আজ রক্ত ঝরানো ২১ আগষ্ট
আকাশ মালিক

আজ ২১ আগষ্ট। বাংলাদেশের ইতিহাসে সে দিনটি আর অন্যান্য দিনের মত সাধারণ দিন নয়, এক বিভীষিকাময় কলংকিত দিন। সে দিনের গ্রেনেড হামলা, দানবীয় সন্ত্রাস,নারকীয় জঘন্যতম হত্যাজজ্ঞ অবলোকন করে সারা পৃথিবীর বিবেক স্তব্ধ বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। বিশ্ব রাজনীতিবৃন্দ এই বীভৎস হত্যাকান্ডের হোতা ঘাতকদের প্রতি ঘৃণা ধিক্ষার জানালেন। কিন্তু নামের কিছু হিংস্র জানোয়ার, কিছু অমানুষ এই ভয়াল দৃশ্য উপভোগ করলো প্রেক্ষাগৃহে ছবি দেখার মত নীরব দর্শক হয়ে। তারা আর কেউ নয়, বি এন পি নামের এ দেশেরই একটি রাজনৈতিক দল, আর এ দেশেই জন্ম নেয়া কুলাঙ্গার কিছু বেজন্মা দেশের স্বাধীনতার শত্রু কিছু ইসলামী সংগঠন। কোনো দেশের কোনো রাজনৈতিক দল তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিরোধী দলকে খুন করে হত্যা করে সমূলে উৎখাত করে দিতে বার বার পরিকল্পিতভাবে হত্যাজজ্ঞ চালিয়েছে এমন প্রমাণ পৃথিবীর ইতিহাসে কয়টি আছে আমার জানার নেই।

ঘাতকেরা শুধু প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকেই নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিল ভাবলে ভুল হবে, তারা একটি আদর্শ একটি চেতনাকে ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল। এর আগে তারা সেই চেষ্টাই করেছিল স্বাধীনতার স্তপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে। ডঃ অজয় রায় সেই হত্যাকান্ডের উদ্দেশ্য বর্ণনায় লিখেন-

‘অনেকে বিষয়টির গভীরে না গিয়ে বলে থাকেন শেখ মুজিব ও তাঁর সরকারকে উৎখাত করা হয়েছে অপশাসন ও দুর্নীতির কারণে কিন্তু তা ঠিক নয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয় তাঁর আদর্শের জন্য, যে আদর্শ বাঙালী জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষ এবং উদারনৈতিক গণতন্ত্রকে তুলে ধরেছে। অন্যদিকে তাঁর হত্যাকারীদের উদ্দেশ্য ছিল এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে পুরানো পাকিস্তানী ধ্যানধারণায় প্রবর্তন এবং বাংলাদেশকে একটি ধর্মতাত্ত্বিক স্টেটে রূপান্তরিত করা এবং সেক্যুলার বাঙালী জাতীয়তাবাদের স্থলে ‘মুসলিম বাংলা’ নামের আদর্শভিত্তিক ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রবর্তন। স্বঘোষিত হত্যাকারীদের একজন হত্যা ষড়যন্ত্রের মূল নায়ক কর্ণেল ফারুক একটি সাক্ষাৎকারে স্পষ্টভাবেই বলেছিলেন- “শেখ মুজিবকে অবশ্যই মৃত্যুবরণ করতে হত। কারণ ঐ ব্যক্তিটি তার ধর্ম ইসলামের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে — যে বিশ্বাস আমাদের জনগণের ধর্ম…।” হত্যাকাণ্ডের আর একজন নায়ক মেজর রশীদের ভাষ্যমতে ‘১৯৭৪’ এর গ্রীষ্মকালে ফারুক ও রশীদ মুজিবকে উৎখাতের ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা শুরু করে — যার উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশকে ধর্মভিত্তিক ‘ইসলামিক রিপাবলিক রাষ্ট্রে পরিণত করা।’

সে দিন ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পরিকল্পনায় সমর্থন দিয়েছিলেন বি এন পি’র প্রতিষ্ঠাতা মেজর জিয়াউর রহমান, আর ২০০৪ সালের ২১ আগষ্টের নারকীয় হত্যাজজ্ঞের পরিকল্পনা করা হয়েছিল তারই পুত্র তারেক জিয়ার হাওয়া ভবনে বসে। আওয়ামী লীগকে দুনিয়া থেকে বিলীন করে দিতে বিএনপি পরামর্শ করলো একাত্তরের ঘাতক মুজাহিদ, ইসলামী জঙ্গী সংগঠনের খুনীদের সাথে। মুফতি হান্নান পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে কারা কারা এই হত্যাপরিকল্পনায় ছিলেন-

দীর্ঘ ৯ বৎসর যাবত ২১ আগষ্টের গ্রেনেড হামলায় আহত শতাধিক আওয়ামী লীগ কর্মী-সমর্থক শতশত বিষাক্ত স্প্লিন্টার দেহে বহন করে অসহ্য যন্ত্রনা নিয়ে দূর্বিষহ দিন কাটাচ্ছেন। অনেকেই জীবনের তরে পঙ্গু হয়ে গেছেন। তারা বলছেন যারা মরে গেছে তারাই বেঁচে গেছে, মৃত্যু বেদনা নিয়ে এ বাঁচার চেয়ে মরাটাই শ্রেয় ছিল। অথচ ঘাতকদের অনেকেই আজও মুক্ত স্বাধীন জীবন যাপন করছে।

প্রশ্ন উঠেছে আওয়ামী লীগ কেন ৫ বছরেও এদের ধরে এনে বিচার করতে পারলোনা। পঁচাত্তরে যেমন জিয়া সরকার ইনডেমনিটি বিল পাস করে ঘাতকদের বিচারের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিল ২০০৪ সালেও ক্ষমতাসীন বি এন পি-জামাত জোট সরকার বিচারের সকল পথ বন্ধ করার যাবতীয় বন্দোবস্ত করে রেখেছিল। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে বি এন পি-জামাত ও তাদের সমমনা ইসলামী দলগুলো জোট সরকারের ৫ বছরের সকল দুষ্কর্ম-অপকর্ম, হত্যাকান্ডের বিচার যাতে না হয় সেই লক্ষ্যে ক্ষমতাসীন বর্তমান আওয়ামী লীগের গোটা শাসনামল জুড়ে সরকারকে অস্থির করে তুলতে সচেষ্ট ছিল অব্যাহত হরতাল সন্ত্রাস, ধ্বংসের মাধ্যমে। যদিও জানি ঘাতকদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে আওয়ামী লীগ সরকার যতটুকু করেছে অন্য কেউ সেইটুকুও কোনদিন করতোনা তবু তা ভিক্টিমদের, সান্তনা দিতে পারবেনা। মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ-চেতনা বাঁচিয়ে রাখার লক্ষ্যে, অসাম্প্রদায়ীক বাংলাদেশ, সুষ্ট গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মানবতা বিরোধী এ হত্যাজজ্ঞের বিচার অবশ্যই হতে হবে। বছর ঘুরে আগষ্ট আসলেই মনটা আতংকিত হয়, বুকটা ভয়ে ধুরুধুরু করে, ১৫ আগষ্ট, ১৭ আগষ্ট, ২১ আগষ্ট দেখেছি, না জানি এই আগষ্টে কী হয়। এই দিনগুলোর ইতিহাস জানার ও আমাদের নতুন প্রজন্মকে জানানোর প্রয়োজন আছে, দেশের স্বার্থে, জাতির স্বার্থে মানবতার স্বার্থে।