১৮৯২ সালের মার্চ মাস, ঢাকা শহর। বেশ কিছুদিন ধরেই কানাঘুষায় শোনা যাচ্ছিল যে একজন ইউরোপিয় রমনী বেলুনে চড়ে সশরীরে আকাশে উড়ে দেখাবেন। ঢাউশ সাইজের গ্যাস বেলুনে চড়ে আকাশে চরে বেড়ানো সে সময় ইউরোপ আমেরিকায় শুরু হলেও ভারতীয় উপমহাদেশে সেটা তখনো অনেকটাই অভাবনীয়। সে আমলে টিভি ইন্টারনেটও ছিল না যে স্বচক্ষে দেখতে না পেলেও লোকে দূরদর্শনের মাধ্যমে হলেও দেখতে পারে। কাজেই আন্দাজ করা যায় আকাশে সশরীরে মানুষ ওড়ার লাইভ প্রদর্শনী সেকালে কি পরিমান আগ্রহ/উদ্দীপনা জনমনে তৈরী করেছিল।

ইউরোপ থেকে আগত (নানান সূত্রে ইউরোপ থেকে আগত লেখা হলেও আসলে তারা মার্কিন মূলুক থেকে আগত ছিলেন) বেলুন শিল্পীর খাই খরচা যে সে হবে না জানা কথা। সে খরচ মেটানোর ক্ষমতা ঢাকার নবাব আহসানউল্লাহ ছাড়া আর কারই বা থাকতে পারে? আমোদপ্রিয় নবাব পরিবার সে সময় এ জাতীয় নানান কাজকারবারের আয়োজন করে ঢাকাবাসীকে ব্যাপক বিনোদন দিতেন। ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে নবাব আহসানউল্লাহ মার্কিনী বেলুন কোম্পানীর মালিক ভ্যান তাসেলের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন শুধুমাত্র এক বিকেল বেলুন প্রদর্শনীর জন্য। অবশেষে চুক্তি চুড়ান্ত হবার পর টানা কয়েকদিন ঢোল পিটিয়ে নগরবাসীকে সেই আশ্চর্য তামাশা দেখার জন্য নিমন্ত্রন জানানো হল। দিন ধার্য করা হল ১৭ই মার্চ (তারিখ নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তি আছে, ১৩-১৭ এর যে কোন একদিন)।

সেই আশ্চর্য দিনটির বিস্তারিত বিবরন পাওয়া যায় সিলেটের মরমী কবি হাছন রাজার নাতি গণিউর রাজার ঢাকা ভ্রমন কাহিনীতে। সেখান থেকেই মূল অংশ সংগ্রহ করেছেন ঢাকা শহরের ইতিহাস নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষনা করা অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন।

১৩ই (কিংবা ভিন্ন সূত্রে ১৬ই) মার্চ বিকেল বেলা। পুরো শহর ভাংগা জনতা বুড়িগংগা পাড়ে নবাব বাড়ির আশপাশে ভরে ফেলেছে, অতি উতসাহী বহুজন নৌকা করে মাঝ নদীতে চলে গেছে। নবাব আহসানউল্লাহ ছাদের ওপর আসন গ্রহন করেছেন। একজন দীর্ঘকায় শ্বেতাংগ যুবককে (খুব সম্ভবত বেলুন কোম্পানীর মালিক পার্ক ভ্যান তাসেল কিংবা ম্যানেজার কলভিনও হতে পারেন) দেখা গেল নবাবের সামনে উপস্থিত হয়ে কেতারদূরস্থ সালাম জানিয়ে হ্যান্ডশেক করতে। সাথে আরো দেখা গেল ৫০/৫৫ এবং ১৫/১৬ বছরের দুজন শ্বেতাংগিনী মহিলাকে। নবাবের সাথে তাদের প্রায় আধা ঘন্টা খানেক আলাপ হল। সে আলাপের বিষয়বস্তু জানা গেল তারা নীচে নেমে আসার পর। জনতার শিক্ষিত দু’চার জন যারা ইংরেজী জানতেন তারা বেলুনওয়ালাদের সাথে আলাপ করে জানতে পারলেন যে নবাব তাদেরকে নদীর দক্ষিন পাড় হতে উত্তরমূখী উড়ে (বর্তমানের জিঞ্জিরা) নবাব বাড়ির ছাদে অবতরনের নির্দেশ দিয়েছেন। ছাদে অবতরনের কারন নবাব বাড়ির পর্দা নশীন মহিলাদেরও এই আশ্চর্য বাজিকরি থেকে বঞ্চিত না করা।

বেলুন প্রদর্শনী পপার্ক ভ্যান তাসেলের পারিবারিক ব্যাবসা। গত বছর দশেক যাবতই তিনি আমেরিকার নানান স্থান সহ বিশ্বের নানান যায়গায় বেলুন প্রদর্শনী করে আসছেন। বেলুন প্রদর্শনী খুব কমই অঘটনের মধ্যে পার করতে পেরেছেন, বহুবার তার জীবন সংশয় ঘটেছে, সেই ১৮৯২ সালের নিউ মেক্সিকোর উদবোধনী প্রদর্শনী থেকেই। সম্প্রতি তিনি পরিনয়সূত্রে আবদ্ধ হয়েছেন তারই মতন আরেক এডভেঞ্চার প্রিয় মহিলা জেনেট (জেনি) রামেরি ভ্যান তাসেলের সংগে। মধ্য বয়সী শ্বেতাংগিনী মহিলা সম্ভবত জেনেটের মা। এই মহিলাই হয়ে উঠেছেন বর্তমানে বেলুন চড়া দলের মূল আকর্ষন। গণিউর রাজার ভ্রমন কাহিনীতে খুব সম্ভবত জেনেট বা জেনিকেই বর্নিত হয়েছে পার্ক ভ্যান তাসেলের ভগ্নি হিসেবে। আদতে তখন জেনির বয়স ১৫/১৬ নয়, ২৪। ঢাকা আসার আগে তারা সুদুর অষ্ট্রেলিয়াবাসীদের মাতিয়ে এসেছেন বেলুন প্রদর্শনী দেখিয়ে। ঢাকা থেকে যাবেন ভারতের কর্পূরথেলায়।

দিনটি বেলুনে চড়ার জন্য ঠিক আদর্শ বলতে যা বোঝায় তা নয়। বেজায় বাতাস দিচ্ছে দক্ষিন দিক থেকে। ভ্যান তাসেল তাই নবাবকে বলেছেন যে এমন জোর বাতাসে তারা ঠিক নবাব বাড়ির ছাদেই নামতে পারবেন এমন নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। আমোদপ্রিয় নবাব ছাড়ার পাত্র নন, তিনি আরো অতিরিক্ত সাড়ে চার হাজার টাকার লোভ দেখালেন। পার্ক ভ্যান তাসেলের অনীহা সত্ত্বেও জেনেট ভ্যান তাসেল অবশেষে পাঁচ হাজার বিনিময়ে সেই বিপদজনক খেলা দেখাতে রাজী হয়ে গেলেন। দ্রুত সংবাদ চাউর হয়ে গেল, জনতা ছুটে চলল বুড়িগংগার দক্ষিন পাড়ে।

এরপর বেশ কিছুক্ষন নদীর দক্ষিন পাড়ে চলল বেলুন ফোলানোর বিশাল এন্তেজাম। খুব সম্ভবত সেটি হাইড্রোজেন বেলুন ছিল না, গণিউর রাজার বর্ননায় দেখা যায় যে কেরোসিন ব্যাবহার করে লাকড়ি জ্বালিয়ে বেলুনে ধোঁয়া ভরা হয়েছিল। দেখতে দেখতে খূটায় গাড়া বেলুন ফুলে উঠতে লাগলো, বিস্মিত ঢাকাবাসীর চোখের সামনেই রাবার নির্মিত সেই অত্যাশ্চর্য বেলুন হয়ে উঠল বিশাল থেকে বিশালকায়।

সেই বেলুন ফোলানার একমাত্র ফটোগ্রাফ- (শামীম আমিনুর রহমানের বই হতে নেওয়া)।

হঠাত বন্দুকের আওয়াজের মত একটি বিকট শব্দের সাথে সাথে বেলুনের দড়ি কেটে দেওয়া হল, জনতার ব্যাপক হর্ষধ্বনির সাথে শুরু হল বেলুনের উর্ধ্বমূখী যাত্রা, রাবারের আঁটসাট প্যান্ট এবং গেঞ্জি পরা জেনি মোক্ষম সময়ে সার্কাসের দক্ষ বাজিকরের মতই লাফিয়ে বেলুনের নীচে বাঁধা ছোট কাঠের পাটাতনে চড়ে বসলেন। বেলুন দেখতে দেখতেই বহু ওপরে উঠে গেল, গনিউর রাজার ভাষায় সাধারনত যে উচ্চতায় চিল শকুন দেখা যায় তারও ওপরে উঠে গেল, ধেয়ে চলল উর্ধ্বমূখী বাতাসের সাথে সাথে উত্তর দিকেই। (অন্য সূত্রানুযায়ী যতটা জানা যায় মোটামুটি ৬০০০ ফুট মত উচ্চতা)।

প্রথম বাংলার আকাশ জয়ী জেনি ভ্যান তাসেল

কিন্তু বিপত্তি অবশেষে এড়ানো গেল না। তীব্র উত্তরমূখী বাতাসের কারনে পরিকল্পনা মাফিক বেলুনের উচ্চতা কমিয়ে নবাব বাড়ির ছাদে অবতরন করার আগেই বেলুন ভেসে চলল বাতাসের সাথে। জেনি প্যারাসুট খুলে অসম সাহসের সাথে ঝাঁপিয়ে পড়লেন নবাব বাড়ির ছাদ উদ্দেশ্য করে; কাজটি তার জন্য খুব একটা কঠিন কিছু নয়, প্যারাসুটিং এ পার্ক এবং তিনি দুজনেই দক্ষ। কিন্তু বাতাসের কারনে হিসেবে গেল গোলমাল হয়ে, প্যারাসুট জেনিকে নিয়ে ভেসে চললে আরো উত্তর পানে। নীচে ছুটে চলল জনতা। অবশেষে নবাব বাড়ি ফেলে আরো মাইল তিনেক উত্তরে জেনি একটি উঁচু গাছের ডগায় অবতরন করতে সমর্থন হলেন। যতদুর মনে হয় স্থানটি আজকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের কোন যায়গা হবে, জনমানবহীন স্থানটি সে সময় ছিল নবাব পরিবারের জংগলময় বাগান।

উদ্ধারকারী দলে সকলের আগে পৌঁছে গেল একজন গোরা পুলিশ অফিসার, সাথে ক’জন স্থানীয় পুলিশ। সেই গোরা অফিসারের তক্ত্বাবধনে উদ্ধার কার্যক্রম শুরু হল। আনা হল একটি লম্বা বাঁশ, গাছের ভেতর দিয়ে সে বাঁশ পৌঁছে দেওয়া হল জেনির কাছে। গোরা অফিসার তাকে আহবান জানাতে থাকলো সে বাঁশ ধরে ঝুলে নেমে পড়তে। কিন্তু জেনি ভয় পাচ্ছিলেন সেই বাঁশ ধরে নেমে আসতে। কিন্তু পুলিশের অব্যাহত আহবানে তিনি অনন্যপায় হয়ে অবশেষে সেই বাঁশ ধরেই নেমে আসা শুরু করলেন। অঘটন ঘটে গেল মাঝপথে, সেই বাঁশে জেনির ভার বহন করতে না পেরে দু’টুকরো হয়ে ভেঙ্গে গেল, জেনি পড়ে গেলেন সোজা নীচের অরক্ষিত ভূমিতে, মাথায় তীব্র চোট পেয়ে আহত হলেন গুরুতর। আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিতসাধীন থাকার পর অবশেষে তিনি ১৮ই মার্চ প্রানত্যাগ করেন। এই দূঃসাহসী মহিলার কবর আজো আছে নারিন্দার পুরনো খ্রীষ্টান গোরস্থানে।

নারিন্দার গীর্জায় রক্ষিত ডেথ রেজিষ্টারে জেনির নাম – (শামীম আমিনুর রহমানের বই হতে নেওয়া)

গণিউর রেজার কাহিনী থেকে জানা যায় যে জেনেটের মা এবং পার্ক পুলিশের নামে মামলা রুজু করতে মনস্থ করেছিলেন, সম্ভবত নবাব আহসানউল্লাহই দু’পক্ষের মধ্যে কিছু অর্থ ক্ষতিপূরনের মাধ্যমে মিটমাট করে দেন।

আকাশে উড়ে বেড়ানো এই বিজ্ঞানের যুগেও হেলাফেলার নয়, বেশী বীরোচিত একটি ভাব এর মাঝে আছে। ঢাকার আকাশজয় প্রথম ঘটেছিল একজন মহিলার দ্বারা ভাবতেই অবাকই হতে হয়। নিজ জন্মভূমি থেকে আধা পৃথিবী দূরে সুদূর ঢাকায় যখন আহত হয়ে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তখন জেনির মনে কি ভাব এসেছিল তা আজ আর জানার কোন উপায় নেই। এই অনন্য সাধারন ঘটনা সে সময় দুনিয়াময় পত্রপত্রিকার খবর হলেও দ্রুতই চলে যায় আড়ালে। মুনতাসীর মামুনের বই না পড়লে আমি নিজেও কোনদিন জানতাম না বাংলার আকাশজয়ী প্রথম এই দূঃসাহসী মহিলার কথা।

এই কাহিনীর ওপর স্থপতি ও গবেষক শামীম আমিনুর রহমান বছর খানেক খেটে “ঢাকার প্রথম আকাশচারী ভানতাসেল” নামে একটি বই লিখেন, সেখান থেকে দুটি ছবি নেওয়া হয়েছে।

মূল সূত্রঃ

১। ঢাকা সমগ্র ৫ – মুনতাসীর মামুন।
২। Van Tassel family ballooning legacy ends in tragedy