বিভ্রান্তিতে ফেসবুক ব্লগ তোলপাড়, লেখার শুরুতেই একটা কথা বলতে চাই, কাদের মোল্লা এবং তার আইনজীবীদের মতে কাদের মোল্লা ও কসাই কাদের আলাদা ব্যাক্তি এবং তাদের দাবী বিহারী কসাই কাদের খুনের দায়ে মোল্লা কাদেরের ফাঁসি হয়ে যাচ্ছে। কাদের ট্রাইব্যুনালকেও বিভিন্নবার বলেন:

“আজ এই কোরআন শরীফ হাতে নিয়ে আমি আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, ১৯৭১ সালে মিরপুরে কসাই কাদের কর্তৃক যেইসব হত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো তার একটি অপরাধের সাথেও আমার দূরতম কোন সম্পর্ক নেই। কাদের মোল্লা বলেন, আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি আমি ১৯৭৩ সালের আগে কোনদিন মিরপুরেই যাইনি।”

তাহলে একটা বিষয় পরিস্কার, আমরা যদি প্রমাণ করতে পারি কসাই এবং মোল্লা এক ব্যাক্তি তাহলে একসাথেই প্রমাণ হয় মানবতা বিরোধী অপরাধের দায়।

বিভিন্ন ভাবেই এটা প্রমাণ করা যায়, এই ছবিটি দেখুন একাত্তরে কাদের মোল্লার:

এই ছবি নিয়েও জল কম ঘোলা করা হয় নি। যারা মানতে নারাজ এই ছবির কাদের মোল্লা সেই কাদের মোল্লা না তাদের জন্য আরেকটি ছবি (ছবির কৃতজ্ঞতা “নিঝুম’দা কে”)।

প্রথম ছবিতে ১৯৭১ সালে নিয়াজির পেছনে দাঁড়িয়ে কাদের মোল্লা। দ্বিতীয় ছবি কাদের মোল্লার ৭০ দশকের ফরমাল ছবি। এই ছবি উদ্ধার করে পাশা পাশি দুইটি ছবির ব্যাবচ্ছেদ করা হয়েছে। এই ব্যাপারে আমরা কথা বলি কাদের মোল্লার বন্ধু “মোজাম্মেল খানে”র সাথেও। তিনি আমাদের জানানঃ

“He was 1 and half year older than me. He was around 23/24 in 1971. The man behind Niazi does not look any older than the age I mentioned. Looking at his hair style he looks no doubt that he is Quader.”

এর পরে কি আর কোন সন্দেহ থাকে এই ছবির ব্যাপারে ?

কিংবা আজকের কথাই ভাবুন:

পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী নিসার বলেছেন –

“১৯৭১ সালের ঘটনার ৪২ বছর পর কাদের মোল্লার ফাঁসি একটি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের প্রতি বিশ্বস্ততা ও সংহতির জন্য কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। তার মৃত্যুতে সকল পাকিস্তানি মর্মাহত এবং শোকাহত। তিনি আরো বলেন, এ ঘটনার মাধ্যমে পুরানো ক্ষত আবারো জাগিয়ে তোলা হয়েছে।”

“জামায়াতে ইসলামি পাকিস্তানের প্রধান মুনাওয়ার হাসান কাদের মোল্লাকে তাদের ‘বাংলাদেশি সহচর’ আখ্যায়িত করে তার ফাঁসিকে শোচনীয় বলে মন্তব্য করেন।” কাদেরের ফাঁসি দেয়ায় বাংলাদেশ আক্রমণের জন্য নিজেদের সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে পাকিস্তানের রাজনৈতিক দল জামায়াত-ই-ইসলামী। কসাই কাদের আর কাদের মোল্লা এক ব্যক্তি না হলে পাকিস্তানী জামাতের এত শখ হল কেন এই বিবৃতি দেবার?

বারবারই বাংলাদেশের জামাত দাবী করে এসেছে কসাই কাদের আর কাদের মোল্লা এক ব্যাক্তি নন, তারা হাজির করে কাদেরের জাবনবন্দী, যেখানে কাদের বলেছিলো:

“১৯৭১ সালের ১২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের আমিরাবাদ চলে যান এবং মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়ই তিনি গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করেন। গ্রামে অবস্থানকালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও হাই স্কুলের প্রায় ৩০ জন ছাত্রের সাথে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ থেকে ১ মে পর্যন্ত (পাকিস্তান সেনাবাহিনী ফরিদপুরে পৌঁছার দিন পর্যন্ত) অন্যদের সাথে তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ চালিয়ে যান। সেনাবাহিনীর জুনিয়র কমিশনড অফিসার (জেসিও) মফিজুর রহমান ডামি রাইফেল দিয়ে তাদের প্রশিক্ষণ দেন।” (ইত্তেফাক)

কাদেরের ভাষ্য মতে সে একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধা ছিল অথচ পাক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিন্তু বলেই যাচ্ছেন -,

“পাকিস্তানের প্রতি বিশ্বস্ততা ও সংহতির জন্য কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই।”

এতে কি প্রমাণিত হয়? কসাই কাদের আর কাদের মোল্লা দুই ব্যাক্তি ?

মিথ্যাচারী এবং মিথ্যার বেসাতি করা জামাত শিবির কেবল কাদের মোল্লাকে কসাই কাদের থেকে পৃথক করার মিশন নিয়েই মাঠে নামেনি, তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পর্যন্ত প্রমাণ করতে চেয়েছে। তিনি নাকি একাত্তরের যুদ্ধে গ্রামে বসে কলেজ ও হাই স্কুলের প্রায় ৩০ জন ছাত্রের সাথে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ থেকে ১ মে পর্যন্ত তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ চালিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। মিথ্যাচারের একটা সীমা থাকে। এই কাদের মোল্লাই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে করেছিলেন চরম বিদ্রুপাত্মক উক্তি, যেটা ২০০৭ সালে দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয়েছিল:

“কেউ সুন্দরী নারীর লোভে, কেউ হিন্দুর সম্পদ লুন্ঠন, কেউ ভারতীয় স্বার্থ রক্ষায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। কেউই আন্তরিকতা কিংবা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি।” – কাদের মোল্লা, সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক, ৩১ অক্টোবর, ২০০৭

এই লোক ‘কসাই কাদের’ না হয়ে মুক্তিযোদ্ধা হবে, সেটা কি কোন পাগলেও বিশ্বাস করবে?

এবার কিছু চাক্ষুষ সাক্ষীর বয়ান শুনুন


একঃ ফজর আলী

“মিরপুর ১১ নম্বর বি ব্লকের বাসিন্দা ফজর আলী গণতদন্ত কমিশনকে দেওয়া সাক্ষ্যে তার ছোটভাই মিরপুর বাংলা কলেজের ছাত্র পল্লবকে নৃশংসভাবে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করেন। ২৯ মার্চ নবাবপুর থেকে পল্লবকে তুলে নিয়ে আসে কাদের মোল্লার সাঙ্গপাঙ্গরা। এরপর তার নির্দেশে ১২ নম্বর থেকে ১ নম্বর সেকশানের শাহ আলী মাজার পর্যন্ত হাতে দড়ি বেধে হেচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ছাত্রলীগ কর্মী পল্লবকে। এরপর আবার ১ নম্বর থেকে ১২ নম্বর সেকশনের ঈদগাহ মাঠে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে টানা ২ দিন একটি গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয় পল্লবকে। ঘাতকরা এরপর তার দু হাতের সবকটি আঙুল কেটে ফেলে। ৫ এপ্রিল একটি মজার খেলা খেলেন কাদের মোল্লা। সঙ্গীদের নির্দেশ দেওয়া হয় গাছে ঝোলানো পল্লবকে গুলি করতে, যার গুলি লাগবে তাকে পুরষ্কার দেওয়া হবে। পরে কাদের মোল্লার সঙ্গী আখতার পল্লবের বুকে ৫টি গুলি করে পরপর। পল্লবের লাশ আরো দুইদিন ওই গাছে ঝুলিয়ে রাখেন কাদের মোল্লা, যাতে মানুষ বোঝে ভারতের দালালদের জন্য কি পরিণাম অপেক্ষা করছে। ১২ নম্বর সেকশানে কালাপানি ঝিলের পাশে আরো ৭ জন হতভাগার সঙ্গে মাটিচাপা দেওয়া হয় পল্লবকে। অক্টোবরে মিরপুর ৬ নম্বর সেকশানে একজন মহিলা কবি মেহরুন্নেসাকে প্রকাশ্যে নিজের হাতে নির্মমভাবে হত্যা করে কাদের মো্ল্লা। প্রত্যক্ষদর্শীদের একজন সিরাজ এই নৃশংসতায় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। মূলত বিহারীদের নিয়ে একটি খুনে দল তৈরী করেছিলেন কাদের মোল্লা আর বুলেট বাচাতে জবাই করা ছিলো তার কাছে বেশী প্রিয়।”


দুইঃ ফিরোজ আলী

“ফিরোজ আলী তখন মধ্য বয়স্ক এক ব্যক্তি, তিনি একাত্তর সালে স্বপরিবারে মিরপুরে থাকতেন। একাত্তরের ২৫ মাচের্র পর তার ভাই পল্লবকে শুধু ‘জয় বাংলা’র অনুসারী হওয়ার অপরাধে কাদের মোল্লার নির্দেশে অবাঙ্গালি গুন্ডারা অকথ্য নির্যাতন করে নির্মম ভাবে হত্যা করে। তখন সমগ্র মিরপুরে হত্যা আর ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে কাদের মোল্লা ও তার অনুসারী অবাঙ্গালিরা । জবাই করে বাঙ্গালি হত্যা ছিল তাদের প্রতিদিনের রুটিনমাফিক কাজ। একেকটি জবাইর আগে ঘোষনা দিত যারা বাংলাদেশ তথা জয় বাংলা অনুসারী, তারা বিধর্মী-নাস্তিক-ভারতের দালাল, এদের হত্যা করা সওয়াবের কাজ! এমন জবাই’র নেশা বেড়ে যাওয়ায় কাদের মোল্লার নাম তখন এ তল্লাটে আতঙ্কের সমার্থক শব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। স্থানীয়রা আব্দুল কাদের মোল্লাকে ‘কসাই কাদের’ নামকরণ করে । গরু জবাই এর মত মানুষ জবাই এ দক্ষতার নামডাকে(!) কসাই কাদের ‘মিরপুরের কসা‌ই’ নামেও পরিচিতি লাভ করে ব্যাপক ।
কসাই কাদের মোল্লার প্রতিহিংসার শিকার শহীদ পল্লবের ডাক নাম ছিল ‘টুনটুনি’। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে বেশকিছু চলচিত্রে পার্শ্ব অভিনেতা হিসেবে অভিনয় করে সুখ্যাতি অর্জন করে প্রতিপক্ষের চক্ষুশূল হন পল্লব। এ কথা জানান ফিরোজ আলীর স্ত্রী। পল্লব ছাড়াও কবি মেহেরুননেছা নামের এলাকায় খুবই শান্ত-নিরীহ প্রকৃতির বাঙ্গালী গৃহবধূ কসাই কাদের মোল্লার প্রতিহিংসার বলি হন। মিরপুর ৬ নং সেকশন, ডি ব্লক মুকুল ফৌজের মাঠের কাছাকাছি একটি বাড়িতে থাকতেন কবি মেহেরুননেছা। তিনি ছিলেন কবি কাজী রোজী’র ঘনিষ্ঠ বান্ধবী । কসাই কাদের মোল্লার নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে লেখালেখি’র অপরাধে মেহেরুননেছাসহ তার পুরো পরিবারকে বটি দিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করা হয়েছিল! এরপর টুকরো করা নরমাংস খন্ডগুলো নিয়ে ফুটবলও খেলা হয়েছিল ৬ নং মুকুল ফৌজ এর মাঠে! কসাই কাদের মোল্লার নির্দেশে ৩০/৩৫ জনের একটি অবাঙ্গালি ঘাতকের দল, মাথায় লাল ফিতা বেঁধে, ধারালো তলোয়ারে সজ্জ্বিত হয়ে অংশ নেয় কবি মেহেরুননেছা ও তার পরিবারকে হত্যাকান্ডে!”

তিনঃ কাদের মোল্লার বন্ধু

মোজাম্মেল এইচ খান (এখানে)-

“১৯৭৩ সালের প্রথমার্ধে আমি যখন উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে আসি তখন জানতাম না কাদের কোথায় আছে। ১৯৭৯ সালে আমি দেশে বেড়াতে গেলে একদিন যখন ঢাকার মগবাজারের রাস্তা দিয়ে হাঁটছি তখন পেছন থেকে একজন আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘তুই কি মোজাম্মেল?আমি কাদের।’ আমার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল,‘কাদের,তুই বেঁচে আছিস?’ কাদেরের উত্তর ছিল,‘হ্যাঁ, আমি ভালভাবে বেঁচে আছি এবং এখন আমি দৈনিক সংগ্রামের নির্বাহী সম্পাদক। তোর “জয় বাংলা” এখন এদেশ থেকে নির্বাসিত; ফিরে এসেছে আমাদের জিন্দাবাদ এবং এটা এখনপ্রচণ্ড ভাবে জাগ্রত।’ যেহেতু কাদের সত্য কথাই বলেছিল, সেহেতু আমি ওর কথার কোন জবাব দিতে পারিনি। কয়েক সপ্তাহ পরে আমি যখন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাই তখন সংবাদপত্রে পড়লাম প্রেসক্লাবে একটি বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিল কাদের মোল্লা; একেই বলে ভাগ্যের নির্মম পরিহাস!”

(এ ছাড়া মুক্তমনার ইংরেজি ব্লগ থেকে পড়ুন – মোজাম্মেল এইচ খানের Quader Mollah: fact versus fiction প্রবন্ধটি)

ড. মোজাম্মেল এইচ খান কাদের মোল্লার ফাঁসির পর স্ট্যাটাসও দিয়েছিলেন:

শেষ করব…
পাঠক নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন আমি আমার লেখায় এখন পর্যন্ত মোমেনা খাতুনের কথা আনিনি। এই নারী কাদের মোল্লার হাতে ধর্ষিত। তার পরিবারের সব সদস্যকে চোখের সামনে মরতে দেখেছেন। তার ভাষ্য পাওয়া যাবে এখানে:

মোমেনার ভাষ্য, বেলা ডোবার আগে কাদের মোল্লার নেতৃত্বে হামলা হয় তাদের বাড়িতে।

“আব্বা দৌড়াইয়া দৌড়াইয়া আসে এবং বলতে থাকে- ‘কাদের মোল্লা মেরে ফেলবে’। আক্তার গুন্ডা, বিহারীরা তারা ও পাক বাহিনীরা দৌড়াইয়া আসছিল। আব্বা ঘরে এসে দরজার খিল লাগায়ে দেয়।”

হযরত দরজা এঁটে সন্তানদের খাটের নিচে লুকাতে বলে। মোমেনার সঙ্গে তার বোন আমেনা বেগমও খাটের নিচে ঢোকে। তখন দরজায় শোনে কাদের মোল্লাসহ বিহারিদের কণ্ঠস্বর।

“এই হারামি বাচ্চা দরজা খোল, বোম মার দেঙ্গা।”

শুরুতে দরজা না খোলায় বাড়ির দরজার সামনে একটি বোমা ফাটানো হয়। এক পর্যায়ে হযরতের স্ত্রী একটি দা হাতে নিয়ে দরজা খোলে। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে তাকে গুলি করা হয়।

“আব্বা তখন আম্মাকে ধরতে যায়। কাদের মোল্লা পেছন থেকে শার্টের কলার টেনে ধরে বলে, ‘এই শুয়ারের বাচ্চা, এখন আর আওয়ামী লীগ করবি না? বঙ্গবন্ধুর সাথে যাবি না? মিছিল করবি না? জয় বাংলা বলবি না?’

“আব্বা হাত জোড় করে বলে, ‘কাদের ভাই, আমাকে ছেড়ে দাও’। আক্তার গুন্ডাকে বললো, ‘আক্তার ভাই, আমাকে ছেড়ে দাও’।”

তবে না ছেড়ে হযরত আলীকে টেনে-হিঁচড়ে ঘরের বাইরে নিয়ে যায় বিহারীরা।

সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে এরপর কাঁদতে কাঁদতে চোখের সামনে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডের বিবরণ দেন মোমেনা।

“দাও দিয়ে আমার মাকে তারা জবাই করে। চাপাতি দিয়ে খোদেজাকে (বোন) জবাই করে। তাসলিমাকেও (বোন) জবাই করে।”

“আমার একটি ভাই ছিল বাবু, বয়স ছিল দুই বছর, তাকে আছড়িয়ে মারে।”

“বাবু মা মা করে চিৎকার করছিল,” বলতে গিয়ে অঝোরে কাঁদেন মোমেনা।

বাবুর চিৎকার শুনে খাটের তলায় লুকানো আমেনা চিৎকার দিলে তার অবস্থান যেনে যায় হামলাকারীরা।

মোমেনা বলেন, “আমেনাকে তারা টেনে বের করে, সব কাপড়-চোপর ছিড়ে ফেলে। এরপর তাকে নির্যাতন করতে থাকে। আমেনা অনেক চিৎকার করছিল, এক সময় চিৎকার থেমে যায়।”

কাঁদতে কাঁদতে প্রায় অজ্ঞান মোমেনা এরপর শোনান নিজের ওপর নির্যাতনের বর্ণনা।

এ প্রসঙ্গে একটা উড়ো (কু)যুক্তি চালু আছে – মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সাক্ষাতকারে মোল্লার নাম নাই।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সাক্ষাতকারে মোল্লার নাম নাই… ব্যাপারটা কি খুব সিম্পল না ? কাদের মোল্লার কথা প্রকাশ করলে সে কি বেচে থাকতে পারত ? সরকারের ট্রাইব্যুনালের নিরাপত্তা নিয়ে সাইদির সাক্ষী মারা গেল আর এসব ছাড়াই খোলা মাঠে কাদেরের কথা প্রকাশ করে বেঁচে থাকতে পারত মোমেনা খাতুন ?

এছাড়াও মোমেনা খাতুন নিজ মুখেই বলেছেন

“অনেক মানুষ আমার কাছে এসেছিলো ও আমার ছবি নিয়েছিলো, কিন্তু ভয়ের কারনে আমি কাউকে কাদের মোল্লা এবং আকতার গুন্ডার নাম বলি নাই।”

ট্রাইব্যুনালের বিস্তারিত রায় পড়ে জানা যায় যে,

সাক্ষী নিয়ে বরং ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়েছিলেন কাদের মোল্লার পক্ষের আইনজীবিরাই। কাদের মোল্লার এক ভিক্টিম পল্লবের ভাইয়ের স্ত্রী মোসাম্মৎ সায়েরাকে তারা হাত করতে চেষ্টা করে, তাকে দিয়ে মিথ্যে সাক্ষ্য দেয়ার চেষ্টা করে তারা। কিন্তু মিথ্যে কথা বলতে গিয়ে লেজে গোবরে করে ফেলেছেন তিনি। (ট্রাইবুনালের রায়ের প্যারা ১৮২-১৮৯ )

শুধু মোমেনা বেগম নয়, অনেকের সাক্ষ্য থেকেই জানা গেছে এই কাদের মোল্লাই আক্তার গুন্ডা, নেহাল, হাক্কা গুন্ডা যারা মীরপুরে ত্রাস সৃষ্টি করেছিলেন একাত্তরে – তাদের সহচর ছিলেন। এদের অনেকেই সরাসরি কাদের মোল্লাকে নিজ চোখে শনাক্ত করেছিল। সেই চাক্ষুষ সাক্ষীর থেকেই দুই জনের বয়ান উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া আছে প্রধান সাক্ষী মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল হক মামা, যিনি আদালতে দাঁড়িয়ে কাদের মোল্লাকে সনাক্ত করেছিলেন। শুনুন তার বক্তব্য একাত্তর টিভিতে :

httpv://www.youtube.com/watch?v=sGsTPnuHMPA

আশা করি এই লেখা বিভ্রান্তি দূর করতে কিছুটা হলেও সাহায্য করবে। খুবই সংক্ষেপে লিখেছি, লিংকগুলোতে বিস্তারিত পাবেন।

সুত্রঃ

১) http:bn.wikipedia.org/wiki/আব্দুল_কাদের_মোল্লা
২)http://bangla.bdnews24.com/bangladesh/article713859.bdnews
৩)http://www.somewhereinblog.net/blog/niandarthal/29905160
৪)http://www.somewhereinblog.net/blog/majoy/29761606
৫)http://www.unmochon.com/2013/12/12/55182.html#.UqyUlWUqaZ_
৬)http://www.bdtomorrow.com/newsdetail/detail/41/58586
৭)http://www.facebook.com/JIPOfficial
৮)http://www.kalerkantho.com/online/world/2013/12/14/30648
৯)http://www.prothom-alo.com/home/article/98515/
১০)http://www.ittefaq.com.bd/index.php?ref=MjBfMTJfMTRfMTNfMV8yXzFfOTMyMTI%3D
১১)http://www.newagebd.com/detail.php?date=2013-10-07&nid=68309#.UrCyXmUqaZ9

সংযোজনঃ

বেশীর ভাগ মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী, জামাত সমর্থক গোষ্ঠীর ধারণা কাদের নির্দোষ ভালো মানুষ। কিছু “বিকৃত তথ্য” এবং তার সাথে একগাদা নির্জলা “মিথ্যাচার” জড়িয়ে সারাদিন এরা করে যাচ্ছে ধর্ম ব্যাবসা।

যারা বলেন কসাই কাদের আর মোল্লা কাদের এক নন, তাদের কাছে আমার একটাই প্রশ্ন –

কসাই কাদেরটা তাইলে গেল কই?

আমি মনে করি, কাদের আর কসাই একই লোক সেটা আদালতেই প্রমাণিত হয়ে গেছে আর শাস্তিও দেয়া হয়েছে, আমার নতুন করে কিছু প্রমাণের নেই। বার্ডেন অব প্রুফটা তাদের কাঁধেই যারা মনে করেন দুই কাদের ভিন্ন ব্যক্তি। মোমেনার মত চাক্ষুষ সাক্ষীরাই যথেষ্ট যাদের পরিবার কাদের মোল্লার হাতে নিগৃহীত হয়েছিলেন, এবং চিনতেন তার বন্ধু এবং সহপাঠীরাও, যেমন ড. মোজাম্মেল এইচ খানের মত ব্যক্তিরা।

অবশ্য বিপরীতপক্ষ বরাবরই বাঁশেরকেল্লা আর গোলাম মওলা রণির মত লোকজনের কথাকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে এসেছে।

আসুন দেখি কতটা নির্ভরযোগ্য এই গোলাম মাওলা রনি !!!

… কথিত আছে রনির সাথে মোল্লা সাহেবের কারাগারে সাক্ষাত হয়েছিলো এবং সেই সুবাদে মোল্লা রনিকে একটা চিঠি দেন, যেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘ আমার ফাঁসির পর একবার হলেও বলো বা লিখো – কাদের মোল্লা আর  কসাই কাদের এক ব্যক্তি নয়’।  এই সেই চিঠি:

এই চিঠিকে পুঁজি করেই সহানুভূতির বাণিজ্য শুরু করেছিলেন গোলাম মওলা রনি ফেসবুকে।  গোলাম মওলা শুরু করেছিলেন কাদেরের গোলামী।

কিন্তু আমাদের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে অন্য তথ্য,
কাদের মোল্লার আরেকটি চিঠিও রয়েছে আমাদের হাতে

ব্যাপারটা কি লক্ষ্য করেছেন পাঠক ??

আপনাদের সুবিধার জন্য দুটো ছবি একসাথে দিলাম, একটু ভালো করে খেয়াল করুন

গোলাম মওলা রনি সাহেবের যে ফেসবুক স্ট্যাটাসটা নিয়ে এত চ্যাঁচামেচি, এখন তো থলের বেড়াল বেরিয়ে এসেছে : সেই চিরকূটের সিগনেচার আর কাদের মোল্লার পরিবারের কাছে লেখা চিঠির সিগনেচার ভিন্ন !

আরেকটা ব্যাপারঃ

এই ট্রাইবুনাল নাকি স্বচ্ছ না তাহলে ট্রাইবুনালের প্রথম রায়ের পর কসাই কাদের কেন দুই আঙ্গুল দিয়ে জয় সূচক ‘ভিক্টোরী চিহ্ন’ দেখিয়েছিলো? যেই ট্রাইবুনাল স্বচ্ছ না, নিরপেক্ষ না, আন্তর্জাতিক না, সেই ট্রাইবুনালে প্রথম রায়ে যাবজ্জীবন কারাদন্ড পাওয়ার পরেও কেন কাদের নিজেকে জয়ী মনে করলো?  কাদের মোল্লা যদি কসাই কাদের না হয়, কস্মিনকালে যদি মিরপুরে না গিয়ে থাকে, একটি মানুষও হত্যা না করে থাকে, তবে কতবড় পাগল হলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাবার পরেও হাত তুলে নিজেকে জয়ী ঘোষণা করে? হিসেবটা কি মেলে?

এবার কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেই:
১)১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ রাইফেলস কলেজের সিনিয়র শিক্ষক ও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসাবে কিভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারলেন যখন রাইফেলসে কর্মরত ছিলেন একজন শহীদ বুদ্ধিজীবীর স্ত্রী ? কি করে উদয়ন স্কুলে চাকরি করলেন ?
কি করে ১৯৮২ ও ১৯৮৩ সালে ২বার সাংবাদিকদের বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হলেন? তখনকার সব রিপোর্টার কি জামাত শিবির ছিলেন যে তাকে নির্বাচিত করলেন ?

উত্তরঃ এক খোঁচায় এর উত্তর দেয়া যায়; ১৯৭৭ সালে এই দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন একজন রাজাকার, কেবিনেটে ছিলো ১৮ জন রাজাকার এম্পি, ৫-৬ জন রাজাকার মন্ত্রী। সেখানে উদয়ন, রাইফেলসে কাজ করা এমনকি অসম্ভব কাজ… আরে প্রধানমন্ত্রী রাজাকার হলে সাংবাদিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি হওয়া কি খুব অবাস্তব ব্যাপার ?

২)কি করে তিনি ১৯৭২ সালের শেষের দিক থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদুল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র হিসাবে হলে অবস্থান করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যায়ন অব্যাহত রাখতে পারলেন?

উত্তরঃ ১৯৭২ সালের শেষের দিকে কাদের মোল্লা মোটেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন না।

কাদের রাজেন্দ্র কলেজেই বিএসসি পড়ে (১৯৬৬-১৯৬৮)। তার পরিবার বলেছে সে ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাস কোর্সে এমএসসিতে ভর্তি হয়, স্বাধীনতার পর পরই ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসে এবং ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত সেখানে অধ্যয়ন করে।

এ বক্তব্যের প্রথম অংশটুকু সত্য নয় এবং যে কোন পাঠকই বুঝতে পারবেন দুই বছরের এমএসসি ডিগ্রীর জন্য ৮ বছর (১৯৬৯-১৯৭১, ১৯৭২-১৯৭৭) বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান করার হিসাব মেলানো যায় না। পরিবারের ভাষ্য অনুযায়ী সে এসএসসি পাস করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিল পড়তে, কিন্তু আসল কাহিনি হল কাদের মোল্লার এইচএসসি পরীক্ষার ফল  গড়পড়তা ছাত্রের থেকে অনেক নিচে ছিল যার ফলে সরাসরি সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স পড়ার যোগ্যতা অর্জন করেনি।  তার সহপাঠী মোজাম্মেল খানই তা ফাঁস করে দিয়েছেন।  অথচ ছাগ-বান্ধব সাইটে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে তিনি নাকি ‘গোল্ড মেডেলিস্ট ছাত্র’ ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের।

১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয়ের পর কাদের আত্মগোপন করে এবং ১৯৭৬ সালে সে আত্মগোপনতা থেকে বেরিয়ে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুনরায় ভর্তি হয় এবং ১৯৭৭ অবধি সে ছাত্র ছিল।
(মুক্তমনা থেকে পড়ুন – মোজাম্মেল এইচ খানের Quader Mollah: fact versus fiction প্রবন্ধটি)

৩) ডেভিড বার্গম্যান ট্রাইবুনালের বিরুদ্ধে

উত্তরঃ ডেভিড বার্গম্যান ট্রাইব্যুনালের জন্য একটা হুমকি বই কি !!!(পুরান পাগল ভাত পায় না নতুন পাগলের আমদানি)। ভাই লোগ এই ডেভিড বার্গম্যান মোটেও তেমন হোমরা চোমরা সাংবাদিক না। বাংলাদেশী একটা ইংরেজি দৈনিক (নিউ এজ) চাকরি করেন, একাধিক বাংলা নিউজ পোর্টাল তাকে ঘাড় ধরে বের করে দিয়েছে বলেও শোনা যায়। ব্লগস্পটে সাবডোমেনে একটা সস্তা সাইট চালান। ট্রাইব্যুনাল বিতর্কিত করার জন্য মোটা অঙ্কের টাকা পান। আমাদের মাঝে কেন যেন একটা প্রবণতা আছে সাদা চামড়া একটা কথা বললেই সেটা ঠিক…

মোটেও ওপর কথা হইল ডেভিড বার্গম্যান কোন বড় মাপের সাংবাদিক না, তার থেকেও অনেক বেশী টাকা দিয়ে জামাত লবিস্ট নিয়োগ করে। যুক্তরাষ্ট্রে মীর কাশেম আলীর ২৫ মিলিয়ন ডলারের (প্রায় ২০০ কোটি টাকা) লবিস্ট নিয়োগ করে, তার তুলনায় ডেভিড তো দুধের বাচ্চা !!!

আরেকটা কথা, সাদা চামড়া যদি এতই পছন্দ তাহলে সায়মন ড্রয়িং, লরেন, এন্থনি, ক্যাথরিন…… এরা সাংবাদিক না, এদের পছন্দ হয় না ? নাকি আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের চেয়ে ন্যাশনাল অখ্যাত ডেইলির সাংবাদিক বেশী বিশ্বাসযোগ্য??

৪) একটাও চাক্ষুষ সাক্ষী নাই !!

উত্তরঃ আদালতে ২৩ বছর বিচার করা বিচারক সাক্ষী দেখে রায় দিলো, আর আপনি এসেছেন….. সাক্ষী নাই……
ভালো করে মোল্লার বন্ধু মোজাম্মেল খানের লেখাটা পড়ে দেখেন ৬৬-৬৮ ব্যাচে রাজেন্দ্র কলেজের সব ছাত্র এই সাক্ষ্য বহন করে কসাই কাদের আর কাদের মোল্লা এক ব্যাক্তি। স্বাধীনতার পর অনেক রি-ইউনিয়ন হয়েছে সেই ব্যাচের ছাত্র-ছাত্রীদের, কিন্তু রাজেন্দ্র কলেজের সেই প্রাক্তন ছাত্ররা কখনোই এই কসাইকে প্রবেশ করতে দেয় নি সেই অনুষ্ঠানে।

আর কত সাক্ষী চান ?? আর কত ??
কখন স্বীকার করবেন আমার মাটিতে যে রক্তের বন্যা বইয়ে ছিলো একাত্তরে; সে আর কেউ না সে রাজাকার, কসাই, কাদের মোল্লা। এখনও সময় আছে সত্যকে স্বীকার করুন। না হলে আপনার পরবর্তী প্রজন্ম কিন্তু চোখে ঘৃণা নিয়ে বলবে, একজন কসাইয়ের পক্ষ নিয়েছিলে ??

ছিঃ ছিঃ ছিঃ