কুণাল জাতকের পর এইবার আমরা আলোচনা করবো ৫৪৫ নম্বর জাতক যার নাম বিদূরপণ্ডিত জাতক। বিদূরপণ্ডিত জাতকের মূল চরিত্রে আছেন মহাপণ্ডিত বিদূর। এই মহাপণ্ডিত মহাপুরুষ বিদূরের ছিল মাত্র এক সহস্র ভার্যা এবং শপ্তশত গণিকা। যৌন সম্পর্কে অত্যাধিক অভিজ্ঞ পণ্ডিত বিদূরের কাছে আমরা জানতে পারি যৌন বিজ্ঞান সম্পর্কে। পণ্ডিত বিদূরের মতে অত্যাধিক নারীর সহিত মিলনে পুরুষের বীর্যক্ষয় হয়। যেহেতু একজন বীর্যবান পুরুষের কাছে সব থেকে মূল্যবান বস্তু হল তার বীর্য তাই যে কোন প্রকারেই হোক এই মহামূল্যবান বীর্যকে সংরক্ষণ করতেই হবে। আর পুরুষের অবশ্যই মনে রাখা উচিত যে এই বীর্য সংরক্ষণের প্রধান প্রতিবন্ধকতা হল নারী।

আসুন এখন কথা না বাড়িয়ে আমরা মহাপণ্ডিত বিদূরের কাছ থেকে নারী সম্পর্কিত নীতিগাঁথা গুলো শুনিঃ

“অত্যধিক স্ত্রী সংসর্গে হয় বীর্যঃক্ষয়
কাস, শ্বাস, দুর্বলতা, সর্বাঙ্গে বেদনা
বুদ্ধির বিলোপ আর এসব কুফল
দেখি স্ত্রী সংসর্গে সদা হয় মিতাচার।
ধনরত্নে পরিপূর্ণ বসুন্ধরা যদি
দেয় কেহ রমণীকে ভাবি ইহা মনে
আমিই ইহার প্রিয় অন্য কেহ নয়,
অবকাশ পেলে কিন্তু সেই নারী আবার
করিবে সে পুরুষকে তৃণবৎ জ্ঞান।
নারীর চরিত্রে হেন কলুষতা হেরি
অসতীর সঙ্গ ত্যাগ করে ধর্মবিদ।”

নারীরক্ষা পুরুষতন্ত্রের জন্য অন্যতম দুশ্চিন্তার কারণ। নারীদের যে কখনোই বিশ্বাস করতে হয়না তার দৃষ্টান্ত আমরা পাই ৩৯ নম্বর জাতকে যার নাম নন্দ জাতক। এই জাতকের অতীত বস্তুতে দেখা যায়, বৃদ্ধের তরুণী স্ত্রীর গর্ভে একটা পুত্র সন্তান জন্মায় আর এনিয়ে সে চিন্তিত হয়ে পড়ে এবং তার মতো বৃদ্ধের পক্ষে আসলেই উৎপাদন করা সম্ভব কিনা তা নিয়ে মনে মনে সংশয় প্রকাশ করে। এছাড়া বৃদ্ধ বলে “আমার স্ত্রী যুবতী, আমার মৃত্যু হলে না জানি অন্য কোন পুরুষকে আশ্রয় করবে।” এভাবেই স্ত্রীকে সন্দেহ করে যাচ্ছে পুরুষ যদিও পুরুষকে সন্দেহ করার অধিকার পুরুষতন্ত্র দেয়নি নারীকে।

শত্তুভস্ত্রা জাতক নামক ৪০২ নম্বর জাতকের অতীত বস্তুতে দেখা যায়, এক ব্রাহ্মণ তার ভিক্ষালব্ধ জিনিষ অন্য এক ব্রাহ্মণের হেফাজতে রাখে কিন্তু দ্বিতীয় ব্রাহ্মণ তা খরচ করে ফেলায় আপন কন্যার সাথে প্রথম ব্রাহ্মণের বিয়ে দিয়ে শেষপর্যন্ত ঋণমুক্ত হয়। এখানে নারীকে বিক্রয় করা হয়েছে বললে অত্যুক্তি হবেনা। পিতা দায়মুক্ত হল ঠিকই কিন্তু কন্যার কথা চিন্তা করলেন না। যুবতী কন্যা বাবার বয়সী বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ সহবাসে তৃপ্ত না হওয়ায় এক তরুন ব্রাহ্মণের প্রতি প্রনয়াসক্ত হয়। আর এর মাধ্যমেই তরুণী যে কতো বড় বেশ্যা তা ইনিয়ে বিনিয়ে বুঝানো হয়েছে এই জাতকটিতে।

পুরুষতন্ত্রের নিকট নারীর দুর্নামের ক্ষেত্রে মাতাকেও ছাড় দেয়নি বৌদ্ধ ধর্মীয় শাস্ত্র। আমরা এই বিষয়ে আলোচনা করবো ৬১ নম্বর জাতক যাকে অশাতমন্ত্র জাতক বলা হয়। এই জাতকের বর্তমান বস্তুতে রয়েছে, গৃহকর্মে উৎসাহী ব্রাহ্মণ যুবককে তার পিতামাতা পুনর্বার গুরুর নিকট পাঠায় নারী চরিত্রের দোষ অনুধাবন করে সংসার-বৈরাগ্য লাভের উদ্দেশে। মাতাপিতার পরামর্শে সে গুরুর নিকট অশাতমন্ত্র দীক্ষায় প্রত্যাশী হয়। অশাতমন্ত্র বলতে সহজ ভাবে বুঝানো হয় অমঙ্গল বিষয়ে সচেতনতার বিদ্যা আর বৌদ্ধ ধর্ম অনুসারে নারীরাই হল এই বিদ্যার কেন্দ্র অর্থাৎ অমঙ্গলের মূল।

গুরুর বৃদ্ধ মাতা জীবিত ছিল এবং গুরুই তার সেবা করতো। এজন্য লোকে গুরুকে ঘৃণা করতো কিন্তু মাতৃসেবা কেন ঘৃণ্য বিষয় হবে তার কোন ব্যাখ্যা জাতকটিতে নেই। ব্রাহ্মণ পুত্রকে গুরু তার মাতার সেবায় নিয়োগ করলেন। ব্রাহ্মণ পুত্র সেবা করতে করতে গুরু মাতার প্রশংসা করতো এই ভাবেঃ “জরাগ্রস্ত হইয়াও আপনার কি অপরূপ দেহকান্তি, না জানি যৌবনকালে আপনি কীদৃীশি রুপলাবণ্যসম্পন্না ছিলেন।” এভাবে কিছুদিন রুপকীর্তন করার ফলে বৃদ্ধার মনে হল ব্রাহ্মণ পুত্র প্রণয় প্রত্যাশী।

বৃদ্ধ মাতা ব্রাহ্মণ পুত্রকে প্রণয়ে উৎসাহিত করলে ব্রাহ্মণ পুত্র তার গুরুভীতির কথা জানান। বৃদ্ধা মাতা তখন তার পুত্র অর্থাৎ গুরুকে হত্যা করার জন্য ব্রাহ্মণ পুত্রকে উৎসাহিত করেন। কিন্তু তাতে ব্রাহ্মণ পুত্র স্বীকৃত না হওয়ায় নিজেই কৌশলে নিজ পুত্রকে হত্যা করতে আগ্রহী হয়। জাতকের ভাষায় –

“ স্ত্রীজাতি এমনি অসতী ও নীচাশয়া যে এতো অধিক বয়স্কা বৃদ্ধাও কামভাবের বশবর্তী হইয়া বোধিসত্তের ন্যায় ভক্তিশীল ও শুশ্রষাপরায়ণ পুত্রের প্রাণসংহারের জন্য প্রস্তুত হইলো।”

কিন্তু ব্রাহ্মণ পুত্র তার গুরুকে তার মায়ের সব কিছু বলে দেয়। ব্রাহ্মণ পুত্রের প্রণয় না পেয়েই লজ্জায় অপমানে পৃথিবী ছেড়ে চলে যায় বৃদ্ধা মাতা। বৃদ্ধার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষে গুরু তার বিদ্যার্থীকে জানায়ঃ “বৎস স্ত্রীজাতি মানেই অসতী এবং ইহাই অসতমন্ত্রের সারকথা। তোমার পরিবার আমার কাছে পাঠিয়েছে ইহার কারণ এই যে তুমি স্ত্রীজাতির দোষ জানিতে পারিবে। আমার মাতার চরিত্রে কি দোষ ছিল তাহা তুমি স্বচক্ষে দেখিতে পারিলে। ইহা হইতেই বুঝিতে পারিবে রমণীরা কীদৃীশি অসতী হতে পারে।” এরপর বিদ্যার্থী ব্রাহ্মণ পুত্র নারী বিষয়ে জ্ঞানলাভ করার পর সংসারে ফিরে না গিয়ে প্রব্রজ্যা (সন্ন্যাস) গ্রহণ করে। গুরু দ্বারা অশতমন্ত্র প্রাপ্ত হয়ে ব্রাহ্মণ পুত্রের মুখ দিয়ে বের হয়ে আসে নীতিগাথাঃ

“নারীর চরিত্র হায়, কে বুঝিতে পারে?
অসতী প্রগলভা বলি জানি সবাকারে।
কামিনী কামাগ্নি তাপে জবে দগ্ধো হয়
উচ্চে নীচে সমভাবে বিতরে প্রণয়।
খাবার প্রস্তুতে বিচার নাই আগুনের ঠাই
নারীর প্রেমে পাত্রাপাত্র ভেদ জ্ঞান নাই।
অতএব ত্যাজি হেন জঘন্য সংসার
সন্ন্যাসী হইবো এই সংকল্প আমার।”

এইবার আমরা আলোচনা করবো বৌদ্ধ শাস্ত্রের ৬২ নম্বর জাতক যার নাম অন্ধভূত জাতক। এই জাতকের বর্তমান বস্তুতে শাস্তা এক উৎকণ্ঠিত ভিক্ষুর উদ্দেশ্যে বলেন- “রমণীরা নিতান্তই অরক্ষণীয়া। পুরাকালে জনৈক পণ্ডিত কোন রমণীকে তাহার ভূমিষ্ঠ হইবার সময় অবধি রক্ষণাবেক্ষণ করেও সৎপথে রাখিতে পারেন নি।” এই জাতকের অতীত বস্তুতে আমরা জানতে পাই, বোধিসত্ত্ব ছিলেন রাজা যিনি তার পুরোহিতের সাথে দ্যূতক্রিয়া করতেন। এই ক্রিয়ায় তিনি একটি মন্ত্র পাঠ করতেন এবং পুরোহিত প্রতিবারেই হেরে যেতো। মন্ত্রটার গাথা হল নিম্ন রুপঃ

“যাহার স্বভাব যেই,
সেই মতে চলে সেই,
কি সাধ্য কাহার করে প্রকৃতি লঙ্ঘন?
বনভূমি পায় যথা,
তরুরাজি জন্মে তথা,
আঁকা বাঁকা পথে সদা নারীর গমন।
পাপাচার পরায়ণ,
জানিবে রমণীগণ,
স্বভাব তাদের এই নাহিক সংশয়।
যখনই সুবিধা পায়,
কুপথে ছুটিয়া যায়,
ধম্মে মতি তাহার কভু নাহি হয়।”

প্রতিদিন হারতে হারতে পুরোহিত বুঝতে পারলো চরিত্র দোষ হয়নি এমন একজন নারী সংগ্রহ করতে পারলেই এই মন্ত্রের ক্ষমতা হারিয়ে যাবে। এজন্য সে সদ্যভূমিষ্ঠ কন্যা সংগ্রহ করে লালন পালন করতে লাগলো এবং মেয়েটি যৌবনে পদার্পণ করলে পুরোহিত তাকে নিজেই বিয়ে করলো। পরে একদিন রাজার সঙ্গে দ্যূতক্রিয়ায় প্রবিত্ত হয়ে পুরোহিত জিতে গেলো। রাজা মন্ত্র পাঠ করলেও জিততে না পেরে বুঝল যে পুরোহিতের গৃহে নিশ্চয়ই এমন কোন নারী আছে যে পতি ব্যাতিত অপর কোন পুরুষে আসক্ত হয়নি। রাজার অনুমান সত্য হওয়ায় নারীটিকে প্রলোভনের ফাদে ফেলে চরিত্রভ্রষ্ট করলো রাজা।

এরপর আবার দ্যূতক্রিয়ায় হেরে গেলো পুরোহিত। তখন পুরোহিত বুঝতে পারলো যে ইতিমধ্যেই তার রমণীর পবিত্রতা নষ্ট হয়েছে। তখন রাজা বলেন “রমণীদের নিজের কুক্ষির অভ্যান্তরে রাখিয়া নিয়ত সঙ্গে লইয়া বেড়াইলেও রক্ষা করা অসম্ভব। জগতে বোধহয় এমন স্ত্রী নেই যে স্বামীভিন্ন পুরুষান্তরের সংসর্গে আসে নাই।“ রাজার বক্তব্য জানার পর পুরোহিত তার স্ত্রীকে প্রশ্ন করে ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে অবগত হতে পারেনা, বরং নারীটি তার চারিত্রিক বিশুদ্ধতা প্রমাণের জন্য অগ্নি পরীক্ষা দিতেও প্রস্তুত হয়। এদিকে পরিচারিকার মাধ্যমে নারীটি পূর্বেই ধূর্তকে সংবাদ প্রদান করে এবং অগ্নিতে প্রবেশের পূর্বেই ধূর্ত নারীটির হাত ধরে ফেলে। নারীটি তখন ঝাপ না দিয়ে দাবী করে যে এই হাত ধরার মাধ্যমেই তার সতীত্ব নষ্ট হয়েছে। কিন্তু ব্রাহ্মণ বুঝতে পারে সবোই নারীটির কৌশল এবং এজন্য সে নারীটিকে প্রহারের পরে বিতাড়িত করে। জাতকের শেষাংশে রাজারুপী বোধিসত্তের নারী সম্পর্কিত নির্দেশনা উচ্চারিত হয় এভাবে,

নারীর স্বভাব এই দেখিবারে পাই,
চৌরী, বহুবুদ্ধি তারা; সত্যজ্ঞান নাই।
জলমধ্যে যাতায়াত করে মৎস্যগণ
কে পারে তাদের পথ করিতে দর্শন?
রমণী হৃদয় ভাব তেমতি দুর্জ্ঞেয়
মিথ্যা তারা সত্য বানায়, সত্য করে হেয়।
নিত্য নব তৃণ খোঁজে গাভীগণ যথা
কামিনী নতুন বর নিত্য চায় তথা।
ভুজঙ্গিনী খলতায় মানে পরাজয়,
চাপল্যে বালুকা ভয়ে দূরে সরে যায়।
পুরুষ চরিত্র জ্ঞানে অদ্বিতীয়া নারী,
নখদর্পণেতে আছে সংসার তাহারি।

(চলবে)

বৌদ্ধশাস্ত্রে পুরুষতন্ত্র (পর্ব ০২)

বৌদ্ধশাস্ত্রে পুরুষতন্ত্র (পর্ব ০১)