রাজনৈতিক সংকট নেই, এমন গণতান্ত্রিকদেশ পৃথিবীতেই নেই। গণতন্ত্রের ইতিহাসেও নেই। আর বাংলাদেশে তদারকি সরকার নিয়ে এই প্রাণঘাতি ক্যাঁচাল, এই নিয়ে চতুর্থবার।

সমস্যা হচ্ছে, একটি সর্বজনগ্রাহ্য তদারকি সরকার প্রণয়নে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক এবং ক্রমবর্ধমান ব্য্ররথতার জন্য, এক পক্ষ অন্যকে দোষ দিচ্ছে। কেও বাংলাদেশের রাজনীতির “স্ট্রাকচারাল” বা কাঠামোগত দুর্বলতা নিয়ে আলোচনা করছে না। গোটা বাংলাদেশ আলীগার বনাম বিএনপিতে দ্বিধাবিভক্ত। আরেকটা শ্রেনী অবশ্য দুপার্টি সিস্টেম নিয়েই বীতশ্রদ্ধ। আমি মনে করি বাংলাদেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা দোষারোপে যতটা সময় দিচ্ছেন, কাঠামোগত দুর্বলতার দিকে তারা তাকাচ্ছেন না।

আমি কোন রাষ্ট্র বিজ্ঞানী নই। সেরকম কোন দাবী আমার নেই। বাংলাদেশের ইতিহাস মোটামুটি জানা। আমি শুধু আমার সীমিত সাধ্যের মধ্যে বোঝার চেষ্টা করছি বাংলাদেশের সমস্যাটা কি।

বাংলাদেশের রাজনীতির অনেক উপদান। প্রথমে বৃটিশ উপনিবেশ, দেশ ভাগ, দাঙ্গা, সংখ্যালঘু সমস্যা,পাকিস্তানের সাথে স্বাধীনতা যুদ্ধ-ভাষা আন্দোলন সব কিছু মিলে মিশে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অসংখ্য “কনট্রোলিং” গিয়ার। যদিও বাংলাদেশের সাধারন মানুষ এখনো ভারতচন্দ্রের ” আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতের” সরলতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয় নি। বিভিন্ন সমীক্ষার ভিত্তিতে এটাই দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবিরা যতই “তুই রাজাকার” শ্লোগান তুলুক, আর বি এন পি দেখানোর চেষ্টা করুক আলীগাররা “ভারতের দালাল”- বাংলাদেশের সাধারন মানুষ মোটেও পাকিস্তান বা ভারতের দালাল তত্ত্বে প্রভাবিত না। তারা অনেক বেশী পরিনত ভোটার। তাদের মূল ক্ষোভ বাংলাদেশের রাজনীতির দুবৃত্তায়ন নিয়ে। তাদের মূলক্ষোভের অভিমুখ কি করে ঘুঁশ নিয়ে কোটিপতি হচ্ছে রাজনীতিবিদদের ভাইরা ভাইরা, আর তাদের দুর্দিনের শেষ হবার কোন আশা নেই। পরিণত ভোটারদের মতন, তারা ভোটটা ঠিক যায়গাতেই দিয়েছেন গত ১৯৯১ সাল থেকেই । নিজেদের ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন রাজনৈতিক পার্টিগুলির দুর্নীতির বিরুদ্ধে।

আমি মনে করি না আগের ইলেকশনে তারা ঢালাও ভাবে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিলেন কাদের মোল্লাকে ফাঁসিতে ঝোলানোর জন্য। তাদের রায় ছিল বি এন পির দুর্নীতির বিরুদ্ধে। এবং আওয়ামী লীগ এসে সেই প্রতিশ্রুতি পূরনে সম্পূর্ন ব্য্ররথ হওয়ায়, তারা নানান স্থানীয় নির্বাচনে আলীগের নৌকা উল্টেছেন।

অর্থাৎ আমি যেটা বলতে চাইছি-বাংলাদেশের ভোটাররা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রএর জন্য সম্পদ। তারা নিজের এবং বাংলাদেশের ভালো ঠিকই বুঝেছেন। কিন্ত একদল রাজনৈতিক ব্যবসায়ী, নিজেদের সম্পদ এবং ক্ষমতার লোভে, বাংলাদেশের রাজনীতিকে কিছু তাত্ত্বিক এলিমেন্ট যথা যুদ্ধপরাধ, ভারতবিরোধিতা ইত্যাদির চড়া সুরে বাঁধতে চাইছে।

এর জন্যে বাংলাদেশের আসল এবং জটিল সমস্যাগুলি রাজনীতিতে আসছে না।

বাংলাদেশের আসল সমস্যাগুলির দিকে এবার তাকানো যাক। বোঝা দরকার কেন এই ইস্যু গুলি বাংলাদেশের রাজনীতিতে না এসে, শুধু শুধু ভারত আর পাকিস্তানের দালাল ইত্যাদি পলিটিক্যাল রেটরিকের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে।

প্রথম সমস্যা অবশ্যই ঘনজনবসতি এবং সেই অনুপাতে জীবিকা নেই। যা ভারত সহ সব তৃতীয় বিশ্বের সমস্যা। বাংলাদেশে অনেক এন জি ও এই নিয়ে কাজ করে চলেছে। তাদের সাফল্যও এসেছে। তবে মূল সাফল্য এসেছে পোষাক শিল্পে। কিন্ত সমস্যা এখনেও বহুবিধ। অধিকাংশ শ্রমিক প্রায় দাসশ্রমিক। মজুরিও ভীষন কম। ভারতে এর জন্য সরকার থেকে ১০০ দিনের কাজ চালু করা হয়েছিল, যেখানে শ্রমিকরা প্রায় কিছু না করেও দৈনিক ১৫০ টাকা রোজগার করত। এতে গ্রাম এবং শহরে সস্তায় শ্রমিক পাওয়া ভারতে দুর্লভ। কারন বেশী টাকা না পেলে, তারা সরকারি কাজই করবে। কার্যত এটা একটা মূল কারন ভারতে গ্রামে শ্রমিকদের দৈনিক রোজগার বেড়েছে।

বাংলাদেশে যেভাবে জিনিসপত্রের দাম উদ্ধমুখী, সেই হারে শ্রমিকদের মজুরী বাড়ে নি।
হাসিনার রাজতত্বকালে বাংলাদেশে মুল্যবৃদ্ধি ৭-১২% এর মধ্যে থেকেছে। এটা হোলসেল ইনডেক্স। শুধু চালের দাম ধরলে, কোন কোন বছরে ( ২০১০), ৪০-৫০% বৃদ্ধি হয়েছে চালের দামে। বাংলাদেশে শ্রমিক এবং নিচের তলার মানুষদের উন্নয়ন সেই ভাবে হয় নি। আমি কয়েকটা রিপোর্টে যা দেখছি-চালের দাম বাংলাদেশে এতটাই বেড়েছে, সেটাকে যদি, মজুরী বৃদ্ধির সাথে এডজাস্ট করা যায়, তাহলে দেখা যাবে, কোন কোন বছরে বাংলাদেশের শ্রমিকদের দৈনিক মজুরী আসলে ২থেকে ৩ % কমেছে ( সূত্র ঃ ইন্টারন্যাশানাল ফুড পলিসি ইন্সটিউট রিপোর্ট )। বাংলাদেশে এই মুহুর্তে হাঙ্গার ইনডেক্সের নীচে আছে ২১% মানুষ। তবে সেটা ভাল এই জন্যে যে ১৯৯১ সালে, সেটা ছিল ৪০%।

তারপরেও বাংলাদেশ ভারতের থেকে হিউমান ডেভেলেপমেন্ট ইন্ডেক্সে ভাল করেছে, এর কারন বিদেশে শ্রমিক সাপ্লাই থেকে বাংলাদেশে ক্যাপিটাল ইনফ্লাক্স এখনো বেশ ভাল। কিন্ত পরিকাঠামোর অভাবে সেই ক্যাপিটাল থেকে ভাল কিছু হচ্ছে না, যেটা ভারতের কেরালাতে হয়েছে। স্থানীয় শিল্প বিকাশে বিরাট বাধা রাজনৈতিক দাদাগিরি। কোন প্রবাসী বাংলাদেশী যে বাংলাদেশে ফিরে সেখানে শিল্পের বিকাশ ঘটাবেন, তার জন্য কোন পরিকাঠামো নেই। ভারতের আই সিটির উন্নতিতে একটা বিরাট অংশ আছে প্রবাসীদের শিল্প স্থাপনা। এই জায়গাটা বাংলাদেশে এখনো তৈরী হয় নি। অধিকাংশ প্রবাসী বাংলাদেশীরা ঢাকাতে ফ্লাট কিনেই খালাস। রাজনৈতিক দাদাগিরির ভয়ে শিল্প স্থাপনাতে কেও এগিয়ে আসতে সাহস পান না। ফলে প্রবাসী বাঙালীদের সাহায্যে বাংলাদেশে বিপুল উন্নয়নের সুযোগ থাকলেও স্থানীয় চাকরি সেভাবে তৈরী হয় নি। পরিকাঠামোগত দুর্বলতা রয়েই গেছে। এই কারনে নানান সুযোগ থাকা সত্ত্বেও দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধির জাঁতাকলে, শ্রমিক শ্রেনীর দুরাবস্থার খুব একটা হেরফের হয় নি।

এরপর তারা যখন দেখে শুধু রাজনীতি করার কারনে কেও কেও কোটিপতি হয়, তারা ঘৃণার চোখে দেখে রাজনীতিবিদদের। তারা ভারত না পাকিস্তানের দালাল -সেটা বোঝার ক্ষমতা এই শ্রেনীর নেই। বাংলাদেশের এই বৃহত্তর শ্রেনীর উন্নতির জন্য কোন রাজনৈতিক দলের কোন এজেন্ডা নেই। মাথাব্যাথা শুধু কিছু এন জি ওর। ফলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই, বাংলাদেশের বৃহত্তর মানুষ এখনো উত্তর খুঁজছে, কবে একটা রাজনৈতিক দল আসবে যাদের ফোকাস থাকবে তাদের রুটিরোজগারের ওপরে।

দ্বিতীয় ইস্যু-ধর্ম নিয়ে। ইসলাম বা জামাত কি সমস্যা? এই প্রশ্নের উত্তরে আমার সাথে আমার বাংলাদেশী বন্ধুরা একমত হবেন না।

জামাত কেন বিজেপির মতন যেকোন ধর্মীয় সুরসুরি মার্কা পার্টিগুলির উত্থানে দুটো এলিমেন্ট থাকে। প্রথমত এদের সব নেতাই ধর্মকে ব্যবহার করে ব্যবসা করে। জামাত এই দিক দিয়ে খুব মজার দল। এরা ভারত পাকিস্তানের বিভাজন চায় নি। পাকিস্তানের বিরোধিতাই করত এরা। তারপরে পাকিস্তানের আমলে বাংলাদেশও চায় নি। এসবের মূল কারন- আসলেই ধর্ম ভিত্তিক পার্টিগুলি চলে শাসক শ্রেনীর শোষনের স্টাকচারটাকে ভাল করে টিকিয়ে রাখার কারনে। ফলে জামাত বৃটিশ আমলে ছিল বৃটিশের সাথে, পাকিস্তানের আমলে পাকিস্তানের সাথে। আওয়ামীলীগ ওদের সাথে নিলে, ওরা আলীগের ভাষাতেই কথা বলবে। যে কাজে ব্যবসা চলে আর কি।

এখানে লক্ষ্যনীয় গুজরাটে নরেন্দ্রমোদির মতন হিন্দুত্ববাদি, হিন্দুত্বের পথ আলগা করে উন্নয়নে মন দিতে বাধ্য হয়েছিলেন গণতন্ত্রের বাধ্যবাধকতায়। অন্য বিজেপি শাসক মুখ্যমন্ত্রীরা যথা রমন সিং বা শিবরাজ চৌহান ও ধর্ম ছেরে সার্বিক উন্নয়নকে অস্ত্র করেই ভোটে লড়ে জিতছেন। গণতন্ত্রের চাপই তাদের বাধ্য করেছে উন্নয়নমুখী রাজনীতি করতে। ভারতের রাজনীতিতে ধর্ম গুরুত্বপূর্ন হলেও শুধু ধর্মকে এজেন্ডা করে কোন পার্টি টিকবে না।

মুশকিল হচ্ছে জামাতের ধর্মীয় উগ্রতার লঘুকরন হল না কেন। বরং তাদের ধর্মীয় উগ্রপন্থা বেড়েছে। গণতান্ত্রিক নিয়মে তা হওয়া উচিত না। কথাটা মিশরের ইসলামিক ব্রাদারহুডের জন্যও সত্য। কেন গণতান্ত্রিক পথে তাদের ইসলামিক উগ্রপন্থা কমছে না?

এর কারন কি ইসলাম একটি উগ্রপন্থী ধর্ম যার সাথে রাজনীতি আলাদা করা যায় না?

আমার মনে হয় সেটা না। ভারতের হিন্দুত্ববাদি দলগুলি শাসন ক্ষমতায় এসেছে এবং শাসকের গদিতে বসে বুঝেছে এবার আর হিন্দু রাজত্ব বললে কেও শুনবে না যদি খেতে না পায়। বাংলাদেশে এবং মিশরের সমস্যা হচ্ছে এখনো ইসলামিক পার্টিগুলির একটা বেস আছে, যারা বিশ্বাস করে, ইসলামের পথেই তারা ভাল থাকবে। মানে ভাল খেতে পড়তে পারবে। কারন তারা দেখেছে শাসন ক্ষমতায় আছে কিছু বাদামী সাহেব। ফলে ইসলাম তাদের ভাল কিছু করে দেবে এই মিথটা এখনো ভাঙে নি বাংলাদেশে বা মিশরে। যদ্দিন শাসন ক্ষমতায় না আসবে জামাত, ইসলামের স্বর্গীয় শাসনের মিথটা চলবে। কারন চোখের সামনে সাধারন মানুষ দেখছে বুর্জোয়া দলগুলি দুর্নীতিতে নিমজ্জ। ফলে তারাআশা করে এই সব ধর্মীয় দলগুলি সৎ রাজনীতি উপহার দেবে। এটা যে রূপকথা সেটা তারা বোঝে না। ১৯৯১ সালে সবাই মনে করত বিজেপি অন্য রকমের দল যেখানে দুর্নীতি সম্ভব না। কিন্ত তারা যেই ক্ষমতাই গেছে, সেইসব মিথ ভেঙে গেছে।

এই মিথটা ভাঙে নি বলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইসলাম এখনো বিশাল ছায়া ফেলছে।

বাংলাদেশের আরেকটা বড় দুর্বলতা সাংবিধানিক। আমেরিকাতে ক্ষমতা তিন ভাগে বিভক্ত-সেনেট, কংগ্রেস এবং প্রেসিডেন্ট। ভারতে ক্ষমতার দুটো ধাপ-লোকসভা এবং রাজ্যসভা। লোকসভার মেয়াদ শেষ হলে, রাজ্যসভার হাতে এক্সিকিউটভ ক্ষমতা থাকে। বাংলাদেশে ক্ষমতার বিভাজন নেই বা যা আছে দুর্বল। ফলে প্রধানমন্ত্রীর হাতে অত্যাধিক বেশী ক্ষমতা অর্পন করা হয়েছে। ক্ষমতার দুটী বা তিনটি স্তর থাকা উচিত-যাতে একটি ক্ষমতার কেন্দ্র বিদায় নিলে, অন্যটির হাতে ক্ষমতা থাকে। বাংলাদেশে শুধু লোয়ার হাউস আছে-আপার হাউস নেই। এটা না থাকা ক্ষতিকর। বিশেষত এই ইলেকশনের সময়ে।

এছারা রাজনৈতিক সংস্কার ও দরকার। বাংলাদেশের দুটিদলই চলে পরিবারের আইনে। ভারতে কংগ্রেস এইভাবে চলে। দলের মধ্যে কোন আভ্যন্তরীন নির্বাচন হয় না। ফলে কোন ভাল রাজনীতিবিদও ঊঠে আসে না।

তাহলে সমাধান কি?

আমি মনে করি-সমাধান নাগরিক সমাজ। সমাধান অরবিন্দ কেজরিওয়ালের মতন আম আদমি বা সাধারন মানুষের পার্টির উত্থান হোক বাংলাদেশে যারা এই দুই পার্টির সাঁড়াশি থেকে বাংলাদেশকে উদ্ধার করবে। অধিকাংশ মানুষ যখন দুই পার্টির পারিবারিক শাসনে বীতশ্রদ্ধ, তখন দরকার তৃতীয় বিকল্প। বাংলাদেশের মাটি আম আদমি পার্টির মতন এক তৃতীয় শক্তির উত্থানের জন্য প্রস্তত। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাদের ভোটদান এটাই প্রমান করে, তারা সুস্থ জীবন চাইছেন। তাদের ভারত, পাকিস্তান ইসলাম ইত্যাদি জুজু দেখিয়ে ভোলানো কঠিন। আম আদমি পার্টির মতন দুর্নীতি বিরোধি, সাধারন মানুষের সমস্যাগুলি নিয়ে কোন রাজনীতির উত্থান হলে উড়ে যাবে বি এন পি এবং আওয়ামী লীগ। যেভাবে দিল্লীর রাজনীতিতে সাফ হচ্ছে কংগ্রেস। সেই সাধারনের পার্টির ভিত্তি বাংলাদেশে মজবুত। সময় শুধু অপেক্ষার কিভাবে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের মতন একজন উঠে আসবে নতুন রাজনীতি নিয়ে।