জেনারেল এরশাদ সরকার বিরোধী ছাত্র-গণআণ্দোলনের উত্তাল দিন। প্রতিদিনই ছাত্র মিছিলে পুলিশী হামলা হচ্ছে, গুলি হচ্ছে। ঢাকায় ও ঢাকার বাইরে প্রতিদিনই ঝরছে রক্ত। এরকমই একটি দিন ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বরের সকাল সাড়ে ৯টা। স্থান মধুর ক্যান্টিন প্রাঙ্গণ।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার প্রবেশপথগুলোতে কড়া দাঙ্গা-পুলিশী প্রহরা। ঘোষিত ছাত্র-গণসমাবেশ যেন কিছুতেই সফল হতে না পারে, সে জন্য ঢাবি’র ছাত্র-ছাত্রীদের পরিচয়পত্র দেখে তবেই ক্যাম্পাসে ঢোকার অনুমতি মিলছে। বুয়েট, ইডেন কলেজ, ঢাকা কলেজ, সিটি কলেজ, তেঁজগা কলেজ, আইডিয়াল কলেজ, বদরুন্নেসা কলেজসহ পুরনো ঢাকার আরো অনেক কলেজ, সে সময়ের কৃষি কলেজ ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ [এখন বিশ্ববিদ্যালয়]সহ আরো বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে একে একে বিশাল সব ছাত্র মিছিল সবদলীয় ছাত্র এক্য’র ব্যানারে ঢাবি ক্যাম্পাস মুখি হতে থাকে। মিছিলের সবার হাতে হাতে লাঠিশোটা।

এক সময় পুলিশী বেস্টনী ভেঙে পড়ে। আমরা আজিমপুর থেকে ঢাকা মহানগর কমিটির একটি খণ্ড মিছিল নিয়ে পলাশী হয়ে ঢাবি’তে মধুর ক্যান্টিনের সামনে জড়ো হই। সেখানে তখন ছাত্র-জনতার হাজারো জ্বলজ্বলে মুখ। ছাত্র নেতারা জানালেন, মিছিল ঢাকার বিশ্ববিধ্যালয় ক্যাম্পাস ঘুরে লাইব্রেরির দক্ষিণ দিকের গেট হয়ে টিএসসি হয়ে প্রেসক্লাবের সামনে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করবে। সেখান থেকে আবারো শুরু হবে ঢাকার রাজপথে স্বৈরাচার এরশাদ শাহী পতনের মিছিল।

সকাল সাড়ে ১০টার দিকে হাজারো ছাত্র জনতার মিছিল শুরু হয়ে যায়। মিছিলটি ঢাবির লাইব্রেরি সংলগ্ন মাঠ [তখন সেটি হাকিম ভাইয়ের চায়ের দোকানের নামে ‘হাকিম চত্বর’ হিসেবে পরিচিত] ঘেঁষে দক্ষিনদিকের গেটের দিকে নানা শ্লোগান দিতে দিতে এগুচ্ছে, ঠিক তখন আমরা শুনতে পাই অবিরাম গুলির শব্দ। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিক থেকে গুলির শব্দ ভেসে আসছে। মুহূর্র্তেই ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে মিছিল। কলেজ ছাত্ররা বেশীরভাগই ভীত সন্ত্রস্ত। তারা ব্যাগ-বইপত্র নিয়ে দিশেহারা হয়। বেশীরভাগেরই এমন সহিংস আন্দোলনের অভিজ্ঞতা নেই।

ছাত্র নেতারা চিৎকার করে আমাদের মাটিতে শুয়ে পড়তে বলেন। সকলেই তাৎক্ষণিকভাবে তাই করে। আমরা কয়েকজন মোটা মোটা কড়ই গাছগুলোর গুড়িঘেঁসে বসে পড়ি। মাথার ওপর দিয়ে সাঁই সাঁই শব্দে বাতাস কেটে যায় অসংখ্য বুলেট। ভাষা তত্ত্ব ইন্সটিটউটের দেওয়ালে বিদ্ধ হয় বেশ কয়েকটি বুলেট। গুলির এসব শব্দে আমরা নিশ্চিত হই, এগুলো পুলিশের ছোঁড়া বুলেট নয়। কারণ তাদের বুলেটের শব্দ এতো তীক্ষ্ণ নয়, বরং বেশ কিছুটা ভোঁতা।

আমাদের মধ্য থেকে দু-একজন শার্টের নীচ থেকে টেনে বের করে পিস্তল, রিভলবার, কাটা রাইফেল। এ পক্ষ থেকেও আকাশে ফাঁকা বুলেট ছুঁড়ে জানান দেওয়া হয়, আমরাও তৈরি!

গোলাগুলি থামলে একজন দৌড়ে এসে খবর দেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে একটি অ্যাবুলেন্সে করে এসেছে এরশাদের শ্যুটার বাহিনী অভি-নিরু। তারাই এতোক্ষণ গুলি ছুঁড়ে পালিয়েছে।

আমরা আবার সংগঠিত হয়ে আগের ঘোষণা অনুযায়ী মিছিল নিয়ে টিএসসির দিকে রওনা হই। শ্লোগান ওঠে:

হইহই, রইরই/ অভি-নিরু গেলো কই?
একটা গুলি চললে/ পাল্টা গুলি চলবে।
পুলিশ তুমি যতোই মারো/ বেতন তোমার ৫১২।
গুলি করে আন্দোলন/ বন্ধ করা যাবে না।
মাস্তান দিয়ে আন্দোলন/ বন্ধ করা যাবে না।…

এরই মধ্যে আমাদের মিছিলের ভেতরে খবর পৌঁছায় টিএসসির মোড়েই চিকিৎসক নেতা ডা. শামসুল আলম খান মিলন মিছিলে যোগ দিতে এসে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন [এখন যেখানে শহীদ মিলন স্মৃতি সৌধ]। ছাত্র কর্মীরা একটি রিকশায় ধরাধরি করে রক্তাক্ত মিলন ভাইকে ঢাকা মিডিকেলের জরুরি বিভাগে নিয়ে যায়। আমরাও রিকশার পেছন পেছন মিছিল নিয়ে যাই। জরুরি বিভাগে মিছিল পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই খবর পাই, মিলন ভাই আর নেই। চিকিৎসকরা তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেছেন।

হাজারো ছাত্র-জনতা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। ঢাকার বুকে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে লাটি-শোটায় সশস্ত্র মিছিল। সবার মুখে মুখে জ্বালাময়ী শ্লোগান:

আর নয় প্রতিবাদ/এবার নেবো প্রতিশোধ।
খুন হয়েছে আমার ভাই/ খুনী এরশাদ রক্ষা নাই।
খুন হয়েছে মিলন ভাই/ এবার হত্যার প্রতিশোধ চাই।
আমাদের ধমনীতে শহীদের রক্ত/ এই রক্ত কোনোদিন/ পরাভব মানে না…

উপসংহারের বদলে: সেলিম-দেলোয়ার, বসুনিয়া, তাজুল ইসলাম, নূর হোসেন, দীপালি সাহা, ডা. মিলনসহ আরো অসংখ্য রক্তের বিনিময়ে ১৯৯০ এর ০৪ ডিসেম্বর পতন হয় এরশাদ সরকারের। এরপর দুর্নীতির মামলায় তার কারাবাস ও আরো পরে রাজনীতিতে আবারো তার পুনঃবহালের ইতিহাস সকলেরই জানা। এখন শুনতে পাই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের অনুষ্ঠেয় [?] এক তরফা র্নিবাচনে এরশাদই নাকি প্রধান কান্ডারি। তার নেতৃত্বেই নাকি হতে যাচ্ছে আগামী সরকারের বিরোধী দল! …


ছবি: মেডিকেলে ডা. মিলনের মরদেহ, মুক্তধারা ডটনেট।