“রাজা আসে যায়, রাজা বদলায়
নীল জামা গায়, লাল জামা গায়
এই রাজা আসে, ঐ রাজা যায়
জামা-কাপড়ের রং বদলায়
দিন বদলায় না।”

(রাজা আসে যায়, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)

এই কথাগুলো বীরেন চাটুজ্জে যত আগেই লিখুন না কেন, মানবসভ্যতায় যেদিন থেকে ভাবা শুরু হল যে, “Man is a political animal”, সেদিন থেকে শুরু করে আজকে, আমদের সমসাময়িক রাজনীতি-ব্যবস্থার জমানাতেও এই কথাগুলো প্রযোজ্য। একজন ছাত্র-রাজনীতির শরিক এবং কর্মী হিসেবে, যত দিন যাচ্ছে, ততই বুঝতে পারছি বর্তমান “হীরক রাজাদের দেশে” বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের এই কবিতাটার প্রাসঙ্গিকতাটা। শুধু আমার একার ক্ষেত্রে নয়, বর্তমানে চোখের সামনে ঘটে যাওয়া নিত্যদিনের দলতান্ত্রিক হুজ্জুতি আর নেতৃবৃন্দের পারস্পরিক সংকীর্ণ অংশীদারি সমঝোতার কারবার, সমাজের একটা বড় অংশের শিক্ষিত আর প্রগতিশীল মানুষদের বৌদ্ধিক স্তরে গিয়ে উদ্বেল করে তুলেছে। রাজা-বাদশাদের জমানা এখন বিলুপ্ত। তবুও রাজতন্ত্র আর মধ্যযুগীয় সামন্ততন্ত্র তাদের দেহাবশেষ রেখে গেছে আজকের রাজনৈতিক মূল্যবোধের বৃহদাংশ জুড়ে। “জোর যার, মুলুক তার” বা রাষ্ট্রোৎপত্তির বলপ্রয়োগের নীতি (Theory of Force) এখনও ছদ্মবেশে বিদ্যমান। এখন “দলীয় নেতার স্বার্থই জনগণের স্বার্থ।” তাই এখন দল-কেন্দ্রিক রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে জনস্বার্থভিত্তিক স্বতন্ত্র এবং অ-দলতান্ত্রিক রাজনীতির পন্থা অনুসরণ করা উচিৎ কিনা ভেবে দেখার সময় হয়েছে।

দলতন্ত্রকে যেসব কারণে আজ বিদায় দেবার প্রয়োজন হয়েছে, তার মধ্যে প্রধান হল সব দেশেই ক্ষমতাসীন বা ক্ষমতালিপ্সু দলগুলোর নেতা থেকে সাধারণ কর্মী পর্যন্ত আদর্শহীনতা কিংবা ভ্রান্ত আদর্শ অনুসরণ। আমাদের চারপাশের দলগুলোর দিকে সতর্ক দৃষ্টি দিলেই দেখা যাবে যে এদের অধিকাংশই হয় আদর্শবিচ্যুত, নয়ত ভুল আদর্শের বশবর্তী। সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল ক্ষমতায় যখন আসে, তখন সে কমিউনিস্ট না বুর্জোয়া গণতন্ত্রী –– এসব কিছুরই কোনো মুল্য থাকে না। তখন মার্ক্স, লেনিন, লুক্সেমবার্গ, চমস্কি, মিল, বেন্থাম, আব্রাহাম লিঙ্কন, সবাই ব্রাত্য হয়ে যান। তখন শাসকের আদর্শ হয়ে ওঠেন হিটলার, মুসোলিনি বা ফ্রাঙ্কোর মতো ডিক্টেটররা। এঁরাই তখন সরকারের পথিকৃৎ। সরকার তখন ঊনবিংশ শতকের অস্ট্রিয়ার যুবরাজ মেটারনিখের মতোই মধ্যযুগীয় সামন্ততন্ত্রের আঁধারে ফিরে যেতে চায়। শুধুমাত্র তাঁবেদার আর কথা বলা পুতুলদের কপালেই জোটে সমস্ত সুযোগ-সুবিধা আর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য। সরকারি দলের গণ-সংগঠনগুলো তাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের যাত্রপালা দেখতে আসার জন্য জনগণকে টিকিট বিক্রি করে। যারা টিকিট কিনবে না, তাদের পদদলিত করে বশংবদ করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত বা ইচ্ছুক থাকে। নেতা-নেত্রীদের অন্ধকার দুনিয়ার গোপন খবর ধামাচাপা দেওয়াটাও তাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হয়ে পড়ে। বিরোধী দমনের জন্য দলীয় সেনাবাহিনীর ট্রেনিংও দেওয়া হয় সেখানে। তাছাড়া, সরকারি পুলিশ-প্রশাসন, বিচার-ব্যবস্থা, ইত্যাদিও তো তাদেরই দখলে। অন্যদিকে, বিরোধী দলও নানাভাবে শাসকদলের সমালোচনা করে, যার অধিকাংশই নিছকই খুঁত ধরার ছেলেখেলা। বিরোধীরাও তাদের বিভিন্ন গণসংগঠনের মাধ্যমে এই খেলায় মানুষকে লিপ্ত করার চেষ্টায় থাকে। কোনো একটা সামাজিক, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে দলতন্ত্র শুরু করে গণমাধ্যমের হেডলাইনে নাম লেখানোর খেলায়। সেখানে মানুষের কোনো মানবিক গুরুত্ব নেই; আছে শুধু নির্বাচনী উপযোগিতা। আরও দুঃখের এবং দুশ্চিন্তার বিষয় এই যে তথাকথিত কমিউনিস্ট এবং radical কমিউনিস্ট পার্টিগুলোও অনেকেই এই খেলায় অংশ নিতে শুরু করেছে। মোট কথা এই যে দলতন্ত্রে সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য বলে চালিয়ে দেওয়া কোনো অপরাধ নয়, যদি তা সংশ্লিষ্ট দলের কাজে আসে।

ভ্রান্ত আদর্শের রাজনৈতিক বহিঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক দলগুলোর কথা তো আর নতুন করে বলার নেই। ভারতের BJP, RSS, ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন, পাকিস্তানের লস্কর-ই-তৈবা, সৌদি আরব এবং সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা আল-কায়দা, আফগানিস্তানের তালিবান কিমবা বাংলাদেশের জামা’আত-এ-ইসলামীদের কীর্তিকলাপ দেখলেই বোঝা যায়। এমনকি ভ্রান্ত আদর্শের বশে এবং তত্ত্বের অপ-উপলব্ধির ফলে বহু বামপন্থী রাজনৈতিক দলও তার কর্মী-সমর্থকদের ভুল পথে চালনা করে। এরা অযথা উগ্রপন্থী হয়ে অলীক বিপ্লবের মেকি ধুয়ো তুলে ‘সর্বহারা’দেরই বিপথগামী করে তোলে। এরা স্রেফ হুজুগের তাড়নায়, যাকে-তাকে ‘শ্রেণীশত্রু’ বলে ব্যক্তিহত্যা, অরাজকতা, নৈরাজ্য শুরু করে। ফলত, এরা যাদের সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে শোষণ-মুক্তির স্বপ্ন দেখায়, তারাই ক্রমশ এদের বিরুদ্ধে চলে যায়। সবচেয়ে খারাপ কথা হল যে এরা অস্ত্রভাণ্ডার বৃদ্ধি করার আশু প্রয়োজনে যে কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী বা ফ্যাসিবাদী জঙ্গীগোষ্ঠীর সাথেও মিত্রতা স্থাপন করতে পারে। ভারতের মাওবাদীরা এবং গত ১৯৭৯ সালে পেরুর আয়াকুচো রাজ্যে গড়ে ওঠা ‘সেনদেরো লুমিনোসো’ বা শাইনিং পাথ এর জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। এরা আসলে এলাকা দখলের জন্য, তথাকথিত ‘মুক্তাঞ্চল’ প্রতিষ্ঠা করার নামে যে নৃশংশতা করে, তা দেখলে যে কোনো মুক্তমনা মানুষও এদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠবে। দলতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রূপ হল এই জাতীয় উগ্রপন্থী সংগঠন।

এ তো গেল আদর্শগত বিচ্যুতির কথা; এবার সমালোচনা এবং সমালোচনাকারীর প্রতি দলতন্ত্রের দৃষ্টিভঙ্গির দিকে আলোকপাত করা প্রয়োজন। বাম-ডান সব দলেই এখন আত্ম বা বাহ্য –– কোনোপ্রকারের সমালোচনাই ভয়ঙ্কর অপ্রিয়। সমালোচনাকে গুরুত্ব দিয়ে নিজের ভুলত্রুটি সংশোধন করার কোনো চেষ্টাই এরা করে না। পাঠকরা হয়ত বলবেন, ‘এসব তো ফ্যাসিবাদী দলের নীতি।’ সত্যিই তাই। এখন তথাকথিত গণতন্ত্রে বিশ্বাসী বাম বা ডান কোনো দলেই গণতন্ত্রের কোনো ছিটেফোঁটাও নেই। সবাই ক্ষমতায় এলে সংসদের আসনের গদির কোমলতায়, এ.সি.-র ঠাণ্ডা হাওয়ায় আর আয়করমুক্ত ভাতার প্রভাবে কর্তৃত্ববাদী এবং অহংবাদী রাজনৈতিক কূপমণ্ডুকে পরিণত হয়। কমিউনিস্ট পার্টির কমরেডরাও এর ব্যাতিক্রম হতে পারেননি। কারণ, এগুলো কৃষকের ক্ষেতের মাটির মতো কঠিন নয়, শ্রমিকের কারখানার মেশিনের মতো শক্তিক্ষয়কারী নয় বা বিজ্ঞানের মতো প্রগতিশীলও নয়। যে মেহনতী জনতার জন্যে কাজ করার আদেশ দেওয়া হয় তাঁদের, ভোটের পরে সেই প্রোলেতারিয়েত সমাজের কথা তাঁরা ভুলে যান। তখন সাম্যের বদলে ব্যক্তিপূজার প্রচলন হয়। তখন সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা, ন্যায়, ইত্যাদি ভুলে যাওয়াই স্বাভাবিক। তখন যদি পার্টির মিটিং-এ মার্ক্সবাদ নিয়ে বা সোভিয়েতের ভাঙনের পেছনে কমিউনিস্টদের কী কী দোষ ছিলো বা জর্জ অরওয়েলের মতো বুদ্ধিজীবিরা কেন স্ট্যালিন জমানার দ্বিতীয়ার্ধের Great Trial-এর সমালোচনা করলেন, ইত্যাদি প্রশ্ন করা হয়, তবে তাকে ‘দলবিরোধী’, ‘প্রতিবিপ্লবী’, ‘সংশোধনবাদী’ বা ‘Scholastic’ বলে গণ্য করা হবে। কেউ অন্তত একবার উত্তর দেওয়ার কথা তো ভাববেনই না, এমনকি একবারও কেউ অনুসন্ধান করবেন না যে প্রশ্নকর্তা সত্যিই ‘সংশোধনবাদী’, ‘দলবিরোধী’ বা ‘প্রতিবিপ্লবী’ কি না। অথচ এঁরাই কথায় কথায় লেনিন-লুক্সেমবার্গ এর কথা ‘কোট’ করে জনসভাতে ভাষণ দেবেন। ‘বিরোধীদের স্বাধীনতাই প্রকৃত স্বাধীনতা’ –– রোজা লুক্সেমবার্গের এই বক্তব্যকেও দলীয় প্রসারের স্বার্থে ব্যবহার করবেন। তৃতীয় বিশ্বের বহু প্রথিতযশা কমিউনিস্ট পার্টি ইদানীং হার্মাদশিল্পেও খ্যাতি অর্জন করেছে, যাতে বিরোধীদের কন্ঠরোধ করা যায়। প্রয়োজন পড়লে, ভোটব্যাঙ্কের স্বার্থে মানুষের নিরক্ষরতার সদ্ব্যবহার করে এরা কুসংস্কারকে রসদ যোগায়। এদের মতো অবৈজ্ঞানিক রাজনীতিকরাই নাকি মার্ক্সবাদ বিজ্ঞান কি না, সেসব নিয়ে কথা বলে(!), এরাই নাকি বিপ্লব করবে(!)। মাঝেমধ্যে মনে হয়, যারা স্বচ্ছতা আর pluralityকে এত ভয় পায়, সেই উত্তরসূরিদের দেখলে মার্ক্স আর এঙ্গেলস্‌ হয়ত কোনোদিনও Communist Manifesto’’ লিখতেন না।

সবচেয়ে হাস্যাস্পদ বিষয় হল যে, যখন সচেতন আর প্রগতিশীল জনসমাজ দলতন্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বলে, তখনই মতাদর্শ নির্বিশেষে, শাসক, বিরোধী, বাম, ডান, সব দলই ভয়ানক সক্রিয় হয়ে ‘সুবিধাবাদী’ তকমা সেঁটে দেয় তাদের ওপর। অ-দলতান্ত্রিক রাজনীতির আদর্শে বিশ্বাসী মানুষদের কোণঠাসা করার জন্যেই এই প্রয়াস। একটা প্রশ্ন করছ: দলীয় রাজনীতিই কি রাজনীতির একমাত্র রাস্তা? শুধুমাত্র জনস্বার্থের ভিত্তিতে লড়াই করা রাজনীতির সমার্থক নয় বুঝি? আর দলতন্ত্রই যে একমাত্র বৈধ রাজনীতির উপায়, এটা কোন Wikipedia বা Encyclopedia-তে লেখা আছে?

আসলে দলীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে বিষয়টা হল, “ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, ছোটো সে তরী।” তাদের বিচরণক্ষেত্রের পরিসর এতটাই সংকীর্ণ যে কমিউনিস্টরা এটা বোঝেন না যে Communism বা communist party-র কার্যকলাপের সমালোচনা করা মানেই তা পুঁজিবাদকে সমর্থন করা নাও হতে পারে। আবার অনেক দক্ষিণপন্থীও এটা বোঝেন না যে পুঁজিবাদের বিরোধীতা সব সময়ে কমিউনিজ্‌মের সমর্থনে নাও করা হয়ে থাকতে পারে। আসলে এঁদের দলীয় শামিয়ানা এতটাই ছোটো যে, এর তলায় এসে এঁদের বিচারবুদ্ধির পরিধিটাও অনেকটা কমে যায়। আর তখনই এঁরা এঁদের দল-নিরপেক্ষ মূল্যায়নকারীদের ‘সুবিধাবাদী’, ‘আদর্শহীন’, এসব বলেন। এটাও প্রমাণ করে যে দলতান্ত্রিক বামপন্থী বা ডানপন্থী, কোথাওই pluralityকে স্বীকার করার কোনো চল নেই। দলের প্রয়োজনে এঁরা যদি কখনো নোয়াম চমস্কি বা জ্যাক দেরিদা-কেও ‘সুবিধাবাদী’ বলে, তাতেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। দলতান্ত্রিক নেতা-নেত্রীদের কাছে একজন রাজনীতি সচেতন মানুষকে বিচার করার মাপকাঠি হল তার দলীয় পরিচয় অথবা তার বক্তব্যের অতিসরলীকরণ আর সেটার একতরফা এবং বিকৃত বিশ্লেষণসহ অপব্যাখ্যা। এই পদ্ধতিটা যে কতটা মারাত্মক, তা এই নেতৃবৃন্দ বোঝেন না বা বুঝলেও সজ্ঞানে এড়িয়ে যান।

সময়ের সাথে সাথে মানুষের রাজনৈতিক সচেতনতা যত বাড়ছে, দলতন্ত্রের কাছে প্রতাড়িত হয়ে তার বিরুদ্ধে জনমত আরো দৃঢ়ভাবে ঘনীভুত হচ্ছে। Hippie Movement, রাস্তাফারি (Rastafari) আন্দোলন থেকে শুরু করে সাম্প্রতিককালে, ২০১১ সালের ওয়াল স্ট্রীট অবরোধ বা ২০১৩ সালে বাংলাদেশের রাজধানীতে শাহবাগ স্কোয়ার বা প্রজন্ম চত্ত্বরের গণ-অভ্যুত্থান –– সবক্ষেত্রেই এটা পরিলক্ষিত হয়েছে যে দলীয় অভিভাবক ছাড়াও সাধারণ মানুষ সংগঠিত হয়ে বিশুদ্ধ জনস্বার্থে লড়াই করতে পারে এবং তা শাসকশ্রেণীকে রীতিমতো নাস্তানাবুদ করে দিতে পারে। এরকম ভাবেই, উত্তরপূর্ব ভারতের মণিপুরে AFSPA বা Armed Forces (Special Powers) Act, 1958-এর বিরুদ্ধে ইরম শর্মিলা চানুর অনশন এবং সেনাবাহিনী কর্তৃক থুঙম মনোরমার ধর্ষনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে যখন গ্রাম-কে-গ্রাম সমগ্র নারীসমাজ সোচ্চার হয়ে বলেছিল, “Indian Army rape us!” –– তখন কোনো দলীয় শামিয়ানার তলায় তারা দাঁড়ায়নি; তারা এসেছিলো শুধুমাত্র নিজেদের একটা ন্যুনতম গণতান্ত্রিক অধিকারকে রক্ষা করার দাবি নিয়ে। এছাড়াও যে সারা বিশ্বে কত এরকম দল-নিরপেক্ষ জনস্বার্থকেন্দ্রিক গণ-আন্দোলন গড়ে উঠছে, তার সব কথা আমাদের কাছে এসে পৌঁছায় না। কারণ, যখনই দলের নিচুতলার কর্মীরা সাহস করে নেতৃবৃন্দকে চ্যালেঞ্জ করবে, তখন তাদের ক্ষমতালিপ্সা ফাঁস হয়ে যাবে, আর আমজনতাকেও তখন আর নেতা-নেত্রীদের ক্রীতদাস বানানো যাবে না। তাই রাষ্ট্রও তাদের শাসন সংরক্ষিত করতে নানাভাবে এই সমস্ত অ-দলতান্ত্রিক গণ-আন্দোলনের খবরগুলোকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। তবুও যখনই এক জায়গায় গণতন্ত্রের কন্ঠরোধ করা হয়, তখনই আরেক জায়গাতে স্বতন্ত্রভাবে কৃষক, শ্রমিক, নারীসমাজ, ছাত্রসমাজ ––  সবাই আরো তীব্রভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে।

আর বিশেষ কিছু বলার নেই। তবে, যাঁরা দলতন্ত্রের বিরুদ্ধে গড়ে তুলছেন অ-দলতান্ত্রিক, জনস্বার্থ-ভিত্তিক স্বতন্ত্র গণ-আন্দোলন, তাঁদের দু’টো অপরিহার্য বিষয় খেয়াল রাখতে হবে:

  • প্রথমত, যাঁরা অ-দলতন্ত্রের ধারকবাহক, তাঁদের এটা কিন্তু মাথায় রাখতে হবে যেন স্বতন্ত্র রাজনীতি কখনোই নৈরাজ্যবাদী পন্থায় না চলে যায় এবং অরাজকতা সৃষ্টি না করে। সন্দেহ নেই, আমরা রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরোধিতা করি, কিন্তু এই বিরোধিতা যেন দর্শনশূন্য এবং দেখনদারির রাজনীতিতে পরিণত না হয়। যখন একটা অ্যানার্কিস্ট দল অযাচিত নৈরাজ্য আর অরাজকতা তৈরি করে, তখন সেটার দায় শুধুমাত্র সেই দলের উপরেই বর্তায়। কিন্তু যদি কোনো স্বতন্ত্র গণ-আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে অরাজকতা তৈরি হয়, তখন তার দায় কিন্তু শুধু সেই আন্দোলনের পরিচালকদের একার ওপরই নয়, বরং তা বৃহত্তর জনসমাজের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তখনই দলতন্ত্রের পুরোধারা জনতার ওপর খবরদারি করার জন্য রাখালবালক রাখার ধারণাটাকে মেনে নেওয়ার জন্য জনগণকে পীড়াপীড়ি করবে।
  • দ্বিতীয়ত, অ-দলতান্ত্রিকতার প্রসঙ্গে অনেকেই অরাজনৈতিকতার কথা ভাবে। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হওয়াটাই স্বাভাবিক। তার ফলে যারা দলতান্ত্রিক রাজনীতির পুরোধা, তারা আমজনতার এই হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা অসামাজিক, অমানবিক এবং অরাজনৈতিক আপোষের সুযোগ নিয়ে সর্বদাই সাধারণ মানুষকে নেতা-নেত্রীর ক্রীতদাসে পরিণত করে যাবে।

 

শেষ করার আগে একটাই কথা বলার আছে। এই যে অ-দলতান্ত্রিক রাজনীতির চিন্তাধারা, সেটা আসলে এখন একটা hypothesisএর পর্যায়ে আছে। এখন এই আদর্শকে ভিত্তি করে যেসব গণ-আন্দোলন হয়েছে বা হচ্ছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে যে মোটামুটি সফলভাবেই এই আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। কিন্তু এখানেও সতর্ক থাকতে হবে যেন এই বিকল্প রাজনৈতিক মতবাদ সনাতন দলীয় গড্ডালিকায় পদার্পণ না করে। ভারতের আম আদমি পার্টি যে কতদিন জনতার পাশে থাকবে, সেটাই এখন পর্যবেক্ষণের বিষয়। এই আদর্শকে জনমতের সাথে সামঞ্জস্য রেখে চলতে হবে। যাদের জন্য আন্দোলন, তারাই ঠিক করবে আন্দোলনের নীতি। তবেই, সাধারণ মানুষকে তাঁবেদারে পরিণত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করা যাবে এবং দলতন্ত্রের পচাগলা বিকৃত শবদেহের সঠিকভাবে সৎকার করা সম্ভব হবে।