মেরিলিন মনরো, কার্ট কোবেইন, দিব্যা ভারতী, সালমান শাহ, জিয়া খান, মিতা নূর-এরা সবাই মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ছিলেন। কেউ পশ্চিমা মিডিয়া, কেউবা ভারতের আর কেউ কেউ আমাদের দেশেই ছিলেন মহাতারকা। তাদের সকলের মধ্যে আরেকটি মিল আছে, অনেকেই আমি নিশ্চিত মিলটা ইতিমধ্যেই ধরে ফেলেছেন। এরা সবাই সুইসাইড বা আত্মহত্যা করেই পরলোক গমন করেছেন।

ম্যালকম গ্ল্যাডওয়েলের বিখ্যাত বই ‘দ্যা টিপিং পয়েন্ট’ পড়তে গিয়েই সুইসাইড নিয়ে খুবই ইন্টেরেস্টিং কিছু জিনিস জানতে পারলাম এবং আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধি হল সুইসাইড বিষয়ক এই আহরিত জ্ঞান সকলের সাথে শেয়ার করা উচিত।

এই সুইসাইড বিষয়ক আলোচনা শুরু করবো ওশেনিয়া মহাদেশের মাইক্রোনেশিয়া নামক একটি দেশের অধিবাসীদের সুইসাইডের কাহিনী দিয়ে। ১৯৬০ সালের দিকে মাইক্রোনেশিয়াতে সুইসাইড ছিলনা বললেই চলে। কিন্তু হঠাৎ করেই আস্তে আস্তে সুইসাইডের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। ২০ বছরের মধ্যেই তা এতটাই প্রকট আকার ধারণ করে যে ১৯৮০ সালের দিকে প্রতি এক লাখে ১৬০ জন আত্মহত্যা করে যা কিনা সেই সময়ে পৃথিবীর অন্যান্য সকল দেশের চেয়ে বেশি ছিল(মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ছিল মাত্র ২২, ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের বর্তমান হিসাবে বাংলাদেশে সংখ্যাটি ১৩.৫২)।

সুইসাইড হঠাৎ করেই কেন এত বৃদ্ধি পেল তা জানার আগে মাইক্রোনেশিয়ার ভিতরেই ইবেয়ে নামক একটি কমিউনিটির দিকে দৃষ্টি দিই। ইবেয়ে কমিউনিটিতে জনসংখ্যা ছিল সাকুল্যে ৬০০০। ১৯৫৫ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত এই কমিউনিটির কেউ আত্মহত্যা করেনি। এরপর ১৯৬৬ সালের মে মাসের দিকে বাইসাইকেল চুরি করার দায়ে অভিযুক্ত এক ১৮-বছর বয়সী তরুণ গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে। অনেক দিন পর এই রকম ঘটনা ঘটলেও তৎক্ষণাৎ কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সে সমাজে দেখা যায়নি। কিন্তু ঐ বছরের নভেম্বরেই একজন সম্ভ্রান্ত, ধনী পরিবারের এক পুরুষ আত্মহত্যা করে বসে কারণ দুই প্রেমিকার ঘরেই একজন করে সন্তান জন্ম নেবার পর সৃষ্ট মানসিক জটিলতা সইতে না পেরে সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এই ঘটনার তিন দিন পরই আরেকটি ছেলে সুইসাইড করে। অর্থাৎ গত ১০ বছরে যে কমিউনিটিতে কোন সুইসাইডের কোন ঘটনাই ঘটেনি, সেখানে এক সপ্তাহে দুইটি(এবং ঐ বছরে মোট তিনটি) সুইসাইডের ঘটনা ঘটে। পরবর্তী এক যুগে মাত্র ৬০০০ জনগোষ্ঠীর এই কমিউনিটিতে আরও ২৫ জন আত্মহত্যা করে বসে এবং আস্তে আস্তে মাইক্রোনেশিয়ার অন্যান্য কমিউনিটির মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে।
তো যারা সুইসাইড করতো, তাদের বৈশিষ্ট্য ঘাটলে দেখা যায় এদের অধিকাংশই সদ্য কৈশোর পেরোনো ছেলে যারা কিনা নিজ বাসাতেই থাকে। আর তাদের আত্মহত্যার কারণও এমন কিছু আহামরি ছিল না। আহামরি বলছিনা কারণ এরকম ঘটনা আমাদের অনেকের জীবনেও হয়ত ঘটেছে। বাবা হয়ত একটা ধমক দিয়েছেন বা হাতখরচ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন অথবা গার্লফ্রেন্ড/বয়ফ্রেন্ডের মধ্যে সামান্য ঝগড়া থেকেই অধিকাংশ আত্মহত্যার সূত্রপাত।

আসলে যে কারণে আত্মহত্যা হঠাৎ করেই মাইক্রোনেশিয়াতে বেড়ে উঠেছিল তা বেশ অস্বস্তিকর। প্রতিটি সুইসাইডের ঘটনাই আসলে সুইসাইডের একটি ন্যাচারাল বিজ্ঞাপন, এবং বিজ্ঞাপনের সাফল্য কয়েক গুণ হবে যদি কিনা কোন বিখ্যাত মানুষ কর্মটি সম্পাদন করে।

উপরের বাক্য দুটি যে সত্য তা বারবার নানা রিসার্চ থেকেই উঠে এসেছে। ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফর্নিয়ার সমাজবিজ্ঞানী ডেভিড ফিলিপ্স সুইসাইড নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা থেকে বারবার এই তথ্যই উদঘাটন করেছেন। ১৯৪০ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের লোকাল পত্রপত্রিকায় যখন কোন সুইসাইডের খবর ছাপা হয়েছে, সেই এলাকার সুইসাইডের ডাটা থেকে ফিলিপ্স দেখেন ঐ এলাকায় তৎক্ষণাৎ সুইসাইডের সংখ্যাও বেড়ে গিয়েছে। মেরিলিন মনরো যে বছর আত্মহত্যা করেন, সেই বছর পুরো আমেরিকায় সুইসাইডের সংখ্যা ১২% বেড়ে গিয়েছিল। এরপর ফিলিপ্স সুইসাইডের সাথে ট্র্যাফিক এক্সিডেন্টের কোন সম্পর্ক আছে কিনা তা খুঁজে দেখার চেষ্টা করেন, কারণ অনেক মানুষই ইচ্ছে করে কার এক্সিডেন্ট করে সুইসাইড করেন। ফিলিপ্স লস অ্যাঞ্জেলস টাইমস এবং সান ফ্র্যান্সিসকো ক্রনিকলসে প্রকাশিত এবং আলোচিত সুইসাইডের পর ট্র্যাফিক এক্সিডেন্টের ডাটা খেয়াল করেন। খুব আলোচিত কোন সুইসাইডের খবর প্রকাশিত হবার পরদিন ফিলিপ্স দেখেন ট্র্যাফিক এক্সিডেন্ট স্বাভাবিকের তুলনায় বেড়ে যায় ৫.৯%, দুই দিন পর ৪.১%, তিনদিন পর ৩.১%, চারদিন পর ৮.১% এবং দশদিন পর সুইসাইডের সংখ্যা আবার নরমাল অবস্থায় পৌঁছে যায়। আরও ইন্টেরেস্টিং হচ্ছে সংবাদপত্রে প্রকাশিত সুইসাইডের ঘটনা যদি কোন তরুণ-তরুণী সংগঠন করে, তাহলে এই ট্র্যাফিক এক্সিডেন্টের মাধ্যমে সুইসাইডও করে তরুণ-তরুণীরা, প্রকাশিত খবর কোন বৃদ্ধকে নিয়ে হলে এক্সিডেন্টের ডাটাতেও দেখা যায় বুড়োদের আধিপত্য। শুধু তাই নয়, ১৯৭০ সালের শেষের দিকে ইংল্যান্ডে নিজের গায়ে আগুন জ্বালিয়ে আত্মহত্যা করার বেশ কিছু ঘটনা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলে পরের বছর শুধু গায়ে আগুন জ্বালিয়ে আত্মহত্যার সংখ্যাই গিয়ে দাঁড়ায় ৮২ তে।

এই পুরো আলোচনা থেকেই আসলে আমাদের এতক্ষণে আমাদের বুঝতে পারা উচিত কী রকম ভয়ংকর অনুকরণপ্রিয় আমাদের মানব প্রজাতি। আশেপাশের কেউ সুইসাইড করলে, বিখ্যাত কেউ করলে তো কথাই নেই, পটেনশিয়ালি সুইসাইড চেষ্টাকারীরা আসলে একধরনের পারমিশন বা অনুমতি পায়, সুইসাইডকে তারা তখন একটা সমাধানের মধ্যে ধরে নেয়।

সুইসাইড বিষয়ক আলোচনা থেকেই আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধি হল সুইসাইড কমানোর সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে সুইসাইডকে মিডিয়া কভারেজ না দেয়া। বলিউডে জিয়া খান মারা যাবার পর যেভাবে দিনের পর দিন এ বিষয়ে সে দেশের মিডিয়াকে কভারেজ দিতে দেখেছি, তাতে ফলাফল যে খুব খারাপ হবার সম্ভাবনা বেশি তা বলাই বাহুল্য।

দুঃখজনক হচ্ছে, একজন বিখ্যাত কেউ যখন সুইসাইড করেন আর সেই খবর যদি পত্রিকায় না থাকে, আপনার পত্রিকার কাটতি কমে যেতে পারে। একেবারেই বাদ না দিলেও যত বিখ্যাতই হোক, আমার কাছে মনে হয় কোন সুইসাইডের খবর যেন প্রথম পাতার খবর না হয়, ভিতরের কোন পাতায় হলেও তা যত অল্পে পারা যায় ততই মঙ্গল। আমার ধারণা আমার এই ইচ্ছেও একটি কল্পনা মাত্র, কারণ কম্পিটিশনের এই যুগে যদি এক পত্রিকা রসিয়ে রসিয়ে পুরো সুইসাইডের গল্প লিখে আর অন্য পত্রিকা শেষ পাতায় এই নিয়ে তিন লাইন লিখে, আবারও সেই একই পত্রিকার কাটতির সমস্যা হতে পারে। সাংবাদিকদের সংগঠন থেকেই যদি এরকম কোন নিয়ম বা নীতিমালা থাকতো তাহলে বেশ হতো কারণ সে ক্ষেত্রে এই নীতিমালা লেভেল প্লেয়িং গ্রাউন্ড হিসেবে কাজ করতে পারতো।

বিখ্যাত কারও সুইসাইডের খবর প্রচার না করলে সমস্যা তো বুঝলাম, কিন্তু একেবারে আমজনতার সুইসাইডের খবরও তো দেখি হরহামেশাই পত্রিকায় আসে। প্রতি বছর এসএসসি বা এইচএসসির পর পত্রিকায় দেখি বাজে ফলের জন্য আত্মহত্যা করার খবর। এই আলোচনা থেকে কেউ যদি কিছু বুঝে থাকেন, তাহলে এতক্ষণে বুঝে যাওয়ার কথা এই সংবাদ গুলোই আসলে আরও অনেকগুলো সুইসাইডের কারণ।

পত্রপত্রিকার কথা তো বুঝলাম, আমরা নিজেরা কী করতে পারি? জিয়া খান বা মিতা নূরের আত্মহত্যা করার পর খেয়াল করেছি ফেসবুকে আমাদের নিউজফিডও এই নিয়ে আলোচনা চলেছে। কেউ তাদের প্রতি সহানুভূতি জানিয়েছেন, কেউ করেছেন আত্মহত্যাকে তিরস্কার। আমার অনুরোধ থাকবে সুইসাইড বিষয়ক সমস্ত আলোচনা-সমালোচনাকে পরিহার করার জন্য। আপনি যখন পুরোপুরি ইগনোর করবেন এই খবর গুলো, সেটি তত কম মানুষের জানার সম্ভাবনা আছে।

আপনি হয়ত খুব বিখ্যাত কারও আত্মহত্যাকে সমালোচনা করে একটি স্ট্যাটাস দিলেন, আপনার দুঃখ-ভারাক্রান্ত বন্ধুটি হয়ত সেখান থেকেই জানতে পারবে আত্মহত্যার ঘটনাটি। সে হয়ত গুগল করে দেখবে জিয়া খানের চেয়ে সে আসলে কয়েক গুণ অসুখী, তার বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাও হয়ত ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসতে পারে। আমাদের ছোট্ট ছোট্ট কাজগুলি আসলে শেষমেষ কোথায় গিয়ে কী প্রতিক্রিয়া ফেলে তা ঘরে বসে হিসেব করা মুশকিল।

আর হ্যাঁ, সুইসাইড বিষয়ক আলোচনায়-সমালোচনায় ইহাই আমার সর্বশেষ বাক্য।(কমেন্ট গুলো বিবেচ্য নয় :P)

দ্রষ্টব্যঃ ম্যালকম গ্ল্যাডওয়েলের দ্যা টিপিং পয়েন্ট না পড়ে থাকলে, পড়ে ফেলতে পারেন। মনে হয় ভালো লাগবে ।