[ধর্মশিক্ষার উপরে ‘বাংলাদেশ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের’ নতুন পদক্ষেপের উপর ছোট একটা ফেসবুক নোট লিখেছিলাম দিন কয়েক আগে। ভেবেছিলাম এটা একটা সামান্য নোট। মানসম্মত কিছু নয়। কিন্তু মুক্তমনা ব্লগার তামান্না ঝুমু আমাকে এটি ব্লগে দিতে অনুরোধ করেন। তার অনুরোধেই দেয়া। ব্লগের জন্য এর কলেবর বাড়াতে হল একটু। তামান্না ঝুমুকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি চেপে ধরে লেখাটা ব্লগে আদায় করে নেয়ার জন্য। ]

এক

মুক্তমনা ব্লগার ওমর ফারুক লুক্সের একটা ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে দেখলাম বাংলাদেশ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের তৃতীয় শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ধর্মীয় বিষয়ের পাঠ্যপুস্তকের সঙ্গে নাকি ‘নৈতিকতা’ বলে কি একটা নাকি জুড়ে দেয়া হয়েছে।  পরে ন্যাশনাল কারিকুলাম এণ্ড টেক্সটবুক বোর্ডের সাইটে গিয়ে দেখি সত্যই তাই।  প্রতিটি ক্লাসের ধর্মগ্রন্থগুলোর সাথে ‘ও নৈতিক শিক্ষা’ বলে দুটি শব্দ যোগ করা হয়েছে। যেমন আপনার ধর্ম যদি ইসলাম হয়, তাহলে সন্তানের জন্য বইয়ের শিরোনাম – ‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’, ধর্ম হিন্দু হলে বইয়ের নাম ‘হিন্দু ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা’, খ্রিষ্ট ধর্মের ক্ষেত্রে ‘খ্রিষ্ট ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা’, বৌদ্ধ ধর্ম হলে শিরোনাম হবে – ‘বৌদ্ধ ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা’। এরকমের। তৃতীয় শ্রেণী থেকে শুরু নবম-দশম শ্রেণীর প্রতিটি ধর্মের বইয়েই এই অবস্থা। কার উর্বর মস্তিষ্ক থেকে  এই নয়া পরিকল্পনা বেরিয়েছে, জানি না, তবে ধর্ম বইয়ের সাথে নৈতিকতা জুড়ে দেবার ব্যাপারটা বেশ মজার লাগলো। আর এটাই হল আজকের এই প্রবন্ধের খোরাক।

দেশের বিজ্ঞজনেরা স্কুলের শিশুদের ‘ধর্মীয় নৈতিকতা’ শেখাতে চান ভাল কথা, কিন্তু এই নৈতিকতা ঠিক কি জিনিস তা ধর্মগুলো ঠিকমত আগাগোড়া না পড়লে আর না জানলে বলা যাবে না। ধর্মগ্রন্থে আমরা বিবর্তন তত্ত্বের বদলে আদম হাওয়ার কথা পড়েছি। বিবর্তন খুব খারাপ,আর আদম হাওয়ার গল্প খুব ভাল। আমরা পড়েছি তাদের দুই সন্তান হাবিল, কাবিলের কথা। আমরা ধরে নিয়েছি দুটো মানুষ, তাদের সন্তানরা মিলে সারা পৃথিবী মানুষে মানুষে ছেয়ে ফেলেছে। তবে এখানেই থেমে না গিয়ে আরেকটু সামনে আগালে, আরেকটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই একটা গভীর প্রশ্নের সম্মুখীন আমাদের হতে হয়। তাদের সন্তান উৎপাদনটা ঠিক কীভাবে হলো? সে সময় ভাইবোনে সঙ্গম ছাড়া আমাদের মানবজাতি কি তৈরি হতে পারে? বোঝাই যায়, আদম হাওয়ার গল্প সত্যি হয়ে থাকলে পৃথিবীতে আমরা এসেছি ঠিক সেই পথ ধরে, যেটাকে খোদ ধর্মগুলোই ‘চরম অনৈতিক এক অজাচার’ বলে মনে করে। যদিও কাঠমোল্লা আর সদামোল্লা সাইটগুলো অজাচার, সমকামিতা, ব্যভিচার সব কিছুর পেছনে কেবল বিবর্তনকেই দায়ী করেন, কিন্তু ধর্মগ্রন্থগুলোতে আমরা যে সমস্ত  নৈতিকতা আর মূল্যবোধের গল্প শুনি তাতে রীতিমত কানে আঙ্গুল দিতে হয়। সেই হাবিল কাবিলের কথাই ধরি। যদিও আদম হাওয়ার কয়জন ছেলে মেয়ে ছিল তা নিয়ে কেউ নিশ্চিত নন, কিন্তু ইহুদী ইতিহাসবিদ জোসেফাসের অনুমান, আদমের তেত্রিশজন পুত্র এবং তেত্রিশজন কন্যা ছিল। আবার কারো কারো মতে পৃথিবীতে আগমনের পর তাঁদের ১৪০ জোড়া সন্তান হয়েছিল। কেউ বা বলেন, তাদের সন্তান সংখ্যা ছিল ৩৬১টি – এর মধ্যে একমাত্র নবী শীস ব্যতীত সবাই নাকি জন্মেছিল জোড়ায়। আদম ও হাওয়ার গর্ভে প্রতিবার নাকি একটি ছেলে ও একটি মেয়ে জন্ম নিত। বয়ঃসন্ধি হবার পরে ছেলেটির সাথে পূর্বে জন্ম নেওয়া মেয়ের এবং মেয়েকে পূর্বে জন্ম নেওয়া ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়া হতো। কিংবা তারা বিয়ে করতো যমজ বোনকেই।   বাইবেলের মতে, কাবিল  ও হাবিল দুজনেই নিজেদের যমজ বোনকে বিয়ে করেছিল। কিন্তু তৃতীয় বোন  আকলিমাকে বিয়ে করা নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে তুমুল ঝগড়া শুরু হলে, এবং ঈশ্বর কাবিলের দান প্রত্যাখ্যান করার ঘোষণা দিলে,  কাবিল একটা সময় হাবিলকে হত্যা করে।পবিত্র বাইবেলেই এটাকে উল্লেখ করেছে মানবেতিহাসের ‘প্রথম হত্যা’ হিসেবে। কাজেই দেখা যাচ্ছে, বিবর্তন তত্ত্বকে হটাতে গিয়ে ধার্মিকরা যে গাল গপ্পের অবতারণা করছে, তাতে আর যাই থাকুক নৈতিকতা কিংবা মূল্যবোধ বলে কিছু নেই।  এই রূপকথা সত্য হলে মানব জাতির উদ্ভব ঘটেছে অজাচার, কলহ,  হত্যা খুন ধর্ষণ আর প্রতারণার মধ্য দিয়ে। এখন কথা হচ্ছে, গল্পের পেছনের নৈতিকতাগুলো কি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড শেখাবেন, নাকি চেপে যাবেন? তারা কি পারবেন আপন বোনের প্রতি কামাসক্ত হাবিল কাবিলের কথা, নারীকে শস্যক্ষেত্র বানিয়ে রাখার কথা, পালিত পুত্রের স্ত্রীর মোহে ধর্মপ্রচারকেরা  কিভাবে লালায়িত হয়েছিলেন কিংবা প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়সে  ছয় বছরের এক বালিকার পাণিগ্রহণের কথা কিংবা তাদের বিবিধ যৌন উন্মাদনার কথা ভণিতা না করে শিশুদের শেখাতে?

তবে  ধর্মীয় নৈতিকতা শেখাতে গেলে হিন্দু ধর্মকে মনে হয় কেউই ছাড়িয়ে যেতে পারবে না। হিন্দু পুরাণ টুরানে যতবার চোখ বোলাই, ততবারই রীতিমত অক্কা পাওয়ার উপক্রম হয়। হ্যাঁ ইসলামের প্রচারকের তার পুত্রবধূর সাথে সম্পর্ককে যদি অনৈতিক ধরা হয়, তবে ব্রহ্মার নিজ মেয়ে শতরূপার সাথে মিলনকে কিভাবে নেয়া যায়? মৎস্যপুরাণে লেখা আছে ব্রহ্মা নাকি একদিন তার নিজের মেয়ে শতরূপাকে দেখে আর নিজেকে সামলাতে পারেন নি। হিন্দুদের আদি মানব মনুর জন্ম হয় ব্রহ্মা আর শতরূপার মিলন থেকেই। শুধু ব্রহ্মাই নয়, নিজ মেয়ের সাথে মিলনের কাণ্ড ঘটিয়েছে দেবতা প্রজাপতিও। ঊষা ছিলেন প্রজাপতি কন্যা। প্রজাপতি ঊষার রূপে কামাসক্ত হন, এবং মিলিত হতে চান। তখন ঊষা মৃগীরূপ ধারণ করেন। প্রজাপতি মৃগরূপ ধারণ করে তার সাথে মিলিত হন (মৈত্রায়ন সংহিতা ৪/২/২২)।

হিন্দুরা ভগবান ডেকে যাকে পুজো করেন – সেই ভগবান ব্যাপারটাই অশ্লীল। ‘ভগবান’ বলতে ঈশ্বরকে বোঝানো হলেও এটি আসলে হচ্ছে দেবরাজ ইন্দ্রের একটি কুখ্যাত উপাধি। তিনি তার গুরুপত্নী অহল্যার সতীত্ব নষ্ট করায় গুরুর অভিশাপে তার সর্বাঙ্গে একহাজার ‘ভগ’ (স্ত্রী যোনি) উৎপন্ন হয় এবং তাতে ইন্দ্রের নাম ‘ভগবান’ (ভগযুক্ত) হয় (পঞ্চ পুরাণ, ষষ্ঠ খণ্ড, ৬৯০ পৃষ্ঠা, মহাভারত, কৃত্তিবাসী রামায়ণের আদিকাণ্ডের ৬৫১ পৃষ্ঠা) । ‘ভগবান শব্দটি তাই ইন্দ্রের ব্যভিচারের একটি স্মারকলিপি, নিন্দনীয় বিশেষণ।

সুধীরচন্দ্র সরকার সংকলিত ‘পৌরাণিক অভিধান’ থেকেও ইন্দ্রের এই ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়  –

‘মহাভারতে উল্লেখ আছে যে, গৌতম মুনির অনুপস্থিতিতে ইন্দ্র তার রূপ ধারণ করে স্ত্রী অহল্যার সতীত্বনাশ করেন বলে মুনির শাপে তাঁর সমস্ত দেহে সহস্র যোনি-চিহ্ন প্রকাশ পায়। ইন্দ্রের অনুনয়-বিনয়ে গৌতম ঐ চিহ্নগুলি লোচন চিহ্নে পরিণত করেন। এইজন্য ইন্দ্রের আরেক নাম সহস্রাক্ষ বা নেত্রযোনি’। (পৌরাণিক অভিধান, পৃঃ ৪৯)

আসলে হিন্দু ধর্মের শ্রদ্ধেয় চরিত্রগুলো – ইন্দ্র থেকে কৃষ্ণ পর্যন্ত প্রত্যেকেই ছিলেন ব্যভিচারী। জলন্ধরের স্ত্রী বৃন্দা ও শঙ্খচূড়ের স্ত্রী তুলসীকে প্রতারিত করে বিষ্ণু তাদের সাথে মিলিত হয়েছেন। সপ্তর্ষির সাত স্ত্রীকে দেখে অগ্নি একসময় কামার্ত হয়ে পড়েন। আসলে ওই বিকৃত কল্পনাগুলো করেছিল বৈদিক যুগের পুরুষেরা। তারা নিজেরা ছিল কামাসক্ত, বহুপত্নীক এবং অজাচারী; তাই তাদের কল্পনায় তৈরি দেব-দেবীগুলোও ছিল তাদের মতই চরিত্রের। এজন্যই সমস্ত হিন্দু ধর্মের বই পুস্তক গুলোতে শুধু অযাচিত কাম আর মৈথুনের ছড়াছড়ি। পান থেকে চুন খসলে সে সময়কার মুনি ঋষিরা রাগে কাঁপতে কাঁপতে শাপ দিতেন। বিয়ে করতেন। তারপরও রাজাদের আমন্ত্রণে হাজির হতেন রানিদের গর্ভে সন্তান উৎপাদন করতে। সুন্দরী অপ্সরা আর বারবনিতা দেখলে এতই উত্তেজিত হয়ে যেতেন যে রেতঃপাত হয়ে যেতো। আর সেখান থেকেই নাকি সন্তান জন্মাত। অগস্ত্য, বশিষ্ঠ, দ্রোণের জন্মের উদাহরণগুলোই এর প্রমাণ।

মুহম্মদের ২০/২২ জন স্ত্রী নিয়ে হিন্দুদের কেউ কেউ নরকগুলজার করেন, কিন্তু তারা হয়তো ভুলে যান, পদ্মপুরাণ অনুসারে (৫/৩১/১৪) শ্রীকৃষ্ণের স্ত্রীর সংখ্যা ষোল হাজার একশ। এদের সকলেই যে গোপবালা ছিলেন তা নয়, নানা দেশ থেকে সুন্দরীদের সংগ্রহ করে তার ‘হারেমে’ পুরেছিলেন কৃষ্ণ।

সে সময় রাজা থেকে সাধারণ মানুষ, দেবতা থেকে ঋষি – সবাই বেদের যুগে যৌন উচ্ছৃঙ্খলতায় মত্ত ছিল। বৈদিক সাহিত্য এ কথাই বলে। বিশিষ্ট প্রত্নতত্ত্ববিদ ও নৃতত্ত্ববিদ ডঃ অতুল সুরের কথায় – ‘মৈথুন ধর্মটাই সেকালের সনাতন ধর্ম ছিল’ (দেবলোকের যৌনজীবন, পৃঃ ৬২)। আর সেজন্যই সাহিত্যে দেখি ৩৩ কোটি দেবতার জন্য ৬০ কোটি বারবনিতা (অপ্সরা) নিয়ে ছিল স্বর্গের সাজানো সংসার। দেবতাদের সন্তুষ্ট করার জন্য উর্বশী, মেনকা, রম্ভা, তিলোত্তমা, সুপ্রিয়ার মত ৬০ কোটি কাম-কলা পটীয়সী বারবনিতা ছিল। তারপরও ওই সব কামুক দেবতারা পরস্ত্রী দেখলেই অজাচারি ও ধর্ষক হয়ে পড়তেন। যেমনি হয়েছেন চন্দ্র। সাতশ টি বৌ আর ৬০ কোটি অপ্সরা নামের বারবনিতার দখল নেয়া সত্ত্বেও দেবগুরু তারার রূপে এমনই কামার্ত হয়ে পড়েন যে তাকে অপহরণ করেন। মহর্ষি উপথ্যের স্ত্রী ভদ্রাকে দেখে জলের দেবতা বরুণ কামনাপীড়িত হন, এবং অপহরণ করেন। এই সমস্ত অনৈতিক ব্যাপার-স্যাপার গুলোই ঐতিহ্যের নামে কালচারের নামে নানা রঙে, নানা ঢঙ্গে হিন্দু ধর্মের ঔদার্যের পায়েস হিসেবে জনগণকে ইদানীং খাওয়ানো হচ্ছে। আর বলা হচ্ছে হিন্দু ধর্মের উদারতার কোন শেষ নেই।হিন্দু ধর্মের উদারতা এতটাই বেশি যে, সেক্সের নামে ধর্ষণও জায়েজ। কোন নারী যৌনমিলন প্রত্যাখ্যান করলে বৃহদারন্যক উপনিষদ ( বৃহ, ৬,৪,৬,৭) বলছে তাকে জোর করে বাধ্য করা উচিৎ।

অশ্বমেধ যজ্ঞ বলে একটা যজ্ঞ প্রচলিত ছিল প্রাচীন কালে। এ নিয়ে কথা কিছু বলা যাক। বাজসনেয়ী সংহিতার ২২-২৩ অধ্যায় থেকে জানতে পারা যায়, অশ্বমেধ যজ্ঞে প্রধান জাদু পুরোহিত প্রধান রাণীর সঙ্গে প্রকাশ্যে যজ্ঞ-ক্ষেত্রের সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে মিলনে মেতে উঠতেন। অন্যান্য রানি পুরোহিতরা যৌন-মিলনের নানা উত্তেজক দৃশ্যের বর্ণনা দিতে থাকতেন উচ্চস্বরে। সব মিলিয়ে (অশ্বমেধ যজ্ঞের) পরিবেশটা হল জীবন্ত খিস্তি-খেঁউড় সহযোগে তা রিলে করে যজ্ঞে হাজির নারী-পুরুষের মধ্যে যৌন-উত্তেজনা ছড়িয়ে দেওয়া। পরবর্তী যুগে অশ্বমেধ যজ্ঞে পুরোহিতের জায়গা নেয় যজ্ঞের অশ্বটি। যজ্ঞে নাকি প্রধানা রানী অশ্বের লিঙ্গটি নিয়ে নিজের যোনির সাথে স্পর্শ করাতেন।

বাইবেলেও অজাচার তথা ‘ধর্মীয় নৈতিকতার’ অনেক কাহিনি আছে।  হাবিল কাবিলের কথা তো এই প্রবন্ধের প্রথমেই বলেছি। এর বাইরেও আছে হাজারটা অজাচার প্রমোট করা উপাখ্যান। তার মধ্যে আব্রাহাম এবং সারার পরিণয়ের কথা উল্লেখ্য। সারা ছিলেন আব্রাহামের বোন (হাফ সিস্টার)। তাকেই বিয়ে করেছিলেন আব্রাহাম। বাইবেলে আয়াত উদ্ধৃত করি – ‘সারা আমার স্ত্রী, আবার আমার বোনও বটে। সারা আমার পিতার কন্যা বটে, কিন্তু আমার মাতার কন্যা নয়’(আদি পুস্তক, ২০:১২)। বাইবেলে আছে অম্রম এবং যোকেবদের কথাও। যোকেবদ ছিলেন অম্রমের পিসি এবং একই সাথে তার স্ত্রী (যাত্রাপুস্তক, ৬:২০)। বাইবেল (সামুয়েল ২ – ১৩) থেকে আমরা পাই অম্নোন এবং তামরের কাহিনি। অম্লোন ছিলেন দাউদের পুত্র এবং তামর ছিল তার বোন। অম্লোন তাকে মনে মনে কামনা করতেন। শিমিযের পুত্র যোনাদব অম্নোনের বন্ধু ছিলেন।  যোনাদবের পরামর্শে অম্লোন একদিন অসুস্থ হয়ে পড়ে ছিলেন, তামর তার বাসায় সেবা সুস্রষা করতে আসলে সুযোগ বুঝে অম্লোন তাকে ধর্ষণ করে এবং ধর্ষণের পর বাড়ি থেকে বের করে দেয় (সামুয়েল ২:৮ – ১৫) ।  তবে সবচেয়ে জম্পেশ হচ্ছে লুত এবং তার কন্যাদের অজাচারের কাহিনি।  এই কাহিনির সূত্রপাত যখন ঈশ্বর অনৈতিকতার অপরাধে সডোম এবং গোমরাহ নগরী ধ্বংস করেন। যদিও বাইবেলে কোথাও স্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই, মোল্লারা খুব নিশ্চিত হয়েই বলেন  অনৈতিকতার কারণ ছিল ‘সমকামিতা’।  তা ভাল। সমকামিতার কারণে নগর ধ্বংস করলেন যে ঈশ্বর, তিনিই আবার পিতা এবং কন্যাকে অজাচারে উৎসাহিত করে মানব জাতি টিকিয়ে রাখার সুমহান উদ্যোগ নিলেন, এবং একে উদযাপিত করলেন আনন্দের সাথেই।

ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় বাইবেলের আদি পুস্তকে (আদিপুস্তক ১৯: ২৯-৩৮)। কাহিনিটা এরকমের।

ঈশ্বর (সডোম এবং গোমরাহ)উপত্যকার সমস্ত নগর ধ্বংস করলেন। কিন্তু ঈশ্বর ঐ নগরগুলি ধ্বংস করার সময় অব্রাহামের কথা মনে রেখেছিলেন এবং তিনি অব্রাহামের ভ্রাতুষ্পুত্রকে ধ্বংস করেন নি। লুত ঐ উপত্যকার নগরগুলির মধ্যে বাস করছিলেন। কিন্তু নগরগুলি ধ্বংস করার আগে ঈশ্বর লুতকে অন্যত্র পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

পয়গম্বর লুত যোয়ার শহরে গিয়ে এক পাহাড়ে দুই মেয়েকে নিয়ে বাস করতে লাগলেন। তিনি শহরে বাস করতে ভয় পাচ্ছিলেন আর আর সেই কারণে পাহাড়ের একটি গুহায় বাস করতে লাগলেন।

বড় কন্যাটি তার ছোট বোনটিকে বললো, “আমাদের পিতা বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। এবং নগরী ধ্বংস হয়ে যাবার পর আমাদের সন্তানাদি দিতে পারে এমন অন্য পুরুষ এখানে নেই। চল আমরা আমাদের বাবাকে  মদ খাইয়ে করিয়ে মাতাল করে ফেলি এবং তার সাথে সঙ্গমের বন্দোবস্ত করি – যাতে করে আমরা আমাদের বাবার বীজকে সংরক্ষণ করতে পারি। আমাদের পরিবার রক্ষা করার জন্যে আমরা এইভাবে আমাদের পিতার সাহায্য নেব!”

অতঃপর তারা সেই রাত্রে তাদের বাবাকে মদ্যপান করালো এবং প্রথম কন্যাটি তার সাথে রাত্রি যাপন করলো। কখন মেয়েটি আসলো, রাত্রি যাপন করলো এবং উঠে চলে গেলো, তিনি (পয়গম্বর লুত) কিছুই জানতে পারলেন না।

পরের রাত্রে প্রথম কন্যাটি তার ছোট বোনটিকে বললো, “গত রাত্রে আমি পিতার সঙ্গে এক বিছানায় শুয়েছি। আজ রাতে আবার তাঁকে দ্রাক্ষারস পান করিয়ে বেহুঁশ করে দেব। তাহলে তুমি তাঁর সঙ্গে যৌনসঙ্গম করতে পারবে। এভাবে আমরা সন্তানাদি পেতে আমাদের পিতার সাহায্য নেব। এতে আমাদের বংশধারা অব্যাহত থাকবে”।

অতঃপর সেই রাত্রেও তারা তাদের বাবাকে মদ্যপান করালো এবং ছোট কন্যাটি তার সাথে রাত্রি যাপন করলো। কখন মেয়েটি আসলো, রাত্রি যাপন করলো এবং উঠে চলে গেলো, তিনি (পয়গম্বর লুত) কিছুই জানতে পারলেন না।

আর এভাবেই পয়গম্বর লুতের দুই মেয়ে তাদের পিতার ঔরসজাত সন্তান গর্ভে ধারণ করলো। প্রথম কন্যার গর্ভে একটি ছেলে সন্তান জন্ম হলো – যার নাম রাখা হলো মোয়াব। তিনিই হলেন মোয়াবাইটস জাতির পিতা (অর্থাৎ তার বংশধরেরা মোয়াবাইটস নামে পরিচিতি লাভ করলো)। ছোট কন্যাটিও এক পুত্র সন্তানের জন্ম দিল। তার নাম বিন্-অম্মি। বর্তমানে য়ে অম্মোন জাতি আছে তাদের আদিপুরুষ হলেন বিন্-অম্মি।

এই হচ্ছে বাইবেলের সুমহান নৈতিকতার কাহিনি। কিন্তু কেবল অজাচারই নয়, কেউ যদি পুরো বাইবেলটি পড়েন ঈশ্বরের নামে খুন, রাহাজানি, ধর্ষণকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। বর্বরতার কিছু উদাহরণ তো দেওয়া যেতেই পারে। যুদ্ধজয়ের পর অগণিত যুদ্ধবন্দিকে কব্জা করার পর মুসা  নির্দেশ দিয়েছিলেন ঈশ্বরের আদেশ হিশেবে সমস্ত বন্দী পুরুষকে মেরে ফেলতে, আর কুমারীদের বাঁচিয়ে রাখতে যাতে তারা ইচ্ছে মত ধর্ষণ করতে পারে:

‘এখন তোমরা এই সব ছেলেদের এবং যারা কুমারী নয় এমন সব স্ত্রী লোকদের মেরে ফেল; কিন্তু যারা কুমারী তাদের তোমরা নিজেদের জন্য বাঁচিয়ে রাখ’ (গণনা পুস্তক, ৩১: ১৭-১৮)।

এই ভার্সের মূলকথাই হল,সবাইকে মেরে ফেল, কেবল কুমারীদের বাঁচিয়ে রাখ যাতে ইচ্ছে মত ধর্ষণ করা যায়।  একটি হিসেবে দেখা যায়, মুসার নির্দেশে প্রায় ১০০,০০০ জন তরুণ এবং প্রায় ৬৮,০০০ অসহায় নারীকে হত্যা করা হয়েছিল। এছাড়াও নিষ্ঠুর, আক্রমণাত্মক এবং অরাজক বিভিন্ন ভার্সসমূহের বিবরণ পাওয়া যায় যিশাইয় (২১: ৯), ১ বংশাবলী (২০:৩), গণনা পুস্তক (২৫: ৩-৪), বিচারকর্তৃগন (৮: ৭), গণনা পুস্তক (১৬: ৩২-৩৫), দ্বিতীয় বিবরণ (১২: ২৯-৩০), ২ বংশাবলী (১৪:৯, ১৪:১২), দ্বিতীয় বিবরণ (১১: ৪-৫), ১ শমূয়েল (৬:১৯), ডয়টারনোমি (১৩:৫-৬, ১৩:৮-৯, ১৩:১৫), ১ শমূয়েল (১৫:২-৩), ২ শমূয়েল (১২:৩১), যিশাইয় (১৩: ১৫-১৬), আদিপুস্তক (৯: ৫-৬) প্রভৃতি নানা জায়গায়।

বিশ্বাসী খ্রিষ্টানরা সাধারণতঃ বাইবেলে বর্ণিত এই ধরনের নিষ্ঠুরতা এবং অরাজগতাকে প্রত্যাখ্যান করে বলার চেষ্টা করেন, এগুলো সব বাইবেলের পুরাতন নিয়মের (ইহুদীদের ধর্মগ্রন্থ) অধীন, যীশু খ্রিষ্টের আগমনের সাথে সাথেই আগের সমস্ত অরাজগতা নির্মূল হয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। এটি সত্য নয়। বাইবেলের নতুন নিয়মে যীশু খুব পরিষ্কার করেই বলেছেন যে তিনি পূর্বতন ধর্মপ্রবর্তকদের নিয়মানুযায়ীই চালিত হবেন :

এ কথা মনে কোর না, আমি মোশির আইন-কানুন আর নবীদের লেখা বাতিল করতে এসেছি। আমি সেগুলো বাতিল করতে আসি নি বরং পূর্ণ করতে এসেছি’ (মথি, ৫: ১৭)।

খ্রিষ্ট ধর্মের অনুসারীরা যেভাবে যীশুকে শান্তি এবং প্রেমের প্রতীক হিসেবে বর্ণনা করে থাকেন, সত্যিকারের যীশু ঠিক কতটুকু প্রেমময় এ নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। যীশু খুব স্পষ্ট করেই বলেছেন যে :

‘আমি পৃথিবীতে শান্তি দিতে এসেছি এই কথা মনে কোর না। আমি শান্তি দিতে আসি নাই, এসেছি তলোয়ারের আইন প্রতিষ্ঠা করতে। আমি এসেছি মানুষের বিরুদ্ধে মানুষকে দাঁড় করাতে; ছেলেকে বাবার বিরুদ্ধে, মেয়েকে মায়ের বিরুদ্ধে, বৌকে শাশুড়ির বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে এসেছি’ (মথি, ১০: ৩৪-৩৫)।

ব্যভিচার করার জন্য শুধু ব্যভিচারিণী নন, তার শিশুসন্তানদের হত্যা করতেও কার্পণ্য বোধ করেন না যীশু:

‘সেইজন্য আমি তাকে বিছানায় ফেলে রাখব, আর যারা তার সঙ্গে ব্যভিচার করে তারা যদি ব্যভিচার থেকে মন না ফিরায় তবে তাদের ভীষণ কষ্টের মধ্যে ফেলব। তার ছেলেমেয়েদেরও আমি মেরে ফেলব ‘(প্রকাশিত বাক্য, ২: ২২-২৩)।

এই ধরণের শ্লোক এবং আয়াতগুলো সঠিকভাবে উল্লেখ করলে শিশুরা কি শিখবে? আমি চাই দেশের কেষ্টবিষ্টুরা আমাদের কোমলমতি শিশুদের যখন ধর্মীয় নৈতিকতা শেখানোর দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছেন, তখন, তাদের সবকিছু ঠিক ঠাক মত শেখানো হোক। তারা খণ্ডিত নৈতিকতা জেনে বড় হবে কেন!

আর নৈতিকতার ব্যাপার যখন আসছেই, যুদ্ধবন্দিনীদের ব্যাপারে ধর্মীয় যে আয়াতগুলো আছে সেগুলোরই বা কি হবে? ধর্মীয় নৈতিকতা শেখাতে গেলে কি সেগুলো আসবে না? মুহম্মদের প্রথম জীবনীকার ইবনে ইসহাক তার ‘সিরাত রসুলাল্লাহ’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন, মুসলমানরা বানু হাওয়াজিন গোত্রকে পরাজিত করার পরে  প্রায় ৬ হাজার নারী ও শিশুর দখল নিয়ে নেয়। যুদ্ধ থেকে সংগৃহীত নারীরা ইসলামী যোদ্ধাদের মধ্যে বন্টিত হয়। যেমন, রায়হানা নামের এক সুন্দরী ইহুদিনী নারীকে নবী নিজের জন্যেই নির্বাচিত করেন। রায়তা নামের সুন্দরী বন্দিনীটি হযরত আলী তার জন্য নেন, জয়নব নামের আরেক যুদ্ধবন্দী নারী পড়ে আবার হযরত ওসমানের ভাগে। হযরত ওমর আবার তিনি নিজে না নিয়ে ভোগ করার জন্যে তা প্রিয় পুত্র আব্দুল্লাহর হাতে তুলে দেন বলে কথিত আছে। শুধু রায়হানা নয়, জাওয়াহিরা এবং সাফিয়া নামের আরও দুই রক্ষিতা ছিল নবীর। জওয়াহিরা তার হাতে আসে বানু আল-মুস্তালিক অভিযান থেকে, সাফিয়া আসে খায়বারের বানু নাজির গোত্রের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযান থেকে।  এমনকি কিছু হাদিসে উল্লিখিত আছে যে, যুদ্ধজয়ের পর স্বামীর সামনে কিংবা জীবিতাবস্থায় স্ত্রীকে ধর্ষণেরও নির্দেশ দিয়েছিলেন মহানবী (দেখুন এখানে)। একবার যুদ্ধজয়ের পরে কোন কোন সাহাবী বন্দিনীদের সাথে সহবাস করতে বিরত থাকতে চাইছিলেন, কারণ তাদের স্বামীরা ছিল জীবিত, কিন্তু মহানবী উপায় বাৎলে দিলেন, ‘তার যদি স্বামী জীবিত থাকে, বন্দী হওয়ার পর সে বিবাহ বাতিল বলে গণ্য হবে’। (কোরআন-৪:২৪, সহি মুসলিম-৮:৩৪৩২)।

সহি মুসলিম, বুক নং-৮, হাদিস নং-৩৪৩২ থেকে জানা যায়:

আবু সাইদ আল খুদরি (রাঃ) বলেছেন যে হুনায়েনের যুদ্ধকালে আল্লাহর রাসুল (দঃ) আওতাস গোত্রের বিরুদ্ধে একদল সৈন্য পাঠান। তারা তাদের মুখোমুখি হলো এবং তাদের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলো। যুদ্ধে পরাজিত করার পর কিছু বন্দী তাদের হাতে আসল। রাসুলুল্লার কিছু সাহাবি ছিলেন যারা বন্দিনীদের সাথে সহবাস করতে বিরত থাকতে চাইলেন, কারণ তাদের স্বামীরা ছিল জীবিত, কিন্তু বহু ঈশ্বরবাদী। তখন মহান আল্লাহ এ সম্পর্কিত আয়াতটি নাজেল করলেন- “এবং বিবাহিত নারীগণ তোমাদের জন্যে অবৈধ, তবে যারা তোমাদের দক্ষিণ হস্তের অধিকারে আছে তাদের ছাড়া”।

বলা বোধ হয় নিষ্প্রয়োজন, ‘তোমাদের দক্ষিণ হস্তের অধিকারে’ [Ma malakat aymanukum, ما ملكت أيمانکم)] একটি আরবি ফ্রেস, যার অর্থ দাস, দাসী এবং যুদ্ধবন্দিনী। ডিকশনারি অব ইসলাম থেকে জানা যায়, দাসী যদি বিবাহিতাও হয়, তাকেও অধিকারে নেয়ার ক্ষমতা আছে মনিবের – সুরা ৪:২৪; “তোমাদের দক্ষিণ হস্ত যাদের অধিকারী- আল্লাহ তোমাদের জন্যে তাদেরকে বৈধ করেছেন”। এই আয়াতের ব্যাখ্যায় জালালাইন বলেন- “অর্থাৎ, যাদেরকে তারা যুদ্ধের ময়দানে আটক করেছে, তাদের সাথে সহবাস করা তাদের জন্যে বৈধ, যদি তাদের স্বামীগণ জীবিতও থাকে’।

একই ধরণের হাদিস সুনান আবু দাউদ, বই ১১ হাদিস ২১৫০ এবং আরো বহু জায়গাতেই পাওয়া যায়।  আবুল কাশেম একটা সময় তার গবেষণালব্ধ সিরিজ ইসলামে বর্বরতা (নারী-অধ্যায়—৯) এধরণের বেশ কিছু হাদিস সংকলিত করেছিলেন। পাঠকদের সেগুলো পুনর্বার পড়ার অনুরোধ করছি। পাশাপাশি, কোরানের ৮:৬৯, ৪:৩, ৪:২৪, ২৩: ৫-৬, ৩৩:৫০, ৭০:২২-৩০, এবং সহি বুখারির ৫:৫৯:৪৫৯, ৮:৭৭:৬০০, ৩:৩৪:৪৩২; সহি মুসলিম ৮:৩৪৩২, ৮:৩৪৩৩, ৮:৩৩৭১, ;  আবু দাউদ ২: ২১৫০, ১১: ২১৫০, ১১: ২১৫৩, ৮: ৩৩৮৩, ৩১:৪০০৬ প্রভৃতি আয়াতগুলো (দেখুন এখানে) পড়লে বোঝা যায়, পাকিস্তানী সৈনিকেরা একাত্তরে বাংলাদেশের নারীদের উপর যা করেছিলো তা ধর্মসম্মত এবং ধর্মপ্রচারকদের দ্বারা নির্দেশিত।  কিন্তু স্কুলের শিশুরা সেগুলো জানবে না। তারা বড়জোর জানবে, কাদের মোল্লা কিংবা বাচ্চু রাজাকারদের মত লোকজন যারা বাঙালি নারীদের মালে গনিমত ভেবে দেদারসে ধর্ষণ করেছে, তাদের কাজ ছিল একেবারেই  অনৈসলামিক।   তারা জানবে না একাত্তরে মালে গনিমত কাদের বানানো হত, আর কেনই বা রাজাকারেরা বিধর্মী নারীদের ‘মালে গনিমত’ বানিয়ে হানাদার বাহিনীর হাতে তুলে দিত, কিংবা  নিজেরাই মনের সুখে ধর্ষণে ঝাঁপিয়ে পড়তো।

এভাবেই ধর্মগুলো টিকে থাকে। আক্রমণাত্মক, মানহানিকর, লজ্জাকর এবং অমানবিক আয়াতগুলো যেগুলো নারীদের অবদমনে,  বিধর্মীদের কতল করতে কিংবা হানাহানি দাঙ্গা ফ্যাসাদে অহরহ ব্যবহৃত হয়, সেগুলোই আবার ধর্মের মাহাত্ম্য প্রচারের সময় সুযোগ বুঝে চেপে যাওয়া হয়, আর ভাল ভাল কথামালা ধর্মের নামে নৈবদ্য আকারে প্রচার করা হয়। কিন্তু তারপরেও শেষ রক্ষা হয় না। গৈরিক লেবাসের ফাঁক গলে বেরিয়ে পরে সত্যিকার নগ্ন চেহারা মাঝে সাঝেই। এমনি একটি চেহারার উন্মত্ত প্রকাশ দেখতে পাওয়া গিয়েছিল  কিছুদিন আগে।  মুক্তমনা ব্লগার আদিল মাহমুদ ‘ধর্মশিক্ষার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতার সরল পাঠ’ নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিরিজ লিখছিলেন মুক্তমনায় ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। তিনি সেসময়কার বাংলাদেশের সরকারী শিক্ষা বোর্ডের নবম-দশম শ্রেণীর ‘ইসলাম-শিক্ষা’ বইটির (তখন বইটির নাম এ বছরের মতো  ‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’ ছিল না) কিছু স্ক্যান করা পৃষ্ঠা উদ্ধৃত করেছিলেন, যা রীতিমত আতঙ্কজনক। বইটিতে ‘কুফ্‌র’ কী, ‘কাফির কারা’ এ সংক্রান্ত আলোচনা আছে, যা রীতিমত সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষপ্রসূত। অবিশ্বাসীরা হল কাফের; তারা অকৃতজ্ঞ, যাদের দুনিয়ায় কোন মর্যাদা নাই, তারা অবাধ্য ও বিরোধী, জঘন্য জুলুমকারী, হতাশ/নাফরমান।

একই বইয়ের ৫৩ পাতায় বেশ গুরুত্ব সহকারে জিহাদ সম্পর্কিত শিক্ষা বর্ণিত হয়েছে। শুধু জিহাদের সংজ্ঞা নয়, কিভাবে এবং কাদের বিরুদ্ধে জিহাদ চালিয়ে আল্লাহর মনোনীত দ্বীন ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে হবে তা স্পষ্ট ভাষাতেই বর্ণনা করা হয়েছে রেফারেন্স সহকারে –

বাংলাদেশের ইসলাম-শিক্ষা বইটির এই অংশটুকু পড়লে কিন্তু অনেকেরই মনে হবে বিন লাদেন, বাংলা ভাই, শায়খ রহমানদের সন্ত্রাসী বলা এই ধর্মশিক্ষার আলোকে মোটেই যুক্তিসংগত নয়। আদিল মাহমুদ যৌক্তিক ভাবেই প্রশ্ন করেছিলেন, ‘বাংলা ভাই/শায়খ রহমানকে সন্ত্রাসী বলা এই ধর্মশিক্ষার আলোকে কতটা যুক্তিসংগত? বেচারারা তো পরিষ্কার আল্লাহর আইনই প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিকুল শক্তির বিরুদ্ধে জেহাদ করছিল’। বইটি পড়লে আরো মনে হবে ইসলাম শিক্ষা বইটি যেন ইমাম আল গাজ্জালির উগ্র আদর্শের আলোকে লেখা হয়েছে যিনি ইসলামের মধ্যে মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারী মোতাজিলাদের মুক্তবুদ্ধিকে এক সময় ধ্বংস সাধন করেন নির্মমভাবে।আদিল মাহমুদ আরো কিছু রেফারেন্স দিয়েছিলেন ইসলাম শিক্ষা বইটি থেকে। তার ভাষ্য মতে,

‘বইটিতে সবই যে এমন ধরনের কথাবার্তা আছে তা না, যে কোন ধর্মগ্রন্থতেই বেশ কিছু ভাল ভাল কথাবার্তা, সদুপদেশ যেমন পাওয়া যায় তেমন এখানেও আছে। সত নাগরিক, সুসন্তান,সুপ্রতিবেশী হবার সুপরামর্শ, দেশসেবা/সমাজ সেবার, গুরুত্ব এ জাতীয় বিষয় ধর্মের আলোকে জোর দেওয়া হয়েছে যেগুলি প্রশংসনীয়ই বলা চলে। যদিও এগুলির ফাঁকেও ফাঁকেও কায়দামত কিছু কিছু যায়গায় সাম্প্রদায়িক চেতনা ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে ঠিকই। যেমন ৫৬ পৃষ্ঠায় প্রতিবেশীর হক আলোচনায় মুসলমান প্রতিবেশীর হক বেশী এমন ধারনা সরাসরি দেওয়া হচ্ছে। ৭৪ পৃষ্ঠায় বন্ধু নির্বাচনের একটি গাইড লাইন হিসেবে মহাত্মা ইমাম গাজ্জালি (রঃ) এর রেফারেন্স দিয়ে বলা হচ্ছে যে লোক কোরান সুন্নাহর পরিপন্থী কাজে লিপ্ত তাকে ত্যাগ করা কর্তব্য বলে। এই গাইড লাইন মেনে পাশের বাড়ির পৈতা পরিহিত, মূর্তিপূজক হিন্দু কিংবা গলায় ক্রুশ ঝোলানো খৃষ্টানের সাথে বন্ধুত্ব করা নিশ্চয়ই সম্ভব নয়। পৈতা পরা, ক্রুশ পরা যে আল্লাহর কাছে অমার্জনীয় অপরাধ কুফরের লক্ষণ সেটা তো আগেই পরিষ্কার করা হয়েছে’।

আমার খুব ইচ্ছে করছিল আমাদের এত সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এবারের নবম-দশম শ্রেণীর জন্য বরাদ্দকৃত ‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’ বইটিতে ঠিক  কি ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে, বা আদৌ কোন কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে কিনা জানতে! কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ ন্যাশনাল কারিকুলাম এণ্ড টেক্সটবুক বোর্ডের সাইটে গিয়ে নবম দশম শ্রেণীর বইটি নামানোর লিঙ্ক পাওয়া গেল না। অন্য সকল শ্রেণীর ইসলাম ধর্মের বইয়ের লিঙ্ক আছে, কিন্তু নবম দশম শ্রেণীরটা নেই। এ বড় অদ্ভুত ঠেকল আমার কাছে।  তবে কি আত্মমণাত্মক আয়াত আর জিহাদি ব্যাখ্যা একটু মোলায়েম করার দরকার পড়েছে?  বাংলা বইয়ের ডাউনলোডের লিঙ্ক না থাকলেও ইংরেজি মিডিয়ামের ছাত্রদের জন্য বরাদ্দকৃত বইয়ের একটা লিঙ্ক পাওয়া গেল (এখানে)।  সেটাতে গিয়ে প্রাথমিকভাবে খুব একটা ভিন্নতা যে পেলাম তা নয়। ৯ নং এবং ১০ নং পৃষ্ঠায় যথারীতি কাফিরদের ভর্ৎসনা করা হয়েছে। আদিল মাহমুদ উপরে যে বাংলা বইয়ের স্ক্রিনশট দিয়েছিলেন, সেই পয়েন্টগুলোই হুবহু ইংরেজিতে তুলে ধরা হয়েছে। কাফিরদের সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে অকৃতজ্ঞ,(Ingratitude), অবাধ্য ও বিরোধী (Disobidience)।কুফর একটি জঘন্য জুলুম (Promotion of Sinfulness),তারা  অনৈতিকতা ছড়ায় (Spread of Immorality) তাদের জন্য রয়েছে হতাশা (Despair Raises)এবং অনন্তকালের শাস্তি (Eternal Punishment)  ইত্যাদি।  এর পর গেলাম বিখ্যাত জিহাদ অংশে। সেটা পাওয়া গেল ১০৬ – ১০৭ পৃষ্ঠার দিকে। গিয়ে একটু অবাকই হলাম। বাংলাতে যেভাবে ‘প্রকাশ্য জিহাদ’ আর  ‘অপ্রকাশ্য  জিহাদ’ বলে মোটাদাগে জিহাদ শেখানোর পায়তারা দেখেছিলাম, ইংরেজিতে যেন অনেকটা মোলায়েম। সেখানেও দুটো পয়েন্ট করে বর্ণনা আছে বটে, কিন্তু ‘প্রকাশ্য জিহাদ’ আর  ‘অপ্রকাশ্য  জিহাদ’ এর ইংরেজি হিসেবে যেরকম ভাবে direct Jihad এবং indirect Jihad গোত্রের কিছু অবধারিতভাবে আশা করছিলাম সেরকম কিছু নেই।   তবে বাংলা বইয়ের দুটি পয়েন্টের বদলে ইংরেজি বইয়ে জিহাদের পয়েন্ট (প্রকারভেদ?) তিনটি। প্রথম পয়েন্টে জিহাদের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে এটা নিজের অশুভত্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ (To fight against one’s own evil self(Nafs))।  ২য় পয়েন্টটা আরো মজার। এখানে জিহাদের ব্যাখ্যা হিসেবে বলা হয়েছে ‘জ্ঞানের মাধ্যমে জিহাদ’ (To conduct Jihad with the help of knowledge) ।  তবে মজার ব্যাপার হল, জ্ঞানের মাধ্যমে যুদ্ধের আয়াত হিসেবে যা উদ্ধৃত হয়েছে তার সারমর্ম  হল, অবিশ্বাসীদের অমান্য (disobey) কর আর তাদের সাথে বড় সড় যুদ্ধে (‘big fight’) যাও –

বিধর্মীদের প্রতি তীব্র আক্রমণাত্মক এই বাণী কি করে জ্ঞানার্জনের সাথে সম্পর্কিত হল তা আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে বোধগম্য হল না। আর এ বইয়ে বলা হয়েছে  কোরানের মতানুযায়ী এটা নাকি  ‘গ্রেটেস্ট জিহাদ’ ।  বিন লাদেনদের কথা যদি বাদও দেই, বাঁশের কেল্লা আর আমার দেশের সম্পাদকেরা যে এ পয়েন্টের আওতায় বেহেস্তবাসী হবেন এটা নিশ্চিত।

তবে এখানে থামলেও না হয় চলত। বক্তব্য একটু ঘোলা হয়ে যাচ্ছে ভেবে এই দুই জিহাদের বাইরে আরেক জিহাদের আমদানি করা হয়েছে। এটাই সেই জিহাদ যেখানে  ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। আর গ্রন্থকারের মতে এটাই জিহাদের সর্বোচ্চ স্তর (highest level of Jihad)।

তবে মজার এখানেই শেষ নয়। এত যুদ্ধংদেহী কথাবার্তা বলতে গিয়ে কিছুটা ক্লান্তি অথবা অস্বস্তির কারণেই কিনা জানিনা, কিংবা মুক্তমনায় ইসলাম শিক্ষা বইটির সমালোচনা প্রকাশের কারণেই কিনা জানিনা, বইয়ের ১০৭ পৃষ্ঠায় ‘জিহাদ এণ্ড টেরোরিজম’ নামে একটি নতুন অনুচ্ছেদ যোগ করা হয়েছে।  সেই অনুচ্ছেদে ইনিয়ে বিনিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে জিহাদের সাথে সন্ত্রাসের আসলে কোনই যোগ নেই । যারা জিহাদের সাথে সন্ত্রাসকে এক করে দেখেন তাদের জ্ঞানগম্মি নেহাতই কম –

এখন কথা হচ্ছে জিহাদের সাথে সন্ত্রাসের কোন যোগ যদি নাই থাকে তবে এই ‘মূল্যবান অংশ’টি কেন কেবল জিহাদ নিয়ে আলোচনার পরেই যোগ করা হয়েছে? ১৭৮ পৃষ্ঠার এই দীর্ঘ বইটিতে আখিরাত, সালাত, ইবাদত, ফিতনা, ফ্যাসাদ, গীবত, আখলাক, তাকওয়া, কেয়ামত সহ এমন কোন বিষয় নেই যা আলোচনা করা হয়নি, অথচ কেবল জিহাদের পরেই হুড়মুড় করে  ‘জিহাদ এণ্ড টেরোরিজম’ অনুচ্ছেদ যোগ করতে হল! শিশুদের নৈতিকতা শিখাতে গিয়ে ‘ঠাকুর ঘরে কে রে, আমি কলা খাইনা’ সিন্ড্রোম প্রকাশ করে দিচ্ছেন না তো?

দুই

ছোটবেলায় একটা গল্প ছিল আমাদের পাঠ্যপুস্তকে। এক বুড়ি নাকি মুহাম্মদ (সাঃ)র চলার পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখতো, প্রতিদিনই।  মহানবী প্রতিদিনই কষ্ট করে পায়ের কাঁটা তুলে ফেলতেন, আর পথ দিয়ে হেঁটে যেতেন। তারপর একদিন পথ দিয়ে হাটতে গিয়ে দেখেন কোন কাঁটা নাই। মুহাম্মদ (সাঃ) বুড়ির বাসায় গিয়ে হাজির হলেন বুড়ি অসুস্থ কিনা জানার জন্য। যে বুড়ি মহানবীর চলার পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখতেন, সে বুড়িকে ক্ষমা করে দিয়ে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন নবী মুহম্মদ। মুশকিল হল, কিন্তু বড় হয়ে খোঁজ খবর নিয়ে দেখলাম, এই গল্পের কোন সত্যতা নাই। বরং জানলাম, মুহম্মদের বিরুদ্ধে স্যাটায়রধর্মী কবিতা লেখার ‘অপরাধে’ বরং তিনি আবু আফাক নামের  এক শতবছরের বয়োবৃদ্ধ কবিকে হত্যা করেছিলেন। হত্যা করা হয়েছিল আসমা বিনতে মারওয়ান নামের আরেক নারী কবিকেও। নবীর নির্দেশে হত্যা করা হয়েছিল ক্কাব ইবনে আশরাফকেও। বুড়ির ঘটনার কোন প্রমাণ না পাওয়া গেলেও, উপরে উল্লিখিত কবিদের  ঘটনাগুলোর সমর্থনসূচক হাদিস পাওয়া যায় অনেক। এগুলো সত্য বলেই মুহম্মদের পরবর্তীকালের অনুসারীরা মুহম্মদের প্রদর্শিত কাজগুলোই ভাইরাসের মত কপি করে করে একনিষ্ঠ-ভাবে পালন করেছেন বিভিন্ন সময়ে। ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ লিখার অপরাধে সালমান রুশদীকে হত্যার ফতোয়া দেয়া হয়েছিল খোমেনির পক্ষ থেকে ১৯৮৯ সালে।  কয়েক বছর আগে আগে ডাচ চলচ্চিত্রকার থিও ভ্যানগগকে ও একইভাবে হত্যা করা হয় ‘ইসলামকে অপমান’ করার অজুহাতে।   আমাদের দেশে হুমায়ুন আজাদ, আসিফ মহিউদ্দীন কিংবা থাবা বাবার উপর জিহাদি আক্রমণও এই ‘বিশ্বাসের ভাইরাসের’ই সংক্রমণ বললে অত্যুক্তি হয় না। অনেকেরই হয়তো মনে আছে, থাবা বাবা ওরফে রাজীব হত্যার পর পরই আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের পক্ষ থেকে একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়া হয়। সে ভিডিওতে খুব স্পষ্ট করেই বলা হয়েছিল,  নবী মুহম্মদ যেভাবে ক্কাব ইবনে আশরাফ, আসমা বিনতে মারওয়ানের মত কবিদের হত্যা করেছিলেন ইসলামের আর নবীর বিষেদগার করার শাস্তি হিসেবে, ঠিক একইভাবে ‘কুলাঙ্গার ব্লোগার’ (ঠিক এভাবেই উচ্চারিত হয়েছে ভিডিওতে) থাবা বাবাকে মেরে ফেলাও জায়েজ হয়েছে।  আমি চাই এই নৈতিকতাগুলোর কথা বইয়ে আসুক।

যিনি সামান্য কবিতা লেখার জন্য এভাবে, এত নির্দয়ভাবে প্রতিপক্ষ কবিদের ধ্বংস করেছেন, বয়োবৃদ্ধ কিংবা নারী বলেও কোন করুণা দেখাননি – তিনি কাঁটা বিছানো বুড়িকে এক লহমায় ক্ষমা করে দেবেন তা বোধ হয় ভাবা যায় না। আসলে ধর্মের পরবর্তীকালের অনুসারীরা তাদের নেতাদের এই নির্দয় কাজ কর্ম দেখে লজ্জিত হয়েছেন বোধ হয়; তারা পরে অনেক ভাল ভাল কথা জুড়ে দিয়ে মিথ্যে একটা মানবিক রূপ দিতে সচেষ্ট হয়েছেন। তাদের এই পরবর্তী সংযোজনগুলো কেবল মিথ, কোন সত্যতা নেই। এরকম অনেক দৃষ্টান্ত আছে। যেমন, ছোটবেলা থেকে আমরা শুনে শুনে বড় হয়েছিলাম, মুহম্মদ (সাঃ) নাকি বলেছেন ‘“জ্ঞানার্জনের জন্য সুদূর চীনে হলেও যাও’। কিন্তু প্রকৃত সত্য হল, এটা তিনি কখনোই বলেননি। এটা একটা জাল হাদিস। একই রকম ভাবে ‘মুসলিমদের ভেতর এমন একজন ব্যক্তিও নেই, যার গুনাহগুলো জুম্মার দিনে ক্ষমা করে দেয়া হয় না’ কিংবা ‘আমি হলাম জ্ঞানের শহর আর আলী তার দরজা’ – এই হাদিসগুলোও জাল। বুখারি, দাউদ, মুসলিম, মুয়াত্তা, কুদসি – কোথাওই এই হাদিসের অস্তিত্ব নেই এগুলো কেবল ছড়ানো হয়েছে ধর্মের বর্বরতাগুলো আড়াল করে একটা মানবিক রূপ দেওয়ার জন্য।

মনে আছে নিশ্চয় বাংলাদেশে নির্বাচনের পর যখন সংখ্যালঘু নির্যাতন শুরু হল, তখন কিছু মডারেট ধর্মবাদীরা কিছু হাদিসের উল্লেখ করে ফেসবুক সয়লাব করে দিলেন  যাতে ‘প্রমাণিত’ হয় যে, হিন্দুদের উপর কত সদয় এই ধর্ম। কিন্তু ব্যাপারটা সেরকম নয়। যে হাদিস নম্বর উল্লেখ করে ছড়ানো হয়েছে, সেই নম্বরে গিয়ে দেখা যায় সেরকম কোন হাদিস নেই। কাছাকাছি কিছু হাদিস আছে (ভিন্ন নম্বর), কিন্তু এগুলো সেগুলো ভিন্ন সময়ে (ধিম্মি সংক্রান্ত) ভিন্ন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এসেছিল, হিন্দুদের ‘রক্ষা’ করার কথা ভেবে নয়।  এব্যাপারে লুক্সের শেষ মন্তব্যটি দেখা যেতে পারে, কিংবা এখানে দুটো লিঙ্ক ( এক, দুই) আছে, কেউ চাইলে বিষদ দেখে নিতে পারেন।

একটা সময় ইন্টারনেট ছিল না। ছিল না কম্পিউটার। এসমস্ত শোনা কথাকে প্রমাণ ধরে মহাপুরুষদের মহিমা প্রচার করা হত, তাদের নবী, রসু্‌ল, পয়গম্বর, দেবদূত বানানো হত। রাখা হত পূজার আসনে বসিয়ে। আজ প্রযুক্তির গতি যেমন বেড়েছে সেই সাথে বেড়েছে মানুষের জ্ঞান, বুদ্ধি এবং সংশয়। এই যুগে মিথ্যে দিয়ে কি আর কালোকে সাদা বানানো যায়?

ধর্মহীন হলে কি সমাজ  অনৈতিক হয়ে যাবে?

আমরা উপরে ধর্ম এবং ধর্মশিক্ষার সাথে নৈতিকতার সম্পর্ক দেখলাম। এবারে একটু বিপরীত চিত্র দেখি, কেমন? এক মাস আগে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোতে, যা হয়তো অনেকেরই চোখ এড়িয়ে গেছে।  খবরের শিরোনাম – ‘অপরাধী কম, তাই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কারাগার’ । ২০১৩ সালের ডিসেম্বর  মাসের ০৩ তারিখে পত্রিকায় প্রকাশিত  সেই সংবাদ থেকে  জানা গিয়েছিল,  সুইডেনের কারাগারগুলো নাকি সব ক্রমশ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বিগত সময়গুলোতে কারাবন্দীর সংখ্যা নাটকীয়ভাবে কমে যাওয়ার ফলেই এই সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে রাষ্ট্রকে।

আমাদের মত দেশ যেটা দুর্নীতিতে শীর্ষস্থানীয়, যেখানে বিশ্ব-বেহায়া এরশাদের মত সুযোগসন্ধানী প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি কিংবা রাষ্ট্রীয় নেতা হবার গৌরব নিয়ে থাকেন, যেখানে কেউ সুযোগ পেলেই অন্যের ঘার ভেঙে, চুরি চামারি কিংবা প্রতারণা করে টু-পাইস কামিয়ে নিতে চায়, তাদের হয়তো ব্যাপারটা অবাক করবে। হয়তো তারা আরো অবাক হবেন জেনে যে, সুইডেন পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষস্থানীয় নাস্তিক-প্রধান দেশ (দেশটিতে নাস্তিকের হার শতকরা ৪৫ থেকে ৮৫ ভাগ হিসেবে উঠে এসেছে বিভিন্ন সমীক্ষায়); এমনি একটি সমীক্ষা  দেয়া হল পাঠকদের জন্য:

আমাদের দশের অনেকেই যারা ধর্ম এবং নৈতিকতাকে এক করে দেখেন, যারা মনে করেন ধর্ম না থাকলেই সমাজ উচ্ছন্নে যাবে, তাদের কাছে ‘প্রায় ধর্মহীন’ সুইডেনে কারাবন্দীদের সংখ্যা এভাবে কমে যাওয়ার উদাহরণটা হয়তো খানিকটা বিস্ময়ের বটে। এর কারণ আছে।  সেই ছেলেবেলা থেকেই নৈতিক চরিত্র গঠনের মূলমন্ত্র হিসেবে তোতা পাখির মতো আমাদের শেখানো হয়েছে নীরক্ত বাক্যাবলী- ‘অ্যাই বাবু, এগুলো করে না। আল্লাহ কিন্তু গুনাহ দিবে’। ছোটবেলা থেকেই এইভাবে নৈতিকতার সাথে ধর্মের খিচুড়ি একসাথে মিশিয়ে এমনভাবে ছেলে-পিলেদের খাওয়ানো হয় যে তারা বড় হয়েও আর ভাবতেই পারে না যে ধর্ম মানা ছাড়াও কারো পক্ষে ভালো মানুষ হওয়া সম্ভব। কিন্তু সত্যিই কি ধর্মের সাথে নৈতিক চরিত্র গঠনের কোনো বাস্তব যোগাযোগ আছে?

ব্যাপারটির অনুসন্ধান করে আমি আমার সহলেখক রায়হান আবীরের সাথে মিলে বছর দুয়েক আগে একটা বই লিখেছিলাম ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ নামে। বইটি লিখতে গিয়ে একাডেমিয়ায় প্রকাশিত বেশ কিছু পরিসংখ্যান নিয়ে আমাদের কাজ করতে হয়েছে, পরিচিত হয়ে হয়েছিল  গবেষকদের প্রাসঙ্গিক কাজের সাথে।  সবচেয়ে আলোচিত ছিল ফিল জুকারম্যানের উদাহরণটি।  ভদ্রলোক ক্যালিফোর্নিয়ার একটি কলেজের সোশিওলজি বিভাগের অধ্যাপক। তিনি ২০০৫ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোতে সমীক্ষা চালিয়েছিলেন। সেসব দেশগুলোতে ঈশ্বরে বিশ্বাস এখন একেবারেই নগণ্য পর্যায়ে নেমে এসেছে। যেমন, সুইডেনের কথা আমরা আগেই বলেছি; সেখানে জনসংখ্যার প্রায় ৮৫ ভাগ এবং ডেনমার্কে প্রায় ৮০ ভাগ লোক এখন ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না । অথচ সেসমস্ত ‘ঈশ্বরে অনাস্থা পোষণকারী’ দেশগুলোই আজ পৃথিবীতে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্থ এবং সবচেয়ে কম সহিংস দেশ হিসেবে চিহ্নিত বলে ফিল সাহেবের গবেষণায় উঠে এসেছিল। ফিল জুকারম্যান তার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে একটি বই লিখেছেন, ‘ঈশ্বরবিহীন সমাজ’ (Society without God: What the Least Religious Nations Can Tell Us About Contentment) শিরোনামে ।

তিনি সেই বইয়ে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন যে, ডেনমার্কের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আরহাসে থাকাকালীন সময়গুলোতে কোনো পুলিশের গাড়ি দেখেন নি বললেই চলে। প্রায় ৩১ দিন পার করে তিনি প্রথম একটি পুলিশের গাড়ি দেখেন রাস্তায়। পুরো ২০০৪ সালে মাত্র একজন লোক হত্যার খবর প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ, সেই ২০০৪ সালে পুরো বছর জুড়ে প্রায় পঁচিশ লক্ষাধিক মানুষ বসবাসকারী মেট্রোপলিটন শহর আরহাসে সংগঠিত খুনের সংখ্যা ছিল এক। এ থেকে বোঝা যায় এ সমস্ত দেশগুলোতে মারামারি হানাহানি কতো কম। শুধু তাই নয়, সাম্প্রতিক সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে ডেনমার্ক পৃথিবীর সবচেয়ে সুখীতম দেশ

মোদ্দাকথা হল – বেশিরভাগ ড্যানিশ এবং সুইডিশ আমাদের দশের মত ধর্ম দ্বারা সংজ্ঞায়িত ‘গুনাহ’ বা পাপ নামক কোনো ব্যাপারে বিশ্বাসী নন অথচ দেশ দু’টিতে অপরাধ প্রবণতার হার পৃথিবীর সকল দেশের তুলনায় সর্বনিম্ন। এই দুই দেশের প্রায় কেউই চার্চে যায় না, পড়ে না বাইবেল। তারা কি অসুখী? ৯১ টি দেশের মধ্যে করা এক জরিপ অনুযায়ী, সুখী দেশের তালিকায় ডেনমার্কের অবস্থান প্রথম, যে ডেনমার্কে নাস্তিকতার হার মোট জনসংখ্যার প্রায় শতকরা আশি ভাগ। স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় মাত্র ২০ শতাংশের মতো মানুষ ঈশ্বরের বিশ্বাস করেন, তারা মনে করেন ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য ঈশ্বরের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বিশ্বাস করেন, মৃত্যুর পরের জগতে। আর বাকিরা স্রেফ কুসংস্কার বলে ছুঁড়ে ফেলেছেন এ চিন্তা।

‘ঈশ্বরহীন’ এইসব সমাজের অবস্থাটা তবে কেমন? দেশগুলো কি সব উচ্ছন্নে গেছে, যেভাবে আমাদেরকে ছোটবেলা থেকে শেখানো হয়েছে? না, তা যায়নি। বরং, সমাজের অবস্থা মাপার সকল পরিমাপ- গড় আয়ু, শিক্ষার হার, জীবন যাপনের অবস্থা, শিশুমৃত্যুর নিম্নহার, অর্থনৈতিক সাম্যাবস্থা, লিঙ্গ সাম্যাবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা, দুর্নীতির নিম্নহার, পরিবেশ সচেতনতা, গরীব দেশকে সাহায্য সবদিক দিয়েই ডেনমার্ক ও সুইডেন অন্যান্য সকল দেশকে ছাড়িয়ে সবচেয়ে উপরে। তবে পাঠকদের আমরা এই বলে বিভ্রান্ত করতে চাই না যে, এইসব দেশে কোনো ধরনের সমস্যাই নেই। অবশ্যই তাদেরও সমস্যা আছে। তবে সেই সমস্যা সমাধানের জন্য তারা যৌক্তিক পথ বেঁছে নেয়, উপর থেকে কারও সাহায্যের অপেক্ষা করে না, কিংবা হাজার বছর পুরনো গ্রন্থ ঘেঁটে সময় নষ্ট করে না। ইহজাগতিক সমস্ত সমস্যার সমাধান ইহজাগতিকভাবেই সমাধানের চেষ্টা এবং উদ্যোগ নিয়েছে তারা।

কেবল ফিল জুকারম্যানের কাজই নয়, অবিশ্বাসের দর্শন বইটিতে আরো অনেক পরিসংখ্যান নিয়েই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছিলাম। আরো কিছু পরিসংখ্যান আসবে আমার পরবর্তী ‘বিশ্বাসের ভাইরাস‘ (প্রকাশিতব্য, ২০১৪) গ্রন্থটিতে। গবেষকদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য থেকে জানা গেছে (মাইকেল শারমারের ‘The Science of Good and Evil’ বইয়ে এ ধরণের বেশ কিছু পরিসংখ্যানের উল্লেখ পাওয়া যাবে), আমেরিকায় নাস্তিকদের চাইতে পুনরুজ্জীবিত খ্রিস্টানদের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদের হার বেশি; এও দেখা গিয়েছে, যেসব পরিবারের পরিবেশ ধর্মীয়গতভাবে অতিমাত্রায় রক্ষণশীল সেসমস্ত পরিবারেই বরং শিশুদের উপর পরিবারের অন্য কোনো সদস্যদের দ্বারা বেশি যৌন নিপীড়ন হয় । ১৯৩৪ সালে আব্রাহাম ফ্রান্সব্লাউ তার গবেষণাপত্রে দেখিয়েছেন ধার্মিকতা এবং সততার মধ্যে বরং বৈরী সম্পর্কই বিদ্যমান। ১৯৫০ সালে মুর রসের গবেষণা থেকে বেরিয়ে এসেছে যে, ধার্মিকদের তুলনায় নাস্তিক এবং অজ্ঞেয়বাদীরাই বরং সমাজ এবং মানুষের প্রতি সংবেদনশীল থাকেন, তাদের উন্নয়নের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেন। ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি ১৯৮৮ সালে ভারতের জেলখানায় দাগী আসামীদের মধ্যে একটি জরিপ চালিয়েছিল। জরিপের যে ফলাফল পাওয়া গিয়েছিল, তা ছিল অবাক করার মতো। দেখা গিয়েছে, আসামীদের শতকরা ১০০ জনই ঈশ্বর এবং কোনো না কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে বিশ্বাসী । আমেরিকায়ও এরকম একটি জরিপ চালানো হয়েছিল ৫ ই মার্চ, ১৯৯৭ তারিখে। সে জরিপে দেখা গেছে যে আমেরিকার জনসাধারণের মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য অংশ (৮-১০%) ধর্মহীন হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে অপরাধ-প্রবণতা কম, সে তুলনায় ধার্মিকদের মধ্যে শতকরা হিসেবে অপরাধ-প্রবণতা অনেক বেশি।  ফেডারেল ব্যুরোর দেয়া পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় জেল হাজতে নাস্তিকর মাত্র ০.২ ভাগ, বাকিরা সবাই ধার্মিক। আমাদের ধারণা আজ বাংলাদেশে জরিপ চালালেও ভারতের মতোই ফলাফল পাওয়া যাবে। ঈশ্বরে বিশ্বাস, পরকালে বিশ্বাস, বেহেস্তের লোভ বা দোজখের ভয় কোনোটাই কিন্তু অপরাধীদের অপরাধ থেকে নিবৃত্ত রাখতে পারে নি। আল্লাহর গোনাহ কিংবা ঈশ্বরের ভয়েই যদি মানুষ পাপ থেকে, দুর্নীতি থেকে মুক্ত হতে পারত, তবে তো বাংলাদেশ এতদিনে বেহেস্তে পরিণত হতো। কিন্তু বাংলাদেশের দিকে তাকালে আমরা আজ কী দেখছি? বাংলাদেশে শতকরা ৯৯ জন লোকই আল্লা-খোদা আর পরকালে বিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও দুর্নীতিতে এই দেশ মাঝেমাঝেই থাকে পৃথিবীর শীর্ষে। ধর্মে বিশ্বাস কিন্তু দেশবাসীকে দুর্নীতিমুক্ত রাখতে পারে নি। পারবেও না। যে দেশে সর্বোচ্চ পদ থেকে বইতে শুরু করে দুর্নীতির স্রোত, যে দেশে গোলাম এরশাদ, শামীম ওসমান, গোলাম আজম, নিজামী, হাজি সেলিম,লালু ফালু, জয়নাল হাজারীর মতো হত্যাকারী, ধর্ষক, ছিনতাইকারী, ডাকাত রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকার দরুন শুধু রেহাই ই পায় না, বরং বুক চিতিয়ে ঘুরে-বেড়াবার ছাড়পত্র পায়, নেতা হবার সুযোগ পায়, সে দেশের মানুষ নামাজ পড়েও দুর্নীতি চালিয়ে যাবে; তারা রোজাও রাখবে, আবার ঘুষও খাবে। তাই হচ্ছে। এই তো ধর্মপ্রাণ, আল্লাহ-খোদায় বিশ্বাসী বাংলাদেশের সামাজিক অবস্থা। অপরদিকে সুইডেন কিংবা ডেনমার্কের মতো ঈশ্বরবিহীন দেশগুলোর দিকে তাকালে বুঝতে পারি আমাদের দেশের ধর্মকেন্দ্রিক নৈতিকতার কলসিটা কতটা ফাঁপা।

আমরা কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় দেখেছি কিছুদিন আগে।  বিশিষ্ট এই ইসলামিস্ট রাজাকার বাংলাদেশের ইসলামিক রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন। কাদের মোল্লা, নিজামী, গোলাম আজম, সাকা চৌধুরী কিংবা বাচ্চু রাজাকারের মতো মানুষেরা আমাদের বারবারেই মনে করিয়ে দেয়, যে ধর্মকে নৈতিকতার উৎস বলে মনে করা হয়, সেই ধর্মের নামে মানুষেরা কতটা নৃশংস হয়ে উঠতে পারে সুযোগ পেলেই। একাত্তরে রাজাকারদের কাজকর্ম আমাদের অনেক সময়ই চোখ আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় মানবিকতার চেয়ে ধর্মের সৈনিকদের কাছে ধর্মবোধটাই বড় হয়ে দাঁড়ায়। এদের মতো লোকদের কথা ভাবলেই নোবেল বিজয়ী পদার্থবিদ স্টিফেন ওয়াইনবার্গের বিখ্যাত উক্তিটি মনে পড়ে যায় –

‘ধর্ম মানবতার জন্য এক নির্মম পরিহাস। ধর্ম মানুক বা নাই মানুক, সবসময়ই এমন অবস্থা থাকবে যে ভালো মানুষেরা ভালো কাজ করছে, আর খারাপ মানুষেরা খারাপ কাজ করছে। কিন্তু ভালো মানুষকে দিয়ে খারাপ কাজ করানোর ক্ষেত্রে ধর্মের জুড়ি নেই’।

শুধু একাত্তর তো কেবল নয়, বছর কয়েক আগে গুজরাটে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক দাঙ্গা, আর তারও আগে অযোদ্ধায় বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে শিবসেনাদের তাণ্ডব নৃত্য ধর্মের এই ভয়াবহ রূপটিকেই স্মরণ করিয়ে দেয়, যেটা প্যাস্কেল বহু আগে আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয় গেছেন –

‘Men never do evil so completely and cheerfully as when they do it from religious conviction.’।

উপরের পরিসংখ্যানগুলো দেওয়ার উদ্দেশ্য এটা প্রমাণ করা নয় যে, মানুষ নাস্তিক হলেই ভালো হবে কিংবা আস্তিক হলেই খারাপ হবে, বরং এটাই বোঝানো যে, ধর্মকে যে নৈতিকতার একমাত্র উৎস বলে ঢালাওভাবে আমাদের সমাজে প্রচার করা হয় সেটা বোধ হয় প্রশ্ন করার সময় এসেছে। ব্যবচ্ছেদ করার সময় এসেছে স্কুল কলেজের ধর্মীয় শিক্ষার সাথে সম্পর্কযুক্ত  বইগুলোকে। আমাদের শিক্ষা এবং চিন্তাচেতনা কেবল ধর্মমুখী না হয়ে বরং হয়ে উঠুক বাস্তবমুখী।

বাংলাদেশ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের নতুন সংযোজন ‘ধর্ম ও নৈতিকতা’ লেখাটি ফেসবুকে দেয়ার পর থেকেই পাঠকদের নানা ধরণের মন্তব্য পাচ্ছি। এর মধ্যে রঞ্জন নন্দির করা মন্তব্যটি সত্যই চিত্তাকর্ষক, হয়তো জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের কর্ণধারেরা আমলে নিতে পারেন –

ধন্যবাদ সবাইকে।