খুব সাধারণ একটা দিন। আর পাঁচটা দিনের সঙ্গে আলাদা করার মতো তেমন কিছুই ঘটেনি। আমার জন্ম হয় এমনই এক দিনে। পরিবারের কেউই আর পরে সেই দিনটিকে উদ্ধার করতে পারেনি। একটা গড়পড়তা ধারণার ভেতর দিয়ে জন্মদিন নির্ধারণ করা হয়েছে। আমার জন্মের প্রকৃত ইতিহাসটা চাপা পড়ে যায় এভাবেই—কতগুলো শব্দের মাঝে। ঘরের পেছন দিয়ে—মাছ নেবে গো মাছ, রুই-কাতলা-ময়া মাছ—হেঁকে যায় মাছবিক্রেতা জুমাত। ঘুরে যায় বরফ বিক্রেতা, তার ফাটা মাইকে তখন সাঈদীর সভা। হাড়িকুড়িওয়ালা হাঁক দেয়—নগদ আর ভাঙ্গা-চুরা দিয়ে নিয়ে যান বাটি-গামলা, হাড়ি-কুড়ি। কুকুরগুলো ডেকে ওঠে, মেতে ওঠে আগের দিনের অসমাপ্ত ঘেউ ঘেউ ঝগড়ায়। একটা হাড়িচাটা কয়েকবার ডেকে কারো কোনো দৃষ্টি আকর্ষণ করতে না পেরে ফিরে যায় অন্য পাড়ায়। মোরগটা এই অসময় ডেকে ওঠে একেবারে দরজার গোঁড়ায়। বাবা স্যান্ডেল ছুড়ে মারেন উঠানের কোণের পেয়ারা গাছে গা ডলতে থাকা ছাগলটাকে তাক করে। ছাগলটা হতভম্ব হয়ে এদিকওদিক তাকায়, লক্ষবস্তু যে সে সেটা আচ করতে পেরে ভ্যা ভ্যা করে ডেকে ওঠে। চালের ওপর একটা প্রতিবেশী পাইরীর পেছন পেছন প্রেম নিবেদনে ব্যস্ত থাকা পায়রাটা উড়ে যায়—পতপত শব্দ হয়। কে যেন চিল্লিয়ে ওঠে রান্নাঘর থেকে—গলায় ভাত বেধে গেল, পানি দে রে! টিউবওয়েল চাপার শব্দ হয়–ঘ্যাচঘ্যাচ শব্দ। উঠানে বসে মুরব্বি বিরতিহীন কেশে যায়। বাইরে যখন এত শব্দে ঝালাপালা প্রকৃতি তখন ঘরের ভেতর থেকে প্রসব যন্ত্রণায় কোনো নারীর মৃদু শব্দ কারো কানে বাজার কথা নয়। বাড়ির কিছু মানুষ যানে ভেতরে কি ঘটছে, কিছু মানুষ তাও জানে না। এ বাড়িতে জন্ম হওয়া রোজ গোসল করা আর কাপড় পড়ার মতো খুব সাদামাটা একটা ঘটনা। ঘরের দরজাটা ভেড়ানো। গরম পানি নিয়ে এগিয়ে গেল একজন, এতক্ষণ এই জিনিসটার কথা কারো মনে ছিল না। দরজাটা আলগা করতেই আবারো শব্দ, ভিড়িয়ে দেওয়ার সময়ও সেই একই শব্দ। শব্দটা হাওয়াই মিলে যাওয়া মাত্র ঘরের ভেতর থেকে চেঁচিয়ে উঠলো দায়মা—ছেলে হয়েছে রে মনুর। দাদি কষ্ট করে কাশি চেপে উত্তর দেয়—‘কত ছেলে চেয়েছি মাগির কাছে। এখন ঢঙ করছে। ও ছেলের মুখ দেখবো না আমি।’ বাড়ির সকলে খানিকটা আগ্রহ নিয়ে শুনলো তারপর যে যার কাজে চলে গেল। এ বাড়ির আমি তেরতম সন্তান, তৃতীয় ছেলে। নয় বোনের পর জন্ম হয় বড় ভাইয়ের। দাদি খালি বড় বোন আর বড় ভাইয়ের মুখখানা মন দিয়ে দেখেছেন।

ছেলে বোধহয় বাচে না রে আওলাদ। এই-প্রথম বাবাকে উদ্দেশ্য করে কেউ কিছু বলল। বাবা গামছাটা গায়ে দিয়ে প্রতিক্রিয়াহীন পুকুরের পথে রওনা হলেন। মা তখন কষ্ট করে বললেন, ‘কেনে, কি হয়ছে চাচী?’
ছেলে কাঁদে না রে মনু। কেমন পাখির মতো শরীর। প্যাঙটা, ভেতরের সব দেখা যায় তো। বাইরে তখন ধানের গোলার টিনের চালে নারিকেল পড়ার বিকট শব্দ। শব্দ শুরু হয়েছে ঘর অতঃপর বাড়ি জুড়েও। শিশুটি মৃত শুনে আগ্রহ শুরু হয়েছে মহল্লাজুড়েই। শব্দের মাঝে নীরব খালি শিশুটি। ও শব্দ করলেই আগ্রহ সবার ঘুচে যায়—খুশি হয় কেউ কেউ, কেউ মুখ যেমন গোমরা করে এসেছিল, তেমন গোমরা করেই ফিরে যায়।
ডাক্তার ডাকবো? একজন বলে।
এইজন্য আগে থেকেই বলেছিলাম হাসপাতালে নিতে। অন্য একজন বলে।
দাদি বাইরে থেকে কাশতে কাশতে বলেন, ছেলেটাকে মেরে ফেললো মাগি! কি ফুটফুটে-দেবদূতের মতো হয়েছিল। একেবারে আমার আওলাদ।

এমন করেই মৃত্যু নিয়েই জন্ম হয়েছিল আমার। আমি যখন শব্দ করলাম তখন শুধু ঘরে ফেরা পাখিদের শব্দ ছাড়া তেমন কোনো শব্দ ছিল না। আর দূরের একটি মসজিদ থেকে আযান ভেসে আসছিল। শিশুটি কাঁদতে থাকে, অল্পক্ষণ কেঁদেই ঘুমিয়ে পড়ে। ঐ মুহূর্তের কান্নার গুরুত্ব বোঝার বয়স তার তখনো হয়নি। কান্নার ভেতর দিয়ে কতগুলো শব্দের মাঝে বুদবুদের মতো ভেসে উঠলো আমার অস্তিত্ব। প্রকৃতি স্বীকার করে নিলো আমাকে।

চলবে…