৭১ এ মোটামুটি যৌবনই ছিল তার। তখন যাদের যৌবন বা তারুণ্য ছিল তাদের অনেকেই জীবন তুচ্ছ করে যুদ্ধে গেছে হায়েনাদের কাছ থেকে নিজেদের মা-বোন-বাবা-ভাই ও মাটিকে বাঁচাতে, মাটি ও মানুষের জীবন ও সম্মান রক্ষা করতে। আর কেউ কেউ তাদের বিক্রি করতে প্রাণপাত করেছে। আমাদের মাটি, মানুষ ও সম্মান পাকিদের হাতে তুলে দিতে গোল্লা তথা গোলাম আযম রাজাকারও যুদ্ধ করেছিল প্রাণপণ। ৭১ এ কী এমন অপরাধ করেছিল গোল্লা রাজাকার! এমন কিছুই তো নয়। আমার কিংবা আপনার বা তার নিজের কন্যাকে, মাকে, বোনকে পাকিদের দেহরঞ্জনের জন্য উপহার স্বরূপ তুলে দিয়েছিল তাদের হাতে। তার ভাগ সেও পেয়েছিল। তার কন্যা বা মায়ের দেহের সুধা সেও পান করেছিল উল্লাস ভ’রে। কুকুরের মতন নিজের দেশের মেয়েদের মাংস সে নিজেও ছিঁড়ে খেয়েছিল। এ আর এমন কি অপরাধ! এ জন্য তার শাস্তি নয় বরং পুরষ্কারই প্রাপ্য।

কিছু মুক্তিকামী, নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছিল নিজ হাতে। আর কিছু মানুষকে হত্যার জন্য তুলে দিয়েছিল হানাদারদের হাতে। পুড়িয়েছিল কিছু বাড়িঘর, কিছু গ্রাম, কিছু শহর, কিছু জনপদ, কিছু ফসলের মাঠ, কিছু মাটি। কয়েক নদী কিংবা কয়েক সাগর রক্ত ঝরিয়েছে, কেড়ে নিয়েছে সংখ্যাহীন প্রাণ। এ জন্য কি কারুকে বিচারের আওতায় আনা যেতে পারে? মোটেই না। তাকে তো তার অনবদ্য কাজের জন্য সম্মানিত করা উচিত।

কিছু মালাউনকে প্রাণের ভয় দেখিয়ে জোরপূর্বক ছহীহ দীনের পথে এনে দোজাহানের কিছুটা অশেষ নেকীও সে হাছিল করেছিল। সে নিজে নেকী লাভ করার খায়েসে কিন্তু এ নেক কাজ করেনি। সে নিজে তো এক নির্লোভ, এক নির্মোহ মাওলানা ব্যক্তি। করেছিল তা মালাউনের বাচ্চাদের নেকীর জন্য। তারা তো বংশ পরম্পরায় মালাউন হয়েই জন্মাত, মালাউন অবস্থাতেই মরে গিয়ে অনন্ত জাহান্নামে পুড়তে পুড়তে যাক্কুম খেতে থাকত।বেচারাদের ইহকাল পরকাল সবই বৃথা হচ্ছিল। গোল্লা রাজাকারের সহ্য হচ্ছিল না তাদের এই অনন্ত নরকযাত্রা, জ্বালাপোড়া ও যাক্কুমভক্ষণ। তার কোমল হৃদয় কেঁদে উঠল তাদের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মুক্তির তরে। তাই তো তাদেরকে সে জোরপূর্বক দিনের আলোয় দীনে দীক্ষিত করে তাদেরই অশেষ উপকার সাধন করেছে। এখন বংশ পরম্পরায় পূর্বপুরুষ মালাউনের সন্তানেরা ছহীহ দ্বীনী হয়ে জন্মানর অতঃপর ইন্তেকাল করার অপার সুযোগ ভোগ করতে পারছে, এবং ইন্তেকালের পরে যাক্কুমের বদলে আঙুর বেদানা খাওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছে। এটা ত গোল্লা রাজাকারের একটা মহৎ অবদান। এ জন্য তাকে অবশ্যই পুরস্কৃত করা দরকার। আরো ৯০ বছরের হায়াত বা তার সমমানের কিছু তাকে দিতেই হবে।

আরো কত মালাউন যে গোল্লা ও অন্য রাজাকারদের অত্যাচার ও ভয়ে নিজেদের বাস্তুভিটে ফেলে, মাটি ফেলে, গরুছাগল ফেলে,হাঁসমুরগি ফেলে, নিজহাতে বোনা লাউ-কুমড়ো গাছ ফেলে, পুকুর ফেলে, পুকুরের মাছ ফেলে, জন্ম-জন্মান্তরের নাড়ির তীব্র টান উপেক্ষা করে এক কাপড়ে প্রাণ বাঁচানর জন্য শুধু প্রাণটুকু নিয়ে চিরতরে ভারতে পালিয়ে গেছে তার কোনো হিসেব নেই। এই নেক কাজের জন্যও তার পুরষ্কার প্রাপ্য আরো ৯০ বছর হায়াত। মুছলমান দেশে মালাউন থাকবে কোন যুক্তিতে? আমরা মালাউনমুক্ত বাংলা মুছলিম দেশ চাই।

কত মালাউন যে গোল্লা রাজাকার, তার দোসর ও হানাদারদের ভয়ে কলেমা মুখস্থ করেছে, সূরা মুখস্থ করেছে, নামাজ পড়তে শিখেছে তার কোনো হিসেব কি আছে? এ জন্যও তার পুরষ্কার পাওয়া উচিত নয় কি?

তারপর যুগ-যুগান্তর পেরিয়ে গিয়েছে। সেই আগুন এখনো জ্বলছে, সেই রক্ত এখনো ঝরছে, সেদিনের তরুণী ধর্ষিতা আজ বৃদ্ধা হয়ে গেছেন; তবুও তাদের দুঃসহ যাতনা আজো তেমনি দুঃসহ আছে। সেই স্বজন-হারারা আজো আছে স্বজন-হারা হয়ে, আজো তারা যন্ত্রণা বহন করছে। সেই প্রাণ রক্ষার্থে গৃহত্যাগী মালাউনেরা আজো ফিরে আসেনি নিজ ভিটিতে। তাদের ভিটেমাটি ত সেই কবেই দখল করে ফেলেছে অন্য কেউ। রাজাকার ও হানাদারদের ঔরসজাত যুদ্ধ-শিশুদের অনেকেই আজো পথের কুকুরের মতন ঘুরছে। যুদ্ধে যাওয়া খোকা আজো ফিরে আসেনি ঘরে। মা তার পথ চেয়ে চেয়ে কেঁদে কেঁদে মরে গেছে পথে ধারে উন্মাদিনী বেশে। আজো আমাদের অশ্রুর সাগরে হৃৎপিণ্ড হতে বিন্দু বিন্দু রক্ত ঝরে পড়ে। আজো স্বজনের রক্তের সাগরে আমাদের ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়ে। পদ্মা, মেঘনা, ইছামতী, ব্রহ্মপুত্রে রক্ত আর অশ্রু একাকার হয়ে আজো হু হু করে বইছে। এভাবেই তো যাচ্ছিল দিনরাত্রি, বছর, যুগ। এত যুগ পরে হঠাৎ করে যেন একটি ক্ষীণ প্রদীপের ঝিলিক দেখতে পেলাম আমরা। ক্ষতের মধ্যে একটু স্নেহের পরশের মতন বোধ করলাম। কেউ যেন অশ্রু মুছিয়ে দিতে এলো। বললো, আর কেঁদো না, ন্যায় বিচার পাবে তোমরা। আমরাও অশ্রু মোছার চেষ্টা করলাম। ন্যায়বিচার দেখার আশায় অপলক, অধীরে তাকিয়ে রইলাম।

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতার কন্যা আমাদেরকে আশান্বিত করেছিলেন, স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন সেই সকল যুদ্ধাপরাধীদের ন্যায় বিচার করবেন ব’লে। আমাদের রক্তঝরা বিক্ষত প্রাণে, অশ্রু-ঝাপসা চোখে একটু আশার আলো জ্বলে উঠেছিল, একটু সান্ত্বনার পরশ লেগেছিল পোড়ামনে। সুবিচার পাবো আশা করিয়েছিলেন তিনি। আমরাও করেছিলাম আশা ও ভরসা। দেখলাম বহুযুগের পরে সুবিচার। জাতির পিতার কন্যা আমাদের সুবিচার দেখালেন। এমন সুবিচার, এমন সুনাটক জীবনে আর দেখিনি। প্রাণ জুড়িয়ে গেল। আমরা যে এই নাটক বুঝতে পেরেছি সেই ব্যাপারটুকু কি তিনি অন্তত বুঝতে পেরেছেন? যদি পেরে থাকেন তাকে অনুরোধ করছি, বন্ধ করুন অযথা অভিনয়, অহেতুক নাটক। প্রকাশ্যে তাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলুন, রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত করুন তাদের; অন্যেরা যেমন করে থাকে। ধোঁকাবাজিতার অহেতুক পরিশ্রম থেকে বিরত থাকুন দয়া করে। কাটা ঘায়ে লবণ-মরিচের ছিটা দেবেন না দয়া করে।

বাংলাদেশের বয়োজ্যেষ্ঠতম রাজাকারগুরু মাত্র ৯১ বছর বাংলার জল-হাওয়া-অন্ন-বস্ত্র-মাটি ধ্বংস করে করে বেঁচেবর্তে আছেন। বাংলাদেশের মুরুব্বি হয়ে, মাথার মণি হয়ে, মর্ত্যের কিংবদন্তী জান্নাতবাসী হয়ে, বাংলার আকাশের নক্ষত্র হয়ে আরো ৯০ বছর এই বাংলাদেশ-বিরোধী ছহীহ ছালামতে বেঁচেবর্তে থাকুন আমাদের সবার মাথার উপরে, এটাই মহামান্য বিচারক তথা বর্তমান সরকার তথা জাতির জনকের কন্যার একান্ত কাম্য। মর্ত্যেই জান্নাতবাসী রাজাকারপিতা না চাইতেই জান্নাতী খানাপিনা যথা; আঙুর, বেদানা, কলার কাঁদি, মাছের কলিজু, পক্ষীমাংস, দুম্বার রোস্ট, দুধের শরবত হাজির তার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কামরায়। তার হাত পা টিপে দেবার জন্য গেলমান মজুত সর্বক্ষণ। অভাব কেবল হুরীর।

বাংলাদেশে কত শিশু ফুটপাতে না খেয়ে কেঁদে মরছে, কত মানুষ খোলা আকাশের নিচেও শোবার জায়গা পাচ্ছে না। কত মুক্তিযোদ্ধা মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। আর নিরাপদ, নিশ্চিন্ত জান্নাতী সুদীর্ঘ জীবনের লাইসেন্স ও নিশ্চয়তা পাচ্ছে বাংলাদেশের চরমতম শত্রু। সেই অশ্রুঝরা, রক্তঝরা দুর্বিসহ বেদনা নিয়ে তবুও ভালই ছিলাম বলতে হয়। কারণ এই সুবিচারের সুনাটক দেখার পর কেমন আছি সেই অনুভূতি ব্যক্ত করবার ভাষাও নেই।