সুমনের একটা গানের লাইন আছে – ‘কয়েকটা দিন ভীষণ রঙিন’।  খুব প্রিয় একটি গানের লাইন।  আজ বিজয় দিবসের দিনে এই লাইনটি বারে বারেই মনের আঙিনায় উঠে আসছে।

এ যেন এক অন্যরকম বিজয়। ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার’ – যে আপাত অসম্ভব ঘটনাকে চিরসত্য  ভেবে নিয়ে দেশে বড় হয়েছিলাম আশি এবং নব্বইয়ের দশকে, যে সময়গুলোতে ‘জয় বাংলা’কে দেখা হত অস্পৃশ্য অচ্ছুৎ এক শব্দাবলী হিসেবে, সেই সময়ের এক কৈশোর অতিক্রান্ত তরুণ ছিলাম আমি। এ এক অলুক্ষণে সময় – যে সময়টাতে আমার চারপাশের বন্ধুবান্ধবেরা জোর গলায় বিএনপি করার কথা বলত, ইসলামী ছাত্র শিবির আর জামায়েতে ইসলামীর ‘হে তরুণ এস সত্যের পথে’ টাইপের চিকা মারা থাকতো বাড়ির আশে পাশের দেয়ালগুলোতে, আর আওয়ামিলীগকে দেখা হত ‘রুশ ভারতের দালাল হিসেবে’,   কিংবা ‘হিন্দুদের পার্টি’ হিসেবে। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ ছিল রেডিও টেলিভিশন থেকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ। নিষিদ্ধ ছিল ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ এর মত অসংখ্য গানও। টিভির নাটকে আর চলচ্চিত্রে রাজাকার শব্দটি পারতপক্ষে মুখে তোলা হত না। পাকিস্তানের নাম না নিয়ে বলা হত ‘শত্রুরা’। … সেই সময় এক অখ্যাত তরুণ বুকের মধ্যে লালন করছিল  যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের স্বপ্ন। মনের গহীন কোনে আশা করে যাচ্ছিল  ঘুরে দাঁড়াবার। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও কি ভাবতে পেরেছিল সেই স্বপ্নগুলো সত্যি হয় উঠবে দুই দশকের মধ্যেই?

একাত্তরে জন্মেছিলাম আমি। আমার বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেইসব গুটিকয় শিক্ষকদের অন্যতম যিনি পঁচিশে মার্চের কাল রাত্রির পর  শহীদ সহকর্মীদের রক্ত ছুঁয়ে শপথ করেছিলেন যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরবেন। তা তিনি ফিরেছিলেন বটে। কিন্তু সেই যুদ্ধের সুফল কি তিনি তার ছেলের প্রজন্মের হাতে তুলে দিয়ে যেতে পেরেছিলেন?  তার ছেলেরা বড় হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে এক ঘৃণ্য পতিত রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে দেখে, আর জেনেছে বঙ্গবন্ধুদের হত্যাকারীরা সবাই ‘সূর্যসন্তান’। বড় বড় রাজাকারেরা কেউ মন্ত্রীসভায়, কেউবা লাখ লাখ মুরীদ জুটিয়ে ওয়াজ মাহফিলের দোকান খুলে বসেছে, কেউ বা দাঁড়িতে মেহেদী লাগিয়ে দাপিয়ে কুপিয়ে ইসলামী অনুষ্ঠান করে যাচ্ছে বিটিভিতে।  মুখচেনা রাজাকারদের মধ্যে কেউ কেউ এমনকি চোখের সামনে পেয়ে যাচ্ছে স্বাধীনতা পদকও।  দেশের মিডিয়াগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের কথা যত না শোনা যাচ্ছিল, তার চেয়ে বেশি প্রচারিত হত এক রাষ্ট্রপতির চোখে রেবন সানগ্লাস পরে খাল খনন বিপ্লবের কথা, কিংবা এক প্লেবয় রাষ্ট্রপতির প্রেমের কবিতা আর আবেগাপ্লুত দেশাত্মবোধক গানের কথা। মুক্তিযুদ্ধ যেটা কিনা বাঙালি জাতির জন্য হাজার বছরের শ্রেষ্ঠতম অর্জন বললেও অত্যুক্তি হয়না, তার চেতনা এবং ইতিহাস যেন ক্রমশঃ বিলীন হয়ে যাচ্ছিল মহাশূন্যে।

সেখান থেকেই, সেই ধ্বংসস্তূপ আর ছাইভস্ম থেকে যেন ফিনিক্স পাখির মতোই উত্থান আমাদের। শুরুটা করেছিলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম; নব্বইয়ের দশকে গোলাম আজমের জন্য গণআদালত গঠন করে। শেষটা করলেন শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরের অসম সাহসী উদ্দীপ্ত তরুণ তরুণীরা। কাদের মোল্লাকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে।  হাতের ফাঁক গলে বেরিয়েই যাচ্ছিলেন কাদের মোল্লা। অজস্র গুমখুন, হত্যা ধর্ষণের নায়ক, কসাই কাদেরের সেই বিখ্যাত দাম্ভিকতাপূর্ণ  ‘ভি’ সাইনের ব্যাপারটা কেউ সহজভাবে নিতে পারেননি। মোল্লাজি ভেবেছিলেন একাত্তরের পর যেভাবে মানুষকে ঘোল খাইয়ে ক্ষমতার রাজনীতিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন, এবারেও তাই হবে। কিন্তু বিধিবাম। ফুসে উঠা তারুণ্য তৈরি করল শাহবাগে এক অমর ইতিহাস।

সেই শাহবাগ। শাহবাগকে নিয়ে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম মনে পড়ে –

 নোনা স্যাঁতস্যাঁতে দেওয়াল, ঘুপচি ঘুপচি ঘর, আর রাস্তার ধারে নর্দমা, আর উসকোখুসকো অপরিচ্ছন্ন ভ্যাগাবণ্ড টাইপের লোকজনের আড্ডা – মনোমুগ্ধকর স্থান হিসেবে কারো মনে উঠে আসবে না নিঃসন্দেহে। কিন্তু আমাদের কাছে সেই এলাকাটাই ছিল পরম পূজনীয়, সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গাগুলোর একটি। দেশে গেলে বসুন্ধরা সুপারমার্কেট আমার যাওয়া পরে না, কিন্তু আজিজে ঢু মারা হয় ঠিকই। ভাবতেই ভাল লাগছে ঢাকাশহরের সবচেয়ে প্রিয় স্থানটি থেকে বিদ্রোহের বারুদ জ্বলেছে, আর এখন তো তা অগ্নিস্ফুলিঙ্গে রূপ নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সাড়া দেশে।

আরো আনন্দের ব্যাপার, কোন রাজনৈতিক দল এর নেতৃত্ব দেয়নি, দিয়েছে -আমরা যারা লেখালিখি করি তাদের মধ্যে থেকে উঠে আসা ব্লগার এবং ফেসবুক এক্টিভিস্টরা। যারা এতদিন ভার্চুয়াল লেখালিখি আর ইন্টারনেটে চেঁচিয়ে কিছু হবে না বলে কথার তুবড়ি ফোটাতেন, তাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে আজ দেখিয়ে দেয়া হয়েছে – ‘আমরাও পারি’।

 

আমরাই পারি!

হ্যা যে কাজটি আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম করতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছেন, আবদ্ধ হয়েছিলেন, বিক্ষত হয়েছিলেন রুদ্ধ হতাশ্বাসে, সেই কাজটি আমাদের প্রজন্ম সমাধান করেছে, খুব সুচারু ভাবেই।  আমরা পুরো জাতিকে উপহার দিতে পেরেছি এক ভিন্ন স্বাদের বিজয়।  এই বিজয়ের জন্য যে আমাদের আজকের এই তরুণ প্রজন্ম কৃতিত্ব দাবী করতেই পারে, তার প্রমাণ মেলে বিশিষ্ট লেখক ও এক সময়কার ডাক সাইটে টিভি প্রযোজক বেলাল বেগের স্ট্যাটাসে –

এই ভিন্ন স্বাদের বিজয়ের উদযাপনে  মুক্তমনাও সেজেছে নতুন সাজে।  অনেকেই দেখছেন আজ মুক্তমনায় লাল সবুজের সমারোহ। সেই ম্যাড়মেড়ে নীল রঙের সাইডবার আর মেনুর জায়গায়  খেলা করছে সবুজের স্পন্দন। সে সমস্ত জায়গায় মাউস নিলে দেখবেন লালের চোখ রাঙানি ভেসে উঠছে। জাতীয় পতাকে খুঁজে পাবেন পাঠকেরা এই সাইটে যেন। মুক্তমনার লেখক লেখিকারা চমৎকার  সব নতুন নতুন লেখার সমারোহ ঘটিয়েছেন দিনটিকে সামনে রেখে। আদিল মাহমুদ  লিখেছেন – ‘মুক্তিযোদ্ধা জালাল ভাই ও সমকালীন বাংলাদেশ’, ফরিদ আহমেদ লিখেছেন, রক্ত পলাশের রঙ, আরিফ রহমান  লিখেছেন, ‘কসাই কাদের আর মোল্লা কাদের নাকি এক ব্যক্তি ছিলেন না; বীরাঙ্গনা মোমেনা বেগম আমায় ক্ষমা করবেন’।  সাব্বির হোসাইন  লিখেছেন ‘একাত্তরে বুদ্ধিজীবি হত্যাকাণ্ড’। কাদের মোল্লার ফাঁসির পর পরই ব্লাডি সিভিলিয়ান লিখেছিলেন, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’।

চমৎকার কিছু কবিতাও এসেছে। কাজি মামুনের ‘অন্য রকম সকাল’, কাজী রহমানের বীরাঙ্গনা, শাখা নির্ভানার ‘কুষ্ঠ বিকার’ ইত্যাদি।

পাশাপাশি, ইংরেজি ব্লগে আছে রায়হান রশীদের ‘We demand proceedings be brought against the Pakistani War Criminals of 1971 immediately’,  ড. মোজাম্মেল এইচ খানের ‘Quader Mollah: fact versus fiction’ এবং ফরহাদের ‘War Crime Trials and The Role of International Community’ ইত্যাদি। সামনে নিশ্চয় এ ধরণের আরো লেখা আসবে।

মুক্তমনার জন্য খুব অল্প সময়ের মধ্যে চমৎকার কিছু ব্যানার করে দিয়েছেন গুণী চিত্রশিল্পী এবং মুক্তচিন্তক আসমা সুলতানা মিতা (তার কাজ সম্পর্কে  আরো জানতে হলে দেখুন এখানে)।  তার চমৎকার ব্যানারগুলো এখানে –

এই বিজয়ের দিনে যারা মুক্তমনাকে প্রাণবন্ত এবং স্পন্দিত করে তুলেছেন, সেই লেখক পাঠক, কবি, চিত্রশিল্পী সবাইকে জানাচ্ছি মুক্তমনার পক্ষ থেকে অভিনন্দন।  আজ গাইতে ইচ্ছে করছে সুমনের মতোই –

ইচ্ছে করে অন্য একটা আকাশ দেখি

একই মাটির উপর অন্য দিক দিগন্ত

অন্য শস্য অন্যরকম ফুল ফুটন্ত

অন্য সময় আসুক এবার ইচ্ছে করে

আমার দেশে সবার দেশে সবার ঘরে…

 

ফুল গুলোকে তাই বলে কি বাদ দিতে চাই?

শস্য এবং ফুলের জন্য গান গেয়ে যাই

ইচ্ছে করে স্বপ্ন ধরুক অন্য মানে

বেচে থাকার অন্য কথায় অন্য গানে।।

 

সবাইকে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা। সকল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং জামাত-শিবিরের রাজনীতি চিরতরে নিষিদ্ধ করার দাবী হয়ে উঠুক এবারকার বিজয় দিবসের অঙ্গীকার।