প্রাচীন ভারতে নারী জীবন সংসার তথা বিবাহ দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত ছিল। নারীর শৈশব-যৌবন-বার্ধক্য যথাক্রমে পিতা-স্বামী-পুত্রের দ্বারাই নির্ধারিত থাকতো। এর ফলে পুরুষ অধীনতা নারীর জন্য হয়ে পড়ে অপরিহার্য। হিন্দুধর্মের থেকে অপেক্ষাকৃত আপাতদৃষ্টিতে উত্তম ধর্ম হিসেবে বৌদ্ধধর্মের আগমন ঘটে এই ভারতে। হিন্দুধর্মের জাতিভেদ থেকে শুরু করে ঈশ্বরের প্রচলিত আরাধনার মতো অনেক কিছুই এখানে অনুপস্থিত ছিল বলে একে আপাতদৃষ্টিতে উত্তম ধর্ম বলেই গণ্য করেন অনেকে।

বৌদ্ধ শাস্ত্র যতখানি অধ্যায়ন করার সুযোগ হয়েছে তাতে আমি দেখেছি আর সব প্রচলিত ধর্ম মতের মতোই বৌদ্ধ ধর্মে বিশেষ করে নারীর ক্ষেত্রে রয়েছে সমসাময়িকতার প্রবল প্রভাব। আমাদের আলোচনার বিষয় বৌদ্ধ ধর্মের দার্শনিক তত্ত্ব নয় বরং আজকে আমরা আলোচনা করবো বৌদ্ধ ধর্মে পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতাবলয় নিয়ে। এই আলোচনা করার অন্যতম কারণ হল, আমাদের বাঙ্গালীদের মধ্যে অনেকেরই বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে ভালোভাবে না জেনেই এই ধর্মের প্রতি এক ধরনের বিশেষ অনুরাগ কাজ করে। তাছাড়া বৌদ্ধ ধর্ম নিয়ে বাংলা ভাষায় বিশেষ করে অনলাইনে ততোটা আলোচনা বা সমালোচনা আমার খুব বেশী দেখার সুযোগ হয়নি যতটা ইসলাম বা হিন্দু ধর্ম নিয়ে হয়েছে।

গৌতম বৌদ্ধ বিতৃষ্ণ ছিলেন তৎকালীন সাংসারিক জীবনাবর্তে। এই জন্য তিনি তার স্ত্রীকেও ত্যাগ করেন। যেহেতু সংসারে বসে অষ্টাঙ্গিক মার্গ পালন করে নির্বাণ লাভ করা সম্ভব নয়, সেহেতু অবশ্যই সাংসারিক মায়া ও কাম ত্যাগ করে গৃহত্যাগী হতে হবে। আর সাংসারিক মায়া ও কাম ত্যাগ করার প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে নারীকে চিহ্নিত করেন গৌতম বৌদ্ধ। তিনি বলেন, “নারী যেহেতু গৃহের মোহ তৈরি করে তাই নারী অবশ্যই পরিত্যাজ্য।”

সমগ্র বৌদ্ধ বানীকে তৃতীয় মহাসঙ্গিতি সূত্র, বিনয় ও অভিধর্ম নামে অভিহিত করা হয়। এদেরকে একত্রে বলা হয় ত্রিপিটক। যেহেতু আমরা বৌদ্ধ ধর্মে নারীদের অবস্থান নিয়ে আলোচনা করবো সেহেতু আমাদের বেশীর ভাগ আলোচনাই হবে সূত্রপিটকের খুদ্দক নিকায়ের অন্তর্গত জাতকের কাহিনীতে আলোচিত নারীর প্রতি গৌতম বৌদ্ধের নির্দেশনামূলক বক্তব্য। জাতক কাহিনীতে নীতিকথা সম্পন্ন হয় সাধারনত তিনটি পর্যায়ে যথা-

১) বর্তমান বস্তু (এখানে কোন সংকট উপস্থাপিত হয়েছে শাস্তা বা পথপ্রদর্শকের কাছে।)
২) অতীত বস্তু (এখানে সংকট মীমাংসার জন্য অতীতের দৃষ্টান্ত প্রদান করেন শাস্তা।)
৩) সমাধান (অতীত বাস্তবতার আলোকে বর্তমানের টীকাভাষ্য রচনা করে দিকনির্দেশনা দেন শাস্তা।)

কথা না বাড়িয়ে আমরা শাস্ত্রে চলে যাই, প্রথমে আলোচনা করবো বৌদ্ধশাস্ত্রের ৫৩৬ নম্বর জাতক যার নাম কুণাল জাতক। এই জাতকের প্রধান চরিত্র হল কুণাল যার মুখ নিঃসৃত বানী থেকে আমরা নারীদের সম্পর্কে জানতে পারি । কুণাল বলেন নারী কখনই বিশ্বাসযোগ্য নয়, নারী স্বভাবতই বিশ্বাস ঘাতিনী। নারী কোন ভাবেই প্রশংসার যোগ্য নয়। পৃথিবী যেমন সকলের আধার তেমনি নারীও কামাচারে পাত্রাপাত্র বিচার করে না। কুণালের মুখে উচ্চারিত হয় নীতি গাথাঃ

“সদা রক্ত মাংস প্রিয়, কঠোর হৃদয়,
পঞ্চায়ুধ, ক্রূরমতি সিংহ দুরাশয়।
অতিলোভী, নিত্য প্রতিহিংসা পরায়ণ,
বধি অন্যে করে নিজ উদর পূরণ।
স্ত্রীজাতি তেমতি সর্বপাপের আবাস,
চরিত্রে তাহাদের কভু করো না বিশ্বাস।”

তারমানে আমরা বুঝলাম পুরুষের অবশ্যই কখনো নারীর চরিত্রে বিশ্বাস করা উচিত নয়। শুধু কি বিশ্বাস? কুণালের মতে, নারীকে বেশ্যা, কুলটা বললেই সব বলা হয় না, নারী প্রকৃত পক্ষে এর অধিক কিছু। নারীরা হল-

@ উন্মুক্ত মলভাণ্ডের মতো দুর্গন্ধ যুক্ত।
@ বিষমিশ্রিত মদিরার মতো অনিষ্টকারী।
@ কুটিলা সাপের মতো দুই জিহ্বা বিশিষ্ট।
@ পাতালের ন্যায় অতল গভীর।
@ রাক্ষসীর ন্যায় সন্তোষহীন।
@ অগ্নির ন্যায় সর্ব গ্রাসিনী।
@ নদীর ন্যায় সর্ব বাহিনী।
@ বায়ুর ন্যায় যথেচ্ছা গামিনী।
@ বিষবৃক্ষের ন্যায় বিষফল প্রসবিনী।

নারীরা কীভাবে মলের মতো দুর্গন্ধময় এ সম্পর্কে কুনাল বলেন,

“নারী হল উন্মুক্ত মলভাণ্ডের ন্যায়। উন্মুক্ত মলভাণ্ড দেখিলে মাছি সেখানে ঝাপ দিবেই তাকে রোহিত করা কষ্টকর। কিন্তু একজন জ্ঞানী মানুষ সব সময় এই মলভাণ্ডের দুর্গন্ধ উপলব্ধি করে তা এড়িয়ে চলে। তদ্রূপ নারীরুপ মলভাণ্ডে মাছিরূপ পুরুষ ঝাপ দিবেই কিন্তু একজন জ্ঞানী ভিক্ষু এই উন্মুক্ত মলভাণ্ডরূপ নারীদের দুর্গন্ধ উপলব্ধি করিয়া তাদের সদাই পরিত্যাগ করেন।”

খবরদার আবার আপনারা দাবী করবেন না যেন, বৌদ্ধধর্মে নারীকে মল বলা হয়েছে। আপনাদের বুঝতে হবে বৌদ্ধ ধর্মে বলা হয়েছে নারী মলের মতো। আল্লামা শফি যেমন তেতুলের মতো বলেছেন বলে অনেকে দাবী করেন তেতুল বলেছেন যা নাকি ঠিক নয়। আপসুস নারীরা তেঁতুলের মতো না মলের মতো এটা বিবেচনার দায়িত্ব নেয় আমাদের ধার্মিক পুরুষেরা আর এভাবে নারীকে বিভিন্ন বিশেষণে বিশেষায়িত করে। এখন দেখবো কুণাল তার নিতিগাথায় কি বলেন-

“চৌর, বিষদিগ্ধসুরা, বিকত্থি বণিক
কুটিল হরিণ শৃঙ্গ, দ্বিজিহ্বা সর্পিণী
প্রভেদ এদের সঙ্গে নেই রমণীর।
প্রতিচ্ছন্ন মলকুপ, দুষ্কর পাতাল
দুস্তোস্যা রাক্ষসী, যম সর্বসংহারক
প্রভেদ এদের সঙ্গে নাই রমণীর।
অগ্নি, নদী বায়ু, মেরু (পাত্রাপাত্রভেদ
জানে না যে) কিংবা বিষবৃক্ষ নিত্যফল
প্রভেদ এদের সঙ্গে নাই রমণীর।”

(চলবে)