২০১৩’র ১১ই জুলাই ডেইলি স্টার এ প্রকাশিত “Brinjal Modified: Bangladesh set to join elusive club of 28 GM crop growing countries” শীর্ষক অগভীর অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন অনুসারে Bangladesh Agricultural Research Institute খুব শিগগিরই National Technical Committee for Crop Biotechnology’র কাছে জিনগতভাবে বিকৃত Bt Brinjal বা বি টি বেগুন এর বানিজ্যিক উৎপাদনের অনুমতির জন্য আবেদন করবে। NTCCB এর উৎপত্তি এবং কার্যক্রম নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্নের অবকাশ থাকলেও এ লেখার মূল উদ্দেশ্য সেটা নয় বলে আমরা সেদিকে যাবনা।

প্রতিবেদনটিতে প্রতিবেদক রিয়াজ আহমেদ বি টি বেগুনকে পোকামাকড় প্রতিরোধী এবং এর উৎপাদন কীটনাশক ব্যাবহার হ্রাস করবে বলে দাবি করেছেন। ভারী মাত্রার কীটনাশক ব্যাবহার না করলে বেগুন ক্ষেতের ৭০% ভাগ বেগুনই নষ্ট হয়ে যায় বলে তিনি মনে করেন। কৃষকরা বেগুন ক্ষেতে এক মৌসুমে ৫০বার পর্যন্ত কীটনাশক ব্যাবহার করেন যেখানে অনুমোদিত মাত্রা ২৫ বার পর্যন্ত বলে তার ধারনা। তার প্রতিবেদনে ব্যাবহৃত সংখ্যাগুলোর উৎস এবং সুস্পষ্টতা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে। তার প্রতিবেদনের মূল সুরটা ছিল কীটনাশক ব্যাবহারের প্রতিস্থাপক হিসেবে জিনগতভাবে বিকৃত বি টি বেগুনকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার।

প্রতিবেদনে দেখা যায় BARI’র ডিরেক্টর জেনারেল ডঃ মোঃ রাফিকুল ইসলাম মণ্ডল দাবি করেছেন বি টি বেগুন উদ্ভাবনের এই কৃতিত্ব BARI’র গবেষকদের। প্রতিবেদনের আরেক অংশে দেখা যায় দুজন BARI গবেষক Cornell University এবং USAID এর অর্থায়নে ২০০৫ সালে ভারতে MAHYCO ( Maharashtra Hybrid Seeds Company) তে যান এবং সেখানে বেগুনের ৯টি জাতে বি টি জিন স্থাপন করেন। MAHYCO বি টি জিন স্থাপনের স্বত্বাধিকার বহুজাতিক MONSANTOর কাছ থেকে পেয়েছে উল্লেখ করলেও MAHYCO এবং MONSANTOর মধ্যে বিদ্যমান ৫০/৫০ যৌথ বিনিয়োগের কথাটি প্রতিবেদক চেপে গিয়েছেন। Bangladesh Agricultural Research Council(BARC) এর নির্বাহী পরিচালক ডঃ ওয়াইস কবির, কৃষি মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈবরসায়ন ও অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হাছিনা খান বি টি বেগুনের এই বাজারজাতকরণকে প্রত্যাশিতভাবেই স্বাগত জানিয়েছেন এবং উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন।

বাংলাদেশের মানুষ আমদানিকৃত সয়াবিন তেল ব্যাবহারের মাধ্যমে অনেক আগে থেকেই বিকৃত জিন খাদ্যে অভ্যস্ত এই অজুহাত দিয়ে বিকৃতজিন বি টি জিন বেগুন এর বর্তমান সংকটের গুরুত্ত্বকে প্রশমিত করার চেষ্টা করা হয়েছে প্রতিবেদনটিতে।

ভারতে এবং ফিলিপাইনে জনরোষের মুখে বিকৃতজিন বি টি বেগুনকে বানিজ্যিক ছাড়পত্র দেয়া হয়নি এবং ছাড়পত্র পেলে বাংলাদেশই হবে দক্ষিন এশিয়ায় প্রথম দেশ যে কিনা বিকৃতজিন খাদ্যশস্য উৎপাদন করবে!!

বাংলাদেশে যে বিকৃতজিন বেগুনকে উৎপাদনের ছাড়পত্র দেবার পায়তারা চলছে তা বিশ্বের আর কোথাও ছাড়পত্র পায়নি। ছাড়পত্র পেলে এই বেগুন উৎপাদনে বাংলাদেশই হবে প্রথম দেশ তথা গিনিপিগ।


ভারতে এবং ফিলিপাইনে জনরোষের মুখে বিকৃতজিন বি টি বেগুনকে বানিজ্যিক ছাড়পত্র দেয়া হয়নি এবং ছাড়পত্র পেলে বাংলাদেশ ই হবে দক্ষিন এশিয়ায় প্রথম দেশ যে কিনা বিকৃতজিন খাদ্যশস্য উৎপাদন করবে এ কথা উল্লেখ করলেও বিশ্বব্যাপী বিকৃতজিন খাদ্যশস্যের বিরুদ্ধে মানুষের ক্রমবর্ধমান সচেতনতা এবং ক্ষোভ এবং বহুজাতিক দানব Monsanto’র সাথে বাংলাদেশে বিকৃতজিন খাদ্যের আবির্ভাবের সম্পৃক্ততার ব্যাপারটা অত্যন্ত সুচতুরভাবে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেছেন প্রতিবেদক। Monsanto’র উৎপাদিত বীজের উচ্চমূল্যে কৃষকের পর্যদুস্ত হবার এবং বীজের স্বত্তাধিকার নিয়ে কৃষক এবং বীজ কম্পানির মাঝে মামলার ভূরি ভূরি নজির থাকলেও প্রতিবেদনটিতে দেখা যায় BARI’র অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ডঃ আল আমিন অস্বীকার করে বসেছেন যে বি টি বেগুন উৎপাদন শুরু হলে কৃষককে বছর বছর Monsanto’র কাছ থেকে উচ্চমূল্যে বীজ কিনতে হবেনা।

বাংলাদেশে রাজনৈতিক ডামাডোলে এ অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে গেলেও Associate Press of Pakistan(APP)র একটি প্রতিবেদন থেকে দেখা যায় বাংলাদেশের হাতেগোনা কিছু সচেতন মানুষের মধ্যে International University of Business Agriculture and Technolgy(IUBAT)’র Centre for Global Environmental Culture(CGEC) এবং Program on Education for Sustainibility (PES)র পরিচালক ডঃ মুহাম্মদ আতাউর রহমান বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত তুলে ধরে জিনগতভাবে বিকৃত খাদ্যকে খাদ্যের মর্যাদা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশে বিকৃত জিন খাদ্য উৎপাদন শুরুর প্রাক্কালে জিনগতভাবে বিকৃত খাদ্যশস্যের স্বরূপ নিয়ে পর্যাপ্ত আলোচনা, সমালোচনা এবং সর্বোপরি প্রতিরোধের অভাব ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

১৩ই মে, ২০১৩। US তথা বিশ্ব কৃষির ইতিহাসে এক কলঙ্কের জন্মদিন। ইন্ডিয়ানার ৭৫ বছর বয়স্ক কৃষক Vernon Bowman এর জীবনে এক কিম্ভুতকিমাকার অভিজ্ঞতার দিন। হাজার বছর ধরে সারা বিশ্বের কৃষকরা পরস্পর বীজ বিনিময় করে এসেছে। বোম্যানও তাই স্থানীয় শস্য এলিভেটর থেকে সয়াবিন কিনে এনেছিলেন। এই সয়াবিন Monsanto’র Roundup Ready সয়াবিন বীজ ব্যাবহার করে উৎপাদিত। তাই Monsanto মামলা ঠুকে দেয় বোম্যান এর বিরুদ্ধে। যেহেতু Roundup Ready বীজ ব্যবহার করে সেই সয়াবিন উৎপাদিত, সেই সয়াবিন বীজ হিসেবে ব্যাবহার করে বোম্যান প্যাটেন্ট আইন ভঙ্গ করেছেন। বোম্যানএর যুক্তি ছিল যেহেতু তার ব্যাবহৃত বীজ ছিল Roundup Ready’র দ্বিতীয় প্রজন্ম, তাই তিনি কোন আইন ভঙ্গ করেননি। US এর ৬০% এর বেশি ভুট্টা ও সয়াবিন বীজ এর নিয়ন্ত্রন কর্তা Monsanto যুক্তি দেয় সেই বীজ দ্বিতীয় প্রজন্মের হলেও যেহেতু তার মধ্যে Roundup Ready’র গুনাগুন বিদ্যমান, তাই সেগুলোকে বীজ হিসেবে ব্যাবহার করে বোম্যান আইন ভঙ্গ করেছেন। বোম্যান এর বিরুদ্ধে সেই মামলা সুপ্রিম কোর্ট অবধি যায়। এবং আক্কেলের মাথা খেয়ে সুপ্রিম কোর্ট বোম্যানকে ৮৪,৪৫৬ ডলার জরিমানা করে!

Percy Schmeiser পশ্চিম কানাডার Sasketchewan প্রদেশে তিন পুরুষেরও বেশি সময় ধরে কৃষক। Percy তার শহরের মেয়র ছিলেন, ছিলেন প্রাদেশিক সংসদের সদস্যও। কানাডায় বিকৃতজিন শস্য অনুমোদনের দুই বছরের মাথায় ১৯৯৮ সালে Percy Monsanto’র কাছ থেকে প্যাটেন্ট চুরির অভিযোগসম্বলিত উকিল নোটিশ পান। ঘটনাটা ছিল এরকমঃ Percy তার ক্যানলা (rape seed বা রাই সরিষা) ক্ষেতের চারপাশে আগাছা দমনের জন্য Roundup আগাছানাশক ব্যাবহার করছিলেন। তিনি আবিষ্কার করলেন অন্যান্য আগাছার সাথে যে ক্যানলার চারাগুলি ছিল তারা মরছেনা। অর্থাৎ প্রতিবেশী ক্ষেতের বিকৃতজিন ক্যানলার ফুল থেকে পরাগায়নের মাধ্যমে Percy’র ক্ষেতের ক্যানলার ফুলকে নিষিক্ত করেছে কিংবা পরিপক্ক বীজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে তার ক্ষেতে এসে পড়েছে। Percy পরীক্ষামূলকভাবে তার পুরো ক্ষেতে সেই আগাছানাশক ব্যাবহার করলেন এবং দেখলেন ৬০% ক্যানলার চারা বেচে যাচ্ছে!! যেহেতু তার ক্ষেতের ক্যানলা আগাছানাশক দিয়ে মরছেনা, সেহেতু সেই চারায় বিকৃত জিন রয়েছে এবং সেহেতু তিনি প্যাটেন্ট আইন ভঙ্গ করেছেন!!! সুতরাং যেভাবেই এ ঘটনা ঘটুক না কেন, আগাছানাশক সহ্যকারী ক্যানলার চাষ করলে Monsantoকে যথাযত ফি দিতে হবে এবং চুক্তিনামায় স্বাক্ষর করতে হবে। ২০০৪ সালে হওয়া আদালতের রায় Monsanto’র পক্ষে যায় যদিও তাকে জরিমানা দিতে হয়নি এই বলে যে বীজের এই দূষণ Percyর জন্য বিশেষ কোন অর্থনৈতিক লাভ বয়ে আনেনি।

শুধু বোম্যান বা Percy নয়, US এ এমন ২৭ অঙ্গরাজ্যের ন্যুনতম ৪১০ জন কৃষক এবং ৫৬টি খুদ্র খামার এর বিরুদ্ধে ১৪৪টি প্যাটেন্ট আইন ভঙ্গের মামলা করে কৃষি সমাজে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে বিশ্বের মোট বানিজ্যিক বীজের ৫৩% এরও বেশি বীজ সরবারহকারী Monsanto।

যে বিকৃত জিন নিয়ে Monsanto এবং অন্যান্য বিকৃত জিন বীজপ্রস্তুতকারকের এহেন বানিজ্য সেই বিকৃত জিন অণুজীব (GMO) বা জিনগতভাবে বিকৃত খাদ্য বা শস্য কিভাবে উৎপাদিত হয় তা সম্পর্কে ধারনাগুলো নিয়ে একটু জাবর কাটা যাক। জিন বিকৃতকরনের মূলমন্ত্র মূলত এরকমঃ ধরুন কোন একটি জাতের উদ্ভিদ বা অণুজীবের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে যা অন্য একটি জাতের গাছে বা জীবে নেই। ধরুন প্রথম শ্রেণীর উদ্ভিদ বা অণুজীব বা প্রাণীর নাম ‘ক’ আর দ্বিতীয় শ্রেণীর নাম ‘খ’। তখন বিশেষ বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন ‘ক’র যে জিন তার সেই বিশেষ চরিত্রের জন্য দায়ী সেই জিনটিকে সনাক্ত করা হয় এবং আলাদা করে লাখ লাখ প্রতিরুপ বা কপি তৈরি করা হয়। এই কপি করা হয় PCR(Polymerase Chain Reaction) পদ্ধতিতে। অতঃপর ‘খ’ এর লাখ লাখ কোষে এই জিনটির অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়। অনুপ্রবেশ ঘটানোর অন্তত দুটি পদ্ধতি আছে। একটি হল সনাতন ‘জিন গান’ পদ্ধতি। গ্রহণকারী ‘খ’ এর কোষে জিনগুলোকে ভারী ধাতু যেমন সোনার গুঁড়োতে মোড়ক হিসেবে পরিয়ে প্রক্ষেপন ঘটানো হয়। অথবা মাটিতে পাওয়া যায় এমন এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া Agrobacterium Tumefaciens বা অন্য কোন অনুরুপ অণুজীবের এর জিনের সাথে সেই কাঙ্ক্ষিত জিনের সন্নিবেশ ঘটিয়ে ‘খ’কে আক্রান্ত করা হয়। উভয় পদ্ধতিতেই সাফল্যের হার নিয়ন্ত্রনের বাইরে। অর্থাৎ ‘খ’ এর ঠিক কতগুলো কোষ বা কলা অনুপ্রবেশকারী জিনকে গ্রহন করবে বা আদৌ করবে কিনা বা করলে এই জিন ‘খ’র জেনমের ঠিক কোথায় অবস্থান গ্রহন করছে তা অজানা থেকে যাচ্ছে। পরবর্তীতে Tissue Culture এর লক্ষ লক্ষ কোষ থেকে নতুন জীব (অণুজীব, উদ্ভিদ অথবা প্রাণী) উৎপাদন করা হয় এবং রাসায়নিক প্রভাবক দিয়ে বাছাই করে এবং বর্ধনশীল জীবের বৈশিষ্ট্য লক্ষ করে ধরে নেয়া হয় যে জিন অনুপ্রবেশ ঘটানো গেছে। এখন ‘ক’ এবং ‘খ’ যদি যৌনভাবে সমগোত্রীয় বা সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় তবে ‘খ’ এর জিন বিকৃতি করন Cisgenic। যেমন ধরুন দুই আলাদা জাতের গরু। কিন্তু ‘ক’ এবং ‘খ’ যদি সম্পূর্ণ দুই ভিন্ন প্রজাতির হয় তবে এই জিন বিকৃতিকরন Transgenic । যেমন ধরুন সিংহ এবং বাঘের মধ্যবর্তী জীব “Liger” । এখন পর্যন্ত অনেক ধরনের Transgenic কম্বিনেশন করার চেষ্টা করা হয়েছে এবং কিছু নমুনা নিম্নরুপঃ

মাকড়শার জিনের অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়েছে ছাগলের জিনের। লক্ষ্য ছিল ছাগলের দুধে মাকড়সার জালের আমিষের সন্নিবেশ ঘটানো যাতে তা থেকে বুলেট প্রুফ জ্যাকেট বানানো যায়।
শুয়রের চামড়া গরুর মত করতে শুয়রের জিনে গরুর জিনের অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়েছিল
শুয়রের জিনে জেলিফিশের জিনের অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়েছিল এই আশায় যে অন্ধকারে শুয়রের নাক জেলিফিশের মত জ্বলবে।
মেরুদেশীয় মাছের জিন টমেটোর জিনে অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়েছিল যাতে প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় টমেটো জমে না যায়
ভুট্টার জিনে মানব জিনের অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়েছিল বীর্য নাশক তৈরির উদ্দেশ্যে

এছাড়াও বর্তমানে যেগুলো পরিক্ষনাধীন রয়েছে সেগুলো হলঃ

ভুট্টার জিনে মানুষের জিনের অনুপ্রবেশ ঘটানো
আখের জিনে মানুষের জিনের অনুপ্রবেশ ঘটানো
ভুট্টার জিনে জেলিফিশের জিনের অনুপ্রবেশ ঘটানো
তামাকের জিনে লেতুচ পাতার জিনের অনুপ্রবেশ ঘটানো
ধানের জিনে মানুষের জিনের অনুপ্রবেশ ঘটানো
ভুট্টার জিনে হেপাটাইটিস ভাইরাস এর জিনের অনুপ্রবেশ ঘটানো

বর্তমানে জিনগতভাবে বিকৃত যেসব ফসল বানিজ্যিকভাবে উৎপাদনের ছাড়পত্র পেয়েছে তার মধ্যে সয়াবিন, ভুট্টা, রাইসরিষা(rapeseed/canola), বীট(sugar beet), তুলা এবং পেঁপে উল্লেখযোগ্য।

গম এবং চাল এর জিনগত বিকৃতি করন করা হলেও বানিজ্যিক উৎপাদনের ছাড়পত্র দেয়া হয়নি।

আর বাংলাদেশে যে বিকৃতজিন বেগুনকে উৎপাদনের ছাড়পত্র দেবার পায়তারা ছলছে তা বিশ্বের আর কোথাও ছাড়পত্র পায়নি। ছাড়পত্র পেলে এই বেগুন উৎপাদনে বাংলাদেশই হবে প্রথম দেশ তথা গিনিপিগ। বস্তুত দক্ষিন দক্ষিন এশিয়াতে বাংলাদেশ হবে প্রথম দেশ যে কিনা জিনগত ভাবে বিকৃত খাদ্যশস্য উৎপাদন করবে। বেগুনের জিন বিকৃতিকরনে মাটিতে পাওয়া Bascillus Thuringiensis ব্যাকটেরিয়া র জিন ব্যাবহার করা হয়। বেগুনের গাছ খাবার হিসেবে গ্রহন করার পরে এর কোষে যে বিকৃত জিন (বস্তুত আমিষ) থাকে তা পোকার অন্ত্রে গেলে (সেখানকার pH মাত্রা ৯.৫ এর বেশি) সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং পোকার অন্ত্রের আবরনের গ্রহীতা আমিষের সাথে বন্ধন তৈরি করে। ফলে পোকার পরিপাক ক্রিয়া এলোমেলো হয়ে যায় এবং পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে পোকাটি মারা যায়। পোকার জন্য বিষক্রিয়া উৎপাদনকারী জিনটি বেগুন গাছের সব অংশে সমপরিমানে ছড়িয়ে থাকে অর্থাৎ বেগুনেও থাকে।

প্রবল বিতর্ক এবং জনরোষের মুখে ভারতের পরিবেশ মন্ত্রী জয়রাম রমেশ ২০১০ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারী বিকৃত জিন বেগুন বানিজ্যিকিকরনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। ভারতের সবকটি রাজ্য এই বেগুন বানিজ্যিকিকরনে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল এবং যেহেতু এই বেগুনের ভোজনযোগ্যতা নিয়ে ও পরিবেশের উপর প্রভাব নিয়ে যথেষ্ট গবেষণার অভাব ছিল তাই এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন বলে এক সাক্ষাৎকারে তিনি উল্লেখ করেন।


প্রবল বিতর্ক এবং জনরোষের মুখে ভারতের পরিবেশ মন্ত্রী জয়রাম রমেশ ২০১০ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারী বিকৃত জিন বেগুন বানিজ্যিকিকরনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। ভারতের সবকটি রাজ্য এই বেগুন বানিজ্যিকিকরনে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল এবং যেহেতু এই বেগুনের ভোজনযোগ্যতা নিয়ে ও পরিবেশের উপর প্রভাব নিয়ে যথেষ্ট গবেষণার অভাব ছিল তাই এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন বলে এক সাক্ষাৎকারে তিনি উল্লেখ করেন। ডেইলি স্টার এর প্রতিবেদনে রিয়াজ আহমেদ জিনগত ভাবে বিকৃত বেগুন উৎপাদনের পক্ষে গান গাইলেও বিকৃতজিন শস্যের ইতিহাস ভিন্ন কথা বলে। বীজাদানব Monsanto তার তৈরি আগাছা নাশক Roundup এর কারখানার পাশে পাওয়া ব্যাকটেরিয়ার জিন সয়াবিনের জিনে অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে যে Roundup Ready সয়াবিন বীজ তৈরি করেছিল তা Roundup এর কার্যকরী উপাদান Glyphosate রোধী। অর্থাৎ Roundup ব্যাবহারের ফলে আগাছা মারা গেলেও সয়াবিনের কোন ক্ষতি হবেনা। কিন্তু বিবর্তনের স্বাভাবিক নিয়মে সয়াবিন ক্ষেতের আগাছা ক্রমশই Glyphosateসহ হয়ে উঠছে, তৈরি করছে অতি আগাছা ও দানব পোকা (Super Weed and Super Pest ) ফলে প্রতি বছর সয়াবিন ক্ষেতে অধিক শক্তিশালী Roundup ব্যাবহার করতে হচ্ছে যার অর্থ অধিক পরিমানে Glyphosate মাটিতে ছড়িয়ে পড়ছে। এই Glyphosate নিরাপদ বলে এর উৎপাদনকারী দাবি করলেও বস্তুত এটি একটি বিষাক্ত পদার্থ যা কিনা মাটি থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি সংগ্রহে আগাছাকে বাধা দেয়। ৯০ এর দশকেই অনেক গবেষণায় (যার কিছু কিছু Monsanto’র পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত) বেরিয়ে আসে যে Glyphosate জন্মগত ত্রুটির জন্য দায়ী হতে পারে। কিন্তু সেসব গবেষণার ফলাফল জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়নি। কিছু স্বাধীন গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে যে Glyphosate ভ্রুন কোষ, বৃক্ক কোষ, ভ্রুন নালীর কোষ (umbilical cord) প্রভৃতির মৃত্যুর জন্য দায়ী। এছাড়াও বিকৃতজিন খাদ্যভোজনে দীর্ঘ মেয়াদে মানুষের উপর কি প্রভাব পড়ে তার উপর সুস্পষ্ট গবেষণার অভাব রয়েছে। আর Monsanto’র বীজ কেনার প্রথম শর্ত হল এই বীজ গবেষণার কাজে ব্যাবহার করা যাবেনা! “Seeds of Death” শীর্ষক একটি ডকুমেন্টারি চলচ্চিত্রে বিকৃতজিন খাদ্যের উপর বিশেষজ্ঞদের মতামত ও বিশ্লেষণ থেকে বিকৃত জিন খাদ্যের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে একটা ধারনা পাওয়া যায়।

৯০ এর দশকের মাঝামাঝি ব্রিটিশ সরকার বিখ্যাত বিজ্ঞানী Dr Arpad Pusztaiকে ৩ মিলিয়ন ডলারের (১.৬ মিলিয়ন ইউরো) একটি প্রকল্পে নিয়োগ করে যার উদ্দেশ্য ছিল বিকৃত জিন খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উপায় বের করা। তার গবেষণার উপর ভিত্তি করে বিকৃত জিন খাদ্যের গ্রহণযোগ্যতার মাপকাঠি তৈরি করার কথা ছিল যা পরবর্তীতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এর জন্য নির্দেশনা হিসেবে ব্যাবহৃত হবার কথা। তিনি গবেষণায় তিন ধরনের আলু তিন দলের ইঁদুরকে খাওয়ান। তিনি প্রথম দলকে পোকামাকড় নাশক ব্যাবহার করে উৎপাদিত বিকৃত জিন আলু, দ্বিতীয় দলকে স্বাভাবিক আলু এবং তৃতীয় দলকে পোকামাকড় নাশক মেশানো (উৎপাদনে ব্যাবহৃত নয়, সরাসরি মেশানো) স্বাভাবিক আলু খাওয়ান। ১০ দিনের মাথায় দেখা গেল, প্রথম দলের ইঁদুরেরা বিভিন্ন রকম সমস্যায় পড়ছে। এদের বৃদ্ধি কম, আভ্যন্তরীণ অঙ্গ প্রত্যঙ্গের বিকাশ সামঞ্জস্যহীন এবং সবচেয়ে গুরুতর ব্যাপার হল এদের রোগ প্রতিরোধ ব্যাবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে । এদের অন্ত্রনালিতে ক্যান্সার পূর্ব কোষ তৈরি হচ্ছে; কলিজা, অণ্ডকোষ ও মস্তিষ্কের গঠন স্বাভাবিকের চেয়ে ক্ষুদ্র, কলিজার কোষ আংশিকভাবে ক্ষয়িষ্ণু, অগ্নাশয় ও ক্ষুদ্রান্ত্র স্ফীত।

বাকি দু দলের ইঁদুর সুস্থ আছে!

এই পর্যবেক্ষণে বস্তুত তিনি নিজেও আঁতকে উঠেছিলেন, কেননা এতদিন তিনি নিজেও জিন বিকৃতি করনের পক্ষে ছিলেন।

তাঁর গবেষণার এই পর্যবেক্ষণ তিনি নিয়োগকর্তা Rowett Institute এর অনুমতিক্রমে ১৯৯৮ এর ১০ই আগস্ট এক দূরদর্শন সাক্ষাৎকারে তুলে ধরেন। ওই দিনই Rowett Institute এর ডিরেক্টর James Phillips এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে Dr Arpad Pusztai এর এই পর্যবেক্ষণকে বিজ্ঞান গবেষণায় এক বিশাল অগ্রগতি বলে দাবি করেন। অথচ পরদিনই ৩৫ বছর ধরে ওই প্রতিষ্ঠানে গবেষণায় নিবিষ্ট Arpad Pusztaiকে বরখাস্ত করা হয়। কথিত আছে সেইদিন ব্রিটিশ প্রধান মন্ত্রীর কার্যালয় থেকে James Phillips এর কাছে দুটি ফোনকল এসেছিল। বিকৃত জিন বীজ উৎপাদনকারীরা এমনি প্রভাব প্রতিপত্তি সম্পন্ন। সত্যি বলতে কি, তোষামোদ বানিজ্যে(lobbying) প্রচুর অর্থ ব্যায়ের ক্ষমতা রাখে এই বীজদানবেরা, আর এ কারনেই “Monsanto Protection Act ” এর মত বিলে স্বাক্ষর করতে ওবামা’র মত প্রেসিডেন্টের দেরি হয় না।

সম্ভবত এ ঘটনার জের ধরেই ইউরোপ এখন পর্যন্ত বিকৃত জিন খাদ্যের ব্যাপারে অনেক কঠোর অবস্থানে আছে। এক ধরনের বিকৃতজিন ভুট্টা আর জার্মান BASF এর উদ্ভাবিত এক ধরনের বিকৃতজিন আলু ছাড়া অন্য কোন বিকৃতজিন খাদ্য ইউরোপে ছাড়পত্র পায়নি। আর এসবের অধিকাংশই গোখাদ্য হিসেবে ব্যাবহৃত হয়। ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন এবং অষ্ট্রিয়া সহ বেশ কিছু দেশে বিকৃতজিন খাদ্য উৎপাদন পুরোপুরি নিষিদ্ধ। সম্প্রতি বিকৃতজিন খাদ্যের প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ইউরোপীয়দের এমন কঠোর অবস্থান দেখে হাল ছেড়ে দিয়েছে বীজ দানব Monsanto। তারা বিকৃতজিন বীজের পরিবর্তে প্রাকৃতিক বীজ বাজারজাতকরনের প্রতি মনোযোগ দেবে বলে অতি সম্প্রতি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে।

জিন বিকৃতির পেছনে সাফাই হিসেবে উৎপাদকেরা দাবি করে এই প্রযুক্তি বিশ্ব খাদ্য সমস্যার সমাধান দেবে। এ দাবি সর্বইব মিথ্যা। জিনগতভাবে বিকৃতি করন একরপ্রতি খাদ্যশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধি বাড়ায়না বরং কমায়। আর বর্তমান বিশ্বে ৮৭ কোটি মানুষ ক্ষুধার্ত অবস্থায় দিন যাপন করে খাদ্যের অপ্রতুলতার কারনে নয় বরং মুনাফালোভী ব্যাবসায়ীদের লোভের কারনে এবং খাদ্য বিপণন ও বিতরনে অসমতার কারনে। বর্তমানে বাৎসরিক যে খাদ্য উৎপাদিত হয় তা দিয়ে ১১০০ কোটি মানুষের খাদ্য সরবারহ নিশ্চিত করা সম্ভব। কৃষিবীজের কুক্ষিগতকরনের মাধ্যমে বীজ বানিজ্যে একাধিপত্য(monopoly) নিশ্চিত করাই এই সকল বীজদানবদের একমাত্র লক্ষ্য।

কৃষকদেরকে তাদের উৎপাদিত বীজের উপর নির্ভরশীল করে তুলে বীজের মুল্য বৃদ্ধির দৃষ্টান্ত আজ নতুন কিছু নয়। USDA( United States Department of Agriculture) এর এক পরিসংখ্যান এ দেখা যায় ২০০১ থেকে ২০০৯ এর মধ্যে সয়াবিন বীজের দাম ১০৮% এবং ভুট্টা বীজের দাম ১৩৫% বেড়ে গেছে। ভারতে বি টি তুলার বীজের দাম এর আবির্ভাবের পর থেকে ২০১৩ পর্যন্ত ৮০০০% বেড়ে গেছে এবং মহারাষ্ট্রে তুলাচাষিদের মধ্যে বছরে গড়ে ৩,৭৫০ জনের আত্মহত্যার সঙ্গে বীজের এমন মূল্যবৃদ্ধি তথা কৃষি উৎপাদনের খরচ বৃদ্ধি কে দায়ী করেছেন Dr Vandana Shiva। Right Livelihood Award বিজয়ী এই লেখিকা দাবি করেছেন ভারত সরকারের হিসেবে গ্রাম্য কৃষকদের কৃষি ঋণের ৭৫%ই কৃষি পন্য ক্রয় সংক্রান্ত ঋণ।

জিনগত বিকৃতিকরন একমুখী প্রক্রিয়া (Irreversible) যা প্রাকৃতিক বিবর্তনে সরাসরি হস্তক্ষেপ। প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যর জন্য হুমকিস্বরূপ এই জিন বিকৃতিকরন সারা বিশ্বের সচেতন মানুষের তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন। বাংলাদেশে বিকৃতজিন বেগুন বাজারজাতকরনের পাঁয়তারার এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমগুলি অদ্ভুত নীরবতা পালন করছে। উবিনিগ (UBINIG) নামের একটি সংগঠন বেশ কিছু সাহসী উদ্যোগ ও প্রতিবাদ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বিকৃতজিন খাদ্য বাজারজাতকরনের সকল উদ্যোগ প্রতিরোধে সচেতন শ্রেণীর এগিয়ে আসা উচিত। বাংলাদেশ সরকারেরও উচিত এ ব্যাপারে রাখঢাক না করে আরও খোলাখুলি আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টি করা।

লেখকঃ অভি

    তথ্যসূত্রঃ

http://www.thedailystar.net/beta2/news/brinjal-modified/
http://ftp.app.com.pk/en_/index.php?option=com_content&task=view&id=98964&Itemid=2
http://www.centerforfoodsafety.org/press-releases/2209/supreme-court-rules-against-farmers

http://www.bibliotecapleyades.net/ciencia/ciencia_geneticfood36.htm
http://rt.com/news/monsanto-europe-gmo-food-309/
http://www.ubinig.org/
http://www.huffingtonpost.com/2010/01/12/monsantos-gmo-corn-linked_n_420365.html
http://www.sciencebeing.com/2013/02/bt-brinjal-and-its-controversy-in-india/
http://www.sourcewatch.org/index.php/History_of_Roundup_Ready_Soybeans
http://www.youtube.com/watch?v=eUd9rRSLY4A
http://www.worldhunger.org/articles/Learn/world%20hunger%20facts%202002.htm#Does_the_world_produce_enough_food_to_feed_everyone
http://www.usda.gov/wps/portal/usda/usdahome?navid=DATA_STATISTICS
http://www.naturalnews.com/026334_soy_research_Roundup.html
GMO Myths and Truths by EarthOpenSource, June 2012

Benachour, N., Seralini, G.E. Glyphosate formulations induce apoptosis and necrosis in human umbilical, embryonic, and placental cells. Chemical Research in Toxicology, 2009. 22: p. 97-105