই দলের সদস্য এহসান রেজা রুম্মন শাহবাগ থেকে সাইকেলে করে রাজীবকে অনুসরণ করে মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বর পর্যন্ত গিয়ে বাসা চিহ্নিত করে আসে। ১৫ ফেব্রুয়ারি দলের সদস্যরা সাইকেল ও বাসে চড়ে বিকেল চারটার দিকে পলাশনগরে রাজীবদের বাসার গলিতে অবস্থান নেয় । সন্ধ্যার দিকে রাজীব বাসার গেটের কাছাকাছি পৌঁছার পর এক্সিকিউশন গ্রুপের সদস্য মো. ফয়সাল বিন নাঈম দীপ, মো. মাকসুদুল হাসান অনিক চাপাতি ও ছোরা দিয়ে হত্যাকাণ্ডে অংশ নয় এবং রাজীবকে নির্মম ভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

 চিত্র: হত্যার পরে এভাবেই পড়ে ছিল রাজীব ওরফে থাবা বাবার লাশ

তার রক্তাক্ত লাশ মাটিতে পড়ে ছিল বহু সময় ধরে। পলাশনগর এলাকায় রক্তমাখা লাশ দেখে স্থানীয় লোকজন রাত ১০টার কিছু পরে থানা পুলিশকে খবর দেয়। এরপরেই ব্যাপারটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

ধর্মের প্যারাসাইটিক ধারণাই কি দায়ী নয়?

রাজীবকে হত্যাকারীরা নিজেদের স্বীকারোক্তিতেই বলেছিল যে, ‘ঈমানী দায়িত্ব পালনের জন্য’ রাজীবকে হত্যা করা হয়েছে। ঠিক যেমন নাইন-ইলেভেনের বিমান হামলার পেছনের অভিযুক্তরা   ‘ঈশ্বরের কাজ করছি’ এই প্যারাসাইটিক ধারণা মাথায় নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল  টুইন টাওয়ারের ওপর, ঠিক একইভাবে ‘ঈমানী দায়িত্ব পালন’ করছি ভেবে রাজীবের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তার হত্যাকারীরা। এই হত্যাকারীরা কেউ অশিক্ষিত ছিল না। শিক্ষা দীক্ষায় চৌকস আধুনিক একটি বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র ছিল তারা। তারা সবাই এসেছিল ভাল পরিবেশ থেকে, ভাল পরিবার থেকে। কেবল একটি জায়গাতেই ছিল সমস্যা। মুফতি মো: জসিমউদ্দিন রহমানীর জঙ্গী সংক্রমণ দিয়ে পরিচালিত হয়েছিল তাদের মস্তিস্ক –   সেটা বুঝেই হোক কিংবা না বুঝেই হোক।

সবচেয়ে বড় কথা হল – হত্যাকারীরা যেভাবে কিংবা যে কারণে রাজীবকে হত্যা করেছে, সেটা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা হয়, এর সমর্থন খোদ ধর্মগ্রন্থেই আছে, আছে পয়গম্বরদের বিবিধ কাজকর্মে। বহু গবেষকই দেখিয়েছেন যে, ইসলামের সূচনাকালে মহানবী মুহাম্মদ ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে যেসব সহিংস পন্থা ব্যবহার করেছিলেন, গুপ্তহত্যা ছিল তার অন্যতম। আবু আফাক, কাব ইবনে আশরাফ, আসমা বিন্তে মারওয়ান প্রমুখেরা ছিলেন এর অন্যতম শিকার।

আবু আফাক ছিলেন আরবের এক বিখ্যাত বয়োবৃদ্ধ কবি। নবী মুহম্মদ আল-হারিথ নামে শত্রুপক্ষের একজনকে অন্যায়ভাবে হত্যার পর আবু আফাক এই কাজের সমালোচনা করে একটি কবিতা লিখেছিলেন। তার অন্য কিছু কবিতাতেও ইসলামের এবং নবীর সমালোচনা ছিল। মুহম্মদের অনুসারীরা যে ধর্মের নামে নিজেদের মধ্যে লড়াই করছে, তা নিয়ে তিনি ব্যঙ্গ করেছিলেন। ব্যাপারটা নবীর কানে গেলে তিনি অতিশয় বিরক্ত হন, এবং এই কবিকে হত্যার দায়িত্ব দেন তার এক শিষ্যকে। সেলিম বিন উমায়ের নামের সেই শিষ্য গিয়ে গভীর রাতে ঘুমন্ত কবি আফাককে হত্যা করে আসে। ইবনে ইসহাকের ‘দ্য লাইফ অব মুহম্মদ’ (পৃঃ ৬৭৫) বইয়ে এই ঘটনার বিবরণ আছে। আছে ইবনে সাদের তাবকাতেও (কিতাব আল তবকাত, ভলিউয়ম ২, পৃঃ ৩১)।

আসমা বিন্তে মারওয়ান নামের আরেক নারী কবি ছিলেন আরবে সেসময়। আবু আফাককে অন্যায়ভাবে হত্যার পর পাঁচ সন্তানের জননী এই আসমা ভীষণ ক্ষুব্ধ হন এবং এ নিয়ে একটি কবিতা লিখেছিলেন। যথারীতি এটাও মুহম্মদের পছন্দ হয়নি। তিনি উমায়ের বিন আদি আল খাতমি নামের এক শিষ্যকে আদেশ দিলেন আসমাকে হত্যা করার। নবীর নির্দেশে সে রাতেই আসমার বাড়িতে গিয়ে তাকে হত্যা করে আসে উমায়ের। ইবনে ইসহাকের (‘দ্য লাইফ অব মুহম্মদ’ পৃঃ ৬৭৫ – ৬৭৬) বর্ণনা থেকে জানা যায়, আসমার ঘরে ঢোকার পর উমায়ের দেখতে পায় যে তার এক শিশুপুত্র তার বুকের উপর ঘুমিয়ে আছে। উমায়ের অতি সতর্কতার সাথে বাচ্চাটিকে আসমার বুকের উপর থেকে সরিয়ে নিয়ে এতো জোরে আসমার বুকে তলোয়ার চালিয়েছিল যে সেটা তার বুক ভেদ করে তার খাটের সাথে আটকে গিয়েছিল। পরদিন সকালে সে আসমার হত্যার কথা মহানবীকে জানালে, মহানবী উৎফুল্ল হয়ে বলেছিলেন, ‘হে উমায়ের, তুমি আল্লাহ ও তার রসুলকে সাহায্য করেছো।’ এই হত্যার জন্য কোন প্রতিফল বহন করতে হবে কিনা এ প্রশ্ন করলে মুহম্মদ উত্তরে বলেছিলেন, ‘ঐ মহিলাকে কোন ছাগলেও পুছে দেখবে না’ [Two goats won’t butt their heads about her]।

কাব ইবনে আশরাফ নামের আরেক তরুণ কবির কথাও জানা যায় ইতিহাস থেকে। কাব ছিলেন একজন ইহুদী কবি ও মহানবীর প্রচারিত ধর্মের এক কঠোর সমালোচনাকারী। বানু নাদির গোত্রের নেতা ছিলেন তিনি। বানু কাইনুকা নামের আরেকটা ইহুদী গোত্রকে মুহম্মদ আক্রমণ করে নির্মমভাবে ধ্বংস করেছিলেন কিছুদিন আগেই। এ দেখে কাব প্রচণ্ড ভাবে বিমর্ষ হন,ক্ষুব্ধ হন, এবং কবিতা লিখে মক্কাবাসীকে নবীর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে উৎসাহিত করেন । এর পর কি ঘটেছিল সেটা আল-বুখারীর একটি হাদিস (সহীহ বুখারি, ৫:৫৯:৩৬৯) থেকে জানা যায় :

হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ রাঃ বলেন, রাসূলুল্লাহ সাঃ কাব বিন আশরাফের ব্যাপারে কে আছো? কেননা সে আল্লাহ ও তার রাসূলকে কষ্ট দেয় তখন মুহাম্মদ বিন মাসলামা দাঁড়িয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি চান আমি তাকে হত্যা করি? তিনি বললেন, হ্যাঁ বিন মাসলামা আরও বললেন, কাবকে হত্যা করা সম্ভব, কিন্তু তা করার জন্য তাকে মিথ্যা ও প্রতারণার আশ্রয় নিতে হবে। নবী কি সেই অনুমতি দেবেন? নবী তাতে অনুমতি দিলেন। তারপর এক রাতে মাসলামা কোন জরুরী বিষয়ে আলোচনার ছুতায় কাবকে তার বাড়ি থেকে বের করে আনার ফন্দি আঁটে। স্ত্রীর বারণ অগ্রাহ্য করে কাব রাস্তায় বেরিয়ে এলে মাসলামার সঙ্গে আসা লুক্কায়িত দুই সহযোগী বেরিয়ে এসে কাবের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে হত্যা করে।”

আবুরাফে  বিন আবি আল হকাইক ছিলেন খাইবারে বসবাসকারী একজন ইহুদী নেতা, এবং বিখ্যাত ব্যবসায়ী। তিনি কবিতা লিখতেন এবং সেগুলোতে নবীর সমালোচনা থাকতো। মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি নাকি টাকা পয়সা দিয়েও সাহায্য করতেন। এ সমস্ত ‘ইসলামবিরোধী’ কাজের জন্য খুব সম্ভবত  ৫ম হিজরী সনের যুলহজ্জ মাসে মহানবীর আবু রাফেকে হত্যা করা হয়। এই এই অভিযানে পাঁচজন সাহাবীর একটি দল অংশ নিয়েছিল বলে কথিত আছে; তারা হলেন (১) আব্দুল্লাহ ইবনে আতীক, (২)মাসউদ বিন সিনান, (৩) আব্দুল্লাহ বিন উনায়স, (৪) আবু কাতাদা বিন হারিস, (৫) খুযা’য়ী বিন আল আসওয়াদ (রাঃ)।

সহীহ আল বুখারির একটি হাদিসে (৪:৫২:২৬৪) আবু রাফেকে হত্যার বিবরণ পাওয়া যায়:

হযরত বারা ইবনে আজেব রাঃ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আনসারদের একটি দলকে ইহুদী আবু রাফে’কে হত্যার উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন। তাদের মধ্য থেকে একজন (আবুআতীক রাঃ) এগিয়ে গিয়ে ইহুদীদের দুর্গে প্রবেশ করেন। তিনি বলেন, অতঃপর আমি গিয়ে তাদের পশুর আস্তাবলে প্রবেশ করলাম আর তারা দুর্গের প্রধান ফটক বন্ধকরে দিল। এদিকে তাদের একজনের একটি গাধা হারিয়ে গিয়েছিলো; তারা গাধাটি খুঁজতে বেরিয়ে পড়লে আমিও গাধা খোঁজার ভান ধরে তাদের সাথে বেরিয়ে পড়লাম। আমি তাদেরকে বুঝাতে চাচ্ছিলাম যে আমিও তাদেরসাথে গাধা খোঁজ করছি। অবশেষে গাধাটি পেয়ে গেলে তারা যখন দুর্গে প্রবেশ করেতখন আমিও তাদের সাথে আবার দুর্গে প্রবেশ করি।

তারপর আমি লক্ষ করলাম যে তারা দুর্গের ফটকবন্ধ করে চাবিটি একটি কুলুঙ্গির মধ্যে রেখে দিলো।অতঃপর তারা ঘুমিয়ে পড়লে আমি চাবি নিয়ে ফটকখুলে রেখে (অন্ধকারের মধ্যে হাতড়ে) আবু রাফে’র ঘরে গিয়েপৌঁছলাম। আমি ‘ও আবু রাফে’ বলে ডাক দিলে সে আমার ডাকেসাড়া দিলো। আমি তার আওয়াজ দ্বারা তার অবস্থানঅনুমান করে তরবারির আঘাত হানলাম, আর অমনি সে চিৎকার করে উঠলো; আর আমি ঘরথেকে বেরিয়ে এলাম। যেন তার সাহায্যের জন্য কেউ এগিয়ে এসেছে এমন ভান করে আমি আবার ঘরে প্রবেশ করে গলার স্বর পরিবর্তন করে জজ্ঞাসা করলাম, ‘ও আবু রাফে’ (চিৎকার করলে কেন) তোমার কী হয়েছে?

সে বলল তোমার মা ধ্বংস হোক (তাড়াতাড়ি আসছো না কেন) কি হল তোমার, কে যেন আমার ঘরে ঢুকেআমাকে আঘাত করেছে। তিনি (আবু আতীক) বলেন, অতঃপর আমি আমার তরবারি তার পেটেরউপর রেখে শরীরের সকল শক্তি দিয়ে এমন জোরে চেপে ধরলাম যে তার (মেরুদণ্ডের) হাড্ডি পর্যন্তগিয়ে ঠেকার শব্দ হল। (এরপর তার চিৎকারে ও বাচ্চাদের কান্নাকাটির শব্দে অন্যরাও জেগে উঠে দরজাখুলতে লাগলো)

অতঃপর আমি ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে গিয়ে পড়েগেলাম এবং এতে আমার পায়ে প্রচণ্ড আঘাত পেলাম। যাই হোক কোন মতে আমি বেরিয়েএসে আমার সঙ্গীদেরসাথে মিলিত হলাম। আমি তাদেরকে বললাম, যতক্ষণ পর্যন্ত আমি (আবু রাফে’র) মৃত্যু সংবাদ প্রচারকারিণীর ঘোষণা শুনতে না পাই ততক্ষনপর্যন্ত আমি এ স্থান ত্যাগ করবো না। সত্যিই হিজাযের বিখ্যাত ব্যবসায়ী আবুরাফে’র মৃত্যু সংবাদ না শুনে আমি সে স্থান ত্যাগ করলাম না। মৃত্যু সংবাদ যখন আমিশুনলাম তখন আমি দাড়িয়ে গেলাম এবং আমার যেন কোন ব্যথাই ছিলো না। অবশেষে আমিআল্লাহর রসূলের কাছে গিয়ে আবু রাফে’কে হত্যার খবর দিলাম।

মহানবী কেবল এই চার কবিকেই নয়, আরো অনেককেই বিভিন্ন সময় গুপ্তহত্যার প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন যেগুলো কখনো সফল হয়েছিল, কখনো বা ব্যর্থ। যেমন, ওহুদ যুদ্ধের পর পরই মক্কার নেতা আবু সুফিয়ানকে হত্যার জন্য তিনি কিছু সহযোগী পাঠিয়েছিলেন। যদিও তারা ব্যর্থ হয়েছিল এ কাজে, কিন্তু অন্য তিনজন কোরাইশকে গুপ্ত হত্যা করে এসেছিল সে দিন। নবী তার সমালোচনাকারীদের এভাবে গুপ্তহত্যার মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার নিয়ম জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বলবত রেখেছিলেন। ইতিহাস থেকে জানা যায় মহানবীর মৃত্যুর এমনকি একদিন আগেও আইহালা ইবনে কাব (‘আল-আসওয়াদ’ বা ‘কালো মানুষ’ নামে মুসলিম মধ্যে পরিচিত ছিলেন) নামক এক ইয়েমেনি প্রতিপক্ষকে মুহম্মদের আদেশে হত্যা করা হয়েছিল । উইকিইসলাম সাইটে এমন চল্লিশ জনের একটি তালিকা আছে, যাদেরকে হত্যার জন্য নবী মুহম্মদ কখনো না কখনো নির্দেশ দিয়েছিলেন, নিজের ক্ষমতার মসনদ সুরক্ষিত রাখার জন্য।

মুহম্মদের পরবর্তীকালের অনুসারীরা মুহম্মদের প্রদর্শিত কাজগুলোই ভাইরাসের মত কপি করে করে একনিষ্ঠ-ভাবে পালন করেছেন বিভিন্ন সময়ে। ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ লিখার অপরাধে সালমান রুশদীকে হত্যার ফতোয়া দেয়া হয়েছিল খোমেনির পক্ষ থেকে ১৯৮৯ সালে। কয়েক বছর আগে আগে ডাচ চলচ্চিত্রকার থিও ভ্যানগগকে ও একইভাবে হত্যা করা হয় ‘ইসলামকে অপমান’ করার অজুহাতে। বাংলাদেশে হুমায়ুন আজাদ, আসিফ মহিউদ্দীন, সানিউর কিংবা থাবা বাবার ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটেছে বলে আমি মনে করি। এক্ষেত্রে মূল অভিযোগ ছিল অবশ্যই তাদের ইসলামবিদ্বেষী লেখালিখির। বহু মৌলবাদী জিহাদী সাইটেই এর পক্ষে সমর্থন মিলবে (যেমন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে কিংবা এখানে)। নবী মুহম্মদের আমলে ‘ইসলামবিদ্বেষী’ আবু রাফেকে হত্যার জন্য যেভাবে পাঁচজন সাহাবীর একটি দল গুপ্ত হত্যায় অংশ নিয়েছিল মুহম্মদের নির্দেশে,  একই কায়দায় মুফতি জসিমের নির্দেশে সাতজনের দল গঠন করে থাবা বাবাকে পল্লবী থানার পলাশনগরের বাড়ির সামনে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছিল আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে। যারা এই অভূতপূর্ব সাদৃশ্য দেখেও না দেখার বা বোঝার ভান করেন, তারা হয় ‘বোকার স্বর্গে’ বাস করছেন, নয়তো নিজেকেই প্রতারিত করে চলেছেন অহর্নিশি।

রাজীব হত্যা : উৎস সন্ধান

রাজীবের এই ঘটনা নতুন করে আমাদের কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন করে দিয়েছে। পরিষ্কার করে দিয়েছে এই জিহাদি ভাইরাসের প্রকটতা। কেবল বাইরের পৃথিবীতে নয়, এই সুজলা সুফলা বাংলাদেশে। একটা সময় মনে করা হতো জিহাদ, ধর্মীয় হত্যা, সন্ত্রাস কেবল আরব দেশে উষর মরুভূমির ফসল, লালনের দেশ, রবি ঠাকুরের দেশ,  নজরুল, জীবনানন্দের দেশে এই সংস্কৃতির লালন পালন হয় না। ভুল কথা। উষর মরুর জিহাদী ভাইরাসে বাংলাদেশ আজ আচ্ছন্ন। আজ যখন লেখাটি লিখছি তখন আয়মান আল-জাওয়াহিরির নাম ও ছবিসহ এক অডিও বার্তায় বাংলাদেশ সৃষ্টির উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলে ‘ইসলামবিরোধী ষড়যন্ত্রের’ বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার আহ্বান জানিয়েছে আল কায়দা (নিউজ এখানে)। বার্তায় বলা হয়েছে,

“বাংলাদেশের মুসলিম ভাইয়েরা, ইসলামের বিরুদ্ধে যারা ক্রুসেড ঘোষণা করেছে, তাদের প্রতিরোধ করার জন্য আমি আপনাদের আহ্বান জানাচ্ছি। উপমহাদেশ ও পশ্চিমের শীর্ষ অপরাধীরা ইসলামের বিরুদ্ধে, ইসলামের নবীর বিরুদ্ধে এই ষড়যন্ত্র করছে, মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, যাতে আপনাদেরকে তারা অবিশ্বাসীদের দাসে পরিণত করতে পারে।”

আল কায়দা এমন একটি সংগঠন যা ইসলাম বাঁচানোর নামে নারীদের যৌনজিহাদপায়ুধর্ষণ (আরো দেখুন এখানে)  সবই জায়েজ এবং হালাল করে দিয়েছে।  বিডিনিউজে ‘প্রসঙ্গ: আল-কায়েদার হুমকি ও তৎপরতা’ শিরোনামে এ নিয়ে একটি চমৎকার বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়েছে আজ (দেখুন এখানে)। রাজীব হত্যার সাথে আল কায়েদার সম্পর্কের কথাও বেশকিছু পত্রিকায় এসেছে (এখানে কিংবা এখানে)।

অনেকেরই বোধ হয় মনে আছে, রাজীব হত্যার পর পরই আল-কায়েদা ভাবধারার জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের পক্ষ থেকে একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। সে ভিডিওতে খুব স্পষ্ট করেই বলা হয়েছিল, নবী মুহম্মদ যেভাবে কাব ইবনে আশরাফ, আসমা বিন্তে মারওয়ানের মত কবিদের হত্যা করেছিলেন ইসলামের আর নবীর বিষেদগার করার শাস্তি হিসেবে, ঠিক একইভাবে ‘কুলাঙ্গার ব্লোগার’ (ঠিক এভাবেই উচ্চারিত হয়েছে ভিডিওতে) থাবা বাবাকে মেরে ফেলাও জায়েজ হয়েছে। ভিডিওটি শেষ করা হয়েছিল এই বলে যে রাজীব হত্যায় অনুপ্রাণিত হয়ে ইসলামের সৈনিকেরা অন্য সকল ‘নাস্তিক ব্লগার’দেরও হত্যা করুক, এটাই প্রত্যাশিত। বহু মানুষই সেই ভিডিওর লিঙ্ক তখন দেখেছিলেন। সচেতন ব্যবহারকারীরা ফেসবুকে রিপোর্টিং এর মাধ্যমে এ ধরণের উগ্রবাদী ভিডিও সরানোতে এগিয়ে আসলেও এখনো অনেক জায়গাতেই বহাল তবিয়তেই আছে। যেমন এখানে:

httpv://www.youtube.com/watch?v=GBRJ_qbToic

মুফতি জসিমের প্রচারণার মতোই এগুলো সংক্রমিত করছে বহু বিশ্বাসী মানুষের মননকে। জন্ম নিচ্ছে ভাইরাক্রান্ত জিহাদি প্রেরণার। জলাতঙ্ক রোগীর মতো মস্তিষ্ককে অধিকার করে ফেলছে ক্রমশ। জিন বা বংশাণুর মতোই কপি করে করে সংক্রমিত করে ফেলছে শতাধিক, সহস্রাধিক মননকে। এ ভাইরাস প্রতিরোধ না করতে পারলে এ ‘সভ্যতার ক্যান্সারে’ রূপ নিয়ে আমাদের সমস্ত অর্জনকে ধ্বংস করবে বলাই বাহুল্য। তাই এই ভাইরাস সম্বন্ধে সতর্ক থাকাটা জরুরী।

আজ যখন রাজীব হত্যার বিষয়ে আমরা কথা বলতে শুরু করেছি, তখন কেবল আশে পাশের ঝোপ ঝাড় পিটিয়ে গেলে হবে না, নজর দিতে হবে মূল জায়গায়। স্পষ্ট করে বলার সময় এসেছে যে এই ‘ধর্ম-ভাইরাস’ই থাবা বাবার হত্যার পেছনে মূল নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে।  ভাইরাসের কথা যখন বলা হয়, তখন হয়তো অনেকেই ভেবে নেন এটা স্রেফ তুলনা, এর বেশি কিছু নয়। আসলে তা নয়। আমি যখন ধর্মকে ‘ভাইরাস’ হিসেবে উদ্ধৃত করি, তখন আসলেই সেটাকে আক্ষরিক অর্থে ভাইরাসের মতোই মনে করি। হ্যাঁ, ধর্মীয় বিশ্বাসগুলোর ডিএনএ কিংবা প্রোটিনের মতো কোন ভৌত রূপ হয়তো নেই, কিন্তু অন্য সকল ক্ষেত্রে এটা প্রকৃত ভাইরাসের মতোই কাজ করে। অধ্যাপক ভিক্টর স্টেঙ্গর তার ‘গড – দ্য ফলি অব ফেইথ’ বইয়ে ডেরেল রে’র গবেষণা থেকে ধর্মের পাঁচটি বৈশিষ্ট্য লিপিবদ্ধ করেছেন, যা ভাইরাসের সমতুল   –

১)  এটা মানুষকে সংক্রমিত করে।

২)  অন্য ধারণার (ভাইরাসের) প্রতি প্রতিরোধ এবং এন্টিবডি তৈরি করে।

৩)  কিছু বিশেষ মানসিক এবং শারীরিক ফাংশনকে অধিকার করে ফেলে, এবং সেই ব্যক্তির মধ্যে এমনভাবে লুকিয়ে থাকে যে সেই ব্যক্তির পক্ষে তাকে সনাক্ত করা সম্ভব হয় না।

৪)   বিশেষ কিছু পদ্ধতি ব্যবহার করে ভাইরাসের বিস্তারে।

৫)  বাহককে অনেকটা ‘প্রোগ্রাম’ করে ফেলে ভাইরাসের বিস্তারে সহায়তা করতে।

 

বহু গবেষকই দেখিয়েছেন যে ধর্মের বিস্তার আর টিকে থাকার ব্যাপারগুলো অনেকটা ভাইরাসের মত করেই কাজ করে অনেকটা। একটি ভাইরাসের যেমন ‘হোস্ট’ দরকার হয় বংশবৃদ্ধির জন্য, নিজেকে ছড়িয়ে দেবার জন্য, ধর্মেরও টিকে থাকার জন্য দরকার হয় এক গাদা অনুগত বান্দা এবং সেবকের, যাদের বুকে আশ্রয় করে ধর্ম টিকে থাকে। শুধু তাই নয়, এক জীবাণু যেমন নিজেকে রক্ষার জন্য অন্য জীবাণুর সাথে প্রতিযোগিতা করে, ঠিক তেমনি এক বিশ্বাসও প্রতিযোগিতা করে অন্য বিশ্বাসের সাথে। নিজেকে অন্য বিশ্বাসের হাত থেকে রক্ষা করতে চায়। বিশ্বাসী বান্দাদের মনে ঢুকিয়ে দেয়া হয় – ‘অবিশ্বাসীদের কিংবা বিধর্মীদের কথা বেশি শুনতে যেয়ো না, ঈমান আমান নষ্ট হয়ে যাবে।’ ভাইরাস যেমন চোখ বন্ধ করে নিজের কপি করে করে জীবাণু ছড়িয়ে যায়, প্রতিটি ধর্মীয় বিশ্বাস অন্য বিশ্বাসগুলোকে দূরে সরিয়ে রেখে কেবল নিজের বিশ্বাসের কপি করে যেতে থাকে। বিস্তার ঘটাতে থাকে বিশ্বাস নির্ভর সাম্রাজ্যের। আরো একটি মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের অনেকেই শৈশবে সর্দি কাশি গলা ব্যথা সহ অনেক উপসর্গের সম্মুখীন হতাম। শিশুরা ভাইরাসাক্রান্ত হয় বেশি, কারণ পূর্ণবয়স্ক মানুষের চেয়ে অরক্ষিত শিশুকে কাবু করা সহজ। তাই শৈশবেই ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে বেশীমাত্রায়। ঠিক একইভাবে ধর্মগুলোও ‘অরক্ষিত শৈশব’কে বেছে নেয় ভাইরাসের প্রসারে।  এ বিষয়গুলো নিয়ে আমি আমার একটি বইয়ে বিস্তৃতভাবে আলোচনার প্রয়াস পেয়েছি; বইটি এ বছর প্রকাশিত হয়েছে জাগৃতি প্রকাশনী থেকে   ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ নামে। বইটির দ্বিতীয় অধ্যায়ে আমি আলোচনা করছে রাজীব হায়দার শোভনের নৃশংস হত্যাকাণ্ড এবং এর পেছনের মোটিভ নিয়ে।  গতবছর শাহবাগ আন্দোলনের সময় ঘটে যাওয়া এই ঘটনা আমাকে এতোটাই পীড়িত করেছিল যে আমার বইটি উৎসর্গ করার  সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এই অসম সাহসী তরুণের প্রতি, কারণ এই রাজীব হায়দারই ছিলেন আমার মতে শাহবাগ আন্দোলনে ‘বিশ্বাসের ভাইরাসের’ প্রথম শিকার।

 দেখতে দেখতে রাজীব হত্যার একটি বছর অতিক্রম করে গেল। এখনো কিন্তু রাজীবের মূল হত্যাকারী রেজওয়ানুল আজাদ রানা ধরা পড়েনি। ধরা পড়েনি আল কায়েদার কলকাঠি নাড়া নাটের গুরুরা। আমরা এখনো অপেক্ষা করে আছি রাজীব হত্যার বিচারের জন্য, প্রতীক্ষা করে আছি রাজীব ঠিক যেমনটি চেয়েছিলেন সেই ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’মুক্ত একটি প্রগতিশীল বাংলাদেশ দেখার আশায়।

সেরকমের বাংলাদেশ অদূর ভবিষ্যতে আমরা পাই –না পাই, অন্ততঃ এমন দিনে আমরা চাই, সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে শিখবেন সবাই।  রাজীব হত্যার পেছনে মূল উৎসটি ঠিক কোথায় সেটা অনুধাবন করবেন তারা।  কারণ কোন রোগ সারাতে হলে রোগের উৎসকে সনাক্ত করাটাই প্রথমে জরুরী।