আমাদের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরটি অসম্ভব সুন্দর। যারা মতিহার চত্বরে এসে ঘুরে গেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই তা স্বীকার করবেন। এই চত্বরে আমাদের শৈশব, কৈশোর এবং যৌবনের সিংহভাগ কেটেছে। এই চত্বর বলা চলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক লীলাভূমি। এখানে ভোর বেলা পাখির কিচির মিচির শুনে আমাদের ঘুম ভেঙেছে, বেলি ফুল সংগ্রহ করেছি বন্ধুদের সাথে কাড়াকাড়ি করে। এখানে প্যারিস রোডের ধারে গগন শিরিষের বাহু আকাশ ছুঁয়েছে, কদম ফুলের সুবাস বর্ষার গানে আরও মুখরিত হয়েছে, কাঁঠালচাপার গন্ধ মৌ মৌ করেছে আমাদের আঙিনায়! চুরি করে লিচু পেরেছি, বড়ই গাছে মেরেছি ঢিল আর পেয়ারা গাছে চরে বসে আড্ডা দিতে দিতে আমাদের কৈশোর গেছে। আশির দশকে বিদ্যুৎ চলে গেলে আমরা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এর ওর সাথে লুকোচুরি খেলেছি আঁধারে, নব্বইয়ের দশকে পাড়া মাত করেছি, জানালার কাঁচ ভেঙেছি ক্রিকেট খেলে। কাদা জল মেখে ফুটবল খেলে বাসায় ফিরে মা’র বকা খেয়েছি আর স্কুলের শেষ বেঞ্চে বসে সুযোগ পেয়েই পালিয়ে গিয়ে কাজলায় গরম সিঙ্গারা ভক্ষন করেছি। বান্ধবীদের সাথে তুমুল ঝগড়া করেছি আবার কখনও বা তাঁদের মুখ দেখতে গিয়ে পিছলে গেছে সাইকেল, মর মর করে পরেছি তাঁদের সামনে আর তাঁদের ছল চাতুরি ভরা হাসি শুনে অভিশাপ দিতে দিতে বাসায় পৌঁছেছি। এখানে পুকুরে গোসল করতে গিয়ে সজোরে হিসু করে আরাম পেয়েছি, আবার কখনও বা সাঁতার কাটতে গিয়ে গলগল করে পানি খেয়েছি।

আবার এরই মাঝে চলেছে গান গাওয়া, কবিতা আবৃত্তি, ছবি আঁকা। দলবেঁধে শরতের প্রথম দিনে পুরো চত্বর প্রদক্ষিণ করেছি ‘ওঠো ওঠো রে’ গান গেয়ে, একুশে ফেব্রুয়ারিতে খালি পায়ে প্রভাত ফেরি করেছি, ফুল দিতে গিয়ে কতদিন কিশোর মন কেঁদেছে তাঁর ইয়ত্তা নেই, বৈশাখের প্রথম দিন ট্রাকে চড়ে গান গাওয়া, শহীদ মিনারের পাদদেশে প্রথম কবিতা আবৃত্তি আর ছবি আঁকা শিখতে গিয়ে অকারণে চঞ্চল হওয়া- এইসব নিয়েই বড় হয়েছি সবুজ ঘাসের মতন, মারামারি করে দাপাদাপি করে, ঝগড়া করে, কুট কাচালি করে, মমতায়, আনন্দে, প্রেমে, উল্লাসে, বেদনায়।

আবার এই বড় হতে হতেই অনেক বড় কেউ এসে স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিয়েছেন। কারো সান্নিধ্য জীবনে বেঁচে থাকার মানের সন্ধান এনে দিয়েছে। কেউ এসে বলেছেন ‘জাগো, জেগে ওঠো।’ কেউ এসে বলেছেন, ‘বাবা, বই পড়।’ বই পড়া। ছোট্ট দুটি শব্দ যুগল। কিন্তু মানুষের জীবনে মোড় ঘুরিয়ে ফেলা। যৌবনের শুরুতে যখন আশি দিনে হুমায়ুন আহমেদের আশিটি উপন্যাস একটানে পড়ে ফেলেছি তখনই কে যেন এসে আলো জ্বালিয়ে দিলেন, হাতে ধরিয়ে দিলেন জিজ্ঞাসা নামক এক ছোট পত্রিকা। সম্পাদক শিব নারায়ন রায়। আর সেটি পড়তে পড়তে মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্নের উদ্ভব জাগতে শুরু করল মনের ভেতর।

যিনি এসে দাঁড়ালেন নয়ন সম্মুখে, তিনি আর কেউ নন, আমাদের স্বজন, আমাদের আত্মার আত্মীয় আমাদের শহিদুল ইসলাম চাচা। শহিদুল ইসলাম স্যার। শহিদুল ইসলাম। আমার বাবা এবং শহিদুল ইসলাম চাচা দীর্ঘদিনের সহকর্মী, সহযাত্রী, সমমনা বন্ধু বিশেষ। উনার দুই পুত্র কন্যা আর দুইজনই আমার বন্ধুসম। টুম্পা আপা এবং সৌম্যর মতন দুই উজ্জ্বল এবং প্রগতিশীল বন্ধু খুব বেশী তো আমার নেই। আর এর সাথে রয়েছে পলি চাচির স্নেহ, পলি চাচির আদর, পলি চাচির আতিথেয়তা। কাজেই এই পরিবারটি আমার জন্য হয়ে উঠল এক তীর্থস্থানের মতন। দীর্ঘ সকাল, দীর্ঘ দুপুর, দীর্ঘ সন্ধ্যে কাটিয়েছি এই বাসায়। টুম্পা আপা ঢাকায় পড়তেন, কিন্তু আমাদের ভেতর ছিল এক দারুণ সখ্যতা, চিঠি ছিল আলাপচারিতার প্রধান মাধ্যম আর উনি রাজশাহী এলে আমি সর্বক্ষণ উনার পায়ে পায়ে থাকতাম, আর গানের তালই তো শিখলাম উনার কাছে। ওদিকে সৌম্য ছিল মুক্তিযুদ্ধ চর্চা কেন্দ্র, মানে আমাদের সংগঠনের এক অন্যতম কাণ্ডারি। কাজেই কর্মক্ষেত্রে সৌম্যর পরামর্শ আর সৌম্যর সঙ্গ না হলে আমার আর মৌলীর চলতই না।

তবে সবকিছুর পরেও এই বাসার একটা প্রধান আকর্ষণ ছিল শহিদুল ইসলাম চাচা। উনার স্নেহ ছিল যেন অবধারিত। উনি আমাকে ডাকতেন ‘আমাদের ছেলে’ বলে। আমি চাচার কণ্ঠে এই ডাকটি শোনার জন্য অপেক্ষা করতাম, আজও করি। এখনও, এত দিন পরেও চাচার বাসায় গেলে উনি বলেন, ‘এই দেখ কে এসেছে, আমাদের ছেলে এসেছে, আমাদের মনি এসেছে।’ আমি এখনও এই কথাগুলি শুনলে সিক্ত হই, চোখের কোনায় জল ভর করে।

পারিবারিক সঙ্গ, পারিবারিক সম্পর্ক ছাড়াও এর বাইরে নানান ধরণের সম্পর্ক রয়েছে আমাদের। আমাদের মানস গঠনে তাঁর ভূমিকা ব্যাপক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষানীতির ওপর যতগুলি সেমিনার এবং আলচনা হয়েছে সব কটিতে উনার অংশগ্রহণ যেন অনিবার্য। ধর্ম, কুসংস্কার, বিজ্ঞান নিয়ে উনার লেখালেখি দীর্ঘদিনের। তাঁর বাড়ির পাঠাগার যারা দেখেছেন, যারা এর সান্নিধ্যে এসেছেন তাঁরা জানেন যে এ যেন আধুনিকতা এবং যুক্তিশীলতার এক তীর্থস্থান। শুধু ‘জিজ্ঞাসা’ পত্রিকা সংগ্রহের জন্যেও তার পাঠাগারে হানা দেয়া চলে। এছাড়া শিল্প সাহিত্যের নানান অলিগলিতে তিনি সাছ্যন্দে বিচরণ করেছেন। যে কোন প্রগতিশীল সামাজিক কর্মকাণ্ডে তিনি হাত বাড়িয়ে উপকার করেছেন জীবনভর। পত্রিকা বিক্রি, শীতের গরম কাপড় সংগ্রহ, বন্যায় চাল সংগ্রহ- সব সময় তিনি যেন প্রয়োজনের অতিরিক্ত দিতে উদ্যত।

উনার যে গুনটি সবচাইতে ভাল লাগে সেটি হল উনার জ্ঞান। উনি বোধ করি কোনদিনই পণ্ডিতি ফলান নি। উনার জ্ঞানের গভীরতা সবসময় আমাদের মুগ্ধ করে। উনি যেভাবে সাল তারিখ মনে রেখে একের পর এক উধৃতি দেন তা এখনও আমাদের বিস্মিত করে। আন্তর্জাতিক মানবতাবাদী লেখকদের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়ার তাঁর কত প্রচেষ্টা। এক সময় ছিল যখন আমাকে প্রায়ই জিজ্ঞেস করতেন কোন বইটা আমি পড়ছি। সেধে জিজ্ঞেস করতেন, এই বইটা তোমাদের পড়া দরকার। যখন সৌম্যর সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিতাম, উনি প্রায়ই সেখানে বন্ধুর মতন এসে ঢুকে পরতেন। এসে দিব্যি আমাদের আলোচনায় অংশ নিতেন। কোনদিনই বয়সের পার্থক্য অনুভব করিনি।

আমাদের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তবুদ্ধির চর্চা যাঁরা করেছেন আজীবন তাঁদের মধ্যে শহিদুল ইসলাম স্যার ছিলেন একদম সম্মুখ কাতারে। যতবার মুক্তবুদ্ধির ওপর আঘাত এসেছে, কুসংস্কার চেপে বসেছে ততবার তিনি তার বিরুদ্ধে লেখনী ধরেছেন। আমাদের দেশে বিজ্ঞান চর্চা এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কলম ধরার প্রয়োজনীয়তাকে তিনি নিরন্তর উৎসাহিত করেছেন। একবার হাসান আজিজুল হক তাঁর একটি বই শহিদুল ইসলাম স্যারকে উৎসর্গ করেছিলেন এইভাবে, “বন্ধু শহিদুল ইসলাম, সম্পদে, বিপদে।” দারুণ লেগেছিল, প্রথমবার যখন এটি পড়েছিলাম। আমি পরে অনেকবার এটা নিয়ে ভেবেছি। এই সত্যকথন কেবল হাসান স্যারের জন্যই নয়, এটি আমাদের জীবনের ক্ষেত্রেও উপযোগী। যতবার মুক্ত বুদ্ধির ওপর আঘাত এসেছে আমরা ছুটে ছুটে গেছি তাঁর কাছে। তিনি আমাদের সাহস যুগিয়েছেন, ভরসা দিয়েছেন। তিনি হচ্ছেন একজন আজন্ম আশাবাদী মানুষ। এমন মানুষের সান্নিধ্য কে হারাতে চায়!

তাঁর গবেষণা, তাঁর কীর্তি মূল্যায়ন করার মতন সাহস কিংবা যোগ্যতা আমার নেই। কিন্তু জানি, তিনি আমাদের বিপদের সহায় হয়ে রয়েছেন। গেলবার উনার ছবি তুলব বলে উনার ঢাকার বাসায় গিয়েছি। বরাবরের মতন কত উৎসাহ উনার। বারবার জিজ্ঞেস করছেন কিভাবে বসবেন, কিভাবে ছবি তুললে উনার মুড কে ধরা যাবে ইত্যাদি। স্নেহের শেষ নেই, উৎসাহের ঘাটতি নেই। চোখে মায়া জরিয়ে আছে, মুখে আগ্রহ। বারবার বলবেন, আমরাই ভবিষ্যৎ, বারবার বলবেন আমাদের কি করা দরকার। এমন আশাবাদী মানুষকে মনে হয় ধরে থাকি, জরিয়ে থাকি। আমার স্পষ্ট মনে আছে, উনি যখন রাজশাহী ছেড়ে ঢাকা চলে এলেন, আমরা দিশেহারা হয়ে পরেছিলাম। মনে হয়েছিল রাজশাহী এক অমূল্য সম্পদ হারাল। যখন বলেছি এই কথা, উনি খুব উদাস হয়ে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, রাজশাহী যেতে চান সবসময়, কিন্তু পিঠের ব্যাথা সারছেনা। তাই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও পারছেন না!

শহিদুল ইসলাম বাংলাদেশের একজন শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী। দেরীতে হলেও উনি চলতি বছরে বাংলা একাডেমী পুরস্কার পেলেন। স্যারের জন্য আমার শুভেচ্ছা। আমি পারলে উনাকে বাংলাদেশের সবগুলি পুরস্কার এনে দিতাম। কিন্তু পুরস্কারের জন্য উনি লেখেন নি কখনও। উনি এমন একটি বাংলাদেশ চেয়েছেন যে দেশে ধর্মীয় কুসংস্কারের ছায়া পর্যন্ত থাকবেনা, উনি এমন দেশ কল্পনা করেছেন যেখানে সকল শিক্ষার্থী সত্যিকারের জ্ঞান লাভ করবে। এমন বাংলাদেশের স্বপ্ন সুদূর পরাহত মনে হলেও তিনি আশার আলো জ্বেলে আছেন। আর এইটা তাঁর কাছ থেকে পাওয়া আমাদের সবচাইতে বড় পুরষ্কার।

স্যার, চাচা, শহিদুল ইসলাম, আপনি শতায়ু হন। আরও দীর্ঘ দিবস, আরও দীর্ঘ রজনী আপনি আমাদের মাঝে থাকুন, সাথে থাকুন, হাত ধরে থাকুন। মিছিলে থাকুন, প্রতিবাদে থাকুন, প্রগতির আন্দোলনে থাকুন, যেভাবে থেকেছেন, সারাটা জীবন!

– মনি শামিম