২০১২ সালের ডিসেম্বরের সাতাশ তারিখ দুই স্যুটকেসে জীবনটাকে ভরে সামিয়া উঠে পড়লো ভাড়া করা সাদা রঙের টয়োটা গাড়িটায়। আগে এই ধরনের রজনীগন্ধা সজ্জিত গাড়ি রাস্তায় চলতে দেখতাম, আর এবার গাড়ির ভেতর থেকে দেখলাম রাস্তাটাকে। সেই রাস্তাটা, রাস্তাগুলোকে পার করে একসময় চলে আসলাম মিরপুরের এক চিপায় তুরাগ নদীর পাড়ের এক বাড়িতে, যে বাড়িটা আমার মা-বাবা বানিয়েছিলেন তাদের জীবনীশক্তি নিঃশেষ করে দিয়ে। ডিসেম্বরের সাতাশ তারিখ মধ্যরাত থেকে সেই ছোট বাড়ির ছোট এক ফ্ল্যাটে শুরু হলো আমার আর সামিয়ার সংসার। যে সংসারে আমাদের প্রতিদিনের জন্য বরাদ্দ তিন বালতি পানি। সকাল সাতটায় উঠে সেই পানি ধরতে হয়, সারাদিন আর পানির দেখা মেলে না, মেলে আবার পরের দিন ভোরে। ভাগ্য ভালো থাকলে সে পানি হয় সত্যিকারের পানির মতো, অন্যান্য দিন ঘোলা কিংবা আমার গায়ের রঙের মতো।

বিয়ে উপলক্ষে উপহার পেয়েছিলাম মাইক্রো-ল্যাবের একটা ছোট স্পিকার। সেই ছোট স্পিকারে রাহিন ভাইয়ের বাঁশি আর আনন্দ ভাইয়ের কণ্ঠের শঙ্খ শুনে ঠিকই আমরা বেঁচে থাকা শুরু করেছিলাম, বেঁচে থাকা শুরু করেছিলাম বুক ভরা আনন্দ নিয়ে। একটা মাস পার করে আমরা চলে এলাম ফেব্রুয়ারিতে, আমাদের প্রিয় ফেব্রুয়ারিতে। ফেব্রুয়ারির শুরুতেই দুর্দান্ত এক ব্যাপার ঘটে গেলো, জয় আমাকে চেনালো সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে লুকিয়ে থাকা মুক্ত মঞ্চ। সে মঞ্চে বিকালের পর সবাই আসে মুক্ত হতে, কেউ গিটার হাতে, কেউ তাস নিয়ে, কেউ বা শুধুই ঘাস পাতা নিয়ে। ফেব্রুয়ারির চার তারিখে সন্ধ্যায় ডান পাশে বইমেলা রেখে বাম পাশের মুক্ত মঞ্চ পরিষ্কারে ঝাড়ু হাতে নেমে পড়লাম সামিয়া, জয়, সাফি, জারিফ, সুইডেনের এরিকা ও অন্যান্যদের সাথে। শতবছরের পড়ে থাকা আবর্জনা আমরা ঝাড়ু হাতে এক পাশে সরাতে থাকলাম। এরিকার হাতে ঝাড়ু ছিলো না সেদিন, সে তাই হাত দিয়ে সেই ময়লা ঢোকাতে থাকলো বস্তায়। একটা সময় পর আমাদের মুক্ত মঞ্চ পরিষ্কার হয়ে গেলো, গিটার হাতে ততক্ষণে চলে এসেছে ফরহাদ। পরিষ্কার সেই মুক্ত মঞ্চে মুক্ত হয়ে যখন আমরা ফরহাদের কণ্ঠে শুনতে থাকলাম মহীনের ঘোড়াগুলি, তখন তিন বালতির কথা ভুলে গিয়ে আমরা স্বীকার করে নিতে বাধ্য হলাম জীবনানন্দময়। এরপর আমরা দলবেঁধে গেলাম বইমেলাতে, প্রাণের মেলাতে। মুক্ত মঞ্চে থাকতেই টুটুল ভাইয়ের ক্ষুদে বার্তা পেয়েছিলাম, মেলায় চলে এসেছে ‘মানুষিকতা’- আমার প্রথম আস্ত বই। সামিয়া সবাইকে সরিয়ে দিয়ে প্রথম বইটা কিনলো, তারপর জয়, জারিফ, লীনা। ঠিক যেমন হবার কথা ছিলো ফেব্রুয়ারির, তেমনই হচ্ছিলো সবকিছু।

কিন্তু এখানেই ফেব্রুয়ারি থেমে গেলো না। পরের দিন জন্ম নিলো শাহবাগ, আমাদের সবাইকে সে এক নিমেষে গ্রাস করে নিলো। সকালে বিশ্ববিদ্যালয় আসা, চা খাওয়া, বিড়ি খাওয়া, বিকাল না হতেই ছবির হাট পেরিয়ে শাহবাগ। সামিয়া চলে আসে অফিস থেকে এমনকি তৌহিদও তার ভুড়িটা দোলাতে দোলাতে হাজির হয় নিয়ম করে। তারপর টিএসএসি থেকে জাদুঘর পর্যন্ত ক্রমাগত হাঁটাহাঁটি, পথে মধ্যে পাওয়া চিংড়ি বড়া, ঝালমুড়ি সহ যাবতীয় যা পছন্দ হয় তা ভক্ষণ, রাতকে গভীর করা এবং এক সময় আবার সেই তিন বালতির কাছে ফিরে আসা। তরুণ প্রজন্ম যখন একাত্ম যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবীতে তখন অনেকেই বলা শুরু করলেন দেশে তেল নাই, গেস, নাই, বিদ্যুৎ নাই। আমার আর সামিয়ারও কিছু ছিলো না, কিন্তু আমরা সে কথা বলতে পারি না। আমরা বিচার চাই, বিচার চাই আমাদের দেশটাকে যারা ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলো তাদের, আমার দেশের মানুষকে যারা হত্যা করেছিলো তাদের, যারা ধর্ষণ করেছিলো আমার দেশকে, আমরা তাদের বিচার চাই।

হাজার হাজার, কখনও লাখ লাখ মানুষ মিলে আমরা শাহবাগকে আগলে ধরে রাখলাম। নিলয় এরমধ্যে গঠন করলো ‘শহীদ রুমী স্কোয়াড’- উদ্দেশ্য শহীদ জননীকে গণজাগরণের কেন্দ্রবিন্দুতে প্রতিস্থাপন করা। চারুকলার ছাদকে সাক্ষী রেখে শুরু হলো কাজ। জননীর ছবি আঁকা শেষে সেটাকে প্রতিস্থাপনের চ্যালেঞ্জ। ‘আর্কিটেকচার’ সামিয়া সহ আরও অনেকে উপায় খোঁজে। সেই উপায় খোঁজার দলে থাকে রাজীব ভাই, আমাদের থাবা বাবা। রাজীব ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় আরও হয়তো বছর খানেক আগে কোনো এক আড্ডায়। নিয়মিত দেখা হওয়া শুরু শাহবাগ আন্দোলনের সময় থেকে। সোনালী ফ্রেমের চশমা, উশকো খুশকো চুল নিয়ে রাজীব ভাই শাহবাগেই থাকতেন, কখনও চটপটির দোকানে বিপ্লব ভাইয়ের সাথে, কখনও একা। একদিনের কথা মনে পড়ে। শাহবাগের প্রথম সপ্তাহেই- পরিচিত এক জটলায় আলাপ হচ্ছিলো একটা গ্রুপ নাকি গঠিত হয়েছে যারা মগবাজারে জামাতের কার্যালয় ঘেরাও করবে, আরও অনেক কিছুই করবে, তারা সুইসাইড স্কোয়াড। সেই আলাপে রাজীব ভাই সবাইকে বোঝাচ্ছিলেন, এমন সহিংস আন্দোলনে না যেতে, সহিংস আন্দোলন কখনই ভালো কিছু বয়ে আনবে না।

দিন রাত শাহবাগ শাহবাগ করে, প্রতিদিন গভীর রাতে বাসায় ফিরে যখন আমরা একটু ক্লান্ত সে সময় হুট করেই পরিকল্পনা হলো সুন্দরবন দেখার। আমি কখনও সুন্দরবন দেখি নাই। ফেব্রুয়ারির তেরো তারিখে শাহবাগে শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে রেখে আমরা ছুটলাম এয়ারপোর্ট রেল স্টেশনের দিকে- খুলনা যাবার ট্রেন ধরতে। আমি, সামিয়া, জামান, আমিন ভাই, তানভীর ভাই, ইমতিয়াজ, লাজিমা, নিলয়, এরিকা এবং নিলয় যাতে এরিকার সাথে নজিরবিহীন বেলেল্লাপনা করতে না পারে তাই তার মা।

পনেরো তারিখ রাতে যখন আমরা রাত দুইটায় মাথায় উপর লক্ষ-কোটি তারা নিয়ে শুয়েছিলাম লঞ্চের ছাদে, দুইপাশে সুন্দরবনকে রেখে ঠিক তখন জানতে পারলাম রাজীব ভাইকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। রাজীব ভাই মরে গেছে, নিথর হয়ে পড়ে আছে পলাশ নগরের সেই রাস্তায়, যেই রাস্তা দিয়ে দুপুরেই তিনি যখন হেঁটেছিলেন তখন ছিলেন জীবিত, ছিলেন স্বপ্নবাজ এক তরুণ। আনন্দময় সেই রাত রূপ নিলো গভীর বিষাদে, সামিয়ার সারা রাত কান্না, আমাদের সবার হতভম্বতা। ঢাকায় ফিরে শাহবাগে আর রাজীব ভাইকে দেখবো না।

প্রথম সপ্তায় শাহবাগ সবাইকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো। ফেসবুকের আরিফ আর হোসাইনের মতো ছুপা ছাগুরাও বাধ্য হয়েছিলো শাহবাগ সম্পর্কিত কিছু একটা লিখে, শেয়ার করে নিজেকে জাতে উঠাতে, রাজীব ভাইয়ের মৃত্যুর পর সে স্রোত কমে গেলো, আলোচনায় চলে আসলো মাহমুদুর রহমান, বাঁশের কেল্লা, হেফাজত এবং সেই চিরায়ত আস্তিকতা, নাস্তিকতা। রাজীব ভাই নাস্তিক হওয়া না হওয়ার সাথে শাহবাগের আন্দোলনের কোনো সম্পর্ক ছিলো না, এ আন্দোলন হায়েনাদের হাত থেকে দেশকে বাঁচানোর আন্দোলন ছিলো- যাদের কোনো ধর্ম নেই, যারা স্বার্থান্বেষী শয়তান, ঈশ্বরের নাম ভাঙ্গিয়ে যারা সকল ধরনের খারাপ কাজ করতে পারে, যারা আর যাই হোক, মানুষের মঙ্গল চায় না কখনও। অথচ এই কথাগুলো স্পষ্টভাবে না বলে শাহবাগও টুপি পরে ফেললো নিরাপদে। ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের মতো প্রাণের দাবীকে সঙ্গোপনে সরিয়ে ফেলা হলো। রাজীব ভাইয়ের লেখাগুলো তার নিজের নয় এই প্রোপাগান্ডা চালানো হলো কিছুদিন তাকে নিরপরাধ বানাবার খায়েশে, মৃত্যুর পর তাকে আবার মুসলমানি করানো হলো। রাজীব ভাই যা লিখেছিলেন, সেটা লেখা তার অধিকার, সেটা কোনোভাবেই কোনো অপরাধ নয়, অথচ তাকে নিরপরাধী হিসেবে দেখাতে আমরা তাকে মুসলমান বানালাম, আমরা ভুলে গেলাম বাক-স্বাধীনতার কথা, আমরা ভুলে গেলাম যেমন ইচ্ছা, যা ইচ্ছে তাই লেখার আমাদের কবিতার খাতার কথা।

তারপরও রয়ে গেলাম শাহবাগে। আর কিই বা ছিলো আমাদের? তেলে, গেস, পানি না থাকলেও আমাদের শাহবাগ ছিলো, একবুক হতাশার মাঝে একটুখানি আলো ছিলো। কিন্তু যাবতীয় জরা-জীর্ণতা-হিপোক্রেসিকে গ্রাস করার বদলে একসময় আমরাই গ্রাস হয়ে গেলাম হিপোক্রেটদের দ্বারা, একটু একটু করে। টুপি পরেও বাঁচতে পারলো না শাহবাগ। রাজীব ভাই খুন হবার পরেই এক ওয়েবসাইটে তার নির্বাচিত কিছু লেখা প্রকাশ করেছিলো তাকে যারা হত্যা করেছিলো তারা। তাদের পরিকল্পনা ছিলো ব্যপক সফল। রাজীব ভাইয়ের মৃত্যুর পর টুপি করা মুসলমানরা প্রতিবাদের পরিবর্তে বলে উঠেছিলেন- ছিঃছিঃ এগুলো কী লেখা। অর্থাৎ এমন লেখা লিখলে জবাই হতেই হবে। অপরদিকে আরেকদল উঠে পড়ে লাগলো তার লেখাগুলো মুছে ফেলতে। কারণ ‘ওসব’ লেখা নাকি তিনি লিখেন নি। আদতে এরাও স্বীকার করে নিয়েছিলো এমন লেখা লিখলে রাজীবের মতোই পরিনতি হবে। অথচ
রাজীব ভাই কোনো অশ্লীল পোস্ট করেন নাই, রাজীব ভাই কাউকে আঘাত করেন নাই, রাজীব ভাই কোনো মিথ্যা কথা বলেন নাই। রাজীব ভাই যুক্তিভিত্তিক সমাজের স্বপ্ন দেখেছেন, রাজীব ভাই শুওরদের ভন্ডামি নিয়ে লিখেছেন, রাজীব ভাই কুত্তাদের মুখোশ খুলতে চেয়েছেন। যারা ‘থাবা বাবা এটা কেনো লিখছে’, ‘ওটা কেনো বলছে’ এ প্রশ্ন নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন তারা সবাই খুনী, তারা মানুষ নামের কলংক। তারা বায়বীয় বেহেস্তের জন্য মানুষ হত্যার প্রতিবাদ করে না। প্রতিবাদ করা দূরের কথা, সামান্য কষ্টও তারা পায় না, নিজের ভাইয়ের লাশ দেখে তারা আনন্দ পায়। যারা রাজীব ভাইকে হত্যা করছে আমার দৃষ্টিতে তাদের মতোই সমান অপরাধী যারা হত্যাকান্ডের প্রতিবাদের বদলে ‘এমন’ লেখার কথা বলেছেন। আজকের বাংলাদেশে এমন মানুষই দেখি চারপাশে।

রাজীব ভাইয়ের লেখাগুলো খুব দ্রুত ইন্টারনেট থেকে হারিয়ে যাচ্ছিলো দেখে আমি নিজের কাছে তার অনেক লেখা সংরক্ষণ করে রেখেছিলাম ভবিষ্যতে বই আকারে যদি কিছু করা যায় এমন পরিকল্পনা নিয়ে। রাজীব ভাইয়ের লেখা নিয়ে বই ছাপানোর প্রেক্ষাপট এখন নেই। তবে তবে ব্লগার কৌস্তুভ তার লেখাগুলো সযতনে সংগ্রহ করে ‘থাবার থাবড়া’ নামে চমৎকার একটা ই-বই তৈরি করেছেন। এক বছরে অন্তত একটা কিছু তো হলো। এমন এক বাংলাদেশের স্বপ্ন আজও দেখি যে বাংলাদেশে আমরা ‘থাবা বাবা’কে ‘থাবা বাবা’ হিসেবে দেখে তার কর্মের যোগ্য সম্মান দিবো, পলাশনগরের সেই রাস্তায় পাশে তৈরি করবো ‘থাবা বাবা’র স্মৃতি সৌধ। রাজীব ভাই বেঁচে থাকবেন আমাদের কর্মে।