আন্তর্জালিক লেখালেখির জগতে এসে অনেকের সাথে পরিচয় ঘটেছে। অনেকের সাথেই বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে। এখানে না আসলে তাদের সাথে পরিচিত বা বন্ধুত্ব হবার সুযোগ কোনোদিনই হতো না। থাবা বাবা আমার তেমনই একজন বন্ধু। তার সাথে পরিচয় হবার পর প্রায়ই কথা হতো আমাদের। ফেসবুকে প্রায় প্রতিদিনই কুশল বিনিময় হতো। স্কাইপে কথা হতো মাঝেমাঝে।

অনর্গল কথা ব’লে যেতো সে কলকল ছলছল ক’রে। কী খেয়েছে, কোথায় গিয়েছে, কী পড়ছে, কী লিখছে, কী ভাবছে ইত্যাদি সব কিছুই বলতো সে। আমার কয়েকজন বন্ধুর কাছে জেনেছিলাম, থাবা কথা বেশি বলে। আমি তার সাথে কথা বলতে গিয়ে দেখলাম, সত্যিই তাই। কথা বলার সময় তার উচ্ছ্বাস ঝ’রে পড়ে। চোখ থেকে আনন্দ ঝ’রে পড়ে। তাছাড়া সরল মনের মানুষেরা কথা বেশি কয় ব’লেই আমি জানি। কোনো কপটতা ছিল না তার মাঝে। কথা বলতে বলতে আমাকে সে বলতো, আচ্ছা, আমি কি খুব বেশি কথা বলছি? আপনি বিরক্ত হচ্ছেন না তো? আমি বলতাম, কথা বলবার জন্যই তো ফোন করা। চুপ করে থাকবার জন্য তো নয়! আমার কথা শুনে সে দ্বিগুণ উচ্ছ্বাসে, তিনগুণ উৎসাহে, চারগুণ বেগে, পাঁচগুণ সরলতার সাথে ছয়গুণ বেশি কথা বলতে শুরু করতো। এমন নিমগ্নভাবে সে কথা বলতো যে, কথা বলতে বলতে এক সময় সে ভুলে যেতো সে কী কথা বলছিল। আমাকে একটু পর পর জিজ্ঞেস করতো, কী যেন বলছিলাম! আমি মনে করিয়ে দিতেই আবার শুরু করতো নদীর মতন কলকল ছলছল।

যেদিন আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিল স্কাইপে, সেদিন আমার এখানে ছিল রাত, ওর ওখানে ছিল সকাল। রাজীব তার ল্যাপটপ হাতে নিয়ে আমাকে তার বাসার চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছিল। দেখাচ্ছিল তার ঘরদোর, হাঁড়িপাতিল, বইখাতা, কফির কাপ, চেয়ারটেবিল, তার সংসার। আমি মনে মনে ভাবছিলাম, এমন সাদামনের মানুষ, এমন সরল মনের মানুষও হয় এ সংসারে!

একবার কয়েকদিন ধ’রে আমার ভীষণ মন খারাপ ছিল। আমার সেই বিষণ্নতা ছড়িয়ে পড়েছিল ফেসবুকেও। খুব মনমরা কয়েকটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম ফেসবুকে। আমার সেই বিধ্বস্ত দুরবস্থায় রাজীব প্রাণান্তকর চেষ্টা করেছিল আমাকে হাসাতে, আমার মন ভালো করে দিতে। তার কথা শুনে শেষ পর্যন্ত সজল চোখেও আমি না হেসে পারিনি। আমার দুর্দিনে, বিষণ্ন সময়ে আমার পাশে এসে একান্ত আপনজনের মতন দাঁড়িয়েছিল রাজীব। আমার অশ্রু মুছিয়ে দিয়েছিল কথা দিয়ে, বন্ধুত্ব দিয়ে। আমার ব্যথাতুর মনে হাসির ঝলক এনে দিয়েছিল। কান্নার মাঝে হাসিয়ে ছেড়েছিল আমায়। তার এই দুর্মূল্য, দুষ্প্রাপ্য সহায়তার দান আমি কোনোদিন ভুলবো না।

২০১৩ সন। ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখ। কথা হচ্ছিল এক বন্ধুর সাথে। সে কথা বলতে বলতে আমায় হুট করে বললো, মন শক্ত করো ঝুমু। খুব খারাপ খবর আছে। আমার চিন্তাশক্তি শূন্যে নেমে গিয়েছিল তার কথা শুনে। আমি অস্থির। সে বললো, স্থির হও, মন শক্ত করে শোনো, থাবা আর নেই। তাকে কেউ খুন করেছে। জবাই করে বাড়ির সামনে ফেলে রেখে গিয়েছে। আমার কেমন অনুভূতি হয়েছিল সে খবর শুনে তা ব্যক্ত করবার নয়। আমি অস্থির, উদ্ভ্রান্ত। ব’লে চলেছি যুক্তিহীনভাবে, আমি দু’দিন আগে কথা বলেছি তার সাথে। সে মরবে কেন? এই তো সেদিন আমি তাকে দেখেছি, সে মরবে কেন? একটু আগে তাকে স্ট্যাটাস দিতে দেখলাম, সে মরবে কেন? সে কার কী ক্ষতি করেছে? তাকে কেউ মারবে কেন? তার বাড়িটি আমি দেখেছি, সেই বাড়ির সামনে কেউ তাকে মারবে কেন?

পরে ফেসবুকে দেখলাম তার রক্তাক্ত নিষ্প্রাণ নিথর দেহ পড়ে আছে তারই বাড়ির সামনে। কাছে প’ড়ে আছে তার অতি প্রিয়, নিত্য সময়ের সঙ্গী ল্যাপটপটি। এই ল্যাপটপের মাধ্যমে সে অন্তর্জালে তার চিন্তাচেতনার প্রকাশ ঘটাত। ঘৃণ্যতম ধর্মগুলির প্রতি প্রবল বিদ্রূপ করতো। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাইতো। এই বাড়িটি আমি অনেক দূরে ব’সে দেখেছিলাম কিছুদিন আগে। এই মানুষটিকে আমি দেখেছিলাম সদা হাস্যময়, সদা প্রাণবন্ত। এই ল্যাপটপটির মাধ্যমে তার সাথে আমার প্রায়ই যোগাযোগ হতো। আজ সেই হাসিখুশি মানুষটির মুখে হাসি নেই। হাস্যময় মানুষটি বিকৃত মুখে শক্ত হয়ে পড়ে আছে পথের ধূলার মাঝে। এই চোখ থেকে খুশির ফুলকি বের হতো। আজ সেই দুটি চোখ দুটি পাথরের টুকরোর মতন শক্ত, মৃত, স্থির। গলা থেক উচ্ছ্বাস বা কথার ফুলঝুরি ঝরছে না। সেই গলা কেটে দিয়েছে কোনো পিশাচ হায়েনা। সেই গলা দিয়ে একটু আগে বয়ে গিয়েছে তাজা রক্তের নদী। তার রক্তের ধারা শুষে নিয়েছে পথের ধূলা। যে পথের উপর দিয়ে তার পদচারণ ছিল নিত্যদিন, সে পথের মাঝে একটু আগে তাকে চিরদিনের মত থামিয়ে দিয়ে গেল কোনও পিশাচ। পথ পড়ে থাকবে, এই পথিক আর হাঁটবে না কোনোদিন পৃথিবীর কোনও পথে। মাছিরা এসে বসেছে তার কাটা গলায়, তার রক্তে মাখা ধূলিতে, তার গায়ে। এই ল্যাপটপের কীবোর্ডে রাজীব আর তার দশ আঙ্গুলে ঝড় তুলবে না। ল্যাপটপটি তার সার্বক্ষণিক সঙ্গীর পাশে স্তব্ধ পড়ে আছে মূক হয়ে। বাড়িটি তাকিয়ে আছে নির্বাক। বোবা পথ তার নিত্যদিনকার চেনা পথিকের নিথর দেহ বুকে নিয়ে বসে আছে অসহায়ের মত।

কী অপরাধ ছিল রাজীবের? কেন তাকে নরপিশাচেরা জবাই করেছে এভাবে?
সে দেশদ্রোহীদের, স্বাধীনতাবিরোধীদের, নরঘাতকদের, ধর্ষকদের বিচার চেয়েছিল। এটাই কি তার অপরাধ? সে তার হৃদয়ে বাংলাদেশ ধারণ করেছিল। এটাই কি তার অপরাধ? সকল ধর্মই চূড়ান্তের চূড়ান্ততম বানোয়াট, মিথ্যে, জঘন্যতম। রাজীব তা বুঝেছিল। আর তাই সকল ধর্মের প্রতি সে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে অট্টহাসি হেসেছিল। এটাই কি তার অপরাধ? বানোয়াট স্রস্টারা তাদের পূজারীদেরকে ঠাট্টার জবাব দিতে বলেছে হত্যা করে, জবাই করে; তাদেরকে মহান ঘোষণা ক’রে।

চরমতম ক্ষতিকর সব ধর্মের চরমতম ক্ষতিকারক ধার্মিকেরা প্রকাশ্যে আজেবাজে ধর্মগুলি পালন করতে পারবে। সমাবেশ করতে পারবে। বাজে গ্রন্থের বাজে বুলি আওরাতে পারবে। পুণ্যের উদ্দেশ্যে পশু বলি দিতে পারবে, এমন কি মানুষও। আমরা ন্যায়ের কথা, যুক্তির কথা, বিজ্ঞানের কথা, মানবতার কথা, সত্যের কথা প্রকাশ্যে তো দূরের ব্যাপার; আড়াল থেকেও কেন বলতে পারবো না? দেশে ধর্মীয় সমাবেশ হয়, ওয়াজ মাহফিল হয়, আশুরায় মানুষের তাজা রক্তের হলিখেলা হয়, লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে মাটির পুতুল বানিয়ে তাকে পানিতে ফেলা হয়, ইজতেমা হয়। অগণিত গৃহহীন মানুষ ফুটপাতেও শোবার জায়গা পায় না। তাদের আবাসনের কথা চিন্তা না করে সরকার উপাসনালয় তথা গৃহহীন স্রস্টাদের গৃহ নির্মাণ ও তাদের শ্রীবৃদ্ধিতে অকাতরে টাকা ঢালেন। সরকার এসব ভয়াবহ রকমের খেলায় নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা প্রদান করে বিশ্বের দরবারে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। কোনো যুক্তিবাদী নাস্তিক সম্মেলনে সরকার এই রকম সহায়তা করবেন কি? অথবা অনুমতি দিবেন কি তার জন্য?

রাজীব আমার কাছে তার মরণোত্তর দেহদানের ইচ্ছার কথা বলেছিল। তার সেই মহৎ ইচ্ছা সে বাস্তবায়িত করে যেতে পারেনি। সে কি জানতো এমন অসময়ে, এমন করে তাকে চলে যেতে হবে? তার জানাজা হয়েছে। হয়েছে আরো কত কিছু! আমরা কিছুই করতে পারিনি। পরিস্থিতি ছিল অন্যরকম। খুব দুঃখ লাগে ভাবলে। আমরা যারা দেশকে ধারণ করি আমাদের বক্ষে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই; মুক্তচিন্তার চর্চা করি অন্তর্জালে, তারা একজন সহযোদ্ধাকে হারিয়েছি। আর আমি শুধু একজন সহযোদ্ধাই নয় আমার একজন দুঃসময়ের বন্ধু, প্রকৃত বন্ধুকে হারিয়েছি। একবছর হতে চললো রাজীবকে হত্যা করা হয়েছে। তার হন্তারকদের বিচার হয়নি। কোনোদিন হবে কিনা জানি না। তবুও হাল ছাড়বো না। বিচার চেয়ে যাবো রাজীবের হন্তারকদের।