এখন আমার বেলা নাহি আর / বহিব একাকী বিরহেরও ভার

ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসগরের মাতৃ ভক্তিতে আপ্লুত বাঙালি মন ও হৃদয়। ছোটবেলায় পাঠ্যপুস্তকে গল্প পড়েছি, কার চিঠি? মায়ের চিঠি। মা লিখিয়াছেন ছোট ভাইয়ের বিবাহ বাড়ি যাইতে হইবে। আর ছুটি না মিলাতে ছেলে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে উত্তাল দামোদর নদী সাঁতরে পার হয়ে গভীর রাতে মায়ের কাছে পৌঁছেছিলেন। মা তখনও জেগে ছিলেন। কারণ মা জানতেন তার ছেলে আসবে।

মায়েরা আজও জেগে আছে। থাকে। তবে ছেলেরা সমুদ্র পাড়ি দিতে উড়ে না। অথবা যানজট, যানবাহন ও যাতায়াতের সমস্যার কথা বিবেচনা করে ঈদ বা পূজায় ঢাকা থেকেই নিজ জেলায় যায় না।কিংবা যেতে পারে না।

ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যা সাগরের কাহিনীতে ছেলের মাতৃ ভক্তিই ফুটিয়ে তোলার যে মহান উদ্দেশ্য তা পুরাপুরি সার্থক। মাতৃ ভক্তি মুখ্য। মায়েদের জেগে থাকা গৌণ। বায়েজিত বোস্তামীর মায়ের জন্য গভীর রাতে জল সংগ্রহও মাতৃ ভক্তির আরেক উদাহরণ। এ সব গল্পসমূহ মায়েদের প্রত্যাশা বাড়িয়ে দিয়েছে। আর ছেলেদের দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ কি বেড়েছে? হয়তো বাড়েনি বা কমেনি। ঠিকই আছে। স্থিতাবস্থায়ই আছে। তবে মায়ের প্রতি আবেগ মনে হয় ঘাটতি হচ্ছে। অথবা আজকাল বাস্তব কারণে, জীবনের পরিবর্তিত সংজ্ঞা, জীবিকার বৈচিত্র্যধর্মী ধরণ, ছেলেদের চেতনাগত অবস্থান মায়েদের প্রত্যাশা থেকে অযুত নিযুত মাইল দূরে। বস্তুগত কিছু সুবিধাদি দিয়ে মায়েদের দূরে রেখে দেয়।

মায়েরা সারাক্ষণ জেগে থাকলেও ছেলে ফি্রে আসে মায়ের চেতনা যখন লোপ পায় তখন। অথবা লাশ রেখে দেয়া হয় তথাকথিত শেষ দেখা দেখানোর জন্য। এ দেখায় মায়ের মনের জন্য কোন প্রভাব নেই। তবে ছেলের সামাজিক অবস্থানে প্রভাব আছে। মাকে শেষবারের মত দেখার জন্য বা মায়ের লাশের শেষকৃত্যে ছেলে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বা দেশে থাকলে মাইক্রো ভাড়া করে উপস্থিত হয়েছে।

ছেলের মনেও নিজের সামাজিক অবস্থানকে জানান দেওয়ার কোন পরোক্ষ উদ্দেশ্য থাকে? এত কষ্ট (?)করে, অনেক ডলার বা পাউন্ড খরচ(?)করে, ছুটি নষ্ট(?) করে মায়ের বা বাবার শেষ সময়ে বা শেষ কৃত্যে উপস্থিত। এটা হয়তো মহান দায়িত্বের পর্যায়ে পড়ে বলে এ প্রজন্মের ধারণা।
মেয়েদের নিয়ে এমন আবেগীয় গল্প নেই। মা ও মেয়ের সম্পর্ক যত গভীর ও ব্যাপক উপলব্ধির প্রদেশে অবস্থান করক না কেন তা, রূপকথার আখ্যানে রূপান্তরিত হয় না। মা বাবার প্রতি মেয়ের দায়িত্ব সামাজিক জীবনে কোন লোকশ্রুতির সৃষ্টি করে না।দায়িত্বই নেই আবার লোকশ্রুতি! যেজন্য মেয়েকে সৎপাত্রে পাত্রস্ত করা মা বাবার দায়িত্ব। এর কোন শোধ বা সুদ নেই।ফিরতি প্রাপ্তির প্রত্যাশা নেই। ছেলের কাছে মা বাবার বিনিয়োগের শোধ ও সুদ আছে।

আমার ছেলের বউয়ের বন্ধুর মা। পার্কিনসন রোগে আক্রান্ত। ছেলে মেয়ে ইউ এস এ তে। একজন পড়া শেষ করে চাকরি করছে। আরেকজন পড়ছে। মধ্যবিত্ত মায়ের আকাংঙ্ক্ষা, স্বপ্ন পুরণে ব্যাপৃত। উনি চান না তারা আসুক। মায়ের জন্য তাদের কাজকর্মে কোন রকম ব্যাঘাত ঘটুক। নিজের শারিরীক ও মানসিক যন্ত্রণা ছেলে মেয়ের কাছে লুকিয়ে রাখেন। ছেলেমেয়েও মায়ের লুকানো যন্ত্রণার কথা জেনেও না জানার ভান করে।

জীবনের প্রয়োজনে সন্তানদের প্রবাসজীবন বা মা বাবা থেকে আলাদা থাকে এখন নৈমিত্তিক বিষয়। এ নিয়ে কিছু লেখার মত বিলাসিতা না করাই উত্তম বা বুদ্ধিমানের কাজ। তবুও এত বেশি ঘটনার সাক্ষী যে কয়েক ফোঁটা চোখের জলের সাথে কলম দিয়ে কিছু কথা বের হয়ে গেল।

অবশ্য দেশে থাকা ছেলেমেয়ের দ্বারাই বা শতেক ভাগের কত ভাগ প্রত্যাশা পূরণ হয়!

এক ভদ্রলোক। কোন এক সময়ে একটি বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করতেন। নামটি ইচ্ছে করেই ব্যবহার করলাম না। উনার সাথে আমার সরাসরি কোন পরিচয় নেই। প্রায় বিশ বছর আগে আমার হাজব্যান্ডের মাধ্যমে কোন একদিন পরিচয় হয়েছিল। আমার মোবাইলে ফোন করলেন এপ্রিলের এক হরতালের দিনে। আমি একটি অফিসিয়েল মেইল করছিলাম বাসায় বসে।উনি ভুমিকাসহ পরিচয় দেওয়াতে মনে পড়ল। ইউনেস্কোর নম্বর চাইলেন। জানালাম, চট্টগ্রামে ইউনেস্কোর কোন অফিস নেই।উনি ঢাকার নম্বর চাইলেন এবং জানালেন এক সময়ে ইউনেস্কোর সাথে অনেক কাজ করেছেন। এখনও কাজ করতে চান। আমার অফিসে কোন সুযোগ আছে কি না। আমি সবিনয়ে আমার অফিসের সীমাবদ্ধতার কথা জানালাম এবং ঢাকা ইউনেস্কো অফিসের নম্বর জানাব বলে ফোন রাখতে চাইলাম।
উনি উনার বাসার লেন নম্বর লিখতে বললেন।

বলমাম, আপনার এ মোবাইল নম্বরে জানাব।

না, না, ল্যান্ড লাইনের নম্বরটা লিখে নিন। ওখানে ফোন দেবেন।

জানালেন, উনি উনার ছেলের বাসায় আছেন। আমি যেন অবশ্যই অবশ্যই উনাকে ল্যান্ড লাইনে ইউনেস্কোর নম্বরটি দেই।
বুড়ো মানুষ। অগত্যা উনার ছেলের বাসার ল্যান্ড লাইনের নম্বর লিখে নিলাম। সাথে সাথে আমি আমার হাজব্যান্ডকে ফোন দিলাম। বুড়ো মানুষের কাজটি মনে থাকতে থাকতে করে ফেলাই ভাল। ভুলে গেলে অনেক পরে যোগাযোগ করতেও অস্বস্তি লাগবে। সামান্য কাজটি করতে বেশি সময় নেওয়ার জন্য লজ্জা পাব।
হাজব্যান্ডকে বললাম, অমুকে ফোন করেছিল ঢাকা ইউনেস্কোর নম্বর জানা থাকলে তুমি জানিয়ে দাও বা আমাকে দিলে আমিও জানিয়ে দিতে পারব।
আমার হাজব্যান্ড বললেন যে উনিতো আজকেই ঢাকা ইউনেস্কো অফিসের নম্বর আমার কাছ থেকে জেনে নিলেন এবং কথা প্রসঙ্গে তোমার চট্টগ্রাম পোস্টিং এর কথা বললাম।

উনি আমার মোবাইল নম্বর কিভাবে পেলেন জানতে চাইনি। এটা আমার অফিসিয়েল মোবাইল। আমার ভিজিটিং কার্ডেও এ নম্বরটা আছে।এখন উনি আমার মোবাইল নম্বর পাবার উৎস বুঝলাম।
আমার হাজব্যান্ডও বললেন উনাকে ল্যান্ড লাইনেই ফোন করতে বলেছেন।

পরে উনার বাসায় ইউনেস্কোর নম্বর দেওয়ার জন্য ফোন করে কথা প্রসঙ্গে জানলাম, ছেলে মোবাইল কিনে দিয়েছ, যাতে বাবাকে উঠে গিয়ে ফোন রিসিভ করতে না হয় এবং মন চাইলে যে কোন সময় কারও সাথে যোগাযোগে অসুবিধা না হয়। তাছাড়া বাবা ফোন ধরলে অনেকক্ষণ কথা বলতে পছন্দ করেন। মোবাইলে টাকা ভরার কৌশলের জন্য বেশি কথা বলার সুযোগ নেই। কিন্তু উনি চান ফোনটি উনার নামে বাজুক। এক সময়ের ব্যস্ত মানুষটির নামে এখন আর ল্যান্ড লাইনে ফোন আসে না।পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা তার নামের ফোন গুরুত্বের সাথে রিসিভ করে তাকে ডাকে না।

উনি চান উনার নামে ক্রিং ক্রিং ডাক আসুক। বাসার সবাই শুনুক যে উনার এখনও ফোন আসে। উনারকে খবর দেওয়া হোক যে উনাকে কেউ খুঁজছে। যিনি অসীমের ডাকে সাড়া দেওয়ার অপেক্ষায় তিনি এখনও সীমানার ভেতরের ডাক শুনতে আগ্রহী। অবশ্য জীবনের ডাক শোনার জন্য আগ্রহী হওয়াইতো মানবের আকুতি। আমার অবচেতনে রবি ঠাকুর গেয়ে উঠল—-
আমি কান পেতে রই
ও আমার আপন হৃদয় গহন-দ্বারে বারে বারে
কোন্‌ গোপনবাসীর কান্নাহাসির
গোপন কথা শুনিবারে–বারে বারে ॥
ভ্রমর সেথা হয় বিবাগি নিভৃত নীল পদ্ম লাগি রে,
কোন্ রাতের পাখি গায় একাকী
সঙ্গীবিহীন অন্ধকারে বারে বারে ॥