সার-সংক্ষেপ: বন্ধু গো, আজি তোমায়, বড়ো বেশী প্রয়োজন…

মাসে মাত্র হাজার ২০ টাকার যোগান দেওয়া গেলেই প্রাণ্তিক শিশুদের আলোর ইস্কুলটি দাঁড়িয়ে যায়। ব্যক্তি প্রতিষ্ঠার মোহ ছিন্ন করে রুবেলরা অনেক কষ্টে চালাচ্ছেন বিদ্যালয়টি। আশাপাশের আর ১০টা মধ্যবিত্তের বিদ্যালয়ের চেয়ে ‘স্কুল ড্রেস ও টিফিন বিহীন’ বস্তির ছেলেমেয়েদের বিদ্যানিকেতনটির ফলাফলও ভালো।

“‘আমি প্রত্যেকদিন সকালে ঠোঙ্গা বানাই। ভাই-ভাবীদের বাসার কাজে সাহায্য করি। তারপর স্কুলে আইসা লেখাপড়া শিখি। আমাদের স্কুলটা এত্তো ভাল যে বাসায় মন টেকে না।’ নিজের বিদ্যালয় সম্পর্কে এমনই অভিব্যক্তি জানায় অষ্টম শ্রেণীতে পড়ুয়া রেশমা বেগম। সে থাকে রাজধানীর পল্লবীর কালাপানি স্কুল ক্যাম্প নামক বস্তিতে। তার সহপাঠি আনিকা আক্তারও একই ক্যাম্পের বাসিন্দা। সে বলে, ‘আমি সকালে কারচুপির (জামা-কাপড়ের ওপর চুমকির নকশা) কাজে বাড়িতে সাহায্য করি। তারপর লেখাপড়া করতে স্কুলে আসি। আমি আরো পড়তে চাই।’ সপ্তম শ্রেণীর শরীফুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিদিন ভোরে আমি বাসা-বাড়িতে পেপার বিলি করি। এরপর গোসল সাইরা নাস্তা খাইয়া স্কুলে আসি। হকারির কাজ খুব মজার। অনেক পত্রিকা পড়া যায়। আর স্কুলে লেখাপড়ার মতো আনন্দ কোনও কাজে পাই না।’ তার বাবা পেশায় রাজমিস্ত্রী। সেও স্থানীয় এক বস্তির বাসিন্দা।”

এই হচ্ছে অদম্য মেধাবীদের অফুরন্ত ভালবাসার পাঠশালা।

এখন আমরা কি পারি না, ভোগ-বিলাসের বাজেট কিছুটা কাট-ছাঁট করে, হাতে হাতে বিদ্যালয়টিকে একটি মজবুত পরিকাঠামো দিতে? বন্ধুজন, আসুন, হাত বাড়িয়ে দিন…

বিস্তারিত:ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মৃত্তিকা বিজ্ঞানে পড়ার সময়ই আবুল হাসান রুবেলের স্বপ্ন ছিল সমাজের জন্য কিছু করার। বিশেষ করে একেবারে অবহেলিত, বঞ্চিত ছিন্ন-মূল শিশুদের জন্য। ছাত্রাবস্থাতেই তারা কয়েক বন্ধু মিলে চেষ্টা করেছেন ক্যাম্পাসে চকলেট বা ফুল বিক্রি করতে আসা অভাবী শিশুদের লেখাপড়া শেখানোর। সেই থেকে রুবেলদের যাত্রা শুরু।

২০০২ সালে বিশ্ববিদ্যালয় শেষে তিনি শিক্ষক হিসেবে যুক্ত হলেন বাংলা মটরের ‘সুলতান-ছফা পাঠশালা’ নামক ছিন্নমূল শিশুদের স্কুলে। প্রয়াত চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের জীবদ্দশাতেই এটি কথা সাহিত্যিক আহমদ ছফা নীলেেত ‘শিল্পী সুলতান পাঠাশালা’ নামে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এটি কিছুদিন বন্ধ থাকার পর আজিজ সুপার মার্কেটের দোতালায় চলে। পরে ছফার মৃত্যুর পরে তার অনুরাগীরা সেই স্কুলটিকেই ‘সুলতান-ছফা পাঠশালা’য় রূপ দেন। কাজ করতে গিয়ে রুবেল দেখলেন দাতা গোষ্ঠির পরিচালিত স্কুলটিতে তার মতের মিল হচ্ছে না। কারণ এনজিও’র ছককাটা ঘরের ভেতরেই স্কুলটিকে চালাতে হয়।


শেষ পর্যন্ত সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন রুবেল। তবে সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের জন্য একটি স্কুল চালানোর বাসনা তার ভেতরে রয়েই গেল। এই নিয়ে চললো সমমনা বন্ধু-বান্ধব, শুভাকাঙ্খিদের সঙ্গে আলাপ-চারিতা। একে একে তার সঙ্গে যোগ দিলেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা আরো কয়েক বন্ধু। এদেরই একজন রণজিত মজুমদার। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০০৩ সালে ফোকলর থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন। তাদেরই আরেক বন্ধু কাজী মুনতাসির বিল্লাহ ওসমানী মেডিকেল কলেজ থেকে ২০০৪-০৫ সালে পাস করেছেন। কিন্তু তারা কেউই ব্যক্তি প্রতিষ্ঠার পথে নামি-দামী চাকরীর পেছনে ছুটলেন না। সকলে মিলে চাঁদা তুলে ২০০৬ সালে পল্লবীর মুসলিম বাজার এলাকায় ছোট একটি ভাড়া বাড়িতে চালু করেন স্বেচ্ছাশ্রমের নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় — ‘আমাদের পাঠশালা’। নিজেরাই ছোটাছুটি করে আশে-পাশের বস্তি থেকে শিশুদের নিয়ে আসেন ১০ টাকা- ১৫ টাকা বেতনের স্কুলটিতে।

এই লেখকের সঙ্গে আলাপচারিতায় আলোর স্কুলটির সূচনা পর্বটি প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক আবুল হাসান রুবেল এভাবেই তুলে ধরেন। পরে কথা হয় কয়েক ক্ষুদে পড়ুয়ার সঙ্গে।

‘আমি প্রত্যেকদিন সকালে ঠোঙ্গা বানাই। ভাই-ভাবীদের বাসার কাজে সাহায্য করি। তারপর স্কুলে আইসা লেখাপড়া শিখি। আমাদের স্কুলটা এত্তো ভাল যে বাসায় মন টেকে না।’ নিজের বিদ্যালয় সম্পর্কে এমনই অভিব্যক্তি জানায় অষ্টম শ্রেণীতে পড়ুয়া রেশমা বেগম। সে থাকে রাজধানীর পল্লবীর কালাপানি স্কুল ক্যাম্প নামক বস্তিতে। তার সহপাঠি আনিকা আক্তারও একই ক্যাম্পের বাসিন্দা। সে বলে, ‘আমি সকালে কারচুপির (জামা-কাপড়ের ওপর চুমকির নকশা) কাজে বাড়িতে সাহায্য করি। তারপর লেখাপড়া করতে স্কুলে আসি। আমি আরো পড়তে চাই।’ সপ্তম শ্রেণীর শরীফুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিদিন ভোরে আমি বাসা-বাড়িতে পেপার বিলি করি। এরপর গোসল সাইরা নাস্তা খাইয়া স্কুলে আসি। হকারির কাজ খুব মজার। অনেক পত্রিকা পড়া যায়। আর স্কুলে লেখাপড়ার মতো আনন্দ কোনও কাজে পাই না।’ তার বাবা পেশায় রাজমিস্ত্রী। সেও স্থানীয় এক বস্তির বাসিন্দা।

বলা ভালো, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের এই ব্যতিক্রমী বিদ্যালয়টি সাফল্যের সঙ্গে গত তিন বছর ধরে স্থানীয় অন্যসব প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ের চেয়েও ভাল ফলাফল করছে। মধ্যবিত্ত অভিভাবকরা এখন ভাল ফলাফল দেখে ‘স্কুল-ড্রেস ও টিফিন বিহীন’ এই বিদ্যালয়েই ছেলেমেয়েদের ভর্তি করতে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।

রুবেল বলেন, বঞ্চিত শিশুদের জন্য মানসম্মত মানবিক শিক্ষাই আমাদের লক্ষ্য। এই ব্রত নিয়ে আমরা পড়াই বলে আর দশটি সাধারণ স্কুলের চেয়ে আমাদের স্কুলের পাঠদান পদ্ধতি ও পরিবেশ আলাদা। ছাত্র-শিক সর্ম্পক এখানে বন্ধু সুলভ। ‘আনন্দময় পাঠ পরিবেশ’ গড়ে তোলায় আমরা দেই বিশেষ গুরুত্ব। আমরা পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার ধারণাই পাল্টে দিতে চাই।

তার কাছ থেকেই জানা যায়, বন্ধু-বান্ধব ও শুভানুধ্যায়ীদের ব্যক্তিগত অনুদানে চলে প্রতিষ্ঠানের খরচ। ১৮০ জন শিক্ষার্থীর সকলেই আশেপাশের উত্তর সিরামিক বস্তি (কালসী), বেগুনটিলা বস্তি ও কালাপানি স্কুল ক্যাম্প বস্তির বাসিন্দা। তাদের বাবা-মা কেউ রিকশা চালান, কেউ গার্মেন্টে কাজ করেন, আবার কেউ হয়তো তরি-তরকারি বিক্রেতা। এখন শিশু থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীর বেতন মাত্র ২০ টাকা। তৃতীয় থেকে আষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বেতন নেওয়া হয় ২৫ টাকা। ১১ জন নিয়মিত শিক্ষক-শিক্ষিকার বেতন দেওয়া হয় সাড়ে ছয় হাজার থেকে আট হাজার টাকা মাত্র। এছাড়া খণ্ডকালীন শিক্ষক রয়েছেন তিনজন। ছোট্ট স্কুল বাড়িটির ভাড়া গুনতে হয় মাসে ১২ হাজার টাকা। দুই শিফটে পাঁচটি শ্রেণী কে কাস চলে সেখানে।

ক্লাসের ফাঁকে স্কুলের ছোট্ট আঙিনায় তৃতীয় শ্রেণীর কয়েক শিক্ষার্থীর সঙ্গে ক্যারাম খেলছিলেন সহকারি প্রধান শিক্ষক রণজিৎ মজুমদার। তিনি এই লেখককে বলেন, আমাদের স্কুলে ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের বইপত্র শিশু শ্রেণীতে পড়ানো হয়। আর প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদানে আমরা অনুসরণ করি সরকারি শিক্ষাক্রম। এটি নিবন্ধিত বিদ্যালয় নয় বলে এলাকার একটি সরকারি বিদ্যালয়ের মাধ্যমে আমরা সরকারি পাঠ্য-পুস্তক সংগ্রহ করি। এরকম একটি বিদ্যালয় থেকে গত তিন বছরে আমাদের শিক্ষার্থীরা সাফল্যের সঙ্গে পঞ্চম শ্রেণীতে পাস করে পেয়েছে ‘প্রাইমারি স্কুল সার্টিফিকেট’ (পিএসসি)। ২০১০ সালে প্রথমবার পিএসসিতে ১৫ জন অংশ নিয়ে ১৩ জন পাস করেছে। পরের বছর ২০১১ সালে ১৩ জনের মধ্যে ১১ জনই পেয়েছে ‘এ’, আর দুজন পেয়েছে ‘এ-মাইনাস’। আর গত বছর ১৫ জনের মধ্যে দুজন ‘এ প্লাস’ ও ১১ জন ‘এ’ পেয়েছে। এ বছর আমাদের শিক্ষার্থীরা জোর প্রস্তুতি নিচ্ছে অষ্টম শ্রেণীর জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষায় বসার জন্য।

রণজিৎ আরো বলেন, ফলাফল ভাল হচ্ছে বলে মধ্যবিত্ত ঘরের অভিভাবকরা ক্রমেই আমাদের স্কুলের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। যেসব ছেলেমেয়ে অন্যান্য স্কুলে ভাল করছে না, অভিভাবকেরা তাদের পড়তে পাঠাচ্ছেন আমাদের স্কুলেই। এছাড়া প্রাইভেট টিউশনি বা কোচিং-এর ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও প্রায়ই এলাকার স্বচ্ছল অভিভাবকরা বাসায় গিয়ে ছেলেমেয়েদের পড়ানোর অনুরোধ জানান। …বস্তির শিশুদের বাসায় যেহেতু পড়ার পরিবেশ তেমন নেই, তাই স্কুলের পড়াটিই যেন যথেষ্ট হয়, সেভাবেই আমরা তাদের পড়াই। চিত্ত বিকাশের জন্য প্রতি শুক্রবার স্কুলে ছবি আঁকা, গান ও নাচ শেখার কাস চলে। এছাড়া আমরা নিয়মিত খেলাধূলা, বার্ষিক প্রতিযোগিতা, নববর্ষ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারি ইত্যাদি উৎযাপন করি। স্কুলের দুটি গাছ — আমতলা ও নিমতলায় শিার্থীদের সাধারণ জ্ঞানের প্রতিযোগিতাও হয়। এসব প্রতিযোগিতায় নম্বর দেওয়া দলবদ্ধভাবে।

‘আমাদের পাঠশালা’র একপাশে দেখা যায়, প্রয়াত কথা-সাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের নামে রয়েছে একটি ছোট্ট পাঠাগার। সেখানেই বেঞ্চ পেতে চতুর্থ শ্রেণীর কাস নিচ্ছিলেন ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে ২০০৯-১০ সালে বিবিএ পাস করা শিক শায়লা আফরিন। প্রতিষ্ঠিত কোনও চাকরিতে না গিয়ে নামমাত্র বেতনে এই স্কুলে পড়াচ্ছেন কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে এই লেখকে তিনি বলেন, এটি নিজের আত্ন-সন্তুষ্টির বিষয়। সমাজের প্রতি দায় তো থেকেই যায়। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের লেখাপড়া শেখাচ্ছি, এটিই একটি বড় পাওনা।

রুবেলের কাছ থেকেই জানা যায়, ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে পরিচালিত স্কুলটিতে নানা আর্থিক সংকট লেগেই আছে। প্রতি মাসে প্রায় ২০ হাজার টাকা ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। তবে এর পরেও সব সংকট কাটিয়ে তাদের ল্য নিজস্ব একটি স্কুল ভবন। সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টায় এ ল্যও তারা সফল করে তুলতে চান।

সংযুক্ত:

HOW TO DONATE
Abul Hasan Rubel (Initiator & Headmaster)
Account number: 139.101.13444
Swift Code: DBBLBDDH
Dutch Bangla Bank
Imamgonj Branch
Dhaka
Bangladesh

‘আমাদের পাঠশালা’র ওয়েব।