সমকামীদের অধিকার নিয়ে ম্যাগাজিন “রূপবান” এর প্রকাশনার যাত্রা শুরুর খবরটি আজকের বেশ কিছু জাতীয় পত্রিকার অন্যতম আলোচিত সংবাদ। নজরকাড়া প্রচ্ছদে ৫৬ পৃষ্ঠার এ ম্যাগাজিনটি রাজধানী ঢাকা থেকে গতকাল প্রকাশিত হয়। নিঃসন্দেহে এটি একটি সাহসী পদক্ষেপ। রূপবানের তরুন সম্পাদক রাসেল আহমেদ বলেন “বাংলাদেশের মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে যেখানে সমকামীরা ব্যাপক বৈষম্যের শিকার হয়, সেখানে সমকামীদের স্বীকৃতি ও গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি সমাজে ছড়িয়ে দিতেই এ প্রয়াস”।

বাংলাদেশের লেসবিয়ান, গেই, বাইসেক্সুয়াল ও ট্র্যান্সজেন্ডার (এলজিবিটি) মানুষদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এটি বিরাট এক পদক্ষেপ। রাসেল আহমেদ বলেন, আমরা আশা করি এটা সমকামী সম্প্রদায়ের ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করবে। রূপবান ম্যাগাজিনের সম্পাদকের প্রত্যাশা, সমকামীদের জীবনযাপন পদ্ধতি ও বিভিন্ন দিক নিয়ে ম্যাগাজিনটিতে যেসব প্রতিবেদন প্রকাশিত হবে, তা মানুষের মধ্যে সহনশীল দৃষ্টিভঙ্গি তৈরিতে সক্ষম হবে। এ খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা এএফপি।

ইতিমধ্যেই বিভিন্ন জায়গা থেকে সমকামী পত্রিকা রূপবান নিষিদ্ধের দাবী উঠেছে। “রূপবান” নামে সমকামী ম্যাগাজিন প্রকাশে গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করে জাতীয় তাফসীর পরিষদ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ূম বলেছেন, “বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ মুসলিম দেশে ইসলামী শরীয়তে হারাম ও নিষিদ্ধ সমলিঙ্গের বিয়েকে বৈধতা দিতে এবং বাংলাদেশের মত পীর-মাশায়েখ ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশে সমকামকে বৈধ দিতে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ক্রীড়নক এদেশে কাজ চালাচ্ছে।”

তিনি বলেন, সমকাম ইসলামে অবৈধ ও হারাম। এটাকে পশ্চিমা বিশ্বে বৈধ মনে করলেও মুসলমানরা কখনো তা সমর্থণ করে না। ইসলামের বিরুদ্ধে নতুনভাবে চক্রান্ত করতে পশ্চিমাদের চাপিয়ে দেয়া হারাম সমকামকে এদেশের মুসলমান সমাজে ছড়িয়ে দিতে যারা এ মিশন নিয়ে মাঠে নেমেছে তাদেরকে এদেশের ইসলামপ্রিয় মানুষ বয়কট করবে।

তিনি সমকামীদের ম্যাগাজিন “রূপবান” নিষিদ্ধ এবং যারা সমকামী হিসেবে পরিচয় দেয় তাদেরকে গ্রেফতার করে শাস্তি দিতে সরকারের প্রতি আহবান জানান। অন্যথায় এ সকল কুলাঙ্গাররা এদেশের যুব সমাজের চরিত্র নষ্ট করে পশ্চিমাদের অশান্তির দাবানল জ্বালিয়ে দিবে বলে বলেন তিনি। আজ বিকেলে জাতীয় তাফসীর পরিষদ বাংলাদেশ-এর উদ্যোগে এক প্রতিবাদ সভায় সভাপতির বক্তব্যে সংগঠনের চেয়ারম্যান মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ূম উপরোক্ত কথা বলেন। সূত্র – ইসলামিক নিউজ ২৪ ডট নেট।

বাংলাদেশের আইনে সমকামিতাঃ বর্তমান বিশ্বে অনেক দেশেই সমকামিতাকে বৈধতা দিলেও বাংলাদেশ রয়েছে তার আগের পর্যায়ে। বাংলাদেশের আইন সমকামিতাকে এখনো প্রকৃতি বিরুদ্ধ মনে করে যাবজ্জীবন কারাদন্ডের শাস্তি প্রদান করে। বাংলাদেশ দন্ডবিধির ৩৭৭ ধারায় বলা হয়েছে যে, যে ব্যক্তি স্বেচ্ছাকৃতভাবে কোনো পুরুষ, নারী বা জন্তুর সাথে প্রকৃতিক নিয়মের বিরুদ্ধে যৌন সহবাস করেন, সেই ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ডে বা দশ বছর পর্যন্ত কারাদন্ডে দন্ডিত হবেন এবং তদুপরি অর্থদন্ডেও দন্ডিত হবেন। এ ধারায় বর্ণিত অপরাধীরূপে গণ্য হবার জন্য যৌন সহবাসের নিমিত্তে অনুপ্রবেশই যথেষ্ট বিবেচিত হবে।

[Section 377. Unnatural offences– Whoever voluntarily has carnal intercourse against the order of nature with any man, woman or animal, shall be punished with imprisonment for life, or with imprisonment of either description for a term which may extend to ten years, and shall also be liable to fine. Explanation– Penetration is sufficient to constitute the carnal intercourse necessary to the offence described in this section.]

এখন প্রশ্ন আসতে পারে প্রকৃতি বিরুদ্ধ বলতে কি বুঝানো হয়েছে? এই আইনের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে – “The unnatural offenses are two: {a} Sodomy and {b} bestiality. Sodomy consists of penetration per anus with another person. Bestiality can be committed either by a male or female human being with an animal.” মূলত এই ধারার অধীনে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন মামলাতে পায়ুকাম এবং পশ্বাচারকেই (পশুর সাথে যৌনসঙ্গম) অস্বাভাবিক অপরাধ অর্থাৎ “অর্ডার অব ন্যাচার” পরিপন্থি হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।

ইসলাম ধর্মে সমকামিতাঃ ২০০১ সালে নেদারল্যান্ড প্রথম সমলিঙ্গের বিয়েকে আইনগত বৈধতা দেওয়ার পর তাদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে ফ্রান্স, বেলজিয়াম, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া, আমেরিকা (অনেক স্টেট) সহ পৃথিবীর প্রায় ৭০টি সুসভ্য দেশ। ২০১১ সালে জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলও সমকামিতার পক্ষে একটি ঐতিহাসিক সনদ পাশ করে। যদিও এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইরান, আফগানিস্তান, ইন্দোনেশিয়া সহ পৃথিবীর সেরা মুসলিম দুর্নীতিবাজ দেশগুলোর কোনটিতেই সমকামিতাকে সামান্য বৈধতা দেয়াও হয়নি।

ইসলামের মূল সংবিধান,কোরান ও হাদিসে সমকামিতাকে অত্যন্ত কঠোরভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে ও শাস্তি প্রদানের কথা বলা হয়েছে। কুরানে সমকামীদের ‘লুতের লোক’ বলা হয়েছে নবী লুতের ঘটনাকে ভিত্তি করে। নবী মুহম্মদ এর শাস্তি নির্ধারন করে গেছেন মৃত্যুদন্ড। (আবু দাউদ ৩৮:৪৪৪৭,তিরমিযি ১:১৫২)মোহাম্মদের পরে খলিফাদের সময়ে আবু বকর ও উমর কিছু সমকামিকে জীবন্ত দগ্ধ করেছিলেন বলে জানা যায়।

ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী মহাপ্রলয় সংঘটিত হওয়ার আগে পৃথিবীজুড়ে এমনকি মুসলিম দেশসমুহতেও যেসব নাফরমানী শুরু হবে তার মধ্যে একটি হল এই সমকামিতা। ধর্মগ্রন্থ আল কোরানের বিভিন্ন সুরা-আয়াতে মানুষের সমকামী-প্রবনতার বিরুদ্ধে বিচিত্র সব শাস্তি/গজবের কথা বলা আছে। পাথরবৃষ্টি, ভুমিকম্প, বন্যা………. দিয়ে আল্লা তাৎক্ষনিক ভাবে সমকামীদের মাটিতে পিশে শায়েস্তা করেন, (সুরা ৭:৮০-৮২, ২৬:১৭৩, ২৯:২৮-২৯)।

তবে, মানুষের সমকামিতাকে বৈধতা দানকারী টপ-লিস্টেড চিহ্নিত রাষ্ট্র নেদারল্যান্ড, নরওয়ে, বেজিয়াম, ডেনমার্ক, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া সহ কোন দেশেই পাথর বৃষ্টি বা অনুরুপ কোন শাস্তি কেন আল্লাহার পক্ষে শুরু করা এখনো সম্ভব হয় নি তা ইসলামিক গবেষণার বিষয় হতে পারে।

হিন্দু ধর্মে সমকামিতাঃ হিন্দু ধর্মের গ্রন্থ গুলোতেও সমকামিতার কিছু অদ্ভুত শাস্তি দেয়া হয়েছে। আবার শাস্তির বিচার করলে দেখা যায় মেয়ে-মেয়ে সমকামিতার শাস্তি পুরুষ-পুরুষ সমকামিতার শাস্তির থেকে বেশী। মনুসংহিতার আইনে উল্লেখ আছে –

‘যদি কোন বয়স্কা নারী অপেক্ষাকৃত কম বয়সী নারীর (কুমারীর) সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করে, তাহলে বয়স্কা নারীর মস্তক মুণ্ডন করে দুটি আঙ্গুল কেটে গাধার পিঠে চড়িয়ে ঘোরানো হবে’ (Manu Smriti chapter 8, verse 370.)।

যদি দুই কুমারীর মধ্যে সমকামিতার সম্পর্ক স্থাপিত হয়, তাহলে তাদের শাস্তি ছিলো দুইশত মূদ্রা জরিমানা এবং দশটি বেত্রাঘাত (Manu Smriti chapter 8, verse 369.)। সে তুলনায় পুরুষদের মধ্যে সম্পর্কের শাস্তি তুলনামূলকভাবে অনেক কম। বলা হয়েছে – দু’জন পুরুষ অপ্রকৃতিক কার্যে প্রবৃত্ত হলে তাদেরকে জাতিচ্যুত করা হবে (Manu Smriti Chapter 11, Verse 68.) এবং জামা পরে তাকে জলে ডুব দিতে হবে (Manu Smriti Chapter 11, Verse 175.)।

দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের আইন এবং প্রধান দুটি ধর্ম ইসলাম ও হিন্দু ধর্মে ভয়াবহ ঘৃণা এবং শাস্তির জন্য সমকামীরা নিজেদেরকে কখনোই প্রকাশ করার কথা চিন্তাও করতে পারে না। এই রকম পরিবেশে রূপবানের মতো একটি সমকামী ম্যাগাজিন বাংলাদেশে প্রকাশ আসলেই সাহসী উদ্যোগ। সাহসী উদ্যোগের প্রশংসা না করে পারলাম না। আশা করি ম্যাগাজিনটি তাদের প্রকাশনায় নিয়মিত হবে, আর তাদের কথা বলবে আমাদের মতো মানুষদের যারা তাদের সম্পর্কে আসলেই না জেনে ভ্রান্ত ধারণা মনে পোষণ করে থাকি।