[পর্ব-১]
[পর্ব-২]
[পর্ব-৩]
[পর্ব-৪]

ডিভোর্সের পর ফাইনম্যানের মনে হলো চার বছর কারাবাসের পর মুক্তি পেয়েছেন তিনি। আবার ব্যাচেলর লাইফের উদ্দাম স্বাধীনতা। ক্যাজুয়েল ডেটিং করছেন ইচ্ছেমত। ন্যুড ক্লাবে গিয়ে জটিল গাণিতিক সমীকরণের সমাধান করছেন। গ্রাভিটন আর পারটনের ধারনার গাণিতিক ভিত্তি তৈরি করা যায় কিনা দেখছেন। কোয়ান্টাম কম্পিউটারের সম্ভাবনা নিয়েও কাজ করেছেন এ সময়।

১৯৫৮ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের আমন্ত্রণে পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার বিষয়ক দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বক্তৃতা দিতে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় যান ফাইনম্যান।

রবিবারের রোদেলা বিকেলে বিচ টাওয়েল হাতে নিয়ে বেড়াচ্ছেন লেক জেনেভার বিচে। সংক্ষিপ্ত পোশাকে বিচের বালিতে শুয়ে অনেকেই রোদ-স্নান করছে। টু-পিস পোলকা ডট বিকিনি পরা অনেক মেয়েই শুয়ে আছে বালির ওপর এখানে সেখানে। আমেরিকায় এখনো এরকম বিকিনির চল হয়নি। হঠাৎ চোখ গেল নীল বিকিনি পরা এক তরুণীর দিকে।

পায়ে পায়ে তরুণীটির দিকে এগিয়ে গেলেন চল্লিশ বছর বয়সী ফাইনম্যান। কীভাবে কথা বলবেন বুঝতে পারছেন না। সুইস ভাষা তিনি জানেন না। কিন্তু এমন সুন্দরী একজন মেয়ের সাথে কথা না বলে চলে যাবেন এটা তো হতেই পারে না। মেয়েটির খুব কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন ফাইনম্যান। বিড় বিড় করে তাঁর নিজস্ব ইংরেজিতেই বললেন, “লেক জেনেভার পানি মনে হয় খুবই ঠান্ডা”
“হ্যাঁ, খুবই ঠান্ডা” – চমকে উঠলেন ফাইনম্যান। মেয়েটি কথা বলছে ইংরেজিতে।
“তুমি ইংরেজি জানো?”
“ইংরেজি আমার মাতৃভাষা। ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ারে জন্মেছি আমি।”
“হাই, আমি ফাইনম্যান, রিচার্ড ফাইনম্যান। আমেরিকান।”
“হাই, গোয়েনিথ হাওয়ার্থ”

ফাইনম্যান তো মহাখুশি। গোয়েনিথও খুশি অনেকদিন পর ইংরেজি বলার লোক পেয়ে। ফাইনম্যান দেরি না করে টাওয়াল বিছিয়ে সূর্যস্নানে শুয়ে পড়লেন গোয়েনিথের পাশে। পরিচিত হতে সময় লাগলো না।

ইয়র্কশায়ারের ছোট্ট একটা গ্রামের মেয়ে গোয়েনিথ। তাদের গ্রামে কখনোই উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটেনি। কোন রকমে স্কুলের গণ্ডি পার হয়ে লোকাল লাইব্রেরিতে লাইব্রেরিয়ান হবার চেষ্টা করছিল গোয়েনিথ। কিন্তু কিছুই ভাল লাগছিল না তার। তাই ১৯৫৮’র শুরুতে ওয়ান-ওয়ে টিকেট কেটে চলে এসেছে জেনেভায়। ওয়ান-ওয়ে টিকেট কাটার উদ্দেশ্য হলো এখানে কাজ করে উপার্জন করে সে টাকায় দেশ-ভ্রমণ করবে।

ইংল্যান্ড থেকে আসার সময় কোন চাকরি ঠিক করে আসেনি সে। লন্ডনের সুইস অ্যামবেসি থেকে দুটো এজেন্সির ঠিকানা নিয়ে এসেছিল। তাদের একটাতে যোগাযোগ করে সে জেনেভায় একটা চাকরি পেয়েছে। একটা ইংরেজ পরিবারে আয়ার কাজ। থাকা খাওয়া ছাড়া মাসে মাত্র পঁচিশ ডলার বেতন। দিনে প্রায় পনের ঘন্টা কাজ করতে হয় তাকে। সপ্তাহে সাড়ে ছয় দিন। সপ্তাহে একটা পুরো দিনও ছুটি নেই তার। বৃহস্পতিবার বিকেলে তিন ঘন্টা আর রবিবার বিকেলে তিন ঘন্টা ছুটি। সেরকম একটা রবিবারের বিকেলেই ফাইনম্যানের সাথে দেখা হয়েছে গোয়েনিথের।

ফাইনম্যান গোয়েনিথকে আমেরিকার সুযোগ সুবিধা সম্পর্কে বললেন। ক্যালিফোর্নিয়ার যেখানে তিনি থাকেন সেই জায়গা কত সুন্দর তা বললেন। এবং শেষে বললেন, “দেখো, তুমি এখানে যা করছো তা যদি আমার জন্য করো – মানে আমার বাড়ির দেখাশোনা। আমি তোমাকে এখানের দ্বিগুণ বেতন দিতে রাজি আছি।”
“আপনার বাড়ির গভর্নেস হতে বলছেন?”
“হ্যাঁ, আমার বাড়ির কাজ করার কেউ নেই। আমার স্ত্রীর সাথে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে দু’বছর আগে। আমি একা মানুষ তোমাকে সারাদিনে দু’ঘন্টাও কাজ করতে হবে না।”
“কিন্তু আমি তো আমেরিকা যাবার কথা ভাবছি না এখনো। আমার প্ল্যান হলো এখান থেকে অস্ট্রেলিয়া যাওয়া। সেখানে বছর দুয়েক থেকে ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়া।”
“এখান থেকে আমেরিকার দূরত্ব অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে কম। তুমি ভেবে দেখো। আমি আমেরিকায় ফিরেই তোমাকে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করছি।”

ফাইনম্যান গোয়েনিথকে একজন গভর্নেসের বেশি কিছুই ভাবেন নি শুরুতে। আমেরিকায় ফিরে এসে উকিলের সাথে যোগাযোগ করলেন গোয়েনিথের স্পন্সরশিপের ব্যাপারে। উকিল বললেন, “আপনি নিজে তাকে স্পন্সর করতে পারেন। কিন্তু আমি বলবো আর কাউকে দিয়ে করাতে।”
“কেন? আমি নিজে করলে অসুবিধে কী?”
“অসুবিধে এখন নেই। তবে ভবিষ্যতে হতে পারে। আপনার গভর্নেস যেহেতু আপনার বাড়িতে থাকবেন, সেহেতু কোনদিন যদি আপনাদের মধ্যে কোন যৌনসম্পর্ক হয় তবে আপনি বিপদে পড়তে পারেন। কারণ স্পন্সরশিপের শর্ত হলো স্পন্সরকে উন্নত চরিত্রের অধিকারী হতে হয়।”
ফাইনম্যান তাঁর বন্ধু ও সহকর্মী ম্যাথিউ স্যান্ডস্‌কে রাজি করালেন গোয়েনিথের স্পন্সর হওয়ার জন্য।

পরের বছর ১৯৫৯ সালে জেনেভা থেকে গোয়েনিথ চলে এলো ফাইনম্যানের বাড়িতে। মেরি লুইয়ের চাপে পড়ে বিরাট বাড়ি নিতে হয়েছিল ফাইনম্যানকে। সেই বিরাট বাড়িতেই থাকতে শুরু করলো গোয়েনিথ। দোতলায় একটা রুমে থাকে গোয়েনিথ, আর নিচের তলায় ফাইনম্যানের থাকা, স্টাডি সবকিছু।

শুরুতে ম্যাথিউ স্যান্ড্‌স ও তাঁর স্ত্রী ছাড়া ক্যালটেকের আর কেউ জানতে পারেনি যে ফাইনম্যান বাড়িতে একজন গভর্নেস রেখেছেন। কিন্তু যখন দেখা গেল ফাইনম্যান প্রতিদিন লাঞ্চ টাইমে বাড়ি চলে যাচ্ছেন – তখন কৌতূহলীদের চোখ এড়ানো গেলো না।

গোয়েনিথকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন ফাইনম্যান। তাই গোয়েনিথ স্থানীয় কিছু আমেরিকান ছেলের সাথে আউটিং-এও যায় মাঝে মাঝে। অচিরেই ক্যালটেকের মুখে মুখে ঘুরতে লাগলো ফাইনম্যান-গোয়েনিথ সংক্রান্ত মুখরোচক গল্প।

মেয়েদের সাথে যথেচ্ছ মেলামেশার কারণে ফাইনম্যানের সুনামের ক্ষতি হচ্ছে। আর মেলামেশার ব্যাপারেও মনে হচ্ছে ফাইনম্যান কোন বাছবিচার করছেন না। অনেক বিবাহিতা মহিলার সাথেও তার ঘনিষ্ঠ মেলামেশা। অনেকেই আবার এ সুযোগে ফাইনম্যানকে ব্ল্যাকমেল করতে শুরু করেছে। অনেক মহিলা ফাইনম্যানের সাথে মেশার পরে যখন তখন চার-পাঁচশ ডলার দাবি করে চিঠি লেখে। তাদের একজন ফাইনম্যানের বাড়ি থেকে আইনস্টাইন গোল্ড মেডেল নিয়ে চলে গেলো। ফাইনম্যান তাঁর আইনস্টাইন মেডেলকে নোবেল পুরষ্কারের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।

ফাইনম্যানের শুভাকাঙ্খীরা ফাইনম্যানকে বোঝাচ্ছেন – “দেখো, যারা তোমার মেধা ও যোগ্যতার ধারে কাছেও নেই তাদের সাথে তুমি শুধুমাত্র জৈবিক প্রয়োজনে মিশছো, এবং তারা তার সুযোগ নিচ্ছে। কে কী বলছে তাতে তোমার কিছু আসে যায় না বলেই তুমি দেখেও দেখতে পাচ্ছো না লোকে কী ভাবছে তোমাকে। আর তুমিও এসব করছো কারণ তুমি মনে করছো তুমি ব্যাচেলর, যা খুশি করতে পারো। মনে করে দেখো আরলিন যখন ছিলো কিংবা মেরি লিউ, তখন তো একদিনের জন্যও অন্য কারো কাছে যাওনি। তোমার বিয়ে করা উচিত ফাইনম্যান।”

একদিন ফাইনম্যানের হঠাৎ মনে হলো তাঁর সহকর্মী প্রফেসর মারি গেল-ম্যান তাঁর ইংরেজ স্ত্রী নিয়ে কত সুখে আছে। গোয়েনিথও তো ইংরেজ। গোয়েনিথ যেভাবে তাঁর দেখাশোনা করছে এবং তাঁর ঘর-বাড়ি গুছিয়ে রাখছে তাতে তো মনে হচ্ছে স্ত্রী হিসেবে বেশ ভালোই হবে সে। দেরি না করে কোনরকম ভনিতা না করেই ফাইনম্যান বিয়ের প্রস্তাব দিলেন গোয়েনিথকে।

চমকে উঠল গোয়েনিথ। ফাইনম্যান তার চেয়ে বয়সে ষোল বছরের বড়। তাছাড়া এ ব্যাপারটা নিয়ে সে ভাবেনি কখনো। সুতরাং তার সময় দরকার। কিন্তু ফাইনম্যান দেরি করতে রাজি নন। তিনি চাচ্ছেন পরের সপ্তাহেই বিয়েটা হয়ে যাক। গোয়েনিথ ফাইনম্যানকে বোঝালেন, “আমার মা-বাবাকে না জানিয়ে আমি কিছুই বলতে পারছি না।”

গোয়েনিথ তার মা-বাবাকে চিঠি লিখে সব জানালেন। তাঁদের কোন ধারণাই নেই কোথায় আমেরিকা, কোথায় ক্যালিফোর্নিয়া, আর ফাইনম্যানই বা কে, কেনই বা তিনি বিখ্যাত। তাঁরা খুশি কারণ তাঁদের মেয়ে অনেক বড় দেশে স্থায়ী ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে।

গোয়েনিথের মা-বাবার পক্ষে বিয়েতে আসা সম্ভব নয়। গোয়েনিথকে আশীর্বাদ জানিয়ে চিঠি লিখলেন তাঁরা। গোয়েনিথ তাঁর মা-বাবার সম্মানে বিয়েটা মা-বাবার ধর্ম মেথডিস্ট খ্রিস্টান মতে করতে চাইলেন। ফাইনম্যান ছোটবেলা থেকেই নাস্তিক। নিজে যা বিশ্বাস করেন না তা করেন না। তাঁর বাবার মৃত্যুর পর রাবাইরা যখন ফাইনম্যানকে বলেছিল হিব্রু ভাষায় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মন্ত্র বলতে – ফাইনম্যান জবাব দিয়েছিলেন, “আমি হিব্রু বুঝি না।” তখন রাবাইরা হিব্রু মন্ত্র ইংরেজিতে অনুবাদ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু ফাইনম্যান তাও উচ্চারণ করতে অস্বীকার করেছিলেন। বলেছিলেন, “আমি ওসব বিশ্বাস করি না।”

কিন্তু এখন গোয়েনিথ যখন বললেন বিয়ে হলে তা রেজিস্ট্রেশনের পাশাপাশি মেথডিস্ট খ্রিস্টান রীতিনীতি মেনে হতে হবে বিশ্বাসের কারণে নয়, গোয়েনিথের মা-বাবার প্রতি সম্মান দেখানোর জন্য, ফাইনম্যান রাজি হয়ে গেলেন। ফাইনম্যান ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার ডিভাইনিটি স্কুলের ডিন ওয়েসলি রবকে রাজি করালেন বিয়ের মন্ত্র পড়ানোর জন্য। ফাইনম্যানের বন্ধু ম্যাথিউ স্যান্ড্‌স, যিনি গোয়েনিথের স্পন্সর হয়েছিলে, গোয়েনিথকে মেথডিস্ট রীতি অনুযায়ী ফাইনম্যানের হাতে তুলে দিলেন। ১৯৬০ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর হান্টিংটন হোটেলে গোয়েনিথ ও রিচার্ড ফাইনম্যানের বিয়ে হলো।

গোয়েনিথ ও ফাইনম্যান

এরপর সারাজীবন গোয়েনিথের সাথে সুখেই কাটিয়েছেন রিচার্ড ফাইনম্যান। বিয়ের পর মারি গেল-ম্যানকে যখন ফাইনম্যান বললেন যে, “তোমার মত আমারও এখন ইংরেজ স্ত্রী আছে।”
মারি বলেছিলেন, “আমার কিন্তু একটা ইংরেজ কুকুরও আছে।”
ফাইনম্যান দ্রুত একটা কুকুর নিয়ে এলেন বাসায়। কুকুরটির নাম রাখা হলো ভেনাস।
বিয়ের পর ফাইনম্যান গোয়েনিথকে নিয়ে গোয়েনিথের মা-বাবার সাথে দেখা করে এলেন।

বিয়ের দু’বছর পর ১৯৬২ সালে ফাইনম্যান ও গোয়েনিথের প্রথম সন্তানের জন্ম হয়। পজিট্রনের আবিষ্কারক কার্ল এন্ডার্সন ছিলেন ফাইনম্যানের বন্ধু। ফাইনম্যান ছেলের নাম রাখলেন – কার্ল। ফাইনম্যান কার্লকে নিজের মত করেই বিজ্ঞানমনস্ক করে গড়ে তুলেছেন। যেমন তাঁকে গড়ে তুলেছিলেন তাঁর বাবা মিলভেল ফাইনম্যান। বড় হয়ে কার্ল নামকরা কম্পিউটার বিজ্ঞানী হন। ১৯৬৮ সালে ফাইনম্যান ও গোয়েনিথ একটা দুই মাস বয়সী মেয়েকে দত্তক নেন। তার নাম রাখেন মিশেল। মিশেল তাঁর বাবার মত বিজ্ঞানী হতে চান নি। তিনি একজন নামকরা ফটোগ্রাফার।

নোবেল পুরষ্কার পাবার পর সাংবাদিকদের সামনে ফাইনম্যান, কার্ল ও গোয়েনিথ

১৯৬৫ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেলেন রিচার্ড ফাইনম্যান। তারপরেও অনেক বিষয়ে নিরলস কাজ করে গেছেন রিচার্ড ফাইনম্যান।
ফাইনম্যানকে পদার্থবিজ্ঞানের জগতে সবাই চিনতেন সারা বিশ্বে। তবে আমেরিকার একেবারে সব মানুষের হিরো হয়ে গিয়েছিলেন জীবনের একেবারে শেষের দিকে এসে। ১৯৮৬ সালের ২৮ জানুয়ারি নাসার মহাকাশ যান ‘চ্যালেঞ্জার’ তার দশম যাত্রাকালে উৎক্ষেপণের এক মিনিট ১৩ সেকেন্ড পরেই সাতজন আরোহী সহ বিস্ফোরিত হয়। এই বিস্ফোরণের কারণ খুঁজে বের করার জন্য যে বৈজ্ঞানিক কমিশন হয় তাতে দায়িত্ব পালন করেন ফাইনম্যান। তদন্ত শেষে টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে বরফ-শীতল পানি ও রাবারের সাহায্যে খুবই সাধারণ একটা পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করে দিয়েছিলেন কীভাবে অতিরিক্ত ঠান্ডার কারণে শাটলের একটা যন্ত্রাংশের রাবার ঠিকমত সম্প্রসারিত না হয়ে দুর্ঘটনাটা ঘটেছে। টিভি ও অন্যান্য প্রচার মাধ্যমের বদৌলতে ফাইনম্যানের জীবন-কাহিনি আবার নতুন করে সামনে চলে আসে। ফাইনম্যান হয়ে পড়েন বহুল উচ্চারিত একটি নাম। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘শিওরলি ইউ আর জোকিং মিস্টার ফাইনম্যান’। প্রকাশের কয়েকদিনের মধ্যেই তা বেস্ট সেলার।

অনেক বছর থেকেই পাকস্থলীর ক্যান্সারে ভুগছিলেন ফাইনম্যান। দু’বার অস্ত্রোপচারের পরেও বেঁচেছিলেন বেশ কয়েক বছর। শেষ বার অস্ত্রোপচারের পর ১৯৮৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি রিচার্ড ফাইনম্যান মারা যান।

ফাইনম্যানের মৃত্যুর পর ফাইনম্যানের কাগজপত্রের সাথে একটা বাক্স পাওয়া যায়। সেখানে মুখ বন্ধ একটা খামে পাওয়া যায় একটা চিঠি। যেটা ফাইনম্যান লিখেছিলেন চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় আগে আরলিনের মৃত্যুর দু’বছর পরে। ভীষণ অযৌক্তিক জেনেও মৃত আরলিনকে লিখেছিলেন ফাইনম্যানঃ

“প্রিয় আরলিন, আমি তোমাকে ভালোবাসি প্রিয়তমা। আমি জানি এটা শুনতে তোমার কত ভাল লাগে। কিন্তু শুধু তুমি পছন্দ করো বলেই আমি তোমাকে লিখছি না। আমি তোমাকে লিখছি কারণ তোমাকে লিখলে আমার ভেতরটা জেগে ওঠে। কতদিন তোমাকে লিখিনি আমি। প্রায় দু’বছর হয়ে গেলো। আমি জানি তুমি আমাকে ক্ষমা করবে তোমাকে এতদিন না লেখার জন্য। কারণ তুমি তো আমাকে চেনো – কতটা জেদি আর বাস্তববাদী আমি।

মৃত্যুর পর তোমাকে লেখাটা অর্থহীন বলেই আমি লিখিনি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তোমাকে আমার লেখা দরকার। তোমার মৃত্যুর পর এতদিন আমি কী কী করেছি তোমার জানা দরকার। আমি তোমাকে বলতে চাই – আমি তোমাকে ভালবাসি, আমি তোমাকেই ভালবাসতে চাই, আমি সবসময় তোমাকেই ভালবাসবো।

আমি ঠিক বুঝতে পারছি না তোমার মৃত্যুর পরও তোমাকে এত ভালোবাসার কী মানে হয়? আমার বাস্তববাদী মনের তা বুঝতে খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আমি এখনো তোমার দেখাশোনা করতে চাই এবং চাই তুমিও আমার দেখাশোনা কর।

আমি তোমার সাথে আমার সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলতে চাই, আমাদের যৌথ প্রকল্পগুলো চালিয়ে নিতে চাই। আগে যেভাবে আমরা একসাথে জামাকাপড় বানাতাম, চায়নিজ শিখতাম, মুভি প্রজেক্টর নিয়ে কাজ করতাম। এখন আমি ওসব কিছুই করতে পারি না। তুমি ছাড়া আমি ভীষণ একা। তুমি ছিলে আমার প্রেরণা-নারী।

তুমি যখন অসুস্থ ছিলে তখন তোমার মন খারাপ থাকতো আমাকে যা দিতে চাও তা দিতে না পেরে। তোমার চিন্তার কোন কারণ নেই। আমাকে তোমার কিছু দেয়ার দরকার নেই। আমি তোমাকে এত বেশি ভালবাসি যে তার বিনিময়ে কোন কিছু পাবার কথা আমার মনেই হয় না।

এখন তুমি নেই। আমি জানি তুমি আমাকে কোন দিনই আর কোন কিছু দিতে পারবে না। কিন্তু তবুও আমি তোমাকে এত ভালবাসি যে আমি আর কাউকে ভালবাসতে গেলেই তুমি এসে দাঁড়াও সামনে। আমিও চাই তুমি এভাবে এসে দাঁড়াও আমার সামনে। আমি বুঝতে পারছি মৃত আরলিন আমার কাছে জীবন্ত অনেকের চেয়েও জীবন্ত।

আমি জানি তুমি আমাকে বোকা ভাবছ এবং চাইছো আমি যেন আবার নতুন করে জীবন শুরু করি, ভালোবাসি। আমি জানি তুমি চাইছো না আর আমার সামনে আসতে।

তুমি আশ্চর্য হবে গত দু’বছরে তুমি ছাড়া আর কাউকে ভালবাসতে পারিনি আমি। আমি বুঝতে পারছি না এটা কীভাবে হলো। আমি অনেক মেয়ের সাথে মিশেছি। তাদের অনেকেই খুব চমৎকার। কিন্তু দু’দিন যেতেই মনে হয়েছে তোমার মত ওরা কেউই নয়।

আমি একা থাকতে চাই না। কিন্তু পারছি না। আমার কাছে তুমিই একমাত্র সত্যি, আর সবাই মিথ্যে।
আমার প্রিয়তমা স্ত্রী, আমি তোমাকে ভালবাসি। আমার স্ত্রীকে আমি ভালবাসি। আমার স্ত্রী মৃতা।
ইতি তোমার রিচ।

বিঃ দ্রঃ চিঠিটি পোস্ট করতে পারছি না বলে আমাকে মাফ করে দিও। কারণ আমি তোমার ঠিকানা জানি না।”

____________
তথ্যসূত্র:
1. Lawrence M. Krauss, Quantum Man: Richard Feynman’s Life in Science, W. W. Norton & Company, New York, 2011.
2. Jagdish Mehra, The Beat of a Different Drum the life and science of Richard Feynman, Clarendon Press, Oxford, 1994.
3. James Gleick, Genius the Life and Science of Richard Feynman, Pantheon Books, New York, 1992.
4. Christopher Sykes, No Ordinary Genius the illustrated Richard Feynman, W. W. Norton & Company, New York, 1994.
5. Richard P. Feynman, Surely you’re Joking Mr Fyenman! Adventures of a curious character, W. W. Norton & Company, New York, 1985.
6. Richard P. Feynman, What Do You Care What Other People Think? Further adventures of a curious character, W. W. Norton & Company, 2001.