বর্ণপ্রথা বা বর্ণবৈষম্য হিন্দুধর্মের সবচেয়ে বেদনাদায়ক অধ্যায়।হাজার বছরেরও বেশী সময় ধরে এই বিষবাষ্পে দগ্ধ হচ্ছে হিন্দু সমাজ।বর্ণশ্রেষ্ট হিন্দুদের মধ্যে এই প্রথা এখনও প্রবল।তথাকথিত উচ্চবর্ণের হিন্দুরা এখনও নিচুবর্ণের হিন্দুদের ঘৃণার চোখে দেখে।মাত্র কিছুকাল আগেও উচ্চ শ্রেণীর হিন্দুবাড়ীতে নিন্মবর্ণের হিন্দুদের(যাদের মূলত দিনভিত্তিক কাজ বা জন খাটার জন্য নিয়োগ করা হতো) খাওয়া দাওয়ার জন্য আলাদা থালা বাটি রাখা হতো।তাদেরকে জলও দেওয়া হতো আলাদা গ্লাসে এবং খাওয়া শেষে তাদেরকেই তাদের ব্যাবহৃত থালা বাসন ধুয়ে দিয়ে যেতে হতো।এই ঘৃণ্য প্রথার কারণে শত শত বছর ধরে যে,কত বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটে গেছে তার কোন ইয়াত্বা নেই।উনবিংশ শতাব্দিতে ভারতীয় প্রেক্ষাপটে রচিত সাহিত্য গুলো পড়লে বর্ণভেদের ভয়ংকর রূপ চোখে পড়ে। বিশ্ব বিখ্যাত শিকারী জিম করবেটের ‘মাই ইণ্ডিয়া’ নামে একটা অসাধারণ বই আছে।এই বইটার পাতায় পাতায় বর্ণবৈষ্যমের বেদনাদায়ক রূপ দারুণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।একটা ঘটনার কথা মনেপড়ে, যেখানে জিম করবেট একটা স্কুল ঘর তৈরি করে দিয়েছিলেন মোকমা ঘাট এলাকার বাচ্চাদের পড়াশুনার জন্য।স্কুলটা ছিল গোলপাতার ছাওয়া ও বেড়া দিয়ে ঘেরা।কিন্তু ঐ এলাকার ব্রাহ্মণরা তাদের সন্তানদের,দলিত শ্রেণীর সন্তানদের সাথে একই ঘরে বসার অনুমতি দিল না।তাতে নাকি ব্রাহ্মণদের জাত চলে যাবে।বাধ্য হয়ে জিম করবেট তাই স্কুল ঘরটির শুধুমাত্র চালাটা রেখে পুরো বেড়া সরিয়ে দিলেন।তাহলে সেটা আর একটা নির্দিষ্ট ঘর হিসেবে থাকবে না,এবং ব্রাহ্মণদের জাতও যাবে না।অর্থাৎ ব্রাহ্মণরা দলিতদের সাথে মোটামুটি একই চালের নীচে বসতে পারবে কিন্তু একটি বদ্ধ ঘরে মোটেই নয়।

বাংলাদেশের ঘরে ঘরে এখনও বর্ণপ্রথা প্রবল।এদেশে এখনও ব্রাহ্মণের ছেলের বিয়ের জন্য ব্রাহ্মণ মেয়ে ,ঘোষের ছেলের জন্য ঘোষ মেয়ে,দত্ত ছেলের জন্য দত্ত মেয়ে লাগবেই।এর অন্যথা হলে শুরু হয়ে যায় পারিবারিক অশান্তি।এদেশেই এমন অনেক হিন্দু পরিবার আছে,যেখানে অভিভাবকরা তাদের দৃষ্টিতে,তাদের মেয়েদের বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেলেও বিয়ে দিতে পারছে না শুধুমাত্র একই বর্ণের সুযোগ্য ছেলে পাওয়া যাচ্ছে না বলে।

তাছাড়া উচুবর্ণের হিন্দুরা তাদের দৃষ্টিতে যারা নিচুবর্ণ তাদেরকে নিয়ে প্রতিনিয়ত তুচ্ছ তাচ্ছিল,হাসি মসকারা করতে থাকে।এসবের পাশাপাশি তাদের গায়ে লাগানো হয় নানা কুৎসিত বিশেষণের তকমা।যদিও খুব নোংরা তবুও একটা বলি,”শোর(শূকর)তাড়ালে তবুও শোর ফেরে,কিন্তু নমো(শূদ্র)তাড়ালে,নমো ফেরে না।”এরকম আরও আছে।যেসব হিন্দুরা একটু নিন্মশ্রণীর কাজ করে তাদেরকে নানা কুৎসিত নামে ডাকা হয়।যেমন মুচি,মেথর,পোদ,চাড়াল ইত্যাদি যার সবগুলোই এদেশে এক একটা গালি বিশেষ।প্রায় একই চেহারা,একই গড়ন,একই চামড়ার রং, একই গ্রামে পাশাপাশি বসবাস করা সত্ত্বেও প্রতিবেশীদের নিয়ে এরকম নোংরা কথাবার্তা বলার সাহস তথাকথিত উচ্চবর্ণের হিন্দুরা পায় কোথা থেকে?এদেরকে এই সাহস দেয় মহা পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলো।

হিন্দুদের বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ গুলোর মধ্যে শ্রীমদভগবদগীতা অন্যতম।ভক্তিবাদী হিন্দুরা এটাকে বলে থাকে পরমেশ্বর, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখ নিঃসৃত বাণী যা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দ্বিধাগ্রন্থ অর্জুনকে বলেছিলেন।এটাকে বলা হয়ে থাকে একধরণের জীবন বিধান।হিন্দুরা তাদের অনান্য ধর্মগ্রন্থ(বেদ বা পুরান) গুলোর ক্ষেত্রে এমনটা দাবি করে না,যে সেটা সরাসরি ভগবানের মুখনিঃসৃত।শুধুমাত্র গীতার ক্ষেত্রেই এমনটা দাবি করা হয়ে থাকে, যেকারণে অধিকাংশ হিন্দুরা গীতা বলতে পাগল প্রায়।তা হতেই পারে, স্বয়ং ভগবানের বাণী বলে কথা!

এই শ্রীমদভগবদগীতা গ্রন্থটি বেদগুলো রচনার বেশ কিছু পরে রচিত হয়েছে বলে মনেহয়।তৎকালীন আর্য তথা ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় সম্প্রদায় প্রথমে মনুসংহিতা পরে গীতার মাধ্যমে তৎকালীন সমাজে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে,যা আজও বহমান।গীতার মত মনুসংহিতাও এক ধরণের জীবন বিধান।কিন্তু মনুসংহিতায় যেহেতু অত্যান্ত নগ্নভাবে ব্রাহ্মণের শ্রেষ্টত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে,তাই অধিকাংশ হিন্দুরা গীতাকেই বেশী বেশী সামনে আনে।তবে গীতাও কম যায় না।এই গ্রন্থের বিভিন্ন জায়গায় রসিয়ে রসিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে,ব্রাহ্মণরা কত শ্রেষ্ঠ,কত জ্ঞানী,ক্ষত্রিয়রা কত উচ্চ বংশীয়,আর শূদ্ররা কত নিকৃষ্ট!

কোন কোন রোমানট্যিক ধার্মিক যদি এরকম মনেকরে থাকেন যে,ভগবান কোন জাত,পাত,বর্ণ,গোত্র এসব সৃষ্টি করেন নি,তিনি শুধুই মানুষ সৃষ্টি করেছেন,তাহলে বিরাট ভূল হয়ে যাবে।ভগবদগীতার ৪র্থ অধ্যায়ের ১৩ নম্বর শ্লোকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গর্বের সাথে ঘোষণা দিয়েছেন,
“চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ।
তস্য কর্তারমপি মাং বিদ্ধ্যকর্তারমব্যয়ম।।” (৪:১৩)
অর্থাৎ, “প্রকৃতির তিনটি গুণ ও কর্ম অনুসারে আমি মানব-সমাজে চারিটি বর্ণবিভাগ সৃষ্টি করেছি।আমি এই প্রথার স্রষ্টা হলেও আমাকে অকর্তা এবং অব্যয় বলে জানবে।”
মানে ভগবানই সব কিছুর স্রষ্টা।সমাজের চারটি বর্ণও তাঁরই সৃষ্টি।এখানে বলে রাখি গীতার এই শ্লোকগুলোর ব্যাখ্যা বা অনুবাদ কোনটায় আমি করিনি।এক্ষেত্রে আমি সাহায্য নিয়েছি ‘শ্রীমদ্ভগবদগীতা যথাযথ’ বইটির।কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ কর্তৃক মূল সংস্কৃত শ্লোকের শব্দার্থ,অনুবাদ ও তাৎপর্য সহ ইংরেজী Bhagavad-Gita As It Is-এর বাংলা অনুবাদক:শ্রীমৎ ভক্তিচারু স্বামী মহারাজ।প্রকাশ ও মুদ্রণ:ভক্তিবেদান্ত বুক ট্রাস্ট প্রেস,শ্রীমায়াপুর,নদীয়া, পশ্চিমবঙ্গ।

চারটি বর্ণ সৃষ্টির ঘোষণার পর ভগবান ব্যাখ্যা করেছেন তিনি কি কি বর্ণ সৃষ্টি করেছেন এবং কেন সৃষ্টি করেছন।
“ব্রাহ্মণক্ষত্রিয়বিশাং শূদ্রাণাং চ পরন্তপ।
কর্মাণি প্রবিভক্তানি স্বাভাবপ্রভবৈগুর্ণৈঃ।।”(১৮:৪১) অর্থাৎ,’হে পরন্তপ! স্বভাব জাতগুণ অনুসারে ব্রাহ্মণ,ক্ষত্রিয়,বৈশ্য ও শূদ্রদের কর্মসমূহ বিভক্ত হয়েছে।’
এই স্বাভাবজাত গুণ ও কর্ম কি জিনিস তা শোনার আগে আসুন একটু পরমপিতা মনুর বচন শুনে আসি।ভগবান তো এদের সৃষ্টি করেছেন,এবং কাকে কোথা থেকে সৃষ্টি করেছেন তা বলা আছে মনুসংহিতায়।
“সর্বস্যাস্য তু সর্গস্য গুপ্ত্যর্থং স মহাদ্যুতিঃ।
মুখবাহুরুপজ্জানাং পৃথক্ কর্মাণ্যকল্পয়ৎ।।” (১:৮৭)
অর্থাৎ: ‘এই সকল সৃষ্টি রক্ষার জন্য মহাতেজযুক্ত প্রজাপতি ব্রহ্মা নিজের মুখ, বাহু, উরু এবং পাদ- এই চারটি অঙ্গ থেকে জাত ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রদের পৃথক পৃথক কার্যের ব্যবস্থা করে দিলেন।’
পা থেকে শূদ্রদের সৃষ্টি করেছেন বলে এখানে আবার কোন বৈষম্য খুজবেন না যেন কারণ ভাগবানের সকল অঙ্গই পবিত্র!
এবার ফিরে আসি গীতায় যেখানে স্বাভাব জাত কর্মের ব্যাখ্যা দেওয়া আছে।
“শমো দমস্তপঃ শৌচং ক্ষান্তিরার্জবমেব চ।জ্ঞানং বিজ্ঞানমাস্তিক্যং ব্রহ্মকর্ম স্বাভাবজম”(১৮:৪২)
অর্থাৎ, ‘শম দম তপ শৌচ ক্ষান্তি,সরলতা,জ্ঞান, বিজ্ঞান ও আস্তিক্য-এগুলো ব্রাহ্মণদের স্বাভাবজাত কর্ম।’দেখা যাচ্ছে যে জ্ঞান বিজ্ঞান সহ সকল ভাল ভাল কর্মগুলো ব্রাহ্মণদের স্বাভাব জাত।ক্ষত্রিয়দের কর্ম গুলোও বেশ চমৎকার,তেজ,দক্ষতা, যুদ্ধে অপলায়ন,দান,শাসন ক্ষমতা এগুলি ক্ষত্রিয়দের স্বাভাবজাত।বাকী থাকছে বৈশ্য আর শূদ্ররা।
“কৃষিগোরক্ষ্যবাণিজ্যং বৈশ্যকর্ম স্বভাবজম।
পরিচর্যাত্মকং কর্ম শূদ্রস্যাপি স্বাভাবজম।।” (১৮:৪৩)
অর্থাৎ,’কৃষি,গোরক্ষা ও বাণিজ্য এই কয়েকটি বৈশ্যের স্বাভাব জাত কর্ম এবং পরিচর্যাত্মক কর্ম শূদ্রের স্বভাবজাত’
এই পরিচর্যাত্মাক কর্মের অর্থ হলো সেবা করা।উচ্চ তিন বর্ণের মানুষদের ত্রমাগত সেবা করা।মানে যাকে বলে জন্মদাস,এবং এটা নাকি আবার স্বভাবজাত।দাসগিরি করা কিভাবে একটি গোত্রের সকল মানুষের স্বভাব হয়ে গেল তা বোঝ গেল না।ঠিক একই ভাবে জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চা কিভাবে শুধুমাত্র ব্রাহ্মণদেরই স্বভাব কর্ম হয়ে গেল তাও বোঝা কঠিন।কোন শূদ্র কখনো জ্ঞান চর্চা করতে পারবে না, দেশ শাসন করতে পারবে না,কারণ তার জন্ম একটা শূদ্র পরিবারে। মোটকথা ব্রাহ্মণ আর ক্ষত্রিয় মিলে খাবে-দাবে,ভোগ করবে,দেশ শাসন করবে, বৈশ্যরা করবে গরু পালন আর চাষবাস,শূদ্ররা হবে জন্মোদাস।কি চমৎকার ভগবানের বাণী!

এখন স্বাভাবিকভাবেই কোন শূদ্রের মনে প্রশ্ন উঠতে পারে তাকে কেন সারা জীবন জন্মদাস হয়ে কটাতে হবে?অথবা কোন একজন শূদ্র এর প্রতিবাদও করতে পারে।তবে কোন রকম প্রশ্ন বা প্রতিবাদ যেন না করা হয় তার ব্যাবস্থাও ভগবান করে রেখেছেন ১৮ অধ্যায়ের ৪৮ নম্বর শ্লোকে।
“সহজং কর্ম কৌন্তেয় সদোষমপি ন ত্যজেৎ।সর্বারম্ভা হি দোষেণ ধূমেনাগ্নিরিবাবৃতাঃ।।”(১৮:৪৮)
অর্থাৎ,’হে কৌন্তেয়!সহজাত কর্ম দোষযুক্ত হলেও ত্যাগ করা উচিত নয়।যেহেতু অগ্নি যেমন ধূমের দ্বারা আবৃত থাকে,তেমনি সমস্ত কর্মই দোষের দ্বারা আবৃত থাকে।’ শূদ্রের মরণযাত্রা রচিত হয়েছে এই শ্লোকের মাধ্যমে।উপরে যে বই টার কথা উল্লেক করলাম তাতে এই শ্লোকটার তাৎপর্য লেখা আছে সেটা এরকম..

মায়াবদ্ধ জীবনে সব কাজই জড়া প্রকৃতির গুণের দ্বারা কুলষিত।এমন কি কেউ যদি ব্রাহ্মণও হন,তা হলেও তাকে যজ্ঞ অনুষ্ঠান করতে হয় যাতে পশু বলি দিতে হয়।তেমনি ক্ষত্রিয়কে শ্রত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়,তেমনি,কোন শূদ্রকে যখন কোন অসৎ মনিবের দাসত্ব করতে হয়,তখন তাকে তার মনিবের আজ্ঞা পালন করতেই হয়,যদিও তা করা উচিত নয়।এই সমস্ত দোষ ত্রুটি সত্ত্বেও, মানুষকে তার স্বধর্ম করে যেতে হয়,কেন না সেগুলি তার নিজেরই স্বাভাবজাত।

সঙ্গে আছে পবিত্র আগুনের সাথে ধোয়ার মিশ্রনের চমৎকার উদাহরণ এবং এই দাসগিরি করতে করতেই নাকি জীব পরমগতি লাভ করবে!

স্বাভাবকর্মের পর দেখা যাক স্বাভাবগুণ কি জিনিস।গুণ তিন প্রকার সত্ত্ব,রজো ও তমো।এগুলোর মধ্যে সত্ত্ব শ্রেষ্ট,তমো গুণ নিকৃষ্ট।
“সত্ত্বাৎ সংজায়তে জ্ঞানং রজোসো লোভ এব চ। প্রমাদমোহৌ তমসো ভবতোহজ্ঞানমেব চ।।”(১৪:১৭)
অর্থাৎ, ‘ সত্ত্বগুণ থেকে জ্ঞান,রজোগুণ থেকে লোভ এবং তমো গুণ থেকে অজ্ঞান,প্রমাদ ও মোহ উৎপন্ন হয়।’
এরপর কোন গুণের ফলে কোন ব্যাক্তি কোথায় গমন করবেন তা বলা হয়েছে
,”ঊর্ধ্বং গচ্ছন্তি সত্ত্বস্থা মধ্যে তিষ্ঠন্তি রাজসাঃ।জঘন্যগুণবৃত্তিস্থা অধো গচ্ছন্তি তামসাঃ।।”(১৪:১৮)
অর্থাৎ,’সত্ত্বগুণ সম্পন্ন ব্যাক্তিগণ উচ্চতর লোকে গমন করে,রজোগুণ সম্পন্ন ব্যাক্তিরা নরলোকে এবং জঘন্য গুণসম্পন্ন তামসিক ব্যাক্তিগণ অধঃপতিত হয়ে নরকে গমন করে।’ আরও আছে,
“রজসি প্রলয়ং গত্বা কর্মসঙ্গিষু জায়তে।তথা প্রলীনস্তমসি মূঢ়যোনিষু জায়তে।।(১৪:১৫)
অর্থাৎ,’রজোগুণে মৃত্যু হলে কর্মাসক্ত মনুষ্যকুলে জন্ম হয়,তেমনি তমোগুণে মৃত্যু হলে পশুযোনিতে জন্ম হয়’
এবং অবধারিত ভাবেই শূদ্ররা যে তমো গুণ দ্বারা আচ্ছাদিত থাকবে তাতে আর আবাক কি!এজন্য আবার ৪র্থ অধ্যায়ের ১৩ নম্বর শ্লোকে ফিরে যায়।
“চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ।
তস্য কর্তারমপি মাং বিদ্ধ্যকর্তারমব্যয়ম।।” (৪:১৩)
অর্থাৎ, “প্রকৃতির তিনটি গুণ ও কর্ম অনুসারে আমি মানব-সমাজে চারিটি বর্ণবিভাগ সৃষ্টি করেছি।আমি এই প্রথার স্রষ্টা হলেও আমাকে অকর্তা এবং অব্যয় বলে জানবে।”উল্লেখিত বইয়ে এই শ্লোকটির তাৎপর্য লেখা আছে যেটা এরকম,

ভগবানই সব কিছুর স্রষ্টা।সমাজের চারটি বর্ণও তারই সৃষ্টি।সমাজের সর্বোচ্চ স্তর সৃষ্টি হয়েছে শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন লোকদের নিয়ে,তাদের বলা হয় ব্রাহ্মণ এবং তারা সত্ত্বগুণের দ্বারা প্রভাবিত।পরের স্তর শাসক সম্প্রদায়,এরা ক্ষত্রিয় এবং এরা রজোগুণের দ্বারা প্রভাবিত।তার পরের স্তর বৈশ্য এরা রজ ও তমোগুণের দ্বারা প্রভাবিত।তার পরের স্তর হচ্ছে শ্রমজীবী সম্প্রদায়,এরা শূদ্র,এরা তমোগুণের দ্বারা প্রভাবিত।

খুব সুন্দর তাৎপর্য!মোটকথা স্বভাবগুণ আর জন্মদোষে, দুষ্ট শূদ্রের নরক দর্শন নিশ্চিত।এবং এর পরে ভগবান প্রিয় কথাটি গোপন করেন নি।

“কিং পুনর্ব্রাহ্মণাঃ পুণ্যা ভক্তা রাজর্ষয়স্তথা/অনিত্যমসুখং লোকমিমং প্রাপ্য ভজস্ব মাম্॥” (৯:৩৩)
আর্থাৎ,’পূণ্যশীল ব্রাহ্মণ ও রাজর্ষিগণ যে পরম গতি লাভ করিবেন তাহাতে আর কথা কি আছে?অতএব আমার আরাধনা কর।’
মানে ব্রাহ্মণের স্বর্গ যাত্রা নিশ্চিত।

গীতার প্রধান বক্তা মানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে বলা হয় পরম জ্ঞানী এবং পুরো পৃথিবীর সৃষ্ট্রা,তবে তার ভূগোল জ্ঞান দেখি ভীষণভাবে ভারতবর্ষ তথা উপমহাদেশ কেন্দ্রিক।গীতার ১০ম অধ্যায়ের ২১ থেকে ৩৮ নম্বর শ্লোক পর্যন্ত ভগবান তার ভূগোল জ্ঞান দেখিয়েছেন।যেমন, জ্যোতিষ্কদের মধ্যে তিনি সূর্য,নক্ষদের মধ্যে তিনি চন্দ্র,বেদের মধ্যে সামবেদ,বস্তুসমূহের মধ্যে হিমালয়,বৃক্ষের মধ্যে অশ্বত্থ,হস্তীদের মধ্যে ঐবারত,মনুষ্যদের মধ্যে সম্রাট,গাভীদের মধ্যে কামধেনু,পশুদের মধ্যে সিংহ,পক্ষীদের মধ্যে গরুড়,মৎসদের মধ্যে মকর(কুমীর),নদীসমূহের মধ্যে গঙ্গা,মাসের মধ্যে অগ্রহায়ন ইত্যাদি।সূর্য জ্যোতিষ্ক আর চন্দ্র নক্ষত্র!সে যাক,এই অতি পরিচিত চন্দ্র সূর্ষের চেয়েও তো ভগবান কতো বড় বড় গ্যালাক্সি কত নক্ষত্র সৃষ্টি করেছেন,সেসবও দু একটা বলা যেত।গুরু,কুমির,হাতি, সিংহ,গরুড় এসব অতি পরিচিত ভারতীয় অঞ্চলের প্রাণীদের কথায়ই শুধু না বলে, লক্ষ লক্ষ বছর আগে তারই সৃষ্টি করা বিশাল বিশাল টোরানোসোরাসের দের নামতো বলতে পারতেন।আমরা তাহলে কতই না মুগ্ধ হোতাম।হিমালয় শ্রেষ্ট মানলাম কিন্তু নীলনদ বা আমাজান নদীতো গঙ্গার চেয়ে শৌর্যে বির্যে কম নয়,তাদের কথাও একটু বলা যেত। ভারতবাসীদের মত ভগবানেরও প্রিয় মাস অগ্রহায়ন!এই মাস মূলত এই অঞ্চলের ফসল কাটার মৌসুম।এতে করে কেন যেন মনেহয় ভগবানও বোধহয় এই ভারতীয় উপমহাদেশ এলাকারই নাগরিক ছিলেন। বাকী পৃথিবীর মানুষ,প্রকৃতি বা সংস্কৃতি নিয়ে তার তো কোনরকম আগ্রহ দেখি না।

ভগবান সব কিছুর স্রষ্টা, আমরা সবাই পরমেশ্বর ভগবানের সন্তান,কিংবা ভগবান নিরপেক্ষ,অব্যয় এই ধরণের রোম্যানটিক কথা গুলো বড্ড পানসে লাগে যখন শ্রীকৃষ্ণ বলে,
“মাং হি পার্থ ব্যপাশ্রিত্য যেহ্যপি স্যুঃ পাপযোনয়ঃ।
স্ত্রিয়ো বৈশ্যাস্তথা শূদ্রাস্তেপি যান্তি পরাং গতিম্॥” (৯:৩২)
অর্থাৎ,’আমাকে আশ্রয় করে স্ত্রী,বৈশ্য,শূদ্র এসব পাপযোনিরাও পরম গতি লাভ করে থাকে।’
চরম আপত্তিকর কথা।নারী,বৈশ্য এবং শূদ্রদের প্রতি স্বয়ং ভগবানের মুখ থেকে এরকম নোংরা কথা শুনে মনেহয়,ভগবানও বোধহয় ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় সম্প্রদায়ের কোন এক সম্ভ্রান্ত পুরুষ সদস্য।নিরপেক্ষ যে না তা তো বোঝায় যাচ্ছে।পাপিষ্ট,জন্মোদোষে দুষ্ট বৈশ্য ও শূদ্রদের কথা নাহয় বাদই দিলাম।কিন্তু ব্রাহ্মণের স্ত্রী বা মেয়েরাও তো ভগবানের কুবাক্য থেকে রক্ষা পেল না।পুরো নারী জাতির প্রতিই ভগবানের এইরকম নোংরা দৃষ্টিভঙ্গি দেখে মনে সন্দেহ জাগে।অথচ এই নারীরাই স্নান সেরে পবিত্র হয়ে,মনে ভক্তিভাব জাগ্রত করে প্রতিদিন গীতাপাঠ করে।তারা কি জানে এই গীতায় ভগবান তাদেরকে কি বিশ্রী ভাষায় অপমান করেছে?