ইংরেজিতে human শব্দটির অর্থ ডিকশনারিতে লেখা হয়েছে, মনুষ্য-সম্বন্ধীয়, মানবীয়, মানবজাতি সম্পর্কিত। আমি যদি বলি, I am a human being . বা We are human being. তবে কি ব্যাকরণগত দিক থেকে তা শুদ্ধ হবে? প্রচলিত অর্থে হবে। কিন্তু কেন? আমি কি একজন man বা পুরুষ? না তো! তবে আমি human হবো কেন? পৃথিবীর সমস্ত মানুষ কি man? কোনও woman কি নেই পৃথিবীতে? সমস্ত মানুষকে man কেন বলা হবে? তবে কি আমি ও জগতের তামাম স্ত্রীজাতি huwoman? এই শব্দটি কি কোনও পুরুষ মেনে নেবেন? এর চেয়ে huperson শব্দটি লিঙ্গ-নিরপেক্ষভাবে নর-নারী সবার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতে পারে না কি? Human being অর্থ লেখা হয়েছে, মনুষ্যজাতি। শুধু পুরুষদের নিয়েই কি পৃথিবীর মনুষ্যজাতি? নারীজাতি মনুষ্যের পর্যায়েও কি পড়ে না? নাকি এই পুরুষবাচক শব্দটির আওতায় তামাম নারীজাতিকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে?

এ রকম আরও শব্দ রয়েছে, humanism, humanist, humanitarianism, mankind, humankind, humanity ইত্যাদি। এই ধরণী কি একেবারেই নারীশূন্য হয়ে গেল? ইংরেজিতে বলা হয়,Man is mortal. Womanকুল কি তবে immortal? Humanity শব্দের অর্থ বাংলায় বলা হয় মানবতা। মানব শব্দটিও কিন্তু লিঙ্গনিরপেক্ষ নয়। মনুষ্যত্ববাদ থেকে মানবীকুল কি বাদ? বাংলায় এ রকম অনেক শব্দ রয়েছে যেমন, মনবপ্রীতি, মানব-সমাজ, মানবধর্ম, মানবজীবন ইত্যাদি। সবগুলোই একচেটিয়াভাবে পুরুষবাচক শব্দ। নারী বা লিঙ্গনিরপেক্ষতার কোনও গন্ধও নেই।

কোনও প্রিয় মানুষের অপরিপক্ক আচরণকে আমরা আদুরে ভাষায় ‘ছেলেমানুষি’ বলে থাকি। সেটা নর কিংবা নারী উভয়ের ক্ষেত্রেই। যেমন, প্রীতি যদি অপরিপক্ক আচরণ করে আমরা বলি, প্রীতিটা বড্ড ছেলেমানুষ। তেমনি কবীরের অপরিপক্ক আচরণের জন্য আমরা কেন বলি না, কবীর একটা মেয়েমানুষ! মেয়েমানুষকে যদি ছেলেমানুষ বলা যায় তবে ছেলেমানুষকে কেন মেয়েমানুষ বলা যাবে না?
বাংলা ব্যাকরণে ‘পুরুষ’ বলে একটা ব্যাপার আছে। উত্তমপুরুষ, মধ্যমপুরুষ, নামপুরুষ। যেমন আমি লিপিকে বলছি, লিপি, রিনা একটি চমৎকার মেয়ে। এখানে ব্যাকরণ অনুযায়ী আমি উত্তমপুরুষ, লিপি মধ্যমপুরুষ, রিনা নামপুরুষ! আমরা তিনজনই নারী হয়েও ব্যাকরণের ভাষায় পুরুষ! কী ভয়াবহ হাস্যকর পুরুষতান্ত্রিকতা! আমি উত্তমনারী, লিপি মধ্যমনারী, রিনা নামনারী। এটাই ত সত্যি। অথবা উত্তমব্যক্তি, মধ্যমব্যক্তি, নামব্যক্তি যদি হতো তাহলে তা লিঙ্গনিরপেক্ষ হতো না কি?

নারীদের জ্ঞান-বুদ্ধিকে হিংসাবশত স্ত্রীবুদ্ধি বলে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে থাকেন পুরুষগণ। আমরা জানি যে, যুদ্ধ-বিগ্রহ সহ জগতের সমূহ ধ্বংসাত্মক ব্যাপারগুলি পুরুষের বুদ্ধিতেই ঘটে থাকে। কিন্তু তাকে স্বামীবুদ্ধি বা পুরুষবুদ্ধি কেন বলা হয় না?

ছোটবেলায় স্কুলজীবনে রাত জেগে মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় লিখেছি ছাত্রজীবন রচনা। ছাত্রজীবন উৎকৃষ্ট জীবন, জীবন গড়ার জীবন। একবার তো উৎকৃষ্ট লিখতে গিয়ে হতক্রিস্ট লিখে ফেলেছিলাম। হতক্রিস্টভাবে মারও খেয়েছিলাম অবশ্য সেজন্য। ছাত্রী হয়েও আমাকে ছাত্রজীবন রচনা মুখস্থ করতে হয়েছে, পরীক্ষার খাতায় ছাত্রজীবনে গুণগান করতে হয়েছে। ছাত্রীজীবন নামে কোনো রচনা বা কোনো শব্দ জীবনে চোখে পড়ে নি। ছাত্রীদের কি জীবন নেই? নাকি ছাত্রীজীবন উৎকৃষ্ট বা হতক্রিস্ট নয়? ছাত্র শব্দটি যেহেতু লিঙ্গনিরপেক্ষ নয়, ছাত্রীদেরকেও কেন এই পুরুষবাচক শব্দের আওতাধীন ভেবে নেওয়া হয়? ছাত্রজীবন না হয়ে শব্দটি শিক্ষাজীবন বা শিক্ষার্থীজীবন হতে পারে কি?

বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের সরকার প্রধান ও বিরোধীদলীয় প্রধান দুজনই নারী। এটা আমাদের জন্য অতি গর্বের বিষয়। বর্তমান সরকার প্রধান শেখ হাসিনাকে বলা হয় রাষ্ট্রনায়ক, খালেদা জিয়াকে বলা হয় বিরোধীদলীয় নেতা। নায়ক ও নেতা দুটিই খাঁটি পুরুষবাচক শব্দ। শেখ হাসিনা যদি রাষ্ট্রনায়ক হন তবে শাবানা, ববিতা, কবরী প্রমুখ এঁরাও তো নায়ক। চিত্রনায়ক। চিত্রনায়ক শাবানা, চিত্রনায়ক ববিতা, চিত্রনায়ক কবরী। পুরুষ দলপ্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধান বা অভিনেতাদেরকে এই যুক্তিতে নায়িকা বলা যায় না কি? যেমন, রাষ্ট্রনায়িকা জিয়াউর রহমান, রাষ্ট্রনায়িকা এরশাদ, নায়িকা আলমগীর, নায়িকা রাজ্জাক, নায়িকা জাফর ইকবাল! রোকেয়া লিখেছিলেন, আমাদিগকে সকল দিক হইতেই পুরুষের সমকক্ষতা অর্জন করিতে হইবে। এ জন্যই কি আমাদের বিপুল ক্ষমতার আধার নারীরাও পুরুষবাচক শব্দে নিজেদের পদ ও পরিচয় দিতে আনন্দিত ও গর্বিত বোধ করেন?

আজকাল নারীদেরকে সভাপতি, সমাজপতি, দলপতি ইত্যাদি পতি হতে দেখা যায়। কোনো নারী কী করে কারুর পতি হয়? কোনো পুরুষ কি কখনও হবে কারুর পত্নী? পুরুষকুল নারীনেতৃত্ব মেনে নিয়েছে। এটা ভাল লক্ষণ। কিন্তু কোনো পুরুষ কি সভাপত্নী, রাষ্ট্রপত্নী, রাষ্ট্রনায়িকা, নায়িকা, দলনেত্রী ইত্যাদি নারীবাচক শব্দগুলি সজ্ঞানে গ্রহণ করবে বা নিজের পরিচয় দেবে এই সকল শব্দে?

৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে সমবেত জনতা ও দেশবাসীর উদ্দেশ্যে মুজিব কয়েকবার বলেছিলেন, ভায়েরা আমার, ভাইরা আমার। সেই সমাবেশে অনেক নারীও উপস্থিত ছিলেন। পুরো বাঙালি জাতিতে ত ছিলেনই। মুজিব একবারও বোনেরা আমার বা ভাই ও বোনেরা বলেন নি। কেন?

রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, মরিতে চাহি না আমি এই সুন্দর ভুবনে/ মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।
মানব শব্দটিই যে পুরুষবাচক! রবি কি শুধু পুরুষের মাঝে বাঁচতে চেয়েছেন? নারী ও পুরুষ সমগ্র মনুষ্যজাতির মাঝে কি নয়?
চণ্ডীদাস লিখেছেন, সবার উপরে মানুষ সত্য। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন, জগত জুড়িয়া এক জাতি আছে/ সেই জাতির নাম মানুষ জাতি। অন্যদিকে জীবনান্দ লিখেছেন, মানুষের –মানুষীর ভিড়/ তোমারে ডাকিয়া লয় দূরে বহু দূরে।
মানুষ শব্দটিও কি তবে পুরুষবাচক। হায়রে পুরুষের আধিপত্য, সর্বগ্রাসী হাসি উদ্রেককারী সাম্রাজ্যবাদ! সমাজ, সংসার, আইন-কানুন সবই দখল করেছিল তারা। ভাষাকে ছাড়বে কেন?

কোনো কট্টর পুরুষতান্ত্রিক, জুলুমবাদী মানসিকতার পুরুষেরাই এই সকল একচেটিয়া স্বৈরাচারী শব্দগুলি আবিষ্কার করেছিলেন। নারীকে সবকিছু থেকে বাদ দিয়েছিলেন তারা সেই বর্বর আমলে। আজ সকল মানুষের সম অধিকারের কথা বলা হচ্ছে, অনেক কাজও হচ্ছে সেই অনুযায়ী।আজকের পৃথিবীর বিদগ্ধ ভাষাবিদেরা এই সকল হাস্যকর পুরুষতান্ত্রিক শব্দের পরিবর্তে লিঙ্গনিরপেক্ষ শব্দ কেন সৃষ্টি করছেন না?
প্রাচীনকালে বৈয়াকরণগণ এই সকল পুরুষবাচক শব্দের মধ্যে নারীজাতিকে দয়া করে উহ্যভাবে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, নাকি নারীকে একেবারে পৃথিবীর প্রাণী প্রজাতি থেকে বাদই দিয়ে দিয়েছিলেন জানি না।

অনেকেই বলে থাকেন, এই শব্দগুলি কোনও ব্যাপার না। এগুলো কারুর কোনও ক্ষতি ত করছে না। সবাই সমান অধিকার ভোগ করতে পারলেই হলো। আমি বলি, না। মানুষের জীবনে ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। সেই ভাষার কাছে নারী কেন হেয়, অকিঞ্চিৎকর কিংবা উহ্য হয়ে থাকবে?