কৃষি মন্ত্রণালয় আবারো বহুজাতিক কোম্পানির কাছে নতি স্বীকার করে দেশের খাদ্য নিরাপত্তার প্রতি হুমকি সৃষ্টিকারী জিএম বিটি বেগুনের বাণিজ্যিক ব্যাবহারের অনুমোদন দেয়ার পাঁয়তারা করছেন বলে খবরে প্রকাশ! জেনেটিক্যালি মোডিফাইড (জিএম) বেগুনের (বিটি বেগুন) চাষ ভারত ও ফিলিপাইনে নিষিদ্ধ হলেও বাংলাদেশে এটি চাষের অনুমতি দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। বেগুনের অন্যতম বালাই ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা প্রতিরোধী এ বেগুনের বীজ কৃষক পর্যায়ে ছাড়ার অনুমোদন চেয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে বিটি বেগুন উদ্ভাবনকারী সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি)।

বিটি বেগুন কি?

Bt অথবা Bacillus thuringiensis হচ্ছে একধরনের বায়ো পেস্টিসাইড ব্যাক্টেরিয়া যার cry1Ac জিন একধরনের ক্রিস্টাল প্রোটিন প্রস্তুত করে যা বেশকিছু পোকামাকড়ের জন্য বিষাক্ত। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং প্রযুক্তি প্রয়োগ করে বেগুন গাছে বিটি’র ঐ বিষ উৎপাদনকারী জিন ঢুকিয়ে বিটি বেগুন তৈরি করা হয়। বিটি’র ওই ক্রিস্টাল প্রোটিন যখন লেদা পোকার অন্ত্রে প্রবেশ করে তখন অন্ত্রের ক্ষারীয় পরিবেশে এক ধরনের জৈব রসের (protease enzyme) উপস্থিতিতে ক্রিস্টাল প্রোটিন টি ভেঙ্গে গিয়ে ডেল্টা -এন্ডোটক্সিন প্রস্তুত হয় যা পোকার অন্ত্রের রিসেপ্টরএর সাথে যুক্ত হলে লেদাপোকার অন্ত্রে ছিদ্র তৈরি হয়। এক পর্যায়ে পোকার মৃত্যু হয়।

মার্কিন কোম্পানি মনসান্তো ও ভারতের মহারাষ্ট্র হাইব্রিড বীজ কোম্পানি মাহাইকোর যৌথ কারিগরি সহযোগিতায় এবং ইউএসএআইডির আর্থিক সহায়তায় ২০০৫ সাল থেকে বাংলাদেশের স্থানীয় নয়টি প্রসিদ্ধ বেগুনের জাতের জিন সিকোয়েন্স পরিবর্তন করে ব্যসিলাস থোরিনজিয়েন্সিস (বিটি) নামক একটি ব্যাকটেরিয়ার প্রতিস্থাপন করেছে বারি। এ প্রক্রিয়ায় জিন পরিবর্তন করা বাংলাদেশের স্থানীয় জাতগুলো হলো জামালপুরের ইসলামপুরী বেগুন, যশোরের চেগা, রংপুরের খটখটিয়া, চট্টগ্রামের দোহাজারি, বারি-১ (উত্তরা), বারি-৪ (কাজলা), বারি-৫ (নয়নতারা), বারি-৬ ও বারি-৭ (সিংনাথ)। এসব জাতের মধ্য থেকে জিন পরিবর্তন করা বারি-১ (উত্তরা), বারি-৪ (কাজলা), বারি-৫ (নয়নতারা) ও বারি-৬ এই চারটি জাতকে কৃষক পর্যায়ে চাষের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছে বারি।

বিটি বেগুনের বাণিজ্যিকীকরণ প্রচেষ্টা এবং ভারত ও ফিলিপাইনে গনপ্রতিরোধ

ইউএসএআইডি’র আর্থিক সহায়তায় বহুজাতিক বীজ কোম্পানি মনসান্তো এবং তাদের ভারতীয় পার্টনার মাহিকো ২০০৫ সালে ভারতে বিটি বেগুনের উদ্ভাবন করলেও ভারতের পরিবেশবিদ, প্রাণ বৈচিত্র্য বিশারদ, কৃষক সমাজ এবং সচেতন নাগরিক সমাজের গণবিক্ষোভের মুখে সরকার এই বেগুনের বীজের বাজারজাতকরণ বন্ধ করতে বাধ্য হয়। একই প্রযুক্তিতে উদ্ভাবিত বিটি কটন (তুলা) নিয়ে ভারতে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে। ওই তুলা দিয়ে তৈরি পোশাক মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর হিসেবে পরিগণিত হয়। এরপর মনসান্তো- মাহিকো ফিলিপাইনে এই বিটি বেগুনের বীজের বাণিজ্যিক ব্যাবহারের প্রচেষ্টা চালালে সেখানেও গণপ্রতিরোধের মুখে পড়ে এবং ফিলিপাইনের কোর্ট বিটি বেগুনের ফিল্ড ট্রায়াল বন্ধ করার জন্য সরকারের প্রতি রুল জারি করলে সরকার তা বন্ধ করে দেয়। ভারত ফিলিপাইনে ব্যর্থ হয়ে বহুজাতিক কোম্পানি এখন বাংলাদেশে এই বেগুনের বীজের বাজারজাতকরণের জন্য জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

http://www.asianscientist.com/tech-pharma/scientific-committee-advises-halt-to-bt-brinjal-trials-2012/

জেনেটিক্যালি মোডিফাইড (জিএম) খাদ্য/শস্য উদ্ভাবন এবং তার বাণিজ্যিক চাষাবাদ নিয়ে আপত্তির জায়গাগুলো হচ্ছে-

১। খাদ্যশস্য সহ বিভিন্ন জিএমও’র উপর কোম্পানির মেধাসত্ত অধিকার অর্জন অর্থাৎ পেটেন্ট আগ্রাসন বা বায়োপাইরেসি।

২। খাদ্য সরবরাহ এবং খাদ্য নিরাপত্তার উপর বহুজাতিক এগ্রো কর্পোরেশনের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার আশংকা

৩। মানুষের স্বাস্থ্যের উপর এর বিরুপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা

৪। পরিবেশের উপর ক্ষতিকর প্রভাব

১। বায়োপাইরেসির শিকার হবে বাংলাদেশের বেগুন, বেগুনের বীজের সত্ত্ব চলে যাবে বহুজাতিক কৃষি কর্পোরেশন এর হাতে

বাংলাদেশী বেগুনের বিভিন্ন জাতকে জেনেটিকালি মডিফাই করে যে বিটি বেগুন উদ্ভাবন করা হয়েছে তার মূল উদ্দেশ্য এসব জিএম জাতের পেটেন্ট বহুজাতিক এগ্রিকালচার কর্পোরেশন মনসান্তো/মাহিকোর করায়ত্তে নিয়ে আসা ফলে এই বেগুন বীজের উপর কোম্পানির একচেটিয়া মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে এবং বাংলাদেশের সবজি বীজের নিরাপত্তা ও খাদ্য নিরাপত্তা অনেকটাই বহুজাতিক কোম্পানির দখলে চলে যাবে। জিএম বিটি বেগুন মূলত বাংলাদেশের লোকাল প্রজাতির বেগুনের উপর বহুজাতিক কর্পোরেশন মনসান্তো/মাহিকোর বায়োপাইরেসিকেই ত্বরান্বিত করবে।

বীজ বিস্তার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এম এ সোবহান বলেন, “ বেগুনের মত এত বিপুলভাবে চাষাবাদকৃত সবজিকে জেনেটিক্যালি পরিবর্তনের জন্য এবং তার পেটেন্ট প্রাপ্তির জন্য প্রাইভেট কর্পোরেশন কেন উঠে পড়ে লাগল তার কোন সদুত্তর নেই। তার মতে বিটি জিন ট্রান্সফার বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা প্রতিরোধে সক্ষম হলেও এই বেগুন আরও সাত প্রকারের বালাইয়ের শিকার হতে পারে”।

কৃষকের বীজের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে বারি দাবি করছে, বিটি বেগুন চাষ করলেও বীজের নিরাপত্তা কৃষকের হাতেই থাকবে। অর্থাৎ বিটি বেগুনের বীজের নিরাপত্তা মনসান্তো বা অন্য কারো হাতে থাকবে না। কিন্তু বারির এ বক্তব্যকে স্রেফ প্রতারণা বলে উল্লেখ করছেন বীজ বিশেষজ্ঞ ফরিদা আখতার। তিনি বলেন, প্রযুক্তিটি জিএম হয়ে থাকলে অবশ্যই কৃষকের হাতে বীজের নিরাপত্তা থাকবে না। তিনি আরো বলেন, এতদিন কৃষকের প্যাটেন্ট রাইটস নিয়ে সমস্যা ছিল না। কিন্তু বিটি বেগুন চাষের ক্ষেত্রে সেই সমস্যা থাকবে। তাই বিটি বেগুন দিয়ে কৃষকদের বীজের নিরাপত্তাহীনতার জালে আটকানোর প্রক্রিয়া চলছে। আন্তর্জাতিক বীজ কোম্পানির এই ষড়যন্ত্র বন্ধ করতে হবে।

মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানির বায়োপাইরেসি বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার প্রতি প্রচণ্ড হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। গত দুই দশক ধরেই পশ্চিমা বিশ্বের বহুজাতিক কোম্পানিগুলো যেমন মনসেন্টো, ইউনিলিভার, ডুপন্ট তৃতীয় বিশ্বের হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী লোকায়ত জ্ঞান, প্রাণবৈচিত্র্য তথা জেনেটিক সম্পদকে অবৈধভাবে পেটেন্ট করে নিয়ে এসব সম্পদের ওপর তাদের নিরঙ্কুশ মালিকানা প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে। জিএম বেগুনের প্যাটেন্ট মনসান্তো/মাহিকোর কাছে চলে গেলে ট্রিপস চুক্তি এবং টিকফা চুক্তির বাস্তবায়ন শুরু হলে আমাদের কৃষকদের চড়া দামে পেটেন্টেড বেগুন বীজ কোম্পানির কাছ থেকে কিনতে হবে এবং পেটেন্টেড বীজের একচেটিয়া ব্যবসা করে অবাধে মুনাফা অর্জন করবে বহুজাতিক কোম্পানি।

২। খাদ্য নিরাপত্তার উপর বহুজাতিক এগ্রো কর্পোরেশনের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে

বিটি বেগুনের বাণিজ্যিক ব্যাবহারের ফলে খাদ্য নিরাপত্তা চলে যাবে প্রাইভেট করপোরেশনের হাতে। স্বত্ব পাওয়া কোম্পানি এসব শস্য বীজ সংরক্ষণ, উৎপাদন ও বিপণন বন্ধ করে দিতে পারবে। কৃষকদের নিজেদের জমিতে/খামারে বীজ সঞ্চয়, নবায়নকৃত ব্যবহার এবং বিক্রয় নিয়ন্ত্রিত হবে পেটেন্ট আইনের কারণে। অধিক উৎপাদনের আশায় কৃষকরা পেটেন্টেড শস্য বীজ উচ্চ দামে কোম্পানি থেকে কিনতে বাধ্য হবে ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। বেগুনের দাম বেড়ে যাবে অনেক। এই বীজ পুনরুৎপাদন করার যে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া ঐতিহ্যবাহী বেগুনে ছিল জিএম বেগুনে তা না থাকলে প্রতি চাষাবাদের আগেই কোম্পানি থেকে বীজ কিনতে হবে, ফলে লোকায়ত জ্ঞান হারিয়ে যাবে, বেগুনের যে বৈচিত্র্য তা হারিয়ে যাবে।

বিটি বেগুনের বাণিজ্যিক ব্যাবহার বাংলাদেশে যে হরেক রকম জাতের বেগুন রয়েছে অর্থাৎ আমাদের বেগুনের জেনেটিক বৈচিত্র্যকে হুমকির মুখে ফেলে দিবে। বেগুন বীজের পেটেন্ট বহুজাতিকের কাছে থাকবে বলে এবং সরকারের পক্ষ থেকে অধিক ফলনের বিজ্ঞাপন দিয়ে বিটি বেগুন চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করা হলে শুধুমাত্র এই জিএম বীজের চাষাবাদে কৃষক নিয়োজিত থাকবে। কৃষকগণ নির্ধারিত কিছু জিই জাতের ফলনের দিকে নজর দিবে ফলে ঐতিহ্যবাহী লোকায়ত জাতগুলোর জায়গা দখল করে নিবে জিএম বীজ। ফলে ধীরে ধীরে দেশি বীজের সংরক্ষণ ও পুনরুৎপাদন এর ধারাবাহিক প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া হারিয়ে যাওয়ার আশংকা থাকবে এবং এসব হরেক রকম বেগুন বীজ হারিয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ শেষ পর্যন্ত বীজের উপর কৃষকদের নিয়ন্ত্রণ থাকবে না বরং প্রতিষ্ঠিত হবে বহুজাতিক কোম্পানির মনোপলি নিয়ন্ত্রণ! ফলন বৃদ্ধির নামে শেষ পর্যন্ত খাদ্যের জন্য বহুজাতিক কোম্পানীর প্রতি সম্পূর্ণ নির্ভরশীলতা তৈরী হবে।

৩। বিটি বেগুন মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর হলেও এই তথ্য গোপন করছে কোম্পানী

জেনেটিকেলি মডিফাইড বেগুন নিয়মিত খেলে অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কা আছে এবং ভারতীয় কোম্পানি মাহিকোর গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী বিটি বেগুন লিভার ক্ষয়সাধন এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমাতে পারে। মাহিকোর ৯০ দিন ধরে ইঁদুরের উপর পরিচালিত বিটি বেগুনের টক্সিসিটি স্টাডি থেকে জানা যায় এই জিএম বেগুন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, যকৃতের ক্ষয় সাধন করে এবং পুনরুৎপাদনের ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। কিন্তু জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ক অনুমোদন কমিটির (GEAC) কাছে রিপোর্ট জমা দেয়ার ক্ষেত্রে এই কোম্পানি এসব গবেষণা লব্ধ তথ্য হয় গোপন করেছে নতুবা ভুলভাবে উপস্থাপন করেছে বলে অভিযোগ করেছে ইন্দিয়া টুডে পত্রিকা। মাহিকোর রিপোর্টের ভিত্তিতে অনুমোদন কমিটি বিটি বেগুনের বাণিজ্যিক ব্যাবহারের অনুমতি দিলেও পরবর্তীতে ভারতের কৃষিবিদ, পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীসহ কৃষকদের আন্দোলনের মুখে পরিবেশ মন্ত্রণালয় ২০১০ সালে এই জিএম বেগুনের বাণিজ্যিক ব্যাবহার ১০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করে।অন্যদিকে কোম্পানির সায়েন্টেফিক তথ্যকে চ্যালেঞ্জ করে পাল্টা গবেষণা রিপোর্ট নিয়ে আসে স্বাধীন বিশেষজ্ঞ মহল যাদের অভিযোগ কোম্পানি বায়োটেকনোলজি বিভাগের নির্ধারিত প্রটোকল অনুসরণ করে গবেষণা করে নাই এবং টেস্ট এনিমেলের স্বাস্থ্যগত সমস্যা আমলে নেয় নাই! জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর উপর স্বাধীন(নন কর্পোরেট) গবেষণাকর্ম পরিচালনার জন্য গঠিত বিজ্ঞান পরিষদের প্রেসিডেন্ট ফ্রান্সের বিখ্যাত বিজ্ঞানি গিলিস-এরিক সেরালিনিও মাহিকোর বিটি বেগুনের উপর স্টাডিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলেছেন এই স্টাডি যথাযথ প্রোটোকল অনুসরণ করে করা হয় নাই এবং তাই তা গ্রহণযোগ্য নয়! মাহিকোর মতে বিটি বেগুনের কোন স্বাস্থ্যগত সমস্যা নেই কিন্তু একই ডাটার গভীর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে জানা যায় এই বেগুন ভক্ষন প্রদাহ/ ইনফ্লামেশন, প্রজনন সম্পর্কিত রোগ বালাই এবং লিভার ক্ষয়ের কারন হতে পারে। http://en.wikipedia.org/wiki/Bt_brinjal

নিউজিল্যান্ড এর এপিডিমলজিস্ট লুই গালাঘারের এনালাইসিস অনুযায়ী বিটি বেগুন ইঁদুরের অর্গান ও সিস্টেম এর ক্ষয় সাধন, জরায়ুর ৫০% ওজন হ্রাস, স্প্লিনের ওজন বৃদ্ধি, বিলিরুবিনের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং ইওসিনোফিলসহ শ্বেতরক্তকনিকার সংখ্যা বৃদ্ধির (৩০-৪০%) জন্য দায়ী অর্থাৎ এই বেগুন প্রজনন স্বাস্থ্যের ক্ষতি , লিভার, স্প্লিন সহ অর্গান ক্ষয় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। স্বাভাবিক খাবারের তুলনায় বিটি বেগুন শ্বেত রক্তকণিকার সংখ্যা ৩০-৪০% কমিয়ে দেয় যা ক্ষয়িষ্ণু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ। এছাড়া এএসটি’র (AST) লেভেল ৫৪-৬০% বৃদ্ধি, বিলিরুবিনের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং এসিটাইলকলিনএস্টারেজ এর প্লাজমা লেভেল কমে যাওয়া লিভার ক্ষয়ের নির্দেশক। অভারি বা জরায়ুর ওজন ৫০% কমে যাওয়া নির্দেশ করে এই বেগুন প্রজনন সাস্থের জন্য হুমকিসরূপ ! http://indiatoday.intoday.in/story/bt-brinjal-can-damage-liver-&-hit-immunity-of-a-human-being./1/126821.html

মাহিকো তার গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যকে যথাযথভাবে সামারাইজ করে নাই এবং ইঁদুরের উপর এই বিটি বেগুনের টক্সিক বা ক্ষতিকর প্রভাবকে অস্বীকার করেছে। গালেঘার এর মতে মাহিকোর স্টাডি রিপোর্টে উল্লেখিত টেক্সট এর সাথে প্রকৃত ডাটার মিল নেই। উদাহরণসরূপ গালেঘার বলেন, “যখন ইদুরের জরায়ু এবং স্প্লিনের ওজন ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ আছে তখন মাহিকো তাকে আড়াল করে মন্তব্য করেছে, “ ১০০০ মি গ্রাম/ কিলোগ্রাম ডোজে বিটি বেগুন ইঁদুরের অঙ্গের ওজনের কোন পরিবর্তন ঘটায় নাই”! এছাড়াও মাহিকোর গবেষণায় বায়োটেকনোলজির যথাযথ প্রোটোকল ব্যাবহার করা হয় নাই বিশেষ করে গবেষণায় নিম্নমানের স্ট্যান্ডার্ড (পজিটিভ কন্ট্রোল) ব্যাবহার করা হয়েছে যা ইঁদুরের শরীরে পরিবর্তনকে নির্দেশ করার ক্ষেত্রে যথাযথ ক্ষমতা সম্পন্ন ছিল না ফলে বিটি বেগুনের বিরূপ প্রভাব ঠিক মত ধরা পড়েনি। এমনকি কোম্পানির একটা ট্রায়ালে পরীক্ষার সময় ২৯% কমিয়ে আনা হয়েছে!

ড লুই গালাঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী ইঁদুরের উপর ৯০ দিনের গবেষণায় বিটি বেগুনের ক্ষতিকর প্রভাব বিবেচনায় নিলে এই জিএম সবজি মানুষের ভোগের জন্য অনুমোদন দেয়া যাবে না।

অবশ্য বিটি প্রযুক্তির আবিষ্কারক কোম্পানি তার নিজস্ব গবেষণায় দাবি করেছে এই বেগুন মানবদেহসহ স্তন্যপায়ী প্রাণীর ক্ষেত্রে নিরাপদ এবং কোন স্বাস্থ্য ঝুঁকি নেই! http://www.agbioworld.org/pdf/bt-short_safet.pdf

৪।পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের উপর ক্ষতিকর প্রভাবঃ

বাংলাদেশের বায়োসেফটি গাইডলাইন অনুযায়ী, জেনেটিকালি মোডিফাইড অরগানিজম বা জিএমও’র ব্যাবহার যেন জীববৈচিত্র্য ও জেনেটিক সম্পদের সুরক্ষার প্রতি হুমকি হয়ে না দাঁড়ায় তা সুনিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু বিশেষজ্ঞগণ বিটি বেগুনের ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ জানিয়ে বলেছেন যে এই বেগুন প্রাণবৈচিত্র্যের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে এবং মানুষ, প্রাণী ও উদ্ভিদের সাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি সাধন করতে পারে। গ্রিনপিসের মত আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদী সংগঠন তার নিজস্ব গবেষণায় দাবি করেছে এই জিএম বেগুনের চাষাবাদ পরিবেশ এবং মানুষের সাস্থ্যের জন্য হুমকি হতে পারে। গ্রিনপিসের মতে বিটি জীন যে আশপাশের বেগুনের জাতের কাছাকাছি অন্যান্য জাত ও প্রজাতির বুনো গাছপালা শাকসব্জি ঝোপঝাড় লতাপাতায় ট্রান্সফার হয়ে বায়োলজিক্যাল জেনেটিক দূষণের জন্ম দিতে পারে সে ব্যাপারটি রিস্ক এসেসমেন্ট এর ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয়া হয় নাই। বেগুনের অন্যান্য প্রজাতি কিংবা অন্য উদ্ভিদে এই বিটি জীনের অনাকাঙ্ক্ষিত ট্রান্সফার ইকোলজিকাল সমস্যা তৈরি করবে। ফলে বায়োসেফটি ও বায়োডাইভার্সিটির জন্য তা হুমকি। বিটি জিনের ট্রান্সফার বেগুনকে এগ্রেসিভ এবং প্রব্লেমেটিক উদ্ভিদে পরিণত করবে। এই বিটি বেগুনের সাথে বুনো প্রজাতি কিংবা চাষাবাদে ব্যাবহার করা প্রজাতির ক্রসিং এর ফলে যে হাইব্রিড প্রজাতি তৈরি হবে তা হবে আরও অধিকতর এগ্রেসিভ উদ্ভিদ অর্থাৎ মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধির ফলে এই অফস্প্রিং ইকোসিস্টেমের সামঞ্জস্য ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। [দি হিন্দু, ৩০ এপ্রিল, ২০১২]; http://www.greenpeace.org/india/PageFiles/446445/GE-Bt-brinjal-revisited.pdf

বিকৃত বিটি বেগুন কৃষক পর্যায়ে চাষের অনুমতি দিলে দেশের স্থানীয় জাতগুলোও ভয়াবহ জৈবিক দূষণের কবলে পড়বে। ফলে ইকোলজিকাল অসামঞ্জস্য এবং উদ্ভিদের জীব বৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়তে পারে।

এই বিটি জীন ট্রান্সফার অন্যান্য অস্তন্যপায়ী প্রাণীদের উপর মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে এবং ফলশ্রুতিতে অন্য প্রাণীদের উপরও পরোক্ষ প্রভাব পড়বে। এই বিটি জিন ট্রান্সফার ক্ষতিকর পোকার প্রতিরোধে কার্যকর হলেও অনেক উপকারি পোকামাকড় ও প্রজাপতির ক্ষতিসাধন করতে পারে।


কর্পোরেট বিজ্ঞান ও ননকর্পোরেট বিজ্ঞানের বয়ান ভিন্নঃ

উপরের আলোচনায় এটা সুস্পষ্ট যে জিএমও নিয়ে দুনিয়া জুড়ে বৈজ্ঞানিক গবেষকরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন, একপক্ষ দাবি করছেন জিএমও মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর নয় অন্যদিকে নন কর্পোরেট স্বাধীন গবেষকদের দাবি জিএমও মানবদেহের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তবে ভারতে মনসান্তোর বিটি তুলার চাষাবাদের অভিজ্ঞতা সুখকর নয় তা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছে। আবার মনসান্তোর জিএম খাদ্য ও বীজ মানবদেহ এবং পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এই অভিযোগ এনে গত ২৫ মে ২০১৩ ইউরোপ আমেরিকাসহ পৃথিবীর ৫২ দেশের ৪৩৬ সিটিতে এক যোগে ২ মিলিয়ন লোক বিক্ষোভ সমাবেশ করে এবং জিএমও বন্ধের দাবি জানায়।

http://www.cbc.ca/news/health/story/2013/05/25/monsanto-worldwide-demonstrations-montreal.html

http://www.businessinsider.com/global-protests-against-monsanto-gmo-foods-2013-5

http://rt.com/news/monsanto-gmo-protests-world-721/


জিএম বীজের পলিটিক্যাল ইকোনমি

তবে আমার মূল আপত্তির জায়গা বিজ্ঞান না, পলিটিকাল ইকোনমি, বহুজাতিক এগ্রো কেমিক্যাল কর্পোরেশনের বীজ নিয়ে যে রাজনীতি তা ধরতে না পারলে বিজ্ঞানবাদি চেতনা দিয়ে এই বিষয়টার সমাধান করা যাবে না। বহুজাতিক বীজ কোম্পানির স্বার্থেই বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার TRIPS চুক্তিতে প্রাণ ও প্রক্রিয়ার পেটেন্টকরণ এর বিধান যুক্ত করা হয়েছে এবং এই বিধানের সুযোগ নিয়ে কোম্পানি তার জিএম টেকনোলজির মাধ্যমে ফল, সবজি ও ওষধি উদ্ভিদের বীজকে মডিফাই করে পেটেন্ট করে নেয় যেন এসব জিএম বীজের বাণিজ্যকীকরণের মাধ্যমে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার মুনাফা অর্জন করতে পারে তাতে করে তৃতীয় বিশ্বের কৃষি ও কৃষকের মারাত্মক ক্ষতি হলেও তা দেখার বিষয় কোম্পানির না। ক্লাসিক্যাল বিজ্ঞান শুধু মানুষকে কেন্দ্র করে ভাবলেও বিজ্ঞানের দর্শন তা এখন আর অনুমোদন করে না, একটা বৈজ্ঞানিক বিষয়কে প্রাণ ও পরিবেশের জন্যও সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। এখন বিটি বেগুন যদি বেগুনের অন্য জাত কিংবা তার কাছাকাছি অন্য জাতের পরিবর্তন ঘটায় ফলে তা প্রাণ ও পরিবেশের জন্য হুমকি ছাড়া আর কিছুই না! এখন ধরে নিলাম কর্পোরেট বিজ্ঞানীদের দাবি সঠিক অর্থাৎ জিএম বেগুন মানুষের জন্য ক্ষতিকর হবে না কিন্তু শুধু তাই বলে একে বাণিজ্যিকভাবে ব্যাবহারের অনুমোদন কেন দিতে হবে যেখানে তা পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর? দ্বিতীয়ত এই বিটি বেগুনের বাণিজ্যকীকরন বাংলাদেশের বেগুন বীজের উপর বহুজাতিক কোম্পানির একচেটিয়া মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করবে, ফলে বীজ নিরাপত্তা মানে খাদ্য নিরাপত্তা চলে যাবে কোম্পানির দখলে, কৃষককে চড়া দামে কোম্পানির কাছ থেকে বীজ কিনতে হবে, একচেটিয়া এই জিএম বীজের চাষের ফলে বেগুন জাতের বৈচিত্র্য হারিয়ে যেতে পারে ফলে বাংলাদেশের কৃষি ধীরে ধীরে কোম্পানির কর্পোরেট পুঁজির অধীনে চলে যাবে। কৃষকের চাহিদার প্রেক্ষিতে নয় বরং বহুজাতিক বীজ কোম্পানির স্বার্থেই স্থানীয় বেগুনের জাতকে জেনেটিক্যালি বিকৃত করা হচ্ছে।

এই বিটি বেগুনের বাণিজ্যিক ব্যাবহার বাংলাদেশেও নিষিদ্ধ করতে হবে

বিটি বেগুনের বাণিজ্যিক ব্যাবহারের বিরুদ্ধে দুনিয়া জুড়ে বিক্ষোভ প্রতিবাদ হচ্ছে অনেকদিন ধরেই। কৃষি, কৃষক, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্যের উপর জিএম বেগুনের এসব সম্ভাব্য ক্ষতির কথা বিবেচনা করেই প্রতিবাদের মুখে কৃষক পর্যায়ে বিটি বেগুন চাষ ভারত ও ফিলিপাইন সরকার নিষিদ্ধ করেছে।বহুজাতিক কোম্পানি ভারত ও ফিলিপাইনে ব্যর্থ হয়ে এখন বাংলাদেশের কৃষিতে জিএম বীজের বিস্তারনের দিকে নজর দিল মনসান্তো। আমরা মনে করি শুধুমাত্র ফলন বৃদ্ধির কথা বিবেচনায় নিয়ে এই জিএম বেগুনের অনুমোদন দেয়া হবে আত্মঘাতী। সামগ্রিকভাবে কৃষকের বীজ নিরাপত্তা, খাদ্যনিরাপত্তা, মানবদেহ, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকির কথা বিবেচনায় নিয়ে এই বিটি বেগুনের বাণিজ্যিক ব্যাবহার বাংলাদেশেও নিষিদ্ধ করতে হবে।


মাননীয় কৃষি মন্ত্রী, বহুজাতিক কোম্পানির মুনাফা বৃদ্ধির দেখভাল করার জন্য আপনাকে মনোনীত করা হয় নাই, কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষকের স্বার্থ দেখভাল করাই আপনার দায়িত্ব! জিএম খাদ্য অনুমোদন দিয়ে বাংলাদেশের কৃষিতে কর্পোরেট আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা বন্ধ করুন!

লেখকঃ মাহমুদ যোবায়ের, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত আছেন ফার্মাসি ডিপার্টমেন্টে।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থঃ দ্রোহের নীল প্রহর, ভূল জন্মে ভালোবাসা।