বারুইপুরের আদালতে আজ ভিড়টা একটু বেশিই।

এরকম ছোট আদালতে এমন অসম্ভব ভিড় মোটেও মানানসই নয়। মামলাটাও এমন কোনো আলোচিত মামলা নয় যে অহেতুক ভিড় করতে হবে। আদালতের মতোই মামলাটাও ছোট। তবে মামলা ছোট হলেও বিবাদী ধনী লোক। কৌঁসুলি হিসাবে নিয়োগ দিয়েছেন সদ্য বিলাত ফেরত এক ব্যারিস্টারকে।

বারুইপুর কোলকাতার কাছে হলেও, সে সময়ে বিলাত ফেরত ব্যারিস্টার পথে ঘাটে দেখা যেতো না। বাঙালি ব্যারিস্টারতো ছিলই না বললেই চলে। তাই, বিলাত ফেরত ব্যারিস্টারকে ভিড় করে দেখার মানুষজনের এই লোভকে খুব একটা দোষ দেওয়া যায় না। তবে, আজকের এই ভিড় শুধু একজন বিলাত ফেরত ব্যারিস্টার দেখার কারণে নয়। এই বিলাত ফেরত ব্যারিস্টারটির নাম তারা তাঁর বিলাত যাবার আগে থেকে জানতো। বিলাতে যাবার আগে ব্যারিস্টারটি কয়েক বছর সাহিত্যচর্চা করে গেছেন। সে কারণে কেউ তাঁর কবিতা পড়েছে, কেউ কাব্যগ্রন্থ পড়েছে, কেউ বা রঙ্গ মঞ্চে তাঁর লেখা নাটক দেখেছে। কবি হিসাবে কিছুটা নামডাকও কামিয়ে ফেলেছেন তিনি এর মধ্যে। একজন আবেগপ্রবন কবি কীভাবে ব্যারিস্টারির মত আবেগশূন্য বৈষয়িক বিষয়কে সামাল দেন, সেটা দেখার কৌতুহলই মানুষজনের মধ্যে বেশি। এমন অদ্ভুত বৈপরিত্য সহজপ্রাপ্য নয়। সে কারণেই আদালত উপচে পড়ছে জনারণ্যে।

যথাসময়েই হাকিম সাহেব এজলাশে এলেন। অল্পবয়েসী একজন হাকিম। বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। কোট পান্টের বদলে চোগা-চাপকান পরে আছেন তিনি। একহারা চেহারা। গায়ে মাংস নেই বলে যতটুকু না লম্বা, তার চেয়ে বেশি লম্বা মনে হয়। মাথার মাঝখানে সিঁথি করা। হাকিম সাহেবের প্রশস্ত ললাট, খড়গের মত চাপা নাক। উপরের ঠোঁটটা নীচের ঠোঁটের চেয়ে বড়। নীচেরটা প্রায় দেখাই যায় না এমন। তারপরেও ঠোঁটের কোণায় একটা শুভ্র হাসির বিদ্যুৎ খেলা করে চলে। চোখ দুটো তীক্ষ্ণ উজ্জ্বল। এই উজ্জ্বল চোখ দেখলেই বোঝা যায় মানুষটা অসম্ভব রকমের বুদ্ধিমান একজন মানুষ।

জনতার মধ্যে যাঁরা একটু জ্ঞানী, একটু বেশি খোঁজখবর রাখেন, তাঁরা জানেন যে, হাকিম সাহেব ব্যারিস্টার সাহেবের মত অত কীর্তিমান না হলেও তাঁর ঝাঁঝও কম নয়। এর মধ্যেই খান দুয়েক উপন্যাস লিখে ফেলেছেন তিনি। জনতার এই জ্ঞানী অংশটা তুমুল লড়াই আর নাটক দেখার জন্য মনে মনে উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। কলোসিয়ামে বাঘ সিংহের লড়াই দেখে প্রাচীন রোমানরা যেমন উত্তেজিত হতো, অনেকটা সেরকম।

বিখ্যাত এবং সুদক্ষ অভিনেতা যেমন তুমুল আত্মপ্রত্যয় নিয়ে মঞ্চে প্রবেশ করেন, ব্যারিস্টার সাহেবও সেভাবেই এজলাশে হাজির হলেন। রাজকীয় ঢঙে, দাপুটে মেজাজে। পোশাক-আশাক, আচার আচরণে পুরোদস্তর সাহেবি তিনি। কেবল গায়ের রঙটিতেই বাঙালির শ্যামল কোমল ছাপ মাখানো। ব্যারিস্টার সাহেব হাকিম মশায়ের মত যুবক নন। মাঝবয়েসী, পৌঢ় তিনি। শরীরে পৌঢ়ত্বের স্থূলতা দেখা দিয়েছে। সিঁথি মাঝ বরাবর। মাথার চুল বিরল হতে শুরু করেছে। নাকটা মোটা, অধরগুলো পুরু। সারা চোখে মুখে ছটফটে চাপা উল্লাস তাঁর। মনের মধ্যে কী হচ্ছে তার পুরো ছাপ প্রকাশিত হয়ে যায় মুখের অভিব্যক্তিতে। কোনো কিছুই গোপন থাকে না সেখানে। চোখ দুটো সাগরের মতো উদার আর উজ্জ্বল। চারিপাশটা এক নজর বুলিয়েই তিনি বুঝে যান যে, এই রঙ্গ মঞ্চের প্রধান অভিনেতা তিনি। হাকিম জবরদস্ত হলেও তার সুতীব্র উজ্জ্বলতার কাছে ম্লান। প্রখর সূর্যের কাছে টিমটিমে মাটির প্রদীপ যেনো। এজলাশ, মামলা, হাকিম সবকিছু উপলক্ষ্য মাত্র, তিনিই একমাত্র লক্ষ্য, তিনিই প্রধান পুরষ। আকাশে একমাত্র নক্ষত্র তিনি, বাকি সবাই গ্রহ-উপগ্রহ, তাঁকে কেন্দ্র করে ঘূর্ণায়মান। হাজার হাজার জনতার হাত থেকে অশ্রুত করতালি তিনি শুনতে পান। তাঁর নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছে সমবেত সবাই।

হাকিম নিজেও টের পেয়েছেন যে, এই বিশালাকায় পর্বতের কাছে আজ তিনি ম্রিয়মান। সবার আগ্রহ এবং কৌতুহলের কেন্দ্র বিন্দু ব্যারিস্টার সাহেব। সমবেত সকলের মনোযোগ পাচ্ছেন বিলাত ফেরত ব্যারিস্টারটি। তিনি স্থির করলেন যে, মনোযোগ প্রত্যাশী আত্মম্ভরি এই ব্যারিস্টারকে আজ তিনি কোনো গুরুত্ব দেবেন না। পুরোপুরি উপেক্ষার নীতি নেবেন। এটাই হবে তাঁর শাস্তি। এই এজলাশে তিনিই প্রধান, আর সবাই গৌণ। ব্যারিস্টার সাহেবের বাইরে নাম যশ যাই থাকুক না কেনো, এখানে তাঁকে তাঁর অধীনতাই মেনে নিতে হবে। তীক্ষ্ণ উজ্জ্বল দুটো চোখ কাগজে নিবদ্ধ রাখলেন তিনি। সরাসরি তাকাচ্ছেন না ব্যারিস্টারের দিকে। অনুকম্পা মিশ্রিত তাচ্ছিল্যের সাথে ব্যারিস্টারের তর্ক শুনতে লাগলেন তিনি।

ব্যারিস্টার সাহেবের জন্য সব জায়গাই রঙ্গমঞ্চ। আর সেই মঞ্চের তিনিই সেরা অভিনেতা। শুধুমাত্র দর্শকেরাই নয়, সহ অভিনেতারাও তাঁর দক্ষ অভিনয়ের দর্শকমাত্র। এই ছোকড়া হাকিমও তাই। অহংকারী শার্দুলের মত তিনি গভীর আত্মবিশ্বাস আর আত্মপ্রত্যয় নিয়ে কেন্দ্রভূমি দখল করে ফেলেন। কৌঁসুলির কৌশল তাঁর কর্ম নয়, বরং নিজেকে মেলে ধরার মধ্যেই মূল আনন্দ লুকিয়ে রয়েছে। সে কারণে দুই চার কথার পরেই তাঁর মক্কেল চলে যায় পশ্চাদভূমিতে। তিনি নিজে চলে আসেন সম্মুখভাগে। দর্শক মনোরঞ্জনই এখন তাঁর একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান। আদালত কক্ষ জুড়ে রাজকীয় পদক্ষেপে হেঁটে বেড়ান তিনি। গমগমে মোটা স্বরে এক নাগাড়ে কথা বলে যেতে থাকেন। সেই বক্তব্যে কখনো থাকে ইংরেজি কাব্যের কোটেশন, কখনো থাকে ভারতচন্দ্রের প্রতি তীব্র ব্যঙ্গোক্তি, শ্লেষ। বক্তব্যের ফাঁকে ফাঁকে কখনো তাকান জনতার দিকে, কখনো তাকান হাকিমের দিকে, কখনো আত্মপ্রেমী নার্সিসাসের মতো নিজের অত্যুগ্র বিলাতি পোশাকের দিকে।

ব্যারিস্টারের মনোযোগ আকর্ষণের এই তীব্র নাটকীয় প্রচেষ্টা দেখে মনে মনে হাসেন হাকিম। পুরোটা সময় ধরে নির্লিপ্ত তাচ্ছিল্য তিনি ধরে রেখেছেন। আত্মপ্রেমী, উদ্ধত, অহংকারী, দুর্বিনীত ব্যারিস্টারকে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন যে হাজারো চেষ্টা করলেও তাঁর মনোযোগ তিনি পাবেন না। সন্তুষ্টির একটা আনন্দ খেলা করে যায় তাঁর মনের মধ্যে। অধর কোণে ফুটে উঠে চাপা কৌতুকের হাসি। বুঝতে পারছেন ব্যারিস্টার সাহেবের চোখ তাঁর দিকে, প্রাণপনে চেষ্টা চালাচ্ছেন তাঁর মনোযোগ পাবার।

হঠাৎ করেই ভুলক্রমে কাগজ থেকে চোখ উঠে যায় তাঁর। ব্যারিস্টারের সাথে চোখাচোখি হয়। এতক্ষণের সংকল্প ভুলে, আদালত ভুলে, জনতা ভুলে, স্থানকালপাত্র ভুলে দুজনে দুজনের চোখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। সময় যেনো থেমে গেছে কোথাও, ইতিহাসের চাকাও বোধ হয় সেই সাথে। কোলাহলমূখর জনতাও আশ্চর্যজনকভাবে স্তব্ধ। ইতিহাসের এক বিরল ঘটনার সাক্ষী তারা আজ।

তীক্ষ্ণ উজ্জ্বল বুদ্ধিদীপ্ত একজোড়া চোখ মিলে গেছে সাগরের মত উদার আত্মপ্রত্যয়ী আবেগী চোখের সাথে, কাব্যের সাথে গদ্যের সম্মিলন ঘটেছে যেনো।

বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বাংলা ভাষার প্রথম আধুনিক কবি এবং সর্বকালের সেরা কাব্য প্রতিভা মাইকেল মধুসূদন দত্তের চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকেন অনন্তকাল।

কালের যাত্রা রূদ্ধ হয়ে যায় ঠিক সেই মুহূর্তটায়।

 

তথ্যসূত্রঃ মাইকেল মধুসূদন – জীবন-ভাষ্য – প্রমথনাথ বিশী