বাঙালী ক্রিকেট পাগল জাতি এটা ব্যাখ্যা করে বোঝানোর কোন বিষয় না। বাংলাদেশের প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক ডঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল একবার লিখেছিলেন,

“……ফুটবল ওয়ার্ল্ড কাপ আমি দুই চোখে দেখতে পারি না। কিন্তু ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড কাপ আমার অসম্ভব প্রিয়। কেউ যেন মনে না করে, আমি একজন খাঁটি বোদ্ধা। আমি ক্রিকেটের ওয়ার্ল্ড কাপ অসম্ভব ভালোবাসি, কারণ এই সময়টাতে সারা দেশের মানুষ লাল-সবুজ রঙের খেলায় মেতে ওঠে। এই খেলায় আমার নিজের দেশ খেলছে এবং আমরা ক্রমাগত ‘বাংলাদেশ’, ‘বাংলাদেশ’ করে চিৎকার করছি। দেশকে ভালোবাসার আর দেশকে নিয়ে গর্ব করার একটা সুযোগ করে দেয় এই ওয়ার্ল্ড কাপ ক্রিকেট খেলা। যাঁরা ক্রিকেট বোদ্ধা, তাঁরা খেলার প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করেন, আমি পারি না। আমি খেলা দেখতে পারি, যখন সেই খেলায় বাংলাদেশ জিততে থাকে, শুধু তখন! বাংলাদেশ যদি কখনো কোনো খেলায় হেরে যায়, তখন দুঃখে আমার বুক ভেঙে যায়, মনে হয় হাউমাউ করে কাঁদি।…”

উপরের ছোট্ট লেখাটা থেকেই বোঝা যায় কি রকম ক্রিকেট পাগল জাতি আমরা

কিন্তু এবার ক্রিকেটের তিন মোড়ল অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ডের নীতির মুখে অস্তিত্ব হারানোর মুখে পড়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেট। আইসিসির তিন ‘শক্তিধর’ দেশের নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী বাংলাদেশের টেস্ট খেলা আজ সত্যিই হুমকির মুখে।
টেস্ট ক্রিকেটকে ‘আকর্ষণীয়’ করার তারা প্রস্তাব করেছে নতুন এক পদ্ধতির। সোজা ভাষায় বলতে টেস্ট ক্রিকেটে আমাদের র্যাবঙ্কিং ৯ আর প্রথম দশটি দল খেলতে পারে। মোড়লদের প্রস্তাবিত পদ্ধতিতে এখন থেকে ৮ টি দল খেলতে পারবে টেস্ট ক্রিকেট এই দ্বি-স্তরবিশিষ্ট টেস্ট ক্রিকেটে র্যাপঙ্কিংয়ের ৯ ও ১০ নম্বর দলকে ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপে খেলার ‘আশঙ্কা’ নিয়ে তোলপাড় এখন দেশের ক্রিকেট।

পাঠক একটু ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখবেন তারা আটটি দল নিয়ে খেলার কথা বলছে, নয়টি নয় আবার সাতটিও নয়। এই পদ্ধতিতে প্রথম কোপটি পড়বে বাংলাদেশের দেশের উপর।
ক্রিকেট বিশ্বে আমরা যখন পৌঁছে যাচ্ছি অপ্রতিরুদ্ধ এক অবস্থানে ঠিক তখনই সংস্কারের নামে ক্রিকেটের তিন ‘মোড়লে’র এই অদ্ভুত প্রস্তাবকে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে চিরতরে শেষ করে দেওয়ার আন্তর্জাতিক চক্রান্ত বললেও ভুল বলা হবে না।

তবে আশার কথা হচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, শ্রীলঙ্কার মত দেশ গুলো এই প্রস্তাবের বিপক্ষে তাদের সুস্পষ্ট অবস্থানের কথা বলছে পরিস্কার ভাবেই। এখন দেখার বিষয় ছিলো আমাদের দেশের বোর্ড কি বলে। টেস্ট ক্রিকেটের নবীনতম দেশের ক্রিকেট নিয়ন্ত্রক সংস্থা, ক্রিকেটকে ‘শেষ’ করে দেওয়ার এই প্রস্তাবের বিপক্ষে কতটা ‘উচ্চকণ্ঠ’ হতে পারবে, উত্কণ্ঠার কারণ মূলত ছিলো এটাই।

সবার অপেক্ষা, উৎকণ্ঠা আর উদ্বিগ্নতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অবশেষে বিসিবির ঘুম ভাঙে ২৩ জানুয়ারি জমিদারদের পক্ষেই কথা বলে আমাদের বিসিবি। সভাপতির নির্লজ্জ দালালি দেখে অবাক হলাম আমরা…

এটাকি আমার বাংলাদেশ !!!

সিদ্ধান্ত গোপন রেখে সভাপতি বললেনঃ

“যেহেতু বিষয়টা জটিল এবং এ-সংক্রান্ত অনেক প্রশ্নের উত্তরই আমাদের জানা দরকার, সে জন্য আমাদের যে মনোভাবই থাক না কেন, সেটা এখন প্রকাশ করতে চাচ্ছি না। এ ব্যাপারে অন্য দেশগুলোর অবস্থান জেনে আমরা আমাদের মতামত

তবে থলের বিড়াল বেরিয়ে গেছে,
আমরা জেনেছি সভাপতিসহ উপস্থিত ২৩ পরিচালকের মধ্যে ২০ জনই মোড়লদের পক্ষে মত দিয়েছেন। প্রস্তাবের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার দাবি ছিল শুধু আহমেদ সাজ্জাদুল আলম এবং নবীন দুই পরিচালক শওকত আজিজ ও তানজিল চৌধুরীর। সাজ্জাদুল আলম তো প্রতিবাদে ওয়াকআউটই করেছেন সভা থেকে। বোর্ড রুম থেকে বের হয়ে আসার আগে তিনি নাকি এমনও বলেছেন, বিসিবির চিন্তাভাবনায় সর্বাগ্রে থাকা উচিত ক্রিকেটের স্বার্থ। কিন্তু এই সভায় যা হচ্ছে, তাতে বাংলাদেশের ক্রিকেটের মৃত্যুদণ্ডের রায়ই লেখা হয়ে যাচ্ছে।

তবে সভাপতি সাহেবের যুক্তি একটাই প্রস্তাবটি মেনে নিলে বিসিবি আর্থিকভাবে লাভবান হবে, তাদের সর্বশেষ অর্থবছরে আইসিসি যেখানে ১.৫ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে, নতুন প্রস্তাব অনুমোদন হলে নাকি ভবিষ্যতে সেটি ৩.৫ বিলিয়নও ছাড়িয়ে যেতে পারে। তখন স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের ভাগে এখনকার চেয়ে বেশি টাকা পাবে। এ ছাড়া ভারতসহ ক্রিকেটের বড় তিন দেশের বিপক্ষে যাওয়ার ঝুঁকিটাকেও বড় করে দেখেছেন তাঁরা। পরিচালকদের শঙ্কা, বিসিবি এর বিপক্ষে অবস্থান নিলে ‘বড় ভাই’দের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটবে। তখন অন্যরাও ‘বড়’দের রোষানলে পড়ার ভয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে খেলা এড়িয়ে যাবে।

নাজমুল হাসানের কয়েকটি উক্তি যা এখন ভাসছে অন্তঃজালের দিকে দিকেঃ
“টেস্টে আমাদের রেটিং পয়েন্ট ১৮। আগামী ১০ বছর টেস্ট খেললেও হয়তো আমাদের ৮ নম্বরে ওঠা হবে না। কিন্তু এই পদ্ধতিতে ৮ নম্বরকে হারাতে পারলেই আমরা ৮-এ উঠে যাব। এখন তো নিউজিল্যান্ডকে হারিয়েও লাভ হচ্ছে না।”

পরে আবার বলেছেন,
“সার্বিকভাবে এই প্রস্তাব গ্রহণ করার পক্ষে কোনো যুক্তি নেই। এটা খারাপ মানছি। কিন্তু ভালোটা কোথায় হচ্ছে? র্যা র্ঙ্কিংয়ের বর্তমান অবস্থান থেকে বের হওয়ারও তো কোনো সুযোগ পাচ্ছি না!”

এমন অন্যায্য পরিস্থিতেও বিসিবি সভাপতি বলেন
“আমরা ঝুঁকি নিতে পারব না। যদি দেখি আমরা হ্যাঁ বললে যা, না বললেও তা, তখন একরকম সিদ্ধান্ত নেব। আবার যদি দেখি, আমাদের অবজেকশনের ওপর প্রস্তাবের পাস-ফেল নির্ভর করবে তখন আরেক রকম।”

মোদ্দা কথা ভারত আর তাদের দোসররা এখন বাংলাদেশের উন্নতি সহ্য করতে পারছে না, এদিকে ক্রিকেট কে কি করে খেলা থেকে পুরপুরি বানিজ্য নির্ভর করে ফেলা যায় সেটাও তাদের মাথায় ঘুরছে। ক্রিকেট বর্তমানে কেবল খেলার মাঝে আটকে নেই, এটি এখন বিরাট এক বাণিজ্যে। যেখানে একজন ক্রিকেটার পণ্যের বিজ্ঞাপন করছেন, নিজেও পণ্যে পরিণত হচ্ছেন, আর ক্রিকেট তার নান্দনিকতার আকর্ষণ হারাচ্ছে জুয়ার আসরে। সাম্প্রতিক সময়ে জুয়ার প্রভাব ও ম্যাচ ফিক্সিং ক্রিকেটে মহামারির আকার ধারণ করেছে। ক্রিকেটার এবং ক্রিকেট বোদ্ধারা টেস্ট ক্রিকেট ধ্বংসের ষড়যন্ত্রের কথা বলে আসছেন কয়েক বছর ধরে। আর তারা কয়েকটি ক্রিকেট বোর্ড এবং আইসিসি’কেই এই ষড়যন্ত্রের হোতা বলে দূষছেন। যেহেতু টেস্ট ক্রিকেট সময় সাপেক্ষ, তাই এতে দর্শকদের উন্মাদনা তুলনামূলকভাবে কম, তাই টেস্ট ক্রিকেটে ব্যবসায়িক ফায়দা কম। অপরদিকে, ওয়ান ডে বা টি-টুয়েন্টি ক্রিকেট খুবই কম সময়ে ফলাফল আসে বলে, এতে দর্শক বেশি, তার মানে বেশি কর্পোরেট বাণিজ্য, যার মানে ক্রিকেট বোর্ডের লাখো ডলারের ফায়দা। আর এরই সাথে আসে বাজিকরদের উন্মাদনা আর ম্যাচ ফিক্সিংয়ের (পাতানো খেলা)। যা ক্রিকেটকে ক্রমাগত কলুষিত করছে।

এমন জুয়া আর ম্যাচ ফিক্সিং শুধু ক্রিকেটকেই আঘাত করছে এমনটাও নয়, তাতে জুয়ার বলি হচ্ছে মানুষের আবেগ। আর ক্রিকেটাররা ক্রমেই পরিণত হচ্ছেন টাকার পুতুলে, যাদের নিজের মত প্রকাশের উপরেও শর্ত আরোপ করে কর্পোরেট কোম্পানি আর কর্পোরেট ক্রিকেট বোর্ড। যে এলিট ক্রিকেট বোর্ডসমূহ নিজেদের এই বনেদী প্রস্তাবনায় তাদের উচ্চাভিলাষ আর বাণিজ্যের চিন্তাটাকেই তুলে ধরেছেন। আর এই বনেদী তত্ত্ব আর কর্পোরেট প্রভাবে ক্রমেই নিষ্প্রভ হচ্ছে নান্দনিক ক্রিকেটের জৌলুস। যার ভাগশেষ কর্পোরেট ক্রিকেট।

সব মিলিয়ে বাংলাদেশকে সরিয়ে দিতে পারলে সবার সব দিক থেকে লাভ। আর সামান্য টাকার লোভে যেখানে দেশী সংস্থা বিক্রি হয়ে যায় সেখানে আইসিসি কে আর কি বলব, এটা তো জানা কথা আইসিসির বর্তমান আয়ের সিংহভাগই আসে এই তিন মোড়ল দেশ অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও ইংল্যান্ড থেকে।

লেখার শুরুতেই বলেছিলাম বাঙালীর ক্রিকেট নিয়ে আবেগের কথা। বাঙালী জাতির রক্তে ক্রিকেট আর তাই এই অন্যায়ের মুখে সোচ্চার হয়েছে আমাদের তরুণেরা। ফেসবুক ইভেন্ট পেজ খুলে সবাইকে বের হতে বলা হয় ঘর থেকে…

“তিন ক্রিকেট বোর্ডের অন্যায্য প্রস্তাবনার বিরুদ্ধে বিসিবি কার্যালয়ের সামনে প্রতিবাদ।”
শেরোনামে ইভেন্টের শুরুতে সবাইকে বিসিবি কার্যালয়ের সামনে আসতে বলা হলেও পরবর্তীতে শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট দল দেশে থাকায় স্থান পরিবর্তন করে নেয়া হয় শাহবাগ জাদুঘরের সামনে।
ইভেন্টের আহ্বায়ক বলেন,

‘শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট দল এই মুহূর্তে ঢাকায় অবস্থান করছে। তারা কাল প্রাকটিসে যাবে মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে। ডিএমপির সঙ্গে বিশদ পর্যালোচনা করা হয়েছে কালকের সমাবেশ নিয়ে। কিছু দিন আগে আইসিসির নিরাপত্তা দল মিরপুর স্টেডিয়াম দেখে গেছে। তার নিরাপত্তা নিয়ে অনেক ভুল খোঁজার চেষ্টা করেছে। আর সামনে বিশ্বকাপ, সেটা কে সামনে রেখে আমরাও চাচ্ছি না অপ্রীতিকর কোনো কিছু জন্ম নিক। সত্যি বলতে ৬০ হাজারকে ইনভাইট করা হয়েছে, ৫ হাজারের উপরে গোয়িং বাটন চেপেছেন চার ঘন্টায়। রাতের ভেতর ১০-২০ হাজার লোক হয়তো ব্যাপারটা জানবেন। তার ভেতর এক হাজার লোকও এলে তা মিরপুর জোনের জন্য অনেক। দেশের কথা ভেবেই ভেন্যু পরিবর্তন করা হলো। বিসিবি অফিসের সামনের বদলে শাহবাগ জাদুঘরের সামনে প্রতিবাদ কর্মসূচি টি পালন হবে। সময় এবং তারিখ আগের টাই অর্থাৎ শনিবার বিকাল ৪টা।’

পেজটিতে বলা হয়,

‘লঙ্কান ক্রিকেট দল অনুশীলনরত কিংবা স্টেডিয়াম ছাড়ার মুহূর্তে এত লোকের সমাগম তাদের নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক। মনে আছে কিনা, শ্রীলঙ্কান দলের উপর পূর্বে জঙ্গী কর্তৃক আক্রমণ হয়েছিলো। সুতরাং আমাদের ছোটো কোনো ভুল আমাদের দেশের উপরেই বিপদ ডেকে আনবে।’

আরও বলা হয়,

‘শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ কর্মসূচীতে একটি পোস্টার লিখে নিয়ে আসুন, কোনো উগ্র বক্তব্য নয়, তাদের দাবির বিরুদ্ধে যৌক্তিক স্লোগান লিখুন।’

পরদিন বিকেল হওয়ার আগেই জমতে থাকে মানুষ। প্রাণের টানে ক্রিকেটের টানে মানুষ জড় হতে থাকে শাহাবাগে

সময়ের সাথে সাথে মানুষও বাড়তে থাকে।

‘তিন মোড়লের মাতব্বরি, মানি না মানবো না’, ‘এক দাবি এক দেশ, টেস্ট খেলবে বাংলাদেশ’, ‘তিন শেয়ালের কাছে, মুরগি বর্গা হবে না’, ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’, ‘ক্রিকেট নিয়ে বাণিজ্য, মানি না মানবো না’, ‘তিন মোড়লকে বিসিবি, না বলো না বলো’ – ক্রিকেটপ্রেমীদের এমন স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত শাহবাগ

ব্যানারে ফেস্টুনে আর মুহূরমুহু শ্লোগানে প্রকম্পিত হতে থাকে আকাশ-বাতাস, পোস্টার গুলো পড়ে দেখা গেলো;

‘এক দাবি, এক দেশ, টেস্ট খেলবে বাংলাদেশ’, ‘ক্রিকেটে ৩ মোড়লের দালালি চলবে না’, ‘৩ মোড়লের সব অন্যায্য দাবিকে না বলো’, ‘বাংলাদেশের ক্রিকেটকে রক্ষা করো’, ‘তিন মাতব্বরের পাগলামি মানি না’, ‘আমাদের ক্রিকেটকে নয়, আমাকে খুন করো’, `This is cricket, not business`, `Cricket is business to you but oxygen to us`, `BCB respect our emotion & say no to big 3 idiots`, `Play for glory not for money` ইত্যাদি

বাংলাদেশের পতাকা, ব্যানার, ফেস্টুন, প্লে-কার্ড নিয়ে কয়েক হাজার ক্রিকেটপ্রেমীর অংশগ্রহণে শাহবাগ মোড় থেকে চারুকলার সামনে পর্যন্ত মানববন্ধন দীর্ঘায়িত হয়। দুই সারিতে মুখোমুখিভাবে অবস্থান করেন শিক্ষার্থী, চাকরিজীবীসহ বিভিন্ন পেশার লোকজন। অবস্থান কর্মসূচিতে ক্রিকেটপ্রেমী বাংলাদেশির পক্ষ থেকে ৪ দফা দাবি জানানো হয়। দাবিগুলো হচ্ছে,

১) ৩ মোড়লের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে বিসিবি’র শক্ত অবস্থান গ্রহণ করা।
২) এর বিরুদ্ধে বিসিবি’র দায়িত্বশীল অবস্থান গ্রহণ করা।
৩) ক্রিকেট নিয়ে কোনো ধরনের রাজনীতি না করা।
৪) উত্থাপিত দাবিগুলো প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা।

তীব্র সমালোচনা আর দেশের মানুষের উত্তপ্ত অবস্থানের কথা বিসিবি সম্ভবত বুঝতে পেরেছে আর তাই তীব্র সমালোচনার মুখে দেশটির ক্রিকেট বোর্ড বিসিবি জানায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসির সংস্কারের খসড়া প্রস্তাবের যে অংশে টেস্ট ক্রিকেটের দ্বিস্তরবিশিষ্ট কাঠামো প্রচলনের প্রস্তাব রাখা হয়েছে সেই অংশের বিরোধিতা করবে বিসিবি।

এদিকে আন্দোলনকারীরা বাংলাদেশ শ্রীলংকার ম্যাচে আবারো ব্যানার ফেস্টুন নিয়ে হাজির হবেন স্টেডিয়ামে, সমগ্র বিশ্বের কাছে জানিয়ে দেবেন এই অন্যায্য জমিদারির বিরুদ্ধে আমাদের সুস্পষ্ট অবস্থানের কথা।

বাংলাদেশের ক্রিকেটের প্রতি প্রতিবেশী দেশের এধরণের আচরণ এই প্রথম না। ১৯৭১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি, ঢাকা স্টেডিয়ামে শুরু হলো চারদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ। পাকিস্তান ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড দলের প্রতিপক্ষ কমনওয়েল্থ একাদশ। তৎকালীন পাকিস্তানের হয়ে ইনিংস ওপেন করতে নামলেন ১৮ বছর বয়সী বাঙালি ব্যাটসম্যান রকিবুল হাসান। পাকিস্তান ক্রিকেট দলের একমাত্র বাঙালি সদস্য।

পাকিস্তান দলের সব ব্যাটসম্যানের ব্যাটেই সোর্ড [তলোয়ার] স্টিকার। যা জুলফিকার আলী ভুট্টোর নির্বাচনী প্রতীক। কিন্তু ব্যতিক্রম শুধু একজন। তিনি রকিবুল হাসান। তিনি মাঠে নামলেন ব্যাটে জয় বাংলা স্টিকার লাগিয়ে, পাশে বাংলাদেশের ম্যাপ!

১ মার্চ ১৯৭১, সোমবার দুপুর ১টা ৫ মিনিট। নিশ্চিত ড্র-য়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে খেলা। তখন রেডিওতে শোনা গেলো ইয়াহিয়ার ঘোষণা, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিস্ট কালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে!
সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠলো গোটা স্টেডিয়াম…!!

ব্যাটে যে জয় বাংলা ধ্বনি নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন রকিবুল হাসান, মুহূর্তেই সেই জয় বাংলা ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়ে উঠলো গোটা দেশ। খেলা মুলতবি ঘোষণা করা হলো। সমগ্র বাঙালি জাতি নেমে এলো
রাজপথে। শুরু হলো অসহযোগ আন্দোলন। এর পরের ইতিহাস সবার জানা।

একজন ক্রিকেটারের জন্য জাতীয় দলের হয়ে টেস্ট খেলার চেয়ে বড় আর কোনো চাওয়া নেই। কিন্তু মাতৃভূমির জন্য রকিবুল হাসান ত্যাগ করেছিলেন আজীবন লালিত টেস্ট খেলার স্বপ্ন। কোনো রকম রাজনৈতিক নির্দেশ ছাড়াই যিনি বরণ করে নিয়েছিলেন জুলুম নির্যাতন, যোগ দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে।

১৮ বছরের টগবগে তরুণ রকিবুল হাসান মাতৃভূমির জন্য টেস্ট খেলার সুযোগ বিসর্জন দিতে পারেন, যে শোষক দলের ওপেনার হওয়ার সুযোগ প্রত্যাখ্যান করেন তার প্রজন্মই তো আমরা। অন্যায়ের প্রতিবাদে সেদিন যেমন রকিবুল মাঠে নেমেছিলেন, ত্রিদেশীয় মোড়লদের অন্যায়ের প্রতাবাদে আজ আমরাও মাঠে থাকবো সোচ্চার হয়ে।

পৃথিবী আরও একবার বলুক;
“সাবাস বাংলাদেশ
এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়
জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার
তবু মাথা নোয়াবার নয়…”