ভিন্নমাত্রার বিজয় দিবস ২০১৩

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে দায়মোচনের শুরু দিয়ে আমাদের প্রথম বিজয় দিবস উদযাপন আজ। সবাইকে মহান বিজয় দিবসের প্রাণঢালা-শুভেচ্ছা ! এই মাটি আমার মা, এই মাটি আমার একান্ত ঠিকানা। এই মাটিতেই মিশে আছে আমাদের জন্ম-জন্মান্তরের স্বজনেরা। আমাদের জন্মের ঋণ সেইসব লাখো শহিদের আত্মত্যাগের কাছে দায়বদ্ধ। যদি নিজের জন্মকে আজ অস্বীকার না করি, আসুন, লাখো শহিদের রক্তধোয়া এই পবিত্র মাটি ছুঁয়ে পাকিস্তানি প্রেতাত্মা মুক্ত দেশ গড়ার রক্ত-শপথে দৃঢ় আঙ্গীকার করি আজ ! আমরা যে তাঁদেরই প্রজন্ম !

আজকের এই ভিন্নমাত্রিক বিজয় দিবস উদযাপনের মধ্য দিয়ে আমাদের অঙ্গীকারটা আরো স্পষ্ট করে বুঝে রাখা দরকার যে, এ মুহূর্তে একাত্তরের সেই পরাজিত শক্তির নৈরাজ্য যে মাত্রায় পৌঁছেছে তার পেছনে সবচাইতে বড় ইন্ধনটা কিন্তু অব্যাহত রেখেছে ইদানিংকালের বুদ্ধিবৃত্তিক নব্য রাজাকার শ্রেণীটা। এই মহলটা এতোকাল নিজেদেরকে এতোটাই নিশ্ছিদ্র মুখোশের আড়ালে ঢেকে রেখেছিলো যে, আমরা তাদের ব্যাপারে এতোটাই আপাদমস্তক বিভ্রান্ত ছিলাম যে, হাল আমলের টকশোখানা নামক বুদ্ধিবাক্সে তাদের নিয়মিত বিকৃত মিথ্যা বক্তব্য প্রচারণা দেখে রীতিমতো হকচকিয়ে যাচ্ছি। কারণ আমরা তাদেরকে নিজেদেরই লোক ভেবেছিলাম, মুক্তিযুদ্ধের অকৃপণ পক্ষশক্তির বলে বিবেচনা করেছিলাম। এবং তারা যত্রতত্র উপস্থিত হচ্ছেন সুশীল, নিরপেক্ষ, মানবাধিকারবাদী, বিশিষ্ট নাগরিক ইত্যাদি অভিধার বহু বহু মুখোশের আড়ালে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশজুড়ে সেই রাজাকার হায়েনাদের আদর্শপুষ্ট সন্ত্রাসীদের নৈরাজ্যকে আড়াল করে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাঁড়ে চাপানোর মধ্য দিয়ে তাদের মুখনিঃসৃত সুমিষ্ট বাণীগুলো আসলে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তির নগ্ন পক্ষপাতদুষ্টতা। স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধাপরাধীর বিচার, এসব ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা মানেই যে তার স্পষ্ট বিরোধিতা, এটা জেনেও এরা কৌশলে রাজনৈতিক সমঝোতা, গণতন্ত্র ইত্যাদির দোহাই টেনে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে আমাদের প্রাণের চেতনাকে বিতর্কিত করার অপপ্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। এবং তা করতে গিয়ে তারা তাদের সেই নিপুণ মুখোশগুলোকে ফালা ফালা করে তাদের স্বরূপটাকেই উন্মোচন করে দিয়েছে।

এভাবে তারা নব্য বুদ্ধিজীবী সেজে আমাদের শ্রদ্ধাপূর্ণ ‘বুদ্ধিজীবী’ শব্দটাকেও খুব চতুরতার সাথে কলঙ্কিত করার অপপ্রয়াস নিয়েছে। তারা ভুলে যান, ‘বুদ্ধিজীবী’ শব্দটা আমাদের প্রাণের আত্মীয়, আমাদের খুব গোপন তন্ত্রীতে কষ্টের টংকার। তাই তাদের এই ঘৃণ্য নব্যরূপকে চিহ্নিত করতে শ্রদ্ধাপূর্ণ বুদ্ধিজীবী শব্দটি তাদের জন্য ব্যবহার না করে আমরা ব্যবহার করি বুদ্ধিব্যাপারী, বুদ্ধিবেশ্যা ইত্যাদি বলে। নিজেদের হীন প্রচেষ্টায় এরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিনষ্ট করতে এরা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের রাজনীতিটাকেও বিতর্কিত করতে উদ্যত হয়েছে, যাতে নতুন প্রজন্ম রাজনীতি বিমুখ হয়ে গেলে গোটা দেশটা তাদের পৈশাচিক ক্রিড়াক্ষেত্রে পরিণত হতে পারে। আমরা কি তা এমনি এমনি ছেড়ে দেবো ? আমাদের অঙ্গীকারগুলো রক্ত-শপথে বাধিয়ে নিতে আসুন ছোট্ট একটু পর্যালোচনা করে ফেলে ফেলি।

বুদ্ধিবৃত্তি বনাম বুদ্ধিবেশ্যামী

যারা বলে রাষ্ট্রের সমস্যার মূল হচ্ছে রাজনীতিকরা, ব্যক্তিগত পর্যালোচনায় মনে হয়, তারা হয় মূর্খ নয় মিথ্যুক ! কেননা রাষ্ট্রের রাজনীতিক কিংবা রাজনীতির চালিকাশক্তিটি নিয়ন্ত্রিত হয় মূলত রাষ্ট্রের বুদ্ধিবৃত্তিক উৎসস্থল থেকে। যাদেরকে আমরা চরিত্রভেদে বলে থাকি বুদ্ধিজীবী কিংবা এর বিপরীতে বুদ্ধিব্যাপারী বা বুদ্ধিবেশ্যা।

মেধাবী বুদ্ধিজীবীদের নিয়ন্ত্রণে থাকলে একটা যোগ্য গণমুখি রাজনৈতিক আন্দোলন যে একটা জাতির স্বপ্নকেই বাস্তবে রূপায়ন করে দিতে পারে, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে সৃষ্ট বাঙালির একাত্তর। আর কোন রাজনীতি যদি চরিত্রহীন বুদ্ধিবেশ্যাদের কবলে পড়ে যায়, তখনই বিএনপি-জামায়াতের মতো প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠির মাধ্যমে তৈরি হয়ে যায় একটা গণবিচ্ছিন্ন নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি, যার নিকৃষ্ট নমুনা হলো এই দু’হাজার তের !

অতএব আপনি মানুন কি না-মানুন, বলা যেতেই পারে, রাষ্ট্রের স্বস্তি ও সুস্থতা নিশ্চিত হয় কল্যাণকামী বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাজগৎ তথা মেধাবী বুদ্ধিজীবীদের সমূর্ত যোগ্যতায়, যারা পথ দেখায়, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে তুলে নেয় না। আর রাষ্ট্রের অকল্যাণ ও নৈরাজ্যকর নিরাপত্তাহীনতা চেপে বসে চতুর বুদ্ধিবেশ্যাদের ধূর্ত ভণ্ডামির সক্রিয়তায় ! মুখোশধারী এরা নিরপেক্ষতার আড়ালে বস্তুত নিজেরাই ক্ষমতা বিলাসী ! এবং একটা রাজনৈতিক দলের যোগ্যতাও নির্ধারিত হয় এই সক্রিয় বুদ্ধিবৃত্তিক চারিত্র্য-সাপেক্ষেই। ফলে, কল্যাণ আর অকল্যাণের মাঝখানে নিরপেক্ষ অবস্থান বলতে আদৌ কিছু থাকে কি ?

রাজনীতিক বনাম বুদ্ধিব্যাপারী

যে যাই বলুন না কেন, রাজনীতিকরা কিন্তু শেষপর্যন্ত একটা দায়বদ্ধ শ্রেণীই, যাঁদেরকে রেলের মতো একটা লাইন ধরেই এগুতে হয়। ভিন্নপথ কিংবা নতুন পথ ধরতে হলেও, যদি তা ভুল পথও হয়, তাঁদেরকে আগেভাগে আরেকটা নির্দিষ্ট লাইন তৈরি করেই সেদিকে যেতে হয় এই দায়বদ্ধতায় আটকে থাকার কারণেই। সে বিচারে বুদ্ধিব্যাপারীরা কিন্তু একেবারেই দায়বদ্ধহীন স্বাধীন। স্বাধীনতাও এক ধরনের দায়বদ্ধতা। কিন্তু রাজনীতিকদের মতো ধাপে ধাপে নিজের দায়বদ্ধতাকে স্বীকার ও প্রমাণের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হতে হয় না বলে এই হঠাৎ আবির্ভূত বুদ্ধিব্যাপারীরা কিন্তু প্রকারান্তরে স্বেচ্ছাচারীও হয়ে যেতে পারেন। কেননা তারা তো কারো কাছেই দায়বদ্ধ নন ! ফলে এই বুদ্ধিব্যাপারীদের স্বেচ্ছাচারী বালখিল্যতায় রাষ্ট্রে কোন একটা অঘটন ঘটে গেলেও দায়বদ্ধহীনতার কারণে এরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যান, আর সব দায় গিয়ে পড়ে সেই দায়বদ্ধ রাজনীতিকদের ঘাড়েই ! জবাবদিহি করতে হয় রাজনীতিকদেরকেই। কারণ তাঁরা রাষ্ট্র ও নাগরিকদের কাছে দায়বদ্ধ মেনেই রাজনীতিক হয়েছেন।

বস্তুত রাজনীতি একটা পেশা, যার জন্য দায়বদ্ধতামূলক জবাবদিহিতা আবশ্যক। কিন্তু বুদ্ধিব্যবসা চূড়ান্ত বিচারে একটা ব্যবসাই, যার সাথে অনিবার্যভাবেই মুনাফা জড়িত। আর যেখানে মুনাফা থাকে সেখানে এই মুনাফার স্বতঃস্ফূর্ত আগ্রাসিতাই তাদেরকে ক্ষমতালোভী করে তোলে। এটাই মুনাফার ধর্ম। ফলে নাগরিকদের কাছে প্রদত্ত অঙ্গীকার পূরণে বৈধ ক্ষমতাকেন্দ্রী দায়বদ্ধ রাজনীতিক না হওয়ায় ক্ষমতালাভের উদগ্র ইচ্ছায় এসব বুদ্ধিব্যাপারীদেরকে তখন কোন-না-কোন বিকল্প উপায় খুঁজতে হয়। রাজনীতিকদের দূর্বলতাগুলো খুঁজে খুঁজে একটা অস্থিরতার ঘোট পাকাতে হয়।

বুদ্ধিজীবীদের সাথে বুদ্ধিব্যাপারীদের গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যটাও এখানে যে, বুদ্ধিজীবীরা রাজনীতিক বা রাষ্ট্রনীতিকদের দূর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে তা সংশোধনের উপায় বাৎলে দেন যেন রাজনীতিকরা নিজেরাই তা ঠিক করে নেয়। আর বুদ্ধিব্যাপারীরা এই দূর্বলতাকে যেনতেন প্রকারে নিজেদের ক্ষমতালাভের একটা উপায় হিসেবে গ্রহণ করতে আগ্রহী হন মুনাফাকামিতার কারণে। অথচ তারা কিন্তু নাগরিকদের কাছে দায়বদ্ধ নন। দৃশ্যমান পণ্য তৈরি ও ব্যবসায়ও একটা নীতি ও আইন মেনে চলতে হয়। কিন্তু এই বিমূর্ত বুদ্ধিপণ্য তার বিমূর্ততার কারণেই সমস্ত নিয়ম-নীতির উর্ধ্বে থেকে যেতে পারে। ফলে অন্যের অধিকার ও সম্পদে হামলে পড়তে পারে। তাঁরা মনে রাখতে চান না যে, রাষ্ট্রপরিচালনা বস্তুতই দায়বদ্ধ রাজনীতিকদেরই বৈধ অধিকার।

অতএব, আপনি একমত হোন বা না-হোন, তবু নিজে নিজে একটু ভেবে দেখুন তো, রাষ্ট্রপরিচালনায় তত্ত্বাবধায়ক মানে কী ? রাষ্ট্র কি আদৌ দায়বদ্ধহীন হতে পারে ?

জাতি এখন স্পষ্টতই দুটো ভাগে বিভক্ত। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ ও মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ। এখানে বিভ্রান্ত হবার কোনো সুযোগ নেই যে, জাতি হিসেবে আমাদের পরিচয়ের সূত্রটা ঐ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মধ্যেই নিহিত বলে এই চেতনা বিনষ্টের যে কোন চক্রান্ত ও হীন প্রচেষ্টা রূখতে হবে এখনই। ওরাই এই দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে আবারো যুদ্ধ শুরু করেছে ঘোষণা দিয়েই। বাঙালি নৈতিক যুদ্ধে হার না-মানা জাতি। যুদ্ধকাল মানেই আপৎকাল। ফলে ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দকে পেছনে রেখে এ মুহূর্তে আমাদেরকেও স্বপক্ষের কোন যোগ্য নেতৃত্বকে শক্তি-সহায়তা জুগিয়ে যেতে হবে এখন। আর তাই এরকম আপৎকালীন সময়ের জন্য মহামতি এরিস্টটলের সেই অমর উক্তিটি স্মরণ করছি-

‘ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ মধ্যসমুদ্রে যাত্রীবোঝাই দিকশূন্য জাহাজকে কুলে নিতে যদি গণতান্ত্রিক উপায়ে দিক নির্ণয় করতে হয়, সে জাহাজের সলিল-সমাধি অনিবার্য।’