মানুষের যৌনতাকে যেদিন থেকে ধর্মীয় পবিত্রতা আরোপের মাধ্যমে, কপট বিবেকীয় ঔচিত্যবোধের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করার মাধ্যমে এবং সামাজিক শৃঙ্খলা ও নৈতিকতার প্রথাগত ধারণায় গণ্ডিবদ্ধ করার মাধ্যমে অবরুদ্ধ করা হল, ধর্মীয় উপকথা সৃষ্টি করে যৌনতাকে পাপাচার হিসেবে চিহ্নিত করা হল, সেদিন থেকেই সত্যিকার অর্থে যৌনতার ক্ষমতা মানব সমাজের একটি বিশেষ শ্রেণির কুক্ষিগত করার এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা হাতে নেয়া হল। ধীরে ধীরে শুরু হল সেই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন, যৌনতার প্রভু হয়ে উঠতে লাগলো সমাজের পুরুষ শ্রেণি, এবং নারী হয়ে উঠতে লাগলো পণ্য-কখনো সে কলা বা কখনো বা তেঁতুল, কখনো কন্যা জায়া জননী আবার কখনো নায়িকা বেশ্যা মডেল কন্যা। পুরুষকে পিতা-ভাই-পুত্র জ্ঞান করে সহানুভূতির নাকি কান্না কেঁদে বস্তুতপক্ষে তাদের দমনের প্রয়োজন হলো না, সেটা প্রয়োজন হল নারীর ক্ষেত্রে। নারীকে তথাকথিত মায়ের সম্মান দিয়ে সম্মানিত সিংহাসনে বসিয়ে তাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ শুরু হল, তাদের স্বাভাবিক মানবীয় সত্ত্বা থেকে আলাদা করে ফেলা হলো। তাদের মধ্যে সতীত্বের ধারনা সৃষ্টি করে দেয়া হল, এবং তাদের বোঝানো শুরু হল যে, তার প্রভু পুরুষটি ভিন্ন অন্য কোন পুরুষের সাথে তার যৌনাঙ্গটি ব্যবহার করা মহাবিশ্বের সর্বাধিক ঘৃণিত এবং আপত্তিকর পাপাচার, তাদের মত তথাকথিত সম্মানিতদের এই কর্মটি করা আরো অনেক বেশি আপত্তিকর। এই সম্মানিত আসন নারীর মর্যাদা একটুও বৃদ্ধ না করলেও, তাদের সামান্য ভুল ভ্রান্তি সমাজের চোখে অমার্জনীয় অপরাধ বলে গণ্য হতে লাগলো, যেহেতু সমাজ দাবী করে তারা নারীকে অনেক সম্মান দিয়েছে, তাই পান থেকে চুন খসলেই তাদের উপরে নেমে আসতে লাগলো শাস্তির খড়গ। এখনো ধর্ষিত নারীরা ন্যায় বিচার পাওয়া তো দুরের কথা, সমাজে মুখ দেখাবার ভয়ে আত্মহত্যাকে বেছে নেয়। যেন সতীত্ব ভিন্ন নারীর আর কোন সম্পদ নেই। একজন নারী যত বড় মেধাবী হোক, যত বড় তুখোড় ছাত্রী হোক, যত বড় বিজ্ঞানী বা দার্শনিক হোক বা হোক কবি ঔপন্যাসিক, তার সতীত্ব না থাকলে; অর্থাৎ, সে তার যৌনাঙ্গটিকে নিজ ইচ্ছামত ব্যবহার করলে বা অন্য কেউ জোরপূর্বকও তার যৌনাঙ্গটিকে ব্যবহার করলে সে হয়ে উঠবে সমাজের সবচাইতে ঘৃণিত মানুষ। মুক্তিযুদ্ধে বীরাঙ্গনাদের আসলে বীরাঙ্গনা খেতাব দিয়ে সমাজে চিহ্নিত করে দেয়া হয়েছে, সবাইকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে এই নারীরা ধর্ষিত হয়েছিল। এমনকি অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা নারীকেও, যারা অসীম সাহসের সাথে পুরুষের সমকক্ষ হয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছিল, তাদের অনেককেও বীরাঙ্গনা খেতাব দিয়ে বস্তুত পক্ষে বলে দেয়া হলো যে, ধর্ষিত হওয়া ছাড়া আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে নারীর আর কোন অবদানই ছিল না! আমাদের মুক্তিযোদ্ধা নারীরাও হয়ে উঠলো যৌনতার প্রতীকে, আমাদের ধর্ষিতা নারীরাও হয়ে উঠতে লাগলো আরো বেশি ধর্ষিত। সমাজের হাতে, রাষ্ট্রের হাতে, এমনকি সমস্ত পুরুষের হাতে। তারা যেহেতু আগে একবার ধর্ষিত হয়েছেই, তাই তাদের আবারো ধর্ষণ করতে কারো যেন কোন বাধা নেই!
এইভাবে যৌনতার ক্ষমতার পালাবদল হতে লাগলো, একসময় মাতৃতান্ত্রিক সমাজে যেভাবে নারী ক্ষমতার উৎস হয়ে উঠেছিল নারীর অসম্ভব শক্তিশালী যৌন ক্ষমতার দ্বারা অথবা প্রজনন ক্ষমতার দ্বারা, পুরুষ সেই ক্ষমতার দায়েই সৃষ্টি করলো ধর্মীয় উপকথা, তাকে বানাতে লাগলো অভিশপ্ত-কখনও পুরুষের একাকীত্বের সঙ্গী, মহাবিশ্ব সৃষ্টির উদ্দেশ্য নয়, পুরুষের জন্য একটি উপকরণ হিসেবে। আর সেই কারণেই যে নারীরা স্বাধীন ভাবে নিজের যৌনতা উপভোগ করে, নিদেনপক্ষে তার শরীর ব্যবহার করে অর্থনৈতিকভাবে পুরুষকে শোষণ করে, সেই নারী হয়ে উঠতে লাগলো ধর্মের শত্রু, সেই নারী হয়ে উঠতে লাগলো পুরুষতন্ত্রের শত্রু। এমনকি কবি সাহিত্যিক দার্শনিকরাও অবস্থান নিতে শুরু করলেন নারীর যৌনতার বিরুদ্ধে, নারীর যৌনতাকে কারারুদ্ধ করে পুরুষাঙ্গের জয়জয়কার সারা পৃথিবীতে ধ্বনিত হতে লাগলো। এমনকি আধুনিকতাবাদের মহাপুরুষরাও নারীকে যৌনযন্ত্র ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারলো না। যৌনতার একমাত্র দেবালয় পরিণত করা হল স্বামীস্ত্রীর শয়নকক্ষকে, স্বামীস্ত্রীর শয়নকক্ষ ছাড়া যৌনতার আলাপ হতে লাগলো পাপাচারের শামিল। কিন্তু পুরুষের প্রয়োজনেই টিকে রইলো বেশ্যালয়, বেশ্যালয় যেন পুরুষতন্ত্র, সমাজ, প্রথা আর ধর্মের লজ্জা হয়ে ঠিকই রয়ে গেল প্রতিটি সমাজে।
আমাদের বেশ্যালয় আমাদের সমাজের চোখে অত্যন্ত ঘৃণিত, ধর্মপুরুষেরা সারাদিন রাম আল্লা আর যীশুকে ডাকাডাকি করে মাঝরাত্রিরে ঠিকই হানা দেয়, নিদেনপক্ষে রাস্তার মোড়ে দেখা নারীকে ভেবে হস্তমৈথুন করে অথবা পত্রিকার রঙ্গিন অর্ধনগ্ন নায়িকা দেখে লালা ফেলে। লালাবিদ আল্লামারা তো প্রকাশ্যেই ঘোষনা দেন নারীকে দেখলে যেই পুরুষের লালা ঝড়ে না তারা নপুংশক! তাই বেশ্যালয় টিকে থাকে, টিকে থাকবে। বেশ্যালয় সভ্যতার একটি আদিম পেশাকে বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মাথা উঁচু করে। সমাজের সম্ভ্রান্ত পুরুষেরা বেশ্যালয়ে এসে কাতর ভঙ্গিতে নগ্ন হতে থাকে, গন্ধ শোঁকার জন্য, চুষে দেখার জন্য গাঁটের পয়সা খরচ করে, তাতে তাদের সতীত্ব বিন্দুমাত্র নষ্ট হয় না। আসলে পুরুষের সতীত্ব বলেই কিছু নেই, তাই বুঝি বেশ্যাদের সতীত্ব নিয়ে তারা সবসময়ই খুব পেরেশান থাকে। আর পেরেশান থাকে বুঝি বেশ্যাপল্লী উচ্ছেদ করতে।

কয়েকদিন আগে মাদারীপুরের একটি যৌনপল্লীতে সেদিন হামলা চালিয়েছে “এসলাহে কওম পরিষদ” নামে একটি ধর্মভিত্তিক সংগঠন! সংগঠনের ধর্মপুরুষেরা সেসময়ে যৌনপল্লীর বেশিরভাগ ঘর ভাঙচুর করে, আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। শুধু তাই নয়, তারা এসময়ে যৌনকর্মীদের মারধোরও করে, ৩০ জনার বেশি যৌনকর্মী আহত হয়। হাইকোর্টের পরিষ্কার নিষেধাজ্ঞা থাকার পরেও পুলিশের উপস্থিতিতে আদালতের আদেশ উপেক্ষা করে ধর্মরক্ষকেরা এই হামলা চালায়। এই ঘটনা যে এবারই প্রথম ঘটলো তা নয়, প্রায় প্রতিমাসেই আমাদের সমাজরক্ষকরা সমাজ রক্ষার নামে যৌনপল্লীতে আক্রমণ চালায়, তাদের উচ্ছেদ করে রাস্তায় নিয়ে আসে।

সাধারণত এই ধরণের ঘটনায় যা হয়ে থাকে, আমাদের রাজনৈতিক নেতা এবং বুদ্ধিবেশ্যা সুশীল সমাজ খুব করুন মুখ করে ধর্মপুরুষদের একটু বকে দেন, বলেন যে “পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে যৌনকর্মীদের উচ্ছেদ করা মোটেও উচিত হয় নি”; সেই সাথে সরকার এবং অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থাগুলো কিছু সাহায্য করে, যেই টাকা তাদের কাছে পৌছুতে পৌছুতে নানা স্তরে স্তরে ভাগ বাটোয়ারায় একবেলা ভাতের টাকাও থাকে না। তারাও শেষমেশ এই মতামত ব্যক্ত করেন যে, এই যৌনকর্মীদের পুনর্বাসন ছাড়া তাদের উচ্ছেদ করাটা একদম ঠিক হয়নি, কিন্তু করেই যখন ফেলেছে তখন তো আর কিছু করার নেই! একে তো আবার গড়ে উঠতে দেয়া যায় না। তাই পুনর্বাসনই একমাত্র পথ! যেন যৌনকর্মীদের পুনর্বাসন ভিন্ন আর কোন গতি নেই!

কিন্তু যৌনকর্মীদের পুনর্বাসন বলতে আসলে কী বোঝায়? আমাদের ধর্মপুরুষেরা যৌনপল্লী উচ্ছেদ, তাদের মারধোর, আগুন জ্বালিয়ে দেয়া ইত্যাদি করে আসলে কী করতে চায়? বেশ্যারা কেন টিকে থাকে? মাঝরাতে তাদের দরজায় কারা কড়া নাড়ে? যৌনপল্লী উচ্ছেদে ধর্মপুরুষের পুরুষত্ব কেন সদা সর্বদা উত্তেজিত থাকে?

সত্যি কথা হচ্ছে, যৌনপল্লীতে আমাদের সৎ চরিত্র ধর্মপুরুষদের প্রবেশ করতে গ্যাঁটের টাকা খরচ করতে হয়, সেই সাথে সামাজিক মানসম্মানও থাকে না। তার চাইতে যৌনকর্মীদের পুনর্বাসনই তাদের জন্য উত্তম, নানাদিক থেকেই। এতে লাভ প্রচুর! সমাজের ধর্মরক্ষকেরা এক একজন ২/৩ জন করে যৌনকর্মী পুনর্বাসনের নামে নিজের কেনা যৌনদাসী করে ঘরে তুলতে পারলে তো সোনায় সোহাগা। তাকে আর পুনর্বাসিত যৌনকর্মীটির সাথে যৌনকর্মের জন্য টাকাও দিতে হবে না, তাদের সামাজিক নাম দেয়া হবে স্ত্রী, কিন্তু তাদের বাস্তবিক অবস্থা সেই যৌনদাসীটিই থেকে যাবে! চাহিবা মাত্র যেখানে তথাকথিত স্ত্রী নামক যৌনদাসীটির কাছ থেকে যৌন আনন্দ পাওয়া যাচ্ছে, সেই সাথে যৌনকর্মীদের পুনর্বাসনের নামে তার সামাজিক মানমর্যাদাও বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেখানে কে আর পয়সা খরচ করে বেশ্যালয়ে যায়? তেঁতুল খাবার লোভে সর্বক্ষণ লালা ঝরানো ধর্মপুরুষ মাত্রই চান বিনামূল্যের যৌনদাসী, তা সেটি স্ত্রী নামেই হোক কী দাসী নামে। এই কাজের জন্য তাকে নগদ টাকা দিতে হচ্ছে, তার উপরে যৌনকর্মীটির মেজাজ মর্জির উপরেও নির্ভর করতে হচ্ছে, এই অবস্থা আমাদের প্রথা-ধর্ম-সমাজ-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য রক্ষক সাধু পুরুষেরা কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না। তাই মাদারীপুরে যৌনপল্লী উচ্ছেদ করা হয়, তাই পুলিশ-প্রশাসন-রাজনৈতিক দল থেকেও তাদের সাহায্য দেয়া হয়। আর সুশীল বুদ্ধিজীবীরা পুনর্বাসন পুনর্বাসন বলে চেঁচাতে থাকেন, তাতে যৌনকর্মীদের কী লাভ হয় জানি না, তবে সেই অঞ্চলের লম্পট পুরুষদের প্রচুর লাভ হয়-তা অস্বীকার করার উপায় নেই।

অর্থাৎ যৌনকর্মীদের তথাকথিত পুনর্বাসন সত্যিকার অর্থে তাদের বিনামূল্যের যৌনদাসী বানাতে পারে, আর কিছুই না। আমাদের গৃহবধূদের প্রতিটি রাতেই স্বামীর দ্বারা ধর্ষিত হতে হয়, তারা না চাইলেও তাদের শরীরে গ্রহণ করতে হয় স্বামীর পুরুষাঙ্গকে। এখানে তার মতামত, তার ইচ্ছা অনিচ্ছা কোন গুরুত্ব বহন করে না। এমনকি আমাদের দেশে স্বামী কর্তৃক স্ত্রী ধর্ষিত হচ্ছে, এই ঘটনাকে কোনদিন গুরুত্বই দেয়া হয় না, যেন স্বামী হওয়া মানেই স্ত্রীর ইচ্ছা অনিচ্ছার বালাই না থাকা, যখন খুশি তখন তাকে ধর্ষণের অধিকার অর্জন করে একজন স্বামী। বেশ্যারা স্বাধীন, অন্তত আমাদের গৃহবধূ নামক সামাজিক যৌনদাসী তারা নয় যে চাহিবা মাত্র স্বামীকে দেহ দান করিতে বাধ্য থাকিবে। অথচ দু’মুঠো ভাতের জন্য তার এই প্রতিটি রাতের ধর্ষিত হওয়া সমাজের চোখে সম্মানিত, অথচ সেই গৃহবধূটিই স্বামীর মুখে লাথি মেরে বেশ্যালয়ে চলে আসলে, নিজের উপার্জিত অর্থে-নিজের ইচ্ছামত পুরুষকে দেহদান করতে চাইলে সে হয়ে যায় চরম ঘৃণিত, সমাজের চোখে বমন উদ্গীরণের সমতুল্য সত্ত্বা। বার্টান্ড রাসেল তার Marriage and Morals বইতে বলেছেন, “Marriage is for woman the commonest mode of livelihood, and the total amount of undesired sex endured by women is probably greater in marriage than in prostitution.”

নাহ, বেশ্যাবৃত্তির পক্ষে বলছি না, বেশ্যাদের পক্ষে বলছি। করুনা বা দয়া বা সহানুভূতির ছদ্মবেশে গোপন ঘৃণা নয়- তাদের মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার অধিকারের পক্ষে বলছি। বেশ্যালয়ে একজন বেশ্যার বেশ্যাবৃত্তির দায় তার উপরে বর্তায় না, সে সমাজের সৃষ্টি, সমাজে নারীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ্যালয় সৃষ্টি করে, আর কেউ নয়। বেশ্যালয়ে আগমন একজন বেশ্যার ইচ্ছায় ঘটেছে নাকি অনিচ্ছায়, সেই আলোচনা গৌণ। এখানে একজন নারী গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সেই সমাজ-প্রথা-ধর্ম-রাষ্ট্র ব্যবস্থা। সে স্বেচ্ছায় এই পেশায় যুক্ত নাকি তাকে জোর করা হয়েছে, সেটার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ ভাবনা হচ্ছে, বেশ্যারা তুলনামূলকভাবে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী, তারা ভাতের জন্য পুরুষের মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজের উপার্জিত পয়সায় আহার করে। আমাদের সমাজে এখনও লক্ষ লক্ষ নারীকে সামান্য ভাতের জন্য প্রতিটা দিন নির্যাতিত হতে হয়, অত্যাচার সহ্য করতে হয়। অন্তত বেশ্যারা কারো দয়ায় জীবন যাপন করছে না, এরপরেও তারাই সমাজে সবচাইতে ঘৃণিত, অসম্মানিত। সমাজের কালো অন্ধকার, পুরুষের সীমাহীন লাম্পট্য তারা নিজ শরীরে গ্রহণ করে সমাজকে সুরক্ষিত রাখে, সমাজকে পরিশুদ্ধ রাখে। এরপরেও প্রতিদিন প্রতিটা মাসে অসংখ্য বেশ্যাকে আমাদের সমাজে অপদস্থ হতে হয়, নানাভাবে ধর্ষিত হতে হয়, যেন তাদের ধর্ষণে কোন অপরাধ নেই, যেহেতু তাদের তথাকথিত সতীত্ব নেই।

যৌনপল্লী উচ্ছেদ, বেশ্যাদের সামাজিক সম্মান দেয়ার নামে বিনামূল্যের যৌনদাসীতে পরিণত করার এই সংস্কৃতি আজকের নয়, সবযুগেই পুরুষেরা নারীকে দমন করতে চেয়েছে, নিজের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে চেয়েছে। যৌনকর্মীদের ঘৃণা করে বা তাদের প্রতি লোক দেখানো দরদ দেখিয়ে আহা উহু করে কোন লাভ হবে না, বরঞ্চ তাতে তাদের ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি। ধর্মপুরুষেরা যদি এতই ধর্মপ্রবণ হয়ে থাকেন, ধর্মবোধ বা মানসম্মান বোধ যদি তাদের এতটাই তীব্র হয়ে থাকে, তবে তারা যৌনপল্লীতে না গেলেই পারেন! পুরুষ মানুষ যৌনপল্লীতে না গেলে সেই যৌনপল্লী এমনিতেই উচ্ছেদ হয়ে যাবে, চাহিদা না থাকলে যৌনকর্মীরা এমনিতেই অন্য পেশা বেছে নেবে, এই সহজ সমীকরণটি কেন নির্বোধ চরিত্রবান লোকগুলোর মাথায় ঢোকে না আমি জানি না!

বেশ্যালয় কেন থাকে? বেশ্যালয় কীভাবে সৃষ্টি হয়? এমা গোল্ডম্যান তার ফেমিনিজমে বলেছেন, “Nowhere is woman treated according to the merit of her work, but rather as a sex. It is therefore almost inevitable that she should pay for her right to exist, to keep a position in whatever line, with sex favors. Thus it is merely a question of degree whether she sells herself to one man, in or out of marriage, or to many men!… The economic and social inferiority of woman is responsible for prostitution.”

তাই ধর্ম-সমাজ-প্রথা রক্ষার নামে বেশ্যালয় উচ্ছেদ চাই না, সেই সাথে পুনর্বাসনের নামে যৌনকর্মীদের বিনামূল্যের যৌনকর্মীতে পরিণত করার অশুভ চক্রান্তও ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করি। আমাদের শরীরে রক্ত প্রবাহের জন্য ধমনী এবং শিরা উভয়ের প্রয়োজন হয়, বিশুদ্ধ রক্ত প্রবাহ এবং খারাপ রক্ত প্রবাহ, যেকোন একটির প্রবাহ বাধাগ্রস্থ হলেই সেই শরীর ক্ষতিগ্রস্থ হবে। আমাদের সমাজও তেমনি। যারা জোরপূর্বক নারীদের যৌনপেশায় আসতে বাধ্য করে, তারা সকলেই সমাজের সুবিধাভোগী শ্রেণি। তাদের উচ্ছেদের আগে নির্যাতিত নারীদেরই উচ্ছেদের চেষ্টা বস্তুতপক্ষে ধর্ষিতা নারীকেই পাথর ছুড়ে হত্যা করার মত ঘৃণ্য। যেদিন আমাদের প্রতিটি যৌনপল্লী খালি হয়ে যাবে, বেশ্যাদের আর কোন চাহিদা থাকবে না, সেদিন অবশ্যই আমরা আনন্দিত হবো, সেটা হবে আমাদের মুক্ত ও আদর্শ সমাজ। কিন্তু সেটা কোনমতেই কোন চাপ বা আক্রমণ বা নির্যাতনের মাধ্যমে নয়। সেটা হতে হবে স্বাভাবিকভাবে, চাহিদা না থাকলে যোগান এমনিতেই থাকবে না। যদি উচ্ছেদ করতেই হয়, তাহলে রাজনৈতিক বেশ্যাদের উচ্ছেদ করুন, অর্থনৈতিক বেশ্যাদের উচ্ছেদ করুন, ধর্মবেশ্যাদের উচ্ছেদ করুন, বুদ্ধিবেশ্যাদের উচ্ছেদ করুন। যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ভাতের যোগার করে, তাদের যেই সমাজ ভাত দিতে পারে না, তাদের যেই রাষ্ট্র ভাত দিতে পারে না, তাদের যেই ধর্ম ভাত দিতে পারে না, তাদের ভাত কেড়ে নেয়ার অধিকারও সেই সমাজের, সেই রাষ্ট্রের, সেই ধর্মের থাকতে পারে না।

যীশু খ্রিষ্ট একজন বেশ্যাকে একবার বলেছিলেন, Her Sins are forgiven because she loved much. তার কোন পাপ নেই, তার কোন শাস্তিরও প্রয়োজন নেই। তাদের অধিকারসমূহ দেয়ার আগ পর্যন্ত, নারীর অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত যৌনপল্লীগুলো দাঁড়িয়ে থাকুক আমাদের সভ্যতার লজ্জা হয়ে। আমরা যেন যৌনপল্লীগুলোর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি, আমাদের সমাজ আসলে কেমন, আমাদের সমাজে একজন নারীর টিকে থাকা-বেঁচে থাকা কতটা কঠিন!