পলাশের গায়ে আদরের একটা চাপড় লাগান তিনি। তারপর গভীর স্নেহে জিজ্ঞেস করেন, ‘কিরে বেটা, পারবি না?’
শীতের সকাল। রূপসা নদীর শান্ত জলে বাতাসের ধাক্কায় হঠাৎ করেই মৃদু ঢেউ জাগে। সেই ঢেউয়ের মাথায় উল্লাসে একটু নেচে নেয় পলাশ। এটাকে হ্যাঁ সূচক উত্তর ভেবে নিয়ে আকর্ণ বিস্তৃত হাসি দেখা দেয় তাঁর মুখে। ‘সাব্বাস বেটা! এই না হলে কী আর বাপের বেটা তুই! আমরা বাপ-বেটা মিলে তিতুমিররে ছাতু বানিয়ে দেবো। তারপর সেই ছাতু গুলিয়ে দুজনে মজা করে খাবো।’ সিনা টান টান করে বলেন তিনি। ‘ছাতু খেতে পারিসতো ব্যাটা? নাকি বিস্বাদ লাগে? যা তোকে গুড় মিশিয়ে দেবো। ছোট মানুষ এমনি এমনি খেতে পারবি না।’ নিজের রসিকতায় নিজেই হাসেন তিনি আপন মনে ।
ইঞ্জিন রুমে পাশেই কাজ করছিলো সারোয়ার। রুহুল আমিনের ইঞ্জিনের সাথে কথা বলা দেখে ঠোঁটের কোণে মৃদু একটা হাসি ফুটে ওঠে। দেখেও না দেখার ভান করে সে। বদমেজাজের জন্য রুহুল আমিন বিখ্যাত। মোটামুটি সবাই তাঁকে ভয় পায়। কিন্তু, খাট্টা মেজাজের এই লোকের মধ্যে যে শিশুর মতো সরল একটা মন লুকিয়ে আছে, পাশে বসে কাজ না করলে সেটা সে কোনোদিনই জানতে পারতো না। পলাশে ওঠার পর থেকেই লোকটার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আদুরে গলায় কথা বলে চলেছে গানবোটের ইঞ্জিনের সাথে অনর্গল। যেনো বাচ্চা একটা ছেলের সাথে কথা বলছে। কে জানে রুহুল আমিনের হয়তো বাড়িতে বাচ্চা কোনো ছেলে আছে। সেই ছেলের কথা ভেবেই হয়তো গানবোটকে ছেলে বানিয়ে কথা বলে। অন্যদিনের তুলনায় আজ অবশ্য একটু বেশিই কথা বলছে। কে জানে কী কারণে?
কারণটা আর কিছুই নয়। অসম্ভব ফুরফুরে মেজাজে আছেন তিনি। এরকম মেজাজে তিনি সাধারণত খুব কম সময়ই থাকেন। এখন পর্যন্ত যা যা করার কথা ঠিক সেভাবেই অপারেশনগুলো সাফল্যজনকভাবে শেষ করে চলেছেন তাঁরা। তবে, এই সাফল্যের কারণেই মেজাজ এমন ফুরফুরে নয়। খুলনা জেলের পাশ কাটিয়ে যখন আসছিলেন তাঁরা, স্থানীয় লোকজন ছুটে এসেছে নদীর পারে। বাংলাদেশের পতাকাবাহী যুদ্ধ জাহাজ দেখে সে কি আনন্দ তাদের। কেউ কেউ খুশিতে আত্মহারা হয়ে আকুল হয়ে কাঁদছে, কেউ লাফাচ্ছে, কেউ বা নদীর তীর ধরে ছুটে চলেছে গানবোটের পাশাপাশি। বয়ষ্ক কেউ কেউ দুই হাত তুলে মোনাজাতও শুরু করে দিয়েছে। তাঁরাও অনেকদিন পর দেশের মানুষ দেখে আনন্দের বাধ ভেঙে ফেলেছিলেন। নাবিকরা সব ছুটে এসেছিল ডেকে। রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে তীরের মানুষের হাত নাড়ার জবাব দিয়েছে সবাই হাসিমুখে তাঁরা দল বেধে গলার সমস্ত আওয়াজ জড়ো করে শ্লোগান দিয়েছে ‘জয় বাংলা’। তীর থেকে মানুষ সমস্বরে তার প্রতিদান দিয়েছে জয় বাংলা বলে। আত্মার সম্পর্ক বোধ হয় একেই বলে।
তাঁরা যে বাহিনী নিয়ে খুলনার পাকিস্তান নৌঘাটি তিতুমির আক্রমণ করতে যাচ্ছেন, সেই বাহিনীটির নাম আলফা ফোর্স। ভারতীয় নৌবাহিনীর রণতরী পানভেল, বিএসএফ এর রণতরী চিত্রাঙ্গদা, আর বাংলাদেশ নৌবাহিনীর দুটি গানবোট পদ্মা আর পলাশ মিলে ফোর্স আলফা। চিত্রাঙ্গদা অবশ্য এই অপারেশনে যাচ্ছে না। নড়াচড়া আর গতিতে মন্থর বলে তাকে রেখে আসা হয়েছে মংলাতে। সবার সামনে পদ্মা, পলাশের যমজ বোন, মাঝে পলাশ আর একেবারে শেষে রয়েছে পানভেল।
সেপ্টেম্বর মাসেই গড়ে তোলা হয়েছিল বাংলাদেশ নৌবাহিনী। এর তত্ত্বাবধানে ছিলেন ভারতীয় নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন সামন্ত। তিনি একজন দক্ষ সাবমেরিনার। কোলকাতা পোর্ট অথরিটি থেকে প্রাপ্ত দুটো টাগবোটকে রূপান্তরিত করা হয়েছে গানবোটে। এর ডেককে পরিবর্তিত করে ইটালিয়ান এল/৬০ এন্টি এয়ারক্রাফট গান বসানো হয়েছে।
আজকের এই আলফা ফোর্সেরও নেতৃত্বে রয়েছেন ক্যাপ্টেন সামন্ত। তিনি রয়েছেন ভারতীয় রণতরী পানভেলে।
***
ভারতের হাসনাবাদ থেকে যাত্রা শুরু করেছিল ফোর্স আলফা। ভারতীয় অর্ডন্যান্স ম্যাপ অনুসরণ করে হিরণ পয়েন্ট হয়ে নানান অব্যবহৃত অলিগলি জলপথ ব্যবহার করে রাত দুটোয় চলে আসে পশুর নদীর মুখের আকরাম পয়েন্টে। এই সময় রাডারে ধরা পড়ে দুটো জাহাজ দ্রুতগতি পালিয়ে যাচ্ছে সাগরের দিকে। কামানের আওতার বাইরে বলে আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকে ফোর্স আলফা। ধাওয়া করলে মূল অপারেশন ব্যাহত হবে। কাজেই, ইস্টার্ন কমান্ডের কাছে ফ্ল্যাশ মেসেজ পাঠিয়ে নিজের পথে এগিয়ে যেতে থাকে সে। ইস্টার্ন কমান্ড সামাল দিক ও দুটোকে।
মংলা পোর্টের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে ফোর্স আলফা। কিন্তু সেখানে তেমন কিছুই করার থাকে না তাদের। মংলা পোর্ট এর মধ্যেই ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। আগেরদিন ভারতীয় বিমানবাহিনী হামলা চালিয়েছে এখানে। নর্থ পোল আর ওশেন এন্টারপ্রাইজ নামের দুটো জাহাজে এখনও আগুন জ্বলছে। এখানে সামান্য একটু প্রতিরোধ আসে পাকিস্তানিদের কাছ থেকে। সেটাকে দমন করে ফোর্স আলফা এগিয়ে চলে খুলনা শহরের দিকে। নৌবাহিনীর ঘাঁটি তিতুমির দখল করাই মূল উদ্দেশ্যে। এটা করতে পারলে গ্রাউন্ড ফোর্সের জন্য খুলনা দখল করা সহজসাধ্য হবে। এখান থেকেই পশুর নদীর নাম পরিবর্তন হয়ে রূপসা হয়ে গিয়েছে। গতি মন্থরতার কারণে চিত্রাঙ্গদাকে এখানেই রেখে দেওয়া হয়। খুলনার কাছেও একটা লাইটনিং নামে একটা প্রায় ডুবন্ত জাহাজ চোখে পড়ে। মুক্তিবাহিনীর তুমুল আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়েছে লাইটনিং।
‘দেশতো মনে হয় স্বাধীন হয়ে যাচ্ছেরে ব্যাটা।’ আবারো আদরের হাত বুলান তিনি পলাশের গায়ে। ‘স্বাধীন হবার পরে তুই আর তোর বোন ইতিহাস হয়ে যাবিরে। বাংলাদেশের প্রথম সন্তান তোরা। যেইতেই সন্তান না, যোদ্ধা সন্তান।’
যেন সব বুঝতে পেরেছে এমন ভঙিতে বো উঁচু করে বুক ফুলায় পলাশ। গতি বাড়িয়ে সম্মুখে ধাবমান পদ্মার কাছে যাবার চেষ্টা করে সে।
রুহুল আমিন নিঃশব্দে হাসেন। সন্তান গর্বে গর্বিত পিতার হাসি।
****
ওয়ারলেসের উপর প্রায় ঝুঁকে এসেছেন লেফটেন্যান্ট কমান্ডার জয়ন্ত রায় চৌধুরী। যদিও অন্যপাশের কথা পরিষ্কারই শুনতে পাচ্ছেন তিনি। পলাশের কমান্ডার ইন চীফ তিনি। কপালে শুধু ভাজই পড়ে নি তাঁর, এই শীতের দুপুরে ঘামও জমা হচ্ছে সেখানে। গভীর মনোযোগ দিয়ে কথা বলছেন তিনি পানভেলে থাকা কমান্ডার সামন্তের সঙ্গে। কিন্তু, ক্ষণে ক্ষণে তাকাচ্ছেন উত্তর আকাশের দিকে। রূপসা ঘাটের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে পলাশ।
‘আমরা আনআইডেন্টিফায়েড তিনটা ফাইটার প্লেন লোকেট করেছি স্যার। উত্তর দিক থেকে আমাদের দিকেই আসছে। পদ্মা থেকেও একই মেসেজ এসেছে। গানারদের রেডি হতে বলবো কি?’
‘আমরাও লোকেট করেছি ওগুলোকে। তোমার লোকদের প্রস্তুত থাকতে বলো। আমি দেখছি এদের পরিচয় পাওয়া যায় কি না?’ শান্ত স্বরে কমান্ডার মানবেন্দ্র সামন্ত বলেন।
চিৎকার করে সবাইকে আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য প্রস্তুত হতে বললেন তিনি। যুদ্ধ বিমানের উপস্থিতির খবর এর মধ্যেই জানাজানি হয়ে গিয়েছে। সমস্ত গানবোট জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে উত্তেজনা। দৌঁড়াদৌঁড়ি শুরু হয়ে গিয়েছে চারপাশে। এরা সবাই প্রশিক্ষিত নাবিক। পাকিস্তান নৌবাহিনী থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। কী করতে হবে এই পরিস্থিতে তা খুব ভালো করেই জানে এরা।
ওয়ারলেস সেটটা ঘড়ঘড় করে উঠতেই আবারো ঝুঁকে পড়েন জয়ন্ত রায় চৌধুরী। ওপাশ থেকে শোনা যায় কমান্ডার সামন্তের গলা।
‘রয়, আই চেকড উইথ ইস্টার্ন কমান্ড। দৌজ এয়ারক্রাফটস আর আওয়ারস এয়ারক্রাফটস। কামিং ফ্রম ওয়েস্ট দিনাজপুর এয়ারফিল্ড। খুলনা বম্বিং জোনের মধ্যে। ওখানেই মনে হয় বম্বিং করতে এসেছে। নাথিং টু বি এফরেইড।’
‘কিন্তু স্যার, ওরা যদি আমাদেরকে পাকিস্তানি ভেবে আক্রমণ করে?’
‘করবে না। আমাদের সবগুলো জাহাজের সুপারস্ট্রাকচার হলুদ রঙে করা হয়েছে একারণে। ওরা হলুদ দেখেই বুঝবে এগুলো মিত্রবাহিনীর জাহাজ। টেল ইওর সেইলরস টু রিলাক্স।’
কাঁচের জানালা দিকে আকাশ পানে তাকান লেফটেন্যান্ট কমান্ডার। খালি চোখেই এখন বিমানগুলোকে দেখা যাচ্ছে। উচ্চতা অনেক কমে এসেছে। জাহাজের সাথে একই লাইনে আছে দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, জাহাজগুলোর দিকেই এগিয়ে আসছে সরাসরি। ভ্রু দুটো কুচকে যায় তাঁর। কিছু একটা জিনিস মাথার মধ্যে খচখচ করছে তাঁর। অশুভ কু ডাক শুনতে পাচ্ছেন তিনি মনের মাঝে।
মাথা ঝাকিয়ে কুচিন্তাটাকে দূর করেন তিনি। কেশে গলা পরিষ্কার করেন। তারপর বলেন, ‘স্যার, বলাতো যায় না। ভুল করে যদি আমাদের আক্রমণ করেই বসে। কি করবো আমরা? আত্মরক্ষা কি করা যাবে? আমাদের কাছেতো এন্টি এয়ারক্রাফট বোফর কামান আছে।’
দীর্ঘ একটা অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে আসে। ওপাশে কমান্ডার সামন্ত কী করছেন, সেটা অনুমান করার চেষ্টা করেন জয়ন্ত রায় চৌধুরী। জানালা দিয়ে আবারো আকাশপানে তাকান। সগর্জনে উড়ে আসছে শিকারী ঈগলের দল। একটা নিখুঁত জ্যামিতিক ত্রিভুজ তৈরি করে।
‘লিসেন রয়।’ কমান্ডারের গম্ভীর গলা ভেসে আসে। ‘ওগুলো আমাদের এয়ারক্রাফট। কোনো অবস্থাতেই ওগুলোর দিকে গুলি ছোড়া যাবে না। এত বড় ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। তুমি আর আমি দুজনেই ভারতীয়। পরিণতি কী হবে, নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো? আমাদের কোর্ট মার্শাল কেউ ঠেকাতে পারবে না। তোমাকেই নিশ্চিত করতে হবে, অন্যেরা যেনো কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত না নেয়। আমরা যুদ্ধ করছি পেশার কারণে, ওরা যুদ্ধ করছে আবেগের কারণে। হঠকারী আচরণ ওরা করতে পারে, আমরা না। গো এন্ড ডিজআর্ম দেম। আমি পদ্মাকেও একই নির্দেশ দিয়েছি।’
ফরোয়ার্ড ডেকে চলে আসেন রায় চৌধুরী। সবাই তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। ‘বয়েজ, ওগুলো ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সের প্লেন। খুলনায় বোমা ফেলতে এসেছে। আমাদের ভয়ের কিছু নেই। কোনো গুলিটুলি করা যাবে না ওদেরকে নিশানা করে। গো এন্ড রিল্যাক্স।’
লেফটেন্যান্ট কমান্ডারের কথা শুনে ঢিল পড়ে সবার শরীরে।
***
মচমচ করে বিকট শব্দ হচ্ছে চৌকিতে। যেনো ভেঙেই যাবে ওটা। নগ্ন কোমরটাকে তীব্রভাবে ওঠানামা করছে দেলু রাজাকার। লোমশ ভালুকের মত বিশাল শরীর তার। হঠাৎ করে পিছন থেকে কেউ দেখলে ভাববে যে, একা একাই চৌকির উপর কোমর দোলাচ্ছে সে। বাচ্চা মেয়েটার ছোট শরীরটা প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে দেলু রাজাকারের বিশাল শরীরের নীচে। শুরুতে মরণ চিৎকার দেওয়া শুরু করেছিল মেয়েটা। মুখ চেপে ধরে আর্তনাদকে ঠেকানোর কোনো চেষ্টাই করে নি দেলু রাজাকার। বাইরে তাঁর সাঙাতরা পাহারা দিচ্ছে বন্দুক হাতে। কারো বাপের সাধ্যি নেই ত্রিসীমানায় আসার। তারা এসেছিল মূলত লুট করতে। লুট করতে গিয়ে অবশ্য খুনোখুনি করতে হয়েছে। তাতে অবশ্য আনন্দই পেয়েছে সে। হিন্দুদের কল্লা কাটতে বেশ ভালোই লাগে তার। কেমন যেনো জেহাদি জেহাদি একটা জোশ জাগে মনে। নিজেরে খালিদ বিন ওয়ালিদের মত বিরাট ইসলামি যোদ্ধা মনে হয়। তবে, খুন করার চেয়েও হাজার গুণে বেশি আনন্দ লাগে মালাউন মেয়েগুলোর সাথে ওইসব কাজ করতে। এগুলোর পেটে বীজ বপনের আনন্দের কোনো তুলনাই হয় না।
খুন খারাবির পর সোনাদানা-টাকা পয়সা লুট করতে ঘরের ভিতরে ঢুকেছিল তারা। জানের ভয়ে চৌকির নীচে লুকিয়ে ছিল মেয়েটা। এগারো বারো বছরের বাচ্চা একটা মেয়ে। ভাবলেও হাসি পায় দেলুর। এটা কোনো লুকোনোর জায়গা হলো? চৌকির নীচ থেকে চুল ধরে টেনে বের করা হয়েছে মেয়েটাকে। তারপর সাঙাতদের ইশারা করেছে সে ঘর থেকে বের হয়ে যাবার জন্য। লোভী হাসি হেসে তারা বের হয়ে গিয়েছে। দেলুর পরেও তাদেরও আশ মিটবে জানে তারা।
বয়স বাড়ার পর থেকেই কচি মেয়েদের প্রতি তীব্র আকর্ষণ অনুভব করে দেলু। তার তৃতীয় বিবির বয়স মাত্র ছাব্বিশ বছর। তারপরেও সেটাকে বুড়ি বলে মনে হয় তার কাছে। চতুর্থ বিয়েটা করেই ফেলতো সে। কিন্তু দেশের এই দুর্যোগের সময়, ইসলামের এই দুরাবস্থায় ব্যক্তিগত খায়েশকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। একজন সাচ্চা জেহাদি ইসলামি সৈনিক যদি তার মনের কামনা-বাসনার উপর নিয়ন্ত্রণ নিতেই না পারে, তাহলে আর সে ইসলামের সৈনিক হলো কীভাবে? এই ভেবেই নিজের মনকে প্রবোধ দিয়ে চলেছে সে। অবশ্য মন বশ মানলেও, শরীর মানতে চায় না। কচি কাচা মেয়ে দেখলেই সেগুলোর শিরায় শিরায় বান ডাকে।
সাঙাতরা ঘর থেকে বের হয়ে যেতেই দুয়ারে খিল দিয়েছে দেলু। ভয়ে আতংকে নীল হয়ে যাওয়া মেয়েটার সামনেই পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি খুলেছে। বিস্ফারিত চোখে মেয়েটা তাকিয়ে থেকেছে তার দিকে। ওই অবস্থাতেই ধাক্কা দিয়ে চৌকির উপরে শুইয়েছে তাকে। তারপর ভালুকের মতো বিশাল শরীরটাকে তুলে এনেছে বাচ্চা মেয়েটার ছোট্ট শরীরের উপরে। শুরুতে অমানুষিক চিৎকার করেছে মেয়েটা ব্যথায়। দেলু সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপই করে নি। এই চিৎকারে তার উত্তেজনা আরো বেড়েছে। চিৎকার একসময় গোঙানিতে রূপ নিয়েছে। তারপর নৈঃশব্দ। নিথর হয়ে শুয়ে আছে মেয়েটি। মরে গেছে না অজ্ঞান হয়েছে বোঝার উপায় নেই। এ নিয়ে অবশ্য মাথা ব্যথা নেই দেলুর। কাজ শেষ হলে এমনিতেওতো মারতেই হবে। নিজের কাজ করে যাচ্ছে সে বিপুল বিক্রমে।
দরজায় জোরে জোরে আঘাতের শব্দে হুশ ফেরে দেলুর। কোমর দোলানো বন্ধ করে চরম বিরক্তি নিয়ে বলে, ‘এই কি হোইচ রে,মুক্তিফোর্জ এ্যইছ নাই ,নাকি কি তোদের আর সহ্যো হচ্ছে না?’
কালু মোল্লার অস্থির গলা শুনতে পাওয়া যায়। ‘দেলু ভাই, শিগগিরি বাইরি আসেন।’ কালুর গলায় এমন একটা তাগাদা ছিল যা উপেক্ষা করতে পারে না দেলু। মেয়েটার উপর থেকে উঠে পড়ে সে। বিছানা একেবারে রক্তে মাখামাখি হয়ে আছে। তার দুই উরুর সংযোগস্থলেও বিপুল পরিমাণে রক্ত লেগে রয়েছে। আশ্চর্য রকমের একটা প্রশান্তিতে মনটা ভরে যায় তার। রক্ত না মুছেই লুঙ্গিটা পরে নেয় সে। গায়ে পাঞ্জাবি গলাতে গলাতে দরজা খোলে সে।
দরজার সামনেই উদ্বিগ্ন চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার চার সাঙাত। ভয়ের একটা শীতল স্রোত নেমে যায় দেলুর শিরদাঁড়া বেয়ে। ‘কী হোলু? এরাম মড়ার মোতোন চেহারা ক্যান, সবার?’
‘প্লেন।’ হাত তুলে উত্তর আকাশের দিকে দেখায় কালু।
কালুর বাড়ানো হাতকে অনুসরণ করে দেখার আগেই শব্দ কানে আসে তার। ঘরের মধ্যে উত্তেজিত অবস্থায় ছিল বলেই বোধ হয় শব্দ কানে যায় নি। এখন কান ফাটানো শব্দ আসছে। তিনটা যুদ্ধ বিমান ডাইভ দিয়েছে একই সাথে। দ্রুতগতিতে নেমে আসছে ভূমির দিকে।
‘এ কাদের প্লেন রে? পাকিস্তানের না ইন্ডিয়ার?’ চিৎকার করে জিজ্ঞেস করে সে।
‘জ্যান নে।’ কেউ একজন অনিশ্চিত স্বরে উত্তর করে।
প্লেনগুলো কোথায় আক্রমণ শানাতে যাচ্ছে তা হঠাৎ করেই বুঝে ফেলে দেলু রাজাকার। ‘নদীর দিকি চল দিন সবাই। ঠিক জাহাজের ওপরেই বোমা ফ্যালবে প্লেনগুলু।’
কারো উত্তরের অপেক্ষায় না থেকেই নদীর দিকে ছুট লাগায় দেলু রাজাকার। তার সাঙাতরা বেয়োনেট লাগানো বন্দুক কাঁধে নিয়ে ছুটতে থাকে তার পিছনে।
এক পাল হায়েনা ছুটে চলেছে রূপসার দিকে।
***
‘ওরা আমাদের আক্রমণ করতে যাচ্ছে।’ কেউ একজন আতংকিত গলায় চেঁচিয়ে ওঠে।
প্রবল বিস্ময়ে ঘাড় ঘুরিয়ে জয়ন্ত রায় চৌধুরী তাকান আকাশে দিকে। কমান্ডার সামন্তের কথা শুনে তিনিও নিশ্চিন্তে ছিলেন। এখন মনে হচ্ছে অতটা নিশ্চিত না হলেই বোধ হয় ভালো হতো। শিকার ধরার সময় বাজপাখি যেমন অনেক উঁচু থেকে ভয়ংকর গতিতে নেমে আসে, ন্যাট বিমান তিনটি ঠিক সেভাবেই নেমে আসছে তাদের দিকে। ভাবভঙ্গিতে আক্রমণের চিহ্ন পরিষ্কার। জয়ন্ত রায়ের অভিজ্ঞ চোখ এই চিহ্ন পড়তে ভুল করে না।
‘শুয়ে পড়ো, শুয়ে পড়ো সবাই।’ চিৎকার করে আদেশ দেন তিনি। নিজেও লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েন ডেকের উপরে।
বিমান তিনটা সোজা নেমে আসে পদ্মার উপরে, সগর্জনে। দেখে মনে হবে যেন পদ্মার সাথে সরাসরি সংঘর্ষ ঘটতে যাচ্ছে। পদ্মার ঠিক সামান্য উপরে এসে নাক উঁচু করে বিমানগুলো। আর ঠিক সেই মুহুর্তেই বোমাগুলো বের হয়ে আসে তাদের পেটের মধ্য থেকে। বোমা ফেলেই পলাশের উপর দিয়ে উড়ে চলে যায় দক্ষিণে। প্রচণ্ড বিস্ফোরণে কেপে ওঠে পদ্মার ইঞ্জিন রুম। কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে যায় আকাশ। ন্যাট বিমানগুলো নাক উঁচু করে হারিয়ে যেতে থাকে দক্ষিণে। পদ্মায় আক্রমণ করে পলাশের মাস্তলের এতো কাছ দিয়ে উড়ে গিয়েছিল সেগুলো যে, পেটে আঁকা অশোক চক্র শোভিত তিন রঙা পতাকাটা দেখতে একটুও ভুল হয় নি জয়ন্ত রায় চৌধুরীর।
সবাই ছুটে যায় ফরোয়ার্ড ডেকের রেলিং এর দিকে। আগুনের তাপ থেকে নিজেকে বাঁচাতেই যেনো রূপসার রূপালি জলে ডুবে দিচ্ছে পদ্মা। হইচই চিৎকার চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে। নৌ সেনারা প্রাণ বাঁচাতে ঝাপিয়ে পড়ছে ঠাণ্ডা পানিতে।
ঠিক সেই মুহুর্তে দূরবর্তী ইঞ্জিনের মৃদু আওয়াজ কানে ভেসে আসে জয়ন্ত রায় চৌধুরীর। দক্ষিণ আকাশের দিকে তাকান তিনি। সাদাটে রঙের হালকা মেঘের ভাজে তিনটি কালো বিন্দু আবিষ্কার করেন তিনি।। ফিরে আসছে বিমানগুলো। নিশ্চিতভাবেই হামলা চালানোর জন্য আবার। দিগন্ত সীমার ওপারে চলে গিয়েছিল তারা পদ্মায় আক্রমণ শাণিয়ে। ওখান থেকে অর্ধ্ববৃত্তাকারে ঘুরে ফিরে আসছে নতুন আক্রমণের উদ্দেশ্যে। এবার নিশ্চয়ই পলাশ তাদের লক্ষ্য।
‘উই আর গোয়িং টু ইভাকুয়েট পলাশ। হারি আপ এভরিবডি।’ হুকুম দিলেন তিনি।
***
হাঁফাতে হাঁফাতে ইঞ্জিনরুমে আসে মোশাররফ। তরুণ একজন নৌসেনা। ‘কমান্ডার স্যার আদেশ দিছেন। আমরা পলাশ ছেড়ে যাচ্ছি। প্লেনগুলো আবার আসছে এটাক করতে।’
প্রবল ব্যস্ততায় নিজের কাজ করে যাচ্ছিলেন রুহুল আমিন। বিস্মিত হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন তিনি তরুণের দিকে। ‘পলাশ ছেড়ে যাচ্ছি আমরা?’
‘জ্বি স্যার। হাতে সময় নেই। পদ্মা ধ্বংস হয়ে গেছে। এইবার আমাদের পালা। আপনারা তাড়াতাড়ি করেন।’
মাথার মধ্যে আগুন ধরে যায় রুহুল আমিনের। উঠে দাঁড়ান তিনি। মোশারফফকে এক হাতে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে দুড়দাড় করে সিঁড়ি ভেঙে উপরে আসেন তিনি। ডুবন্ত পদ্মার দিকে চোখ যায় তাঁর। সন্তান হারানোর তীব্র বেদনা এসে পাঁজরে বিদ্ধ হয় তাঁর। এক মুহুর্তের জন্য স্থবির হয়ে যান তিনি। পদ্মার গায়ের জ্বলন্ত আগুন দেখতে দেখতে টের পান তাঁর মাথার মধ্যের আগুনও দাবানল হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। খপ করে পাশে দাঁড়ানো রউফের বুকের কাছের শার্ট চেপে ধরেন তিনি। পলাশের একজন গানার সে। টেনে নিয়ে আসেন নিজের কাছাকাছি।
‘পদ্মায় বোমা পড়লো কীভাবে? কামানের পিছনে বসে ঘোড়ার ঘাস কেটেছো তোমরা? প্লেনগুলোকে ফেলতে পারো নি?’ প্রবল রাগে চিবিয়ে চিবিয়ে তিনি বলেন।
রুহুল আমিনের বজ্রমুষ্ঠিতে চাপা পড়ে হাঁসফাঁস করে রউফ। ভয় পেয়েছে সে। রুহুল আমিনের বদমেজাজের কথা কারোরই অজানা নয়।
‘আমরাতো কামান দাগি নাই স্যার।’ তোতলাতে তোতলাতে বলে সে।
‘কামান দাগো নাই?’ বিস্ময় যেনো বাধ মানে না রুহুল আমিনের। ‘কেন?’
‘আমি নিষেধ করেছি।’ পিছন থেকে গম্ভীর একটা কণ্ঠ ভেসে আসে। ‘ওগুলো ইন্ডিয়ার প্লেন।’
রউফকে ছেড়ে দেন রুহুল আমিন। চরকির মতো ঘুরে যান তিনি। চোখে তীব্র আগুন নিয়ে তাকান জয়ন্ত রায় চৌধুরীর দিকে। যেন ভস্ম করে ফেলবেন তাঁকে তিনি।
‘পলাশ ছেড়ে যাবার আদেশ কেন দিয়েছেন আপনি?’
‘বললাম না। ওগুলো ইন্ডিয়ার প্লেন। আবারো আসছে আমাদের এটাক করতে। ইভাকুয়েট ছাড়া আর কী উপায় আছে?’
‘এটা যুদ্ধ জাহাজ। আমাদের এন্টি এয়ারক্রাফট গান আছে। যুদ্ধ না করে চোরের মতো আমরা পালাবো কেনো?’
‘রুহুল, তুমি কি পাগল হয়ে গেছো? বলছি না ওগুলো ইন্ডিয়ার প্লেন। তুমি ইন্ডিয়ার প্লেনে কামান দাগতে চাও?’
অগ্নি দৃষ্টি নিয়ে জয়ন্ত রায় চৌধুরী দিকে এগিয়ে যায় রুহুল আমিন। প্রথম দেখায় মনে হবে যেন গায়ে হাত তুলতে যাচ্ছে। জয়ন্ত-র খুব কাছে গিয়ে হুংকার ছাড়ে রুহুল।
‘এটা বাংলাদেশের যুদ্ধ জাহাজ। একে যে আক্রমণ করতে আসবে তার দিকেই কামান দাগাবো। ইন্ডিয়া পাকিস্তান বুঝি না আমরা। জাহাজ ছেড়ে কেউ যাচ্ছি না আমরা। আপনি সবাইকে বলেন এ কথা।’
আগুন জ্বলে ওঠে জয়ন্ত রায় চৌধুরীর গলায়। তীব্র দৃষ্টিতে তিনি তাকিয়ে থাকেন রুহুল আমিনের দিকে। রাগে কাপছে তাঁর সমস্ত শরীর।
‘আমি এই গানবোটের কমান্ডিং অফিসার। হু দ্য হেল আর ইউ টু টেল মি হোয়াট টু ডু? আমরা ইভাকুয়েট করছি। এটাই ফাইনাল।’ এক চোখে আগুয়ান বিমানগুলোর দিকে তাকান তিনি। খুব কাছে চলে এসেছে ওগুলো।
অনল দৃষ্টিতে জয়ন্ত রায় চৌধুরীর দিকে অনন্তকাল তাকিয়ে থাকেন রুহুল আমিন। আফ্রিকার জঙ্গলে যুদ্ধমান দুই সিংহ যেন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে মরণ লড়াই শুরু হবার ক্ষণে।
দুই পা পিছিয়ে যায় রুহুল আমিন। পিছন ফিরে তাকায়। সবার দৃষ্টি তাঁদের দিকে। ধমকে ওঠেন তিনি।
‘মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছো কেনো সবাই? যে যার পজিশনে যাও। পলাশ ছেড়ে আমরা কেউ যাচ্ছি না। প্লেনগুলোকে উড়িয়ে দেব আমরা। আমরা এগিয়ে যাবোই। যুদ্ধ করে জয়ী হবো। কিছুতেই লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হবো না।’
‘তুমি উর্ধ্বতন অফিসারের কমান্ড অমান্য করছো রুহুল। কোর্ট মার্শালের ব্যবস্থা করবো আমি। তোমার মৃত্যুদণ্ড কেউ ঠেকাতে পারবে না। শুধু তুমি না, অন্য যারা আমার কমান্ড অমান্য করবে সবারই ফাঁসির ব্যবস্থা করবো আমি।’ পিছন থেকে কঠিন গলায় জয়ন্ত বলেন।
জয়ন্তর দিকে ঘুরে দাঁড়ান রুহুল আমিন। ঠোঁটের কোণায় বাঁকা হাসি। আশ্চর্য রকমের শান্ত স্বরে বলেন,
‘চট্টগ্রাম নৌঘাটি থেকে পালিয়ে যেদিন ত্রিপুরাতে গিয়েছি, সেদিন থেকেই জীবনটা দেশের জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছি স্যার। খামোখা আমাকে মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে লাভ নেই।’
ঘাড় ঘুরিয়ে দক্ষিণ আকাশের দিকে তাকন তিনি। মৃত্যুদূতের মতো এগিয়ে আসছে যুদ্ধ বিমান তিনটা। অস্থির চঞ্চল হয়ে ওঠেন।
‘কুইক, যে যার পজিশনে যাও। সময় নেই।’ তাড়া দেন তিনি। নিজেও ছুটতে থাকেন সিঁড়ির দিকে। ইঞ্জিন রুমে যেতে হবে তাকে দ্রুত।
রুহুল আমিনের ছুটন্ত একহারা শরীরের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন জয়ন্ত। বুকের মধ্যে ঈর্ষা মিশ্রিত আশ্চর্য এক ধরণের ভালবাসা অনুভব করছেন তিনি এই রগচটা লোকটার জন্য। দেশের জন্য যাদের বুকের মধ্যে এরকম অফুরন্ত ভালবাসা জমানো, সেই বাঙালদের পরাধীন করে রাখার শক্তি কারোরই নেই।
***
ন্যাট বিমানগুলো হামলা চালালো প্রত্যাশার চেয়েও দ্রুত গতিতে। পলাশে যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছিল তার পুরো ফায়দা নিয়ে। চিলের মতো ছো মেরে সেগুলো নেমে এলো পলাশের ঘাড়ের উপরে। একেবারে নিঃশ্বাস ফেলার দুরত্ব থেকে কোনোরকম প্রতিরোধ ছাড়াই পলাশের গায়ে বোমা ফেললো তারা।
একটা বোমা এসে পড়লো ইঞ্জিন রুমে। প্রচণ্ড বিস্ফোরণ শব্দে কানে তালা লেগে গেলো রুহুল আমিনের। বিস্ফোরণের ধাক্কায় দেয়ালে গিয়ে পড়েছে তাঁর শরীরটা। তীব্র ব্যথায় আবিষ্কার করলেন যে, একটা হাত উড়ে গেছে বোমার আঘাতে। জাহাজে রাখা গোলাবারুদগুলো ফুটছে। কোনো রকমে হামাগুড়ি দিয়ে বের হয়ে এলেন তিনি বাইরে। টেনে হিঁচড়ে শরীরটাকে নিয়ে উঠে এসেছেন ডেকে। চারিদিকে মৃত্যুর ছড়াছড়ি। যারা জীবিত আছে ছুটোছুটি করে নদীতে ঝাপিয়ে পড়ছে। শরীরের ভারসাম্য রাখতে কষ্ট হচ্ছে রুহুল আমিনের। একদিকে হেলে পড়ছে আহত পলাশ।
‘আমার পলাশকে ছেড়ে তোমরা যেও না। ওকে বাঁচাও। ও যে বাংলাদেশের প্রথম সন্তান।’ এক হাতে রেলিং ধরে দুর্বল স্বরে পলায়নপর নাবিকদের প্রতি আকুতি জানান তিনি।
তুমুল হট্টগোলে তাঁর কথা কানে যায় না কারোরই। আরো কাত হয়ে গিয়েছে পলাশ। শরীরের নীচের অংশে পানি ঢুকছে। সেই চাপে আস্তে আস্তে করে তলিয়ে যেতে থাকে সে। দুর্বল এক হাত দিয়ে রেলিং ধরে কাত হয়ে ছিল রুহুল আমি। রক্তে পিচ্ছিল হাত ফসকে যায় রেলিং। উলটে পড়ে যান তিনি রূপসার ঠাণ্ডা পানিতে। পড়েই তলিয়ে যেতে থাকেন তিনি। আবিষ্কার করেন পলাশও তাঁর পাশেই তলিয়ে যাচ্ছে। এক হাত দিয়েই তিনি আঁকড়ে ধরেন পলাশকে। কিছুতেই ডুবতে দেবেন না তিনি তাকে। তাঁর সন্তান তাঁর চোখের সামনেই ডুবে যাচ্ছে, বাবা হয়ে তিনি কীভাবে তা হতে দিতে পারেন।
পলাশের ভারি শরীরের সাথে তিনিও নেমে যেতে থাকেন অতল জলের গভীরে।
ফুসফুস বিশ্বাসঘাতকতা করে তাঁর সাথে। একটু বাতাসের জন্য হাঁসফাঁস করে ওঠে সেটি। পলাশের গা থেকে হাত ফসকে যায় তাঁর। নিজের অজান্তেই বাতাসের আশায় তাঁর শরীরটা উঠে আসতে থাকে জলের উপরে। পলাশ হারিয়ে যেতে থাকে জলের আঁধারে।
পানির উপরে এসেই বড় করে নিঃশ্বাস নেন তিনি। পলাশের কোনো চিহ্নই নেই কোথাও। হারিয়ে গেছে সে জলের নীচে। আর্তনাদ করে ওঠেন তিনি।
‘তোকে বাঁচাতে পারলাম না বাবা। মাফ করে দিস আমাকে।’ আকুল হয়ে মাঝ নদীতে শিশুর মতো কাঁদতে থাকেন রুক্ষ্ণ কঠিন মানুষটা।
***
ছোটবেলা থেকেই দক্ষ সাঁতারু তিনি। জল তাঁর আপন ঠিকানা। নদী, নালা, সাগরে তিনি বিচরণ করেন মাছের মত সাবলীলতায়। কিন্তু, সেই তিনিও এখন রূপসার তীরে আসতে রীতিমত সংগ্রাম করছে। আহত অবস্থায় এক হাত দিয়ে সাঁতার কাটাটা দুঃসাধ্যই বটে। প্রবল মনোবলই তাঁকে ভাসিয়ে রেখেছে। জ্ঞান আর অজ্ঞানের একটা মাঝামাঝি অবস্থায় তিনি আছেন। ঠিক যে মুহুর্তে চোখ বন্ধ করে হাল ছেড়ে দিয়েছেন তিনি, ঠিক সেই সময়ে হাতে মাটির স্পর্শ পেলেন। ক্লান্তিতে গা এলিয়ে দিলেন তিনি। চোখ খোলারও শক্তি নেই তাঁর। গভীর ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
দুটো রোমশ হাত শক্তভাবে চেপে ধরে তাঁর একমাত্র হাতটা। কেউ একজন পানি থেকে টেনে তুলছে তাঁকে। টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে শুকনো মাটিতে। শুকনো মাটিতে এনে হাতটা ছেড়ে দেয় তাঁর। অনেকগুলো উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শুনতে পান তিনি। কিন্তু কোনো কথাই বুঝতে পারছেন না তিনি। হঠাৎ করেই প্রচণ্ড ব্যথায় কাঁতরে ওঠেন তিনি। কেউ একজন তাঁর কাটা হাতের জায়গাটাতে ভুল করে পা চেপে ধরেছে। এই ব্যথাতেই সচেতন হয়ে ওঠেন তিনি। চোখ মেলে তাকান। একটা দাঁড়িওয়ালা লোক তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। বিশাল ভালুকের মত চেহারা। পাশে আরো চারজন। সবার হাতেই বেয়োনেট লাগানো বন্দুক। কারা এরা? স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা?
তাঁর উড়ে যাওয়া হাতের ক্ষতস্থানে পায়ের চাপ আরো বাড়ে। ব্যথায় মুচড়ে ওঠে শরীরটা। এরা কেমন লোক? একজন আহত মানুষকে কষ্ট দিচ্ছে। বুঝতে পারছে না, নাকি? লোকটাকে পা সরানোর কথা বলার জন্য তাঁর দিকে তাকান তিনি। ক্রুর একটা হাসি লেগে আছে দেলু রাজাকারের কালো ঠোঁটে। কুতকুতে দুটো চোখে সীমাহীন ঘৃণা আর জিঘাংসা। কারা এরা, সেটা এক মুহুর্তেই সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যায় তাঁর কাছে। পালাতে হবে। শরীরটা মুচড়ে ওঠে তাঁর।
চার বন্দুকধারী রাজাকার বন্দুক উলটো করে ধরে কাঁধের একপাশে তোলে। দুপুরের রোদ বেয়োনেটগুলোতে প্রতিফলিত হয়ে তাঁর চোখ ঝলসে দেয়। তিনি চোখ বন্ধ করেন।
কোঁচ যেভাবে মাছকে বিদ্ধ করে, ঠিক সেইভাবে তাঁর আহত শরীরটাকে বিদ্ধ করার জন্য চারটে নিষ্ঠুর বেয়োনেট নেমে আসতে থাকে সবেগে।
———————————
১. মুক্তমনায় অসাধারণ একজন মানুষ ছিলেন। ছিলেন বললাম এই কারণে যে, অনেকদিন ধরেই তাঁকে দেখি না আমি। লিখতেন না তিনি, কিন্তু অসাধারণ সব মন্তব্য করতেন। তাঁর নাম মনজুর মুরশেদ। গত বছর আমি বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরকে নিয়ে একটা গল্প লিখেছিলাম শিশির ভেজানো ভোর নামে। সেই গল্পে তিনি মন্তব্য করেছিলেন এই বলে যে, আমি যেন বাকি সব বীরশ্রেষ্ঠদের নিয়েও এরকম গল্প লিখি। এই দূরাশা আমি করি না। তারপরেও এই দ্বিতীয় গল্পটা লিখতে গিয়ে ভদ্রলোকের কথা মনে পড়েছে বার বার আমার। সে কারণেই এই গল্পটা আমি তাঁকেই উৎসর্গ করছি।
২. আমরা ইতিহাস অসচেতন জাতি। কোনো ঘটনা লিখে যাওয়ার প্রতি আমাদের অনীহা রয়েছে। পলাশ এবং পদ্মার ঘটনা খুঁজতে গিয়ে কোথাও বিস্তারিত কিছুই পাই নি আমি। সবই কেমন যেন ভাসাভাসা গৎবাঁধা বিবরণ। পলাশে ইঞ্জিন রুম আর্টিফিসার হিসাবে কাজ করেছেন রুহুল আমিন। পলাশ ধ্বংস হবার আগে নাটকীয় এক এনকাউন্টারে গেছেন তিনি এর কমান্ডিং অফিসারের সাথে। সেই সব বিবরণ বিস্তারিত কেউ লিখে যায় নি। তাঁর সঙ্গীদেরতো এগুলো জানার কথা। অবশ্য এগুলোর কথা আর কী বলবো। ফোর্স আলফার অপারেশনেরও পুরো ঘটনা কোথাও নেই। আমি অনেক খুঁজে একটা বই পেয়েছি। নাম Transition to Triumph: History of Indian Navy, 1965-75. এই বইতে কমান্ডার মানবেন্দ্র সামন্তের বরাত দিয়ে ফোর্স আলফার অপারেশনের কথা লেখা আছে। তবে, পলাশের অভ্যন্তরীন ঘটনা সেখানে অনুপস্থিত বোধগম্য কারণেই। কমান্ডার সামন্ত পলাশে ছিলেন না, ছিলেন পানভেলে।
৩. গত কয়েকদিনে অপ্রত্যাশিতভাবে আপন একজন নিত্য গুঁতিয়ে গিয়েছে নতুন একটি লেখার জন্য। এরকম উৎসাহ পেতে অভ্যস্ত নই আমি। আপনজনের নাম নিতে নেই, তাই নামটা নিলাম না। কিন্তু কৃতজ্ঞতা রইলো তার প্রতি।
৪. খুলনার আঞ্চলিক ভাষাটা আমার জানা নেই। সে কারণে দেলু রাজাকার আর তার সাঙাতদের সংলাপগুলো শুদ্ধ বাংলাতে লিখতে হয়েছে আমাকে। খুলনার কেউ যদি আঞ্চলিক ভাষায় রূপান্তর করে দেন, খুশি মনে আমার অংশগুলোকে বাদ দিয়ে সেগুলোকে সংযুক্ত করে দেবো।
৫. তথ্যের অভাবে আমাকে এই গল্পটাতে অনেক বেশি কল্পনার আশ্রয় নিতে হয়েছে। মূল ঘটনাকে অবশ্য অক্ষুণ্নই রেখেছি আমি। তারপরেও বলবো, এটাকে ইতিহাসাশ্রিত গল্প হিসাবেই দেখবেন সবাই দয়া করে, ইতিহাস হিসাবে নয়।
৬. সবাইকে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা।
অনবদ্য! আপনার লেখা নিয়ে যা ই বলি তা অসম্পূর্ণ ই মনে হয়; লেখাট পড়তে পড়তে আমি চলে যাই সাক্ষাৎ ঘটনাস্থলে; জানি সবটা সত্য নয়, তবু এই লেখার পেছনে যে তাড়ণা, যে বোধ ছিল, যে প্রত্যয় ছিল সেটা টের পাই ভীষণভাবে, আর তাই আমাকে টেনে নিয়ে যায় কল্পনাকে সত্যানুসান্ধানের পথে। আশা করব বাকী পাঁচজনের জন্যও আপনার লেখা পাব খুব তাড়াতাড়ি। অন্তরের গভীর থেকে অনেক শ্রদ্ধা আর অনেক অনেক ধন্যবাদ ফরিদ ভাই।
ফরিদ ভাই, অসাধারন, আমি বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমীনের বিস্তারিত গল্পটা জানতাম না।আজ আপনার লেখা পড়ে অনেক কিছু জানলাম। বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা ( দেরি হয়ে গেল, দুঃখিত) নিবেন।
এটাও এমন একটা নতুন খবর। আমি বিস্মিত হচ্ছি যে সত্যি কি ভারতীয় কমান্ডার বোঝে নাই নাকি এইটা পাকিস্তানের চর, নাকি বেশি দেমাগ আর আত্ম বিষাসের ফল, নাকি শুধুই ভুল? একটু জানতে ইচ্ছে করছে।খুব বিস্মিত হচ্ছি যে নিজেদের বিমান আর শত্রু বিমান চিনল না এর সামরিক অফিসার!!!
সব শেষে খালি একটাই কথা বলতে হয় যে, ইতিহাস কে গল্প আকারে লেখায় সত্যি আপনি অতুলনীয় একেবারে মাস্টারপীস এই লেখাটি (F) , মনের কথাটাই কিন্তু বলে দিলাম 🙂 ।
@দারুচিনি দ্বীপ,
যুদ্ধক্ষেত্রে এই রকম মিস আইডেন্টিটি খুব একটা ব্যাতিক্রম নয়। আসলে ভারতীয় প্লেনগুলি ধারনা করেছিল সেগুলি পালাতে থাকা ছদ্মবেশী পাকিস্তানী জাহাজ। সে সময় পাকিস্তানীরা খুলনা বন্দর দিয়ে খোলা সাগরের দিকে পালাবে এমন পাকা গোয়েন্দা তথ্য ছিল।
@আদিল মাহমুদ, ওহ আচ্ছা ধন্যবাদ আদিল ভাই, বুঝতে পেরেছি এবার।
(F) (F) (F) (F) (F) (F) (F)
প্রিয় ফরিদ আহমেদ,
সত্যি বিভিন্ন কারনে বহুদিন মুক্তমনায় আসা হয় নি। গতকালই ভাবলাম বিজয়ের মাস, তার উপর মোল্লা বিদায়; নিশ্চই অনেক ভাল লেখা এসেছে মুক্তমনায়। ……ধারনা সত্যি; বেশ আয়েশ করে লেখাগুলো পড়ছিলাম। ভেবেছিলাম আপনার লেখাটা পড়বো সবচেয়ে শেষে…… তারপর পাদটীকায় পৌঁছে ……!!?!… সত্যিই এই অসাধারণ সুন্দর গল্পটা আমাকে উৎসর্গ করায় আমি ধন্য হয়েছি।
আমি কিন্তু আপনার থেকে খুব বেশী দূরে নই, মন্ট্রিয়লে, কাছাকাছি কোথাও এলে আড্ডার দাওয়াত রইল।
আর সবার মত আশা করছি বাকী গল্পগুলোও খুব শীঘ্রই পড়তে পারবো। আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি আবারো; আর সবাইকে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা
@মনজুর মুরশেদ,
আরে! এতো অনেক কাছে। আমি থাকি স্কারবরোতে। টরন্টো এলে, ঢোকার মুখেই পাবেন আমাকে । 🙂
বীরশ্রেষ্ঠদের সকল তথ্য ও ইতিহাস আমরা অনেকেই জানি না। এটা অত্যন্ত দুঃখ ও লজ্জাজনক। শুধু জানার জন্য জানা নয়, আমাদের কর্তব্য তাঁদের সম্মন্ধে জানা। তাঁদের সম্পর্কে আমাদের জানানোর এই মহৎ ও কষ্টসাধ্য কাজ আপনি শুরু করেছেন, সেজন্য ধন্যবাদ। আশা করবো, আপনি এই কাজ সুসম্পন্নও করবেন।
@তামান্না ঝুমু,
ধন্যবাদ ঝুমু। মাত্রতো সবে দুজনকে নিয়ে লিখলাম। এখনো বাকি পাঁচ জন। দেখা যাক পারি কিনা।
লেখাটির গুরুত্ব মনে হয় পুরো কেউ ধরতে পারেননি। আমার জানা মতে বাংলাদেশে এই ইতিহাস সম্ভবত এই প্রথম বার হল।
আমাদের একটি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয় আছে জানি। তারা ঠিক কি করেন আমার পরিষ্কার জানা নেই। যে ধরনের ইতিহাস শখের ব্লগাররা নিজেদের কর্মব্যাস্ততার ফাঁফে সময় দিয়ে বার করতে পারেন সে ধরনের ইতিহাসের সন্ধান তারা কেন প্রফেশনাল এবং সরকারী সুযোগ সুবিধে পেয়েও করেন না কে জানে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয়ে কি রিসার্চ এনালাইসিস জাতীয় কোন বিভাগ নেই? তাদের ওয়েব পেজে কি ইতিহাস বিষয়ক এ জাতীয় তথ্যাবলী আছে? কি বিস্ময়কর ব্যাপার, একজন বীর শ্রেষ্ঠ, অথচ তার শহীদ হওয়া বিষয়ক তথ্যাবলী আমরা জানি না। প্রায় সব যায়গায় এমনকি লেখা হয় পাকিস্তানী বিমান হামলা হয়……
ফরিদ ভাইকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করার দরকার দেখি না……উনি এমনিতেই ছোটখাট মানুষ।
বিজয় দিবসে এরকম একটা লেখা উপহার দেবার জন্য ধন্যবাদ।
যদি আপনার জানা থাকে, তাহলে আমাদের জানাবেন কি যে পানভেলের কি হয়েছিল মানে ওটা কি আক্রমনের শিকার হয়েছিল? যদি না হয়ে থাকে, তবে কেন হলনা?
আর রুহুল আমিনের বীরত্বের আর কিছু কি নেই, কমান্ডিং অফিসারের অবাধ্য হয়ে জীবন হারানোর আগে নিশ্চয় তিনি আরো কিছু করেছিলেন। নিশ্চয় বীরচিত কিছুই করেছিলেন। সেগুলোর বর্ননা পেলে আরও ভালো লাগত। একজন বীরশ্রেষ্ঠ কেন শ্রেষ্ঠ তাও বোধগম্য হত। –ধন্যবাদ।
@আসাদ,
কমান্ডার মানবেন্দ্র সামন্ত এর ভাষ্য অনুযায়ী পানভেল এই আক্রমণ এড়াতে সক্ষম হয়েছিল। আমি তাঁর ভাষ্যই তুলে দিচ্ছি এখানে।
My intention was to go upto PNS TITUMIR, the pakistan NAval establishment in Khulna, capture it and thereby support our Army from the rear of the defending Pak forces.
Unfortunately at that time, three Indian Air Force Gnat fighters appeared in the sky and despite the fact that we were displaying our pre-arranged recognition signal of very large yellow flag, they attacked us in broad daylight. We opened fire on these Gnats, not with the intention of hitting them, because they were our own fighters, but just to put them off. Unfortunately, the Gnats got both the boats, PADMA and PALASH, which were set ablaze and sunk. INS PANVEL escaped damage by violent evasive manouvers and the use of engines.
After the Gnats went away, I started picking up the survivors of these two boats. The total casualties were 4 or 5 Mukti Bahini sailors dead. One BSF Jawan who was badly injured subsequently died and quite a few of us were injured, including myself. I had a glazing bullet wound.
Then, half an hour later the second wave of Gnats came and again swooped down on us. Fortunately for us this time, the Gnats did recognize that we were a friendly force and peeled off to attack shore targets.
লেফটেন্যান্ট কমান্ডার জে, পি, এ নরনহা ছিলেন পানভেলের কমান্ডিং অফিসার। তাঁর ভাষ্যটাও এখানে তুলে দিচ্ছি।
Having been fired upon by Indian aircraft, the Pakistani themselves thought us to be Pakistani. I made full use of that confusion. I opened fire against the aircraft to disturb their aim. I thought it preferable if one pilot’s life was lost as against losing my entire ship and it’s crew. I tried to weave to avoid being hit. But, finding that I could not outgun or out-manouvre the aircraft doing such high speeds, I decided to climb up the river bank and keep my engines at full ahead. so, that the smoke could give the appearances of the ship having been hit. This helped me in the second and third sorties when they flew over me and they did not attack me. They attacked the port and other installations and went away.
এই প্রসঙ্গে আরেকটা তথ্য জুড়ে দেই। কমান্ডার সামন্ত এবং লেফটেন্যান্ট কমান্ডার নরনহা, দুজনেই তাঁদের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য ভারত সরকারের কাছ থেকে মহাবীর চক্র পদক পেয়েছিলেন।
@আসাদ,
ইতিহাসকে আশ্রয় করে আমি আসলে গল্প লিখেছি। বেশি তথ্য ঠেসে ঢোকাতে গেলে গল্পের গতি রুদ্ধ হয়। কী কারণে তিনি বীরশ্রেষ্ঠ, সেটা দেখানোর চেয়ে দেশের প্রতি এই মানুষটির অসাধারণ ভালবাসাকেই আমি হাইলাইট করার চেষ্টা করেছি।
শুধু কমান্ডিং অফিসারের আদেশ অমান্য করার কারণে তিনি বীরশ্রেষ্ঠ হন নি। বোমার আঘাতে পলাশ যখন ডুবতে বসেছিল, কমান্ডিং অফিসার জয়ন্ত রায় চৌধুরীর হুমকি ধামকিতে সবাই পলাশ ত্যাগ করেছিল, রুহুল আমিন তা করেন নি। জীবনের ঝুকি নিয়ে শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত পলাশকে ভাসিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন তিনি ইঞ্জিনরুমে। পরে যখন পলাশের গোলাবারুদ ফুটতে শুরু করেছে, তার আঘাতে তিনি মারাত্মকভাবে আহত, তখনই তিনি পলাশ ছেড়েছেন। আরো আগে পলাশ ত্যাগ করলে তিনি ঠিকই বেঁচে যেতেন।
জাহানারা ইমামের লেখা প্রবন্ধ ‘পলাশের বীর’ থেকে কিছুটা অংশ তুলে দেই এখানে।
“শত্রুর বিমান অনুমান করে পদ্মা ও পলাশ থেকে গুলি করার অনুমতি চাওয়া হয়। জবাবে ক্যাপ্টেন সামন্ত জানান – বিমানগুলি ভারতীয়, সুতরাং ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও, হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবেই বিমানগুলি নিচে নেমে এসে বোমাবর্ষণ শুরু করে। প্রথমে গানবোট পদ্মার উপর, এবং পরে পলাশের উপর। গোলা সরাসরি পদ্মার ইঞ্জিনরুমে পড়ায় ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। বহু নাবিক হতাহত হয়। গানবোট পলাশ এবং পানভেল তখনো সচল। এমন সময় পলাশের অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট কমান্ডার রায় চৌধুরী আদেশ দেন, ‘জাহাজ ত্যাগ কর।’ ইঞ্জিন্রুম আর্টিফিসার রুহুল আমিন ইঞ্জিনরুমে প্রাণপনে চেষ্টা করছিলেন ইঞ্জিন সচল রাখার জন্য। লে.ক. রায় চৌধুরীর জাহাজ ত্যাগ করার আদেশে তিনি ক্ষুব্ধ হন। উপরে এসে চিৎকার করে জানতে চান, জাহাজ থামাতে বলা হয়েছে কেন? পরাজয়ের গ্লানি বরণ করবেন, এ তিনি কল্পনাও করতে পারেন না। চিৎকার করে সবাইকে অনুরোধ করে বলতে লাগলেন, মৃত্যুর ভয়ে আমরা ভীত নই। আমরা এগিয়ে যাবই। যুদ্ধ করে জয়ী হব। কিছুতেই উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হব না। কামানের ক্রুদের বললেন বিমানের দিকে গুলি করতে। নিজে ফিরে গেলেন ইঞ্জিনরুমে। একদিকে অধিনায়কের আদেশ এবং অন্যদিকে রুহুল আমিনের প্রতিবাদে বিভ্রান্ত সব নাবিক। এদিকে বিমানগুলি আবার ফিরে এসে পিছন থেকে গোলাবর্ষণ করে গানবোট পলাশের উপর।
ধ্বংস হল পলাশের ইঞ্জিনরুম।
পলাশের রঙ গায়ে মেখে শহীদ হলেন মোহাম্মদ রুহুল আমিন।”
আশা করি এখন বুঝতে পারছেন যে তিনি কেন একজন বীরশ্রেষ্ঠ। 🙂
শহীদ রুহুল আমিনদের জাহাজ আক্রমনের ঘটনা যে ভারতীয় বিমানের সেম সাইড সেটা জানতাম, তবে এত বিস্তারিত জানা ছিল না। সেম সাইড বলেই হয়ত এই ঘটনা তেমন বিস্তারিতভাবে আসে না। কি কারনে সময় থাকতে বিমানগুলির সাথে যোগাযোগ করে ভুল ভাংগানো হয়নি কে জানে।
রুহুল আমিনের একখানে ছবি জুড়ে দিতে পারেন।
@আদিল মাহমুদ,
ঘটনা এত দ্রুত ঘটেছে যে, যোগাযোগ করার সময়ও আসলে কেউ পায় নি। জান বাঁচাতেই ব্যস্ত ছিল পদ্মা, পলাশ আর পানভেল।
গল্প হিসাবে লিখেছি, সে কারণে ছবি দেই নি ইচ্ছা করেই।
মুক্ত-মনার পাঠকদের জন্য বিজয় দিবসে ফরিদ আহমেদের উপহার রক্ত পলাশের রঙ।
আমি মনজুর মুরশেদ সাহেবের কথার প্রতিধ্বনি করছি। ২৬ মার্চ ১৪ তে আরেকজনকে নিয়ে লেখা চাই।
@গীতা দাস,
খাইছে!!!
@ফরিদ আহমেদ,
বিৎলামি কর মিঞা। বীরশ্রেষ্ঠ সব কয়জনারে নিয়া লেখা শ্যাষ না করা পর্যন্ত তোমার খবর আছে। খাইছে মানে
আবার কি?
@কাজী রহমান ভাই, ভালই বলছেন 😀
@ফরিদ আহমেদ,
হ্যাঁ ফরিদ ভাই, মঞ্জুর মুরশেদ সাহেব আর গীতাদির মত আমিও অনুরোধটা করে গেলাম। বেঁচে থাকলে আপনার লেখা যেন আবার পড়তে পারি ২৬ মার্চ আরেক বীরশ্রেষ্ঠকে নিয়ে 🙂
আরেকটা মাস্টারপিস!
@অভিজিৎ,
লজ্জা পেলাম। 🙂
@ফরিদ আহমেদ,
ঢং দেইখা বাঁচি না।
পান যত ইচ্ছা লজ্জা। লজ্জাই আপনার (মতো পুরুষবাদীর) ভূষণ।
আমি আপনার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক লেখাগুলোর মুগ্ধ পাঠক। এই বিষয়ে আবার লেখার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। (Y)
বাঙ্গালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা এবং ভালবাসা। (F) (FF)
@তারিক,
দেশের প্রতি আপনার মমত্ববোধ দেখেও আপ্লুত আমি। লেখাটা পড়েছেন, সে কারণে আপনার ধন্যবাদ প্রাপ্য আমার কাছ থেকে। (FF)
খুলনার ভাষা লেখার চেষ্টা করলাম।কিরকম হল কি জানি?
কোমর দোলানো বন্ধ করে চরম বিরক্তি নিয়ে বলে, ‘এই কি হোইচ রে,মুক্তিফোর্জ এ্যইছ নাই ,নাকি কি তোদের আর সহ্যো হচ্ছে না?
কালু মোল্লার অস্থির গলা শুনতে পাওয়া যায়। ‘দেলু ভাই, শিগগিরি বাইরি আসেন।’
‘কী হোলু? এরাম মড়ার মোতোন চেহারা ক্যান, সবার?
‘এ কাদের প্লেন রে? পাকিস্তানের না ইন্ডিয়ার?’ চিৎকার করে জিজ্ঞেস করে সে।
‘জ্যান নে।’ কেউ একজন অনিশ্চিত স্বরে উত্তর করে।
‘নদীর দিকি চল দিন সবাই। ঠিক জাহাজের ওপরেই বোমা ফ্যালবে প্লেনগুলু।’
@প্রাক্তন আঁধারে,
অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। আঞ্চলিক ভাষার সংলাপগুলো যোগ করে দিয়েছি গল্পে। (F)
মুক্তিযুদ্ধ নির্ভর এইসব ঘটনাগুলো দেশকে জন্ম দেবার গৌরব ইতিহাস। একটু গবেষনা একটু মমত্ব ভালবাসা আর একটুখানি সময়; এর চেয়ে বেশি কিছু দরকার নেই এসব রেকর্ড করে রাখতে। ফরিদ আহমেদের মত শক্তিশালী লেখকের লেখা হলে তো কথায় নেই। হৃদয়ের গভীরে গেঁথে যায়।
মুক্তিযুদ্ধের সকল বীর মুক্তিযোদ্ধা সকলেই শ্রেষ্ঠ; শ্রেষ্ঠদের জন্য অন্তহীন ভালবাসা (F)
ফরিদ আহমেদ; আবার এই রকম চমৎকার একটা লেখা উপহার দেবার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি (C) (Y)
@কাজী রহমান,
একমত।
আরে কী আশ্চর্য! এতে কৃতজ্ঞতা জানানোর কী হলো? আমি লিখি আমাদের সোনালি প্রজন্মের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য। তাঁরা আত্মত্যাগ না করলে আমাকে পাকিস্তান নামের একটা অসুস্থ দেশের নাগরিক হয়ে দিন কাটাতে হতো।
@ফরিদ আহমেদ,
নতুনরা সত্যি অনুসন্ধান করছে এখন। বহুকাল জলপাই শাসন আড়াল করেছে তথ্য প্রমান। ভয় দেখিয়েছে। নতুনদের তথ্য দিয়ে সাহায্য করতে হবে। ওরাই পোড়াবে জঞ্জাল। তথ্যসূত্র দিয়ে সুন্দর লেখাটির জন্য কৃতজ্ঞতা।
কৃতজ্ঞতা, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্বরণ করবার জন্য। আজকের দিনে আলোর কথা বলবার জন্য কৃতজ্ঞতা, এবং কুষ্ঠরোগী, শুয়োর কাদের মোল্লা আর হতাশার কথা অন্তত আজ না বলবার জন্য এই কৃতজ্ঞতা।