বইয়ের নাম- A History of Anthropology
লেখক- Thomas Hylland Eriksen and Finn Sivert Nielsen

অধ্যায় একঃ সূচনা

নৃতত্ত্ববিদদের অস্তিত্ব কতো আগে থেকে? এই বিষয়ে মতামত নানারকম হতে পারে। প্রশ্নের উত্তরটা মুখ্যত নির্ভর করে কেউ একজন নৃতত্ত্ববিদ বলতে আসলে কী বোঝাচ্ছেন। নিকটবর্তী এবং দূরবর্তী- এই দু ধরণের মানুষ সম্পর্কে মানুষের আগ্রহ চিরকালের। তারা যেমন এইসব মানুষদের বিষয়ে মুখরোচক আলাপ করত তেমনি আবার তাদের সাথেই লিপ্ত হত লড়াইয়ে। কখনো বা পরস্পরের সাথে বিবাহ বন্ধনেও আবদ্ধ হতে দেখা যেত তাদের। এই নিয়ে রচিত হয়েছে কতশত আখ্যান আর পুরাণকথা। এইসব আখ্যান কিংবা পুরাণকথার কিছু কিছু লিখে রাখা হয়েছে। পরবর্তীতে এই সৃষ্টিগুলো সমালোচিত হয়েছে ভুল কিংবা স্বজাত্যকেন্দ্রিক (এথনোসেন্ট্রিক) ব’লে- সোজা বাংলায় যাকে বলা হয় বর্ণবাদী। ভিন্ন ভিন্ন এইসব আখ্যান পরস্পরের সাথে তুলনা করে ‘অন্য মানুষ’ সম্পর্কে আরও ‘সাধারণ ধারণা’ লাভের প্রয়াস নিয়েছে মানুষ। এক্ষেত্রে, আমরা বলতে পারি একটা নৃবৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের সূচনা তখনই হয় যখন একজন আগন্তুক তাঁর প্রতিবেশীর গৃহে প্রবেশ করেন।

আমরা যদি নৃবিজ্ঞানকে একটা বৈজ্ঞানিক শৃঙ্খল হিশেবে সংগঠিত হওয়ার কথা বলি, তাহলে কেউ কেউ হয়তো এর আদিমূল খুঁজতে গিয়ে ইউরোপীয় এনলাইটেন্মেন্টের সময়ের কথা বলবে; অন্যরা হয়তো বলবে ১৮৫০ এর আগে নৃবিজ্ঞান বিজ্ঞান হিশেবে বিকশিত হয় নি। এবং আরও অনেকে বলবে, এই সময়ের নিমিত্তে যে নৃবৈজ্ঞানিক গবেষণার কথা বুঝি- তার সূচনা হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে। আমরা এই দ্ব্যর্থতাও বাতিল করতে পারি না।

যাই হোক, নৃবিজ্ঞান- যাকে বলা হয় ‘মানবতার বিজ্ঞান’- তার উদ্ভব হয়েছিল সেই অঞ্চলে যাকে কী না আমরা সাধারণত এবং একই সাথে ভ্রমাত্মকভাবে বলি থাকি ‘পশ্চিম’; লক্ষণীয়ভাবে তিন কিংবা চারটা ‘পশ্চিমা’ দেশে; ফ্রান্স, গ্রেইট ব্রিটেইন, যুক্তরাষ্ট্র, এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের জার্মানিকে। ঐতিহাসিকভাবে বলতে গেলে, এটা একটা ইউরোপিয় জ্ঞানভাষ্য, এবং এর পরিকল্পকেরা, অন্যান্য সব ইউরোপিয়ান বিজ্ঞানের মতো এই বিষয়ের আদিমূল খুঁজতে গিয়ে প্রাচীন গ্রিসের শরণাপন্ন হয়েছেন।

হেরোডেটাস এবং অন্যান্য গ্রিকেরা

নৃবিজ্ঞানী, ঐতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিকদের নিরলস গবেষণার জন্যে তাদের ধন্যবাদ প্রাপ্য, কেননা তাঁদের গবেষণার বদৌলতেই আমরা জানি- প্রাচীন গ্রিক সামগ্রিকভাবে আমাদের থেকে মোটামুটি ভিন্নরকমের ছিল। প্রাচীন গ্রিসের ধ্রুপদি ‘গণতান্ত্রিক’ নগর রাষ্ট্রের অর্ধেকের বেশি মানুষ ছিল দাস। সাধারণ নাগরিকেরা কায়িক পরিশ্রমকে মনে করতো অসম্মানজনক এবং গনতন্ত্রের ধারণা সম্পর্কিত ব্যাপারে (যা আবিষ্কৃত হয়েছিল গ্রিকদের দ্বারাই) প্রতিষ্ঠানগতভাবে আধুনিক সংবিধান থেকে তাদের সাথে কোয়্যাকিউটল (Kwakiutl) পোটল্যাচ(potlatch) ভোজেরই বেশি সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায় (এ ব্যাপারে চতুর্থ অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে)।

গ্রিকদের সেইসব ব্যাপারে আলোচনা করা বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, এবং তাদের জগত সম্পর্কে আমাদের ধারণা লাভের প্রক্রিয়াটা বলতে গেলে অনেকটা আঁচড় পড়া ধোঁয়াটে গ্লাসের ভেতর দিয়ে দৃষ্টি দেয়ার মতো। সেদিকে দৃষ্টিপাত করলে আমাদের চোখে ভেসে ওঠে লৌহযুগের প্রথাগত ছোট ছোট নগর রাষ্ট্রের কথা- যার চারদিকে শস্যভূমি দ্বারা আবৃত ছিল, এবং সমুদ্রপথের বাণিজ্যের মাধ্যমে বাইরের পৃথিবীর নগরভিত্তিক জনপদের সাথে তাদের একটা যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। এই যোগাযোগের ব্যপ্তি ছিল ভূমধ্যসাগরীয় উপকূল থেকে শুরু করে কৃষ্ণ সাগরীয় উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত। বিলাসবহুল দ্রব্য ও দাস বাণিজ্যের মাধ্যমে তারা যথেষ্ট পরিমাণ সম্পত্তির অধিকারী হওয়ায় পলিসের (polis) নাগরিকেরা মন্দির, স্টেডিয়াম, স্নানাগার এবং সর্বসাধারণের জন্যে অনেক স্থাপনা তৈরি করেন। কায়িক পরিশ্রম সম্পর্কে যথেষ্ট অনীহা এবং প্রচুর উদ্বৃত্ত সম্পত্তির মালিক হওয়ার ফলে পুরুষ নাগরিকেরা এইসব জায়গায় এসে পৃথিবীর গতিবিধি সম্পর্কিত দার্শনিক বিতর্ক এবং ভাবনাচিন্তায় মগ্ন হতেন।

হ্যালিকারনাসাসের হেরোডটাস এরকম একটা সমাজেরই মানুষ। হেরোডটাস জন্মগ্রহণ করেছিলেন এখনকার তুরস্কের দক্ষিন পশ্চিমের এক গ্রিক উপনিবেশিক শহরে। তরুণ বয়স থেকেই তিনি বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন এবং গ্রিকদের সাথে বাইরের যেসব মানুষদের যোগাযোগ ছিল নানা কারণে- এই ভ্রমণের মাধ্যমে তাদের সম্পর্কে গভীর ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। আজকের দিনে হেরোডটাসকে সাধারণত স্মরণ করা হয় তার ‘পারস্য যুদ্ধের ইতিহাস’ এর জন্যে, কিন্তু এছাড়াও তিনি তার পশ্চিম এশিয়া এবং মিশর ভ্রমণের ধারাবাহিক বর্ণনা এবং কৃষ্ণ সাগরের উত্তর উপকূলের সায়দিয়ানদের সম্পর্কে নানা রকমের তথ্য পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লিপিবিদ্ধ করে গিয়েছিলেন। যদিও আজকের বিশ্ব থেকে এই রচনাগুলো অনেক ভিন্ন প্রেক্ষাপটের, তবুও এইসব আখ্যানে আমরা একটা নৃবৈজ্ঞানিক সমস্যার কথা ঘুরেফিরে নানাভাবে লক্ষ্য করতে পারি, সেটা হচ্ছে- আমরা নিজেরা ‘অন্য’-দেরকে কোন মানদণ্ডে বিবৃত করবো? তারা কি আমাদের থেকে ভিন্ন, না কি তারা আমাদের মতোই? অনেক নৃবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব এই অবস্থান সম্পর্কে একটা সমতা অর্জনের চেষ্টা করেছে, ঠিক যেমনটা হেরোডটাস করেছিলেন। এইসব বর্ণনা দিতে গিয়ে মাঝে মাঝে তিনি পক্ষপাতদুষ্ট সভ্য ‘এথনোসেন্ট্রিক’ মানুষের মতো আচরণ করেছেন, যে কী না অপরিচিত সবকিছুই অবজ্ঞা করেন। আবার মাঝে মাঝে তিনি এটা বুঝতে পেরেছেন, নানা রকমের মানুষেরা ভিন্ন ভিন্ন মূল্যবোধের অধিকারী হন পরিবেশগত ভিন্নতার কারণে, এবং এই ভিন্ন ভিন্ন রকমের মূল্যবোধকে নৈতিকতার বিচ্যুতি বলা যায় না। হেরোডটাসের ভাষা, পোশাক, রাজনীতি এবং বিচারসংক্রান্ত বর্ণনা আজকের দিনেও পঠনযোগ্য। তিনি কিছু কিছু ব্যাপারে সম্পূর্ণ ভুল থাকা সত্ত্বেও তাকে একজন বিচক্ষণ পণ্ডিত বলে অবশ্যই স্বীকৃতি দিতে হবে- যার বই কিছু কিছু ক্ষেত্রে সুদূর অতীতের একমাত্র লিখিত তথ্যের উৎস।

অনেক গ্রিকই এই দার্শনিক কূটাভাসের ব্যাপারে তাদের মতামত দিয়েছেন যেটা সরাসরি ‘অন্য’-দেরকে কীভাবে বিবৃত করবো- এই সমস্যার সাথে সম্পর্কযুক্ত। এটা হচ্ছে বৈশ্বিকতাবাদ (universalism) বনাম আপেক্ষবাদের (relativism) কূটাভাস। আজকের যুগের একজন বৈশ্বিকতাবাদী চেষ্টা করবে প্রত্যেক সমাজের মধ্যে সাধারণ মিল ও অভিন্নতাগুলো (যা কী না সার্বজনীন) খুঁজে বের করার, অপরদিকে একজন আপেক্ষবাদী জোর দিবেন প্রত্যেক সমাজ এবং সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য এবং বিশেষত্বের ওপর। অ্যাথেন্সের সোফিস্টদের বলা হয়ে থাকে ইউরোপীয় ইতিহাসের প্রথম আপেক্ষবাদী ধারার প্রবর্তক (একই সময়ে এশিয়ার নানা চিন্তাবিদ যেমন গৌতম বুদ্ধ, কনফুসিয়াস এবং লাও জু এই ব্যাপারে অবগত ছিলেন)। প্লেটোর (৪২৭-৩৪৭ খ্রিষ্টপূর্ব) ‘সংলাপ’ প্রটাগোরাস এবং গরজিয়াসে আমরা সক্রেটিসকে সোফিস্টদের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হতে দেখি। এই দুইপক্ষ সুশোভিত মন্দির কিংবা জাঁকজমকপূর্ণ কোন দালানে গাম্ভীর্যপূর্ণ বৌদ্ধিক তর্কে লিপ্ত হয়ে আছেন, অন্যান্য নাগরিকেরা সেটা উপভোগ করছেন এবং তাদের দাসদের মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে দুই স্তম্ভের মাঝখানে ছায়ার ভেতরে- এরকম একটা দৃশ্যকল্প আমরা সহজেই কল্পনা করতে পারি। যেখানে সক্রেটিসের আস্থা ছিল বৈশ্বিক এক কার্যকারণে যা বৈশ্বিক সত্য নিরূপণ করতে পারে, সেখানে সোফিস্টরা তাদের আপেক্ষবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে যুক্তি দিত যে, সত্য সবসময়ই অভিজ্ঞতার আলোকে ভিন্ন হবে- এবং সম্ভবত একেই আজকের দিনে আমরা সংস্কৃতি বলি।

প্লেটোর ‘ডায়লগ’ এ সাংস্কৃতিক ভিন্নতা নিয়ে সরাসরি কিছু উল্লেখ করা নেই, কিন্তু নগর রাষ্ট্রের দৈনন্দিন জীবনে যে সাংস্কৃতিক বৈপরীত্য বোধের (cross cultural encounters) অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হতো তার স্বপক্ষে সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়। গ্রিকদের বাণিজ্যপথ জিব্রাটার প্রণালী থেকে আজকের দিনের ইউক্রেন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, তাদের পারস্যবাসী এবং অন্যান্য ‘বর্বরদের’ সাথে যুদ্ধও হয়েছিল। ‘বর্বর’ (barbarian) শব্দটার উৎপত্তি গ্রিক থেকে এবং এটা বলতে ভিনদেশিই (foreigner) বোঝানো হতো। গ্রিকরা মনে করতো গ্রিসের বাইরের লোকেরা একটা শব্দই বলতে পারে, সেটা হচ্ছে ‘বার বার বার’ (bar-bar-bar)। একইভাবে রাশিয়াতে জার্মানদের বলা হয় নেমটসি (মূক); এর মানে যারা কথা বলে কিন্তু কিছুই বোঝাতে পারে না।

দার্শনিক এরিস্টটলও (৩৮৪-৩২২ খ্রিস্টপূর্ব) মানুষের আচরণ নিয়ে গভীর ভাবনায় নিয়োজিত ছিলেন এবং প্রজ্ঞাবান দৃষ্টি দিয়ে তা ব্যাখ্যা করারও চেষ্টা করেছেন। তাঁর নৃবৈজ্ঞানিক দর্শনে সাধারণ মানুষ এবং প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য নিরূপণের প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। তাঁর ভাষ্যমতে, প্রাণীর সাথে মানুষের কিছু চাহিদার ব্যাপারে সাদৃশ্য লক্ষ্য করা গেলেও একমাত্র মানুষই যুক্তি, প্রজ্ঞা এবং নৈতিকতার অধিকারী। তিনি আরও বলেছিলেন, স্বভাবে মানুষ মূলত সামাজিক। বিভিন্ন গোত্রের মানুষের মধ্যকার পার্থক্যের থেকে সাদৃশ্যের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করা এরকম বৈশ্বিক চিন্তাভাবনা নৃবিজ্ঞান এবং অন্যান্য জ্ঞানের শাখায় এখনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আরও বলা যায়, এটা পরিষ্কার যে ইতিহাসের পরিক্রমায় নৃবিজ্ঞান এই বৈশ্বিক এবং আপেক্ষিক অবস্থানে দোদুল্যমান এবং জ্ঞানভাষ্যের কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলোর অবস্থান কোন না কোনভাবে এই পক্ষ কিংবা অন্য পক্ষের (যাকে বলা হয় ‘us’ এবং ‘them’) দিকে ঝুঁকে আছে।

উত্তর-প্রাচীন যুগ

ধ্রুপদী গ্রিক নগর রাষ্ট্রে, শাস্ত্রবদ্ধ বিজ্ঞানের বিকাশই সম্ভবত পরিবেশের পক্ষে অনুকূল ছিল। কিন্তু পরবর্তী কয়েক শতাব্দি ধরে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলগুলোতেও কলা, বিজ্ঞান ও দর্শনের মতো ‘সুসভ্য’ বিষয়ের চর্চা হতো। মেসিডনিয়ানদের পরে হেলেনীয় যুগে সম্রাট অ্যালেকজান্ডার (৩৫৬-৩২৩ খ্রিস্টপূর্ব) তাঁর সৈন্যদলসমেত উত্তর ভারত পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল এবং তারা যেখানেই গিয়েছে, গ্রিক নগর সংস্কৃতির প্রভাব সম্প্রসারণ করতে সক্ষম হয়েছে। তারপর রোম যখন ইউরোপের অধিকাংশ, মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার অধিকর্তা হিশেবে আবির্ভূত হয়, তখন তারাও এই জনগোষ্ঠীর ওপর সাংস্কৃতিক প্রভাব জিইয়ে রেখেছিল; যেই সংস্কৃতির উদ্ভব ও বিকাশ হয়েছিল অনেকটা গ্রিক আদর্শ থেকে। তাই তাদের কাছেও বহুজাতিক সমাজ সম্পর্কিত গ্রিকদের এই ‘অন্য’- দের প্রতি আগ্রহের সংক্রামণ ছিল স্বাভাবিক। সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করে, ভূতাত্ত্বিক স্টারবো (খ্রিস্টপূর্ব ৬৪- ২৩ খ্রিষ্টাব্দ) দূরবর্তী বিচিত্র ধরণের মানুষ সম্পর্কে কয়েক খণ্ডের মোটা মোটা পাণ্ডিত্যপূর্ণ বই লিখেছিলেন যা ছিল আগ্রহ এবং আবিষ্কারে আনন্দে উজ্জ্বল। কিন্তু পরবর্তীতে ইউরোপিয় সাংস্কৃতিক জীবনে মৌলিক পরিবর্তন দেখা দেয় খ্রিস্টান ধর্ম রাষ্ট্রধর্ম হিশেবে স্বীকৃতি এবং রোমান সাম্রাজ্যের পতনের সূচনার মাধ্যমে। গনদের বলা হয় প্রাচীন রোমের সমৃদ্ধশালী জনগোষ্ঠী। বাণিজ্য এবং দাসদের শ্রমের মাধ্যমে প্রচুর ধনসম্পদ অর্জন করায় তারা নিজেদেরকে বিজ্ঞান ও দর্শন চর্চায় নিয়োজিত রাখতে পারত। গন ছিল সামগ্রিক নগর সংস্কৃতি যার দ্বারা পুরো রোম্যান সাম্রাজ্য একটা অখণ্ড রাষ্ট্র (যদিও ঢিলেঢালাভাবে) হিশেবে একীভূত ছিল। জার্মান, স্লভিক, ফিনো আগরিক এবং কেল্টিক প্রথার মতো প্রাক-নগর গ্রিক যুগের অসংখ্য স্থানীয় প্রাচীন সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছিল এই জায়গায়ই। রাজনৈতিকভাবে ইউরোপ সেইসময় অসংখ্য মুখিয়াতন্ত্র, নগর, স্বায়ত্তশাসিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্র দ্বারা বিভক্ত থাকলেও ষোড়শ শতাব্দির দিকে শুধুমাত্র আধুনিক রাষ্ট্রের বিকাশের মাধ্যমে সেটা একটা বড় এককে পরিণত হয়। এই দীর্ঘ সময়ের পরিক্রমায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে রোম্যান সাম্রাজ্যের শেষ সার্বজনীন একক ছিল চার্চ যেটা গোটা ইউরোপ একসূত্রে গেঁথে রেখেছিল। চার্চের তত্ত্বাবধায়নে সন্ন্যাসী এবং পাদ্রিদের একটা সুবিশাল বৃত্ত গড়ে ওঠে এবং বিকাশ লাভ করে। তারা বুৎপত্তিগতভাবে জ্ঞানচর্চার তত্ত্বাবধায়ক হয়ে ওঠেন এবং প্রাচীন যুগের দার্শনিক এবং বৈজ্ঞানিক চর্চার ধারা তারাই অব্যাহত রেখেছিলেন।

ইউরোপিয়ানরা তাদেরকে প্রাচীন যুগের সরলরৈখিক উত্তরাধিকারী হিশেবে দেখতে পছন্দ করলেও পুরো মধ্যযুগে ইউরোপ ছিল অনুন্নত অঞ্চল। ৬০০ এবং ৭০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে আরবেরা স্পেন থেকে ভারত পর্যন্ত পুরো ভূখণ্ড বিজয় করে এবং পরবর্তী সাত শতাব্দি ধরে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার কেন্দ্রস্থল ছিল বাগদাদ এবং কর্ডবার মতো সমৃদ্ধ মহানগরী; রোম বা অ্যাথেন্সের ধ্বংসাবশেষ নয় কিংবা লন্ডন অথবা প্যারিসের মতো উন্নত গ্রামের কথাও উল্লেখ করা অসমীচীন এক্ষেত্রে। এই সময়ের শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক এবং দার্শনিক ছিলেন ইবনে খালদুন (১৩৩২-১৪০৬)। তিনি বাস করতেন এখনকার তিউনিসিয়ায়। তথ্যের উৎস সম্পর্কিত একটা সুশোভিত-দীর্ঘ সমালোচনাসহ তিনি আরব এবং ব্যারব্যারদের (berber) বিশাল ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেন। তিনি সর্বপ্রথম অ-ধর্মীয় সামাজিক তত্ত্বের প্রবক্তা এবং সমাজবিজ্ঞানী ইমাইল দুর্খাইমের বহু পূর্বেই সামাজিক সংহতি (social solidarity) তত্ত্বের ধারণা দিয়েছিলেন( দ্বিতীয় অধ্যায় দ্রষ্টব্য)।


ইবনে খালদুনের এই তত্ত্বকে আজকের দিনের সমাজবিজ্ঞান এবং নৃবিজ্ঞানের অন্যতম ভিত্তি হিশেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। দুর্খেইম এবং প্রথম দিকের নৃবিজ্ঞানীরা যারা তাঁর তত্ত্বকে ব্যবহার করেছেন- তাঁদের মতো তিনিও গোত্রের ভেতরের সংহতি ও পারস্পারিক সৌহার্দ সৃষ্টি এবং তা বজায় রাখার জন্যে তিনি জ্ঞাতিত্ব (kinship) ও ধর্মের ওপর বিশেষ জোর দিয়েছিলেন।

এইসব ডামাডোলের পরেও মধ্যযুগের শেষের দিকের কয়েকটা ইউরোপিয় লেখার নাম উল্লেখ করা যায় যেগুলো পরবর্তী সময়ের নৃবিজ্ঞানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। তন্মধ্যে মার্কো পোলোর (১২৫৪-১৩২৩) প্রায় সাত বছরের চীন ভ্রমণের বর্ণনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই সময়ের পশ্চিম এশিয়া সম্পর্কিত আরেকটা বিখ্যাত ভ্রমণকাহিনীর নামও উল্লেখ করা যায়। ‘The Voyage and Travels of Sir john Mandeville, knight’- চৌদ্দ শতকে রচিত এই ভ্রমণকাহিনীর নাম জানা গেলেও এর রচয়িতার নাম এখনো জানা যায় নি। এই দুইটা বইয়েই ‘অন্য’-মানুষ এবং তাঁদের প্রথা সম্পর্কে ইঊরোপিয়ানদের ধ্যান ধারণা বিবৃত হয়েছে। এরপর অগ্রসরমান মার্কেন্টালিস্ট অর্থনীতি এবং বিজ্ঞান ও কলার ক্ষেত্রে রেনেসার বদৌলতে মধ্যযুগের শেষের দিকে ইউরোপের ছোট ছোট নগররাষ্ট্রগুলো দ্রুত বিকাশ লাভ করা শুরু করে এবং সেসব জায়গায় পুঁজিবাদী শ্রেণীর প্রথম দিকের লক্ষনগুলো দেয় সেইসময়। স্ফুলিঙ্গের ন্যায় এসব সামাজিক পরিবর্তন এবং নতুন বাণিজ্যিক উদ্যোক্তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ইউরোপের শাসকেরা কয়েক দফায় বিশাল বিশাল সমুদ্র যাত্রার উদ্যোগ নেয়। আফ্রিকা, এশিয়া এবং আমেরিকাসম্মুখে এই সমুদ্রযাত্রাগুলোকে পশ্চিমে ‘মহৎ আবিষ্কার’ হিশেবে বর্ণনা করা হলেও ‘আবিষ্কৃত’ মানুষেরা পশ্চিমের এই ‘মহত্ত্ব’ সম্পর্কে প্রশ্ন করার যথেষ্ট খুঁজে পেতে পারে বলে আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি।

ইউরোপিয় বিজয়ের ফলাফল

ইউরোপিয় এই ‘মহৎ’ আবিষ্কারগুলো পরবর্তীতে ইউরোপ এবং সারা পৃথিবীর উন্নয়নের জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং আরেকটু বলতে গেলে- নৃবিজ্ঞানের বিকাশের জন্যেও আবিষ্কারগুলো একইভাবে দরকারি ছিল। পনেরো শতাব্দির শুরু দিকে হেনরি দা নেভিগেটরের পশ্চিম আফ্রিকার উপকূল আবিষ্কার থেকে শুরু করে আমেরিকা সম্মুখে কলম্বাসের (১৪৯২-১৫০৬) পঞ্চম যাত্রা অথবা ম্যাগেলানের (১৫১৯-২২) জলপথে বিশ্ব ভ্রমণ- পর্যটকদের এইসব অভিযান এবং আবিষ্কার ও তাঁর দ্বারা লব্ধ প্রানবন্ত বর্ণনা ইউরোপিয়দের বহির্জগত সম্পর্কিত কল্পনাকে তৃপ্ত করেছিল যেটা সম্পর্কে তারা কোনভাবেই অবগত ছিল না। ১৪৪৮ সালে ছাপখানা আবিষ্কারের পরে খরচের দিক থেকেও এই ধরণের ভ্রমণ পুস্তিকাগুলোর প্রসার খুব সহজ হয়ে ওঠে এবং ছাপখানার সহজলভ্যতার কারণে তুলনামূলক কম খরচে খুব সহজেই ইউরোপের বিশাল জনগণের কাছে পৌঁছে যায়।
সঙ্গত কারণেই এসব ভ্রমণ পুস্তকের অনেকগুলোতেই তথ্যগত ভুল এবং গভীরভাবে খ্রিস্টীয় কুসংস্কার দ্বারা আচ্ছন্ন ছিল। এক্ষেত্রে মানচিত্রবিদ আমেরিগো ভেসপুচ্চির নাম উল্লেখ করা যায়। তিনি বেশ কয়েকটা বিখ্যাত বই প্রকাশ করেন যেগুলো আজো তার নাম স্মরণে রাখতে সাহাজ্য করেছে। তার বইগুলোর বেশ কয়েকবার পুনর্মুদ্রণ এবং অনুবাদ হয় কিন্তু আমেরিকার মানুষজনের (যাদেরকে ‘ইন্ডিয়ান’ বলা হতো, কারণ কলম্বাস মনে করত তিনি ভারতবর্ষে যাওয়ার পথ আবিষ্কার করেছেন) বর্ণনা দেয়ার সময় বাস্তবতা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তিনি হেরোডটাস কিংবা খালদুনের মতো সতর্ক ছিলেন না। ভেসপুচ্চি নিজের সমাজকে সমর্থন করার ক্ষেত্রে ভারতীয়দের সম্পর্কে নিছক মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়েছে। নেটিভ আমেরিকানদের সম্পর্কে তার ভাবনার বহিঃপ্রকাশ হিশেবে তাঁদের বিকৃত অথবা ইউরোপীয়দের সম্পূর্ণ উল্টো বলে উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন- ‘তারা হচ্ছে ঈশ্বরহীন, বিশৃঙ্খল, নগ্ন, কোন শাসন কিংবা আইন নেই, এমনকি তারা নরমাংসভোজী’। ভেসপুচ্চি জোরালো গলায় সামগ্রিক রাজতন্ত্র এবং পোপের ক্ষমতায়নের কথা বলার চেষ্টা করলেও নেটিভদের জীবন সম্পর্কে সেই সময়কার এথনোগ্রাফিক বর্ণনা কার্যত অকার্যকর।

ভেসপুচ্চির সমসাময়িক আরও কয়েকজন আছে- যেমন ফরাসি হুগয়োন জ্যঁ দ্য লেভি। তিনি ভারতীয় জীবন সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ বর্ণনা লিখেছিলেন এবং সেই বইগুলোও ভালো বিক্রি হয়েছিল। কিন্তু দূরবর্তী জায়গা নিয়ে দুঃসাহসিক গল্পের ইউরোপীয় বাজার তখনো তৃপ্ত হতে পারে নি। এই ধরণের বেশিরভাগ বইয়ে, ইউরোপের প্রচলিত কাঠামোর সাথে ‘অন্য’- দের (যারা ছিল নয় মহান অসভ্য (noble savage) অথবা বর্বর) কম বা বেশি কিন্তু স্পষ্ট বৈপরীত্যের বর্ণনা দেয়ার রীতির প্রচলন ছিল (নয় চ্যালেঞ্জ, না হয় সমর্থন দেয়া হ’তো)। পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে আমরা দেখবো, প্রথম দিকের এইসব অস্পষ্ট বর্ণনা সমসাময়িক কালের নৃবিজ্ঞানে গভীর প্রভাব ফেলেছে এবং এইসময়ের নৃবিজ্ঞানীদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ যে- উপনিবেশ, তৃতীয় বিশ্ব, উপসংস্কৃতি কিংবা প্রান্তিক মানুষদের যে বর্ণনা তারা দিয়ে থাকেন, তাতে সেইসব মানুষদের বাস্তবতাকে বিকৃত করে উপস্থাপন করা হয়। ভেসপুচ্চির বর্ণনার ক্ষেত্রে এই সমালোচনাটা করা হয় যে, সে যত না অন্য মানুষদের সম্পর্কে তার নৃবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়েছে তার থেকে নিজের পটভূমি বেশি বিবৃত করেছে।

আমেরিকা বিজয় ইউরোপিয় বুদ্ধিজীবীদের একটা যথার্থ বৈপ্লবিক অবস্থানের সম্মুখীন করে দেয়। এটা শুধু সাংস্কৃতিক পার্থক্য সম্পর্কেই তাঁদের আগ্রহকে উদ্দীপিত করে নি- তারা সাথে সাথে এটাও বুঝতে পারলো একটা সম্পূর্ণ মহাদেশ তারা আবিষ্কার করেছে যেটার কথা বাইবেলে উল্লেখ করা নেই। এই ধর্মহীন অন্তর্দৃষ্টি ইউরোপিয় সেইসময়ের চলতি বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের ধর্মনিরপেক্ষিকরণ, চার্চের হস্তক্ষেপ থেকে বিজ্ঞানের মুক্তি এবং নৈতিকতা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যজনিত ব্যাপারে চিন্তার আপেক্ষিকরণকে উদ্দীপিত করেছিল। টর্ডভের (১৯৮৪) মতে, মানুষ বলতে কী বোঝায়- ইউরোপের এই ধারণার ব্যাপারে ভারতীয়রা একেবারে মর্মমূলে আঘাত করে। ভারতীয়রাও মানুষ ছিল, কিন্তু তাঁদের ব্যবহার তেমন ছিল না যেটাকে ইউরোপিয়রা মানুষের পক্ষে ‘স্বাভাবিক’ বলে জানত। তাহলে মানুষ বলতে কী বোঝাতো? কোনটাই বা স্বাভাবিক? মধ্যযুগে দার্শনিকেরা মনে করত ঈশ্বর একবার এই বিশ্ব একেবারে সৃষ্টি করে এইখানের বসবাসকারীদের নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্য দান করেছেন যেটা তারা নিজেদের মধ্যে বজায় রাখে। এইসময় এটা জিজ্ঞেস করা ক্রমেই সম্ভব হয়ে উঠছিল যে, ভারতীয়রা মানবতার বিকাশের ‘প্রথম স্তরে’ অবস্থান করছিল। এই প্রশ্ন পালাক্রমে প্রগতি এবং উন্নয়ন সম্পর্কিত প্রাথমিক ধারণার দিকে চালিত করে যেটা মধ্যযুগের স্থির বিশ্ব সম্পর্কিত ধারণাকে যুক্তিগতভাবে ভেঙেচুরে দেয়। নৃবিজ্ঞানের পরবর্তী ইতিহাসে, উন্নয়ন এবং প্রগতি বিষয়ক ধারণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু প্রগতি যদি সম্ভব হয়, এটা মানুষের কার্যক্রম দ্বারাই সম্ভব হয়ে ওঠে। মানুষেরা নিজেদের লক্ষ্য নিজেরা নির্ধারণ করে- এই ধারণা নৃবিজ্ঞানে আরও বেশি গ্রহণযোগ্য।

এইভাবে, ইউরোপিয়রা যখন নিজেদেরকে ভারতীয়দের আয়নায় পরখ করে দেখল, তখন আবিষ্কার করল তারা অনেক বেশি স্বাধীন, স্বতন্ত্র আধুনিক। বৈষয়িক স্বাধীনতাজনিত এই নতুন মতের সবচেয়ে জোরালো অভিব্যক্তির কথা বলতে গেলে ফরাসি দার্শনিক মিশেল দ্য মন্তেইনের (১৫৩৩-৯২) ‘essays’ (১৮৫০) এর কথা বলতে হবে। ইউরোপের সেই সময়ের অপ্রচলিত উদারনৈতিক এবং ব্যক্তিগত আঙ্গিকে মন্তেইন ছোট বড় বিভিন্ন ব্যাপার নিয়ে ভেবেছিলেন। তার সমসাময়িক অন্যান্যদের পথে না এগিয়ে মন্তেইন তার দূরবর্তী মানুষ সম্পর্কিত লেখাতে যা প্রকাশ করেন তাতে তাকে আজকের দিনের একজন সাংস্কৃতিক আপেক্ষবাদী (cultural relativist) বলে স্বীকৃতি দেয়া যায়। তার ‘ক্যানিবাল সম্পর্কিত’ (Of cannibals) রচনায় তিনি এই বলে সিদ্ধান্ত টানেন যে, তিনি যদি একটা নরমাংসভোজী গোষ্ঠীতে জন্মগ্রহণ এবং বড় হতেন, তিনিও সম্ভবত নরমাংস খেতেন। এই রচনাতেই তিনি ‘মহান অসভ্য’ (the noble savage, le bon sauvage) পরিভাষাটার প্রথম ব্যবহার করেন এবং পরবর্তীতে এই পরিভাষাটা রুশোকে অনুপ্রাণিত করেছিল।

চলতি শতাব্দীগুলোতে, ইউরোপিয় সমাজ বিভিন্ন জটিলতার মধ্যে দ্রুত হারে বিকাশ লাভ করতে শুরু করে এবং বাণিজ্য, যুদ্ধ, মিশনারি কার্যক্রম, উপনিবেশিকরণ, দেশান্তরে গমন এবং গবেষণার মাধ্যমে সাংস্কৃতিক বৈপরীত্য ক্রমেই বাড়তে থাকে। এই সময়ে শেক্সপিয়ারের নাটক থেকে শুরু করে র‍্যামোর লিব্র্যাটোতে (libretto) তথা ইউরোপিয় সংস্কৃতিতে ‘অন্য’-রা ক্রমেই দৃশ্যমান হয়ে উঠতে থাকে এবং দেকার্ত (১৫৯৬-১৬৫০) থেকে শুরু করে নিতশে (১৮৪৪-১৯০) পর্যন্ত সকল প্রধান দার্শনিকেরা মানুষের আচরণ সম্পর্কিত তাঁদের নিজেদের দার্শনিক নৃবিজ্ঞানের মতবাদ প্রকাশ করা শুরু করে। এইসব মতবাদের ভিত্তি ছিল অ-ইউরোপীয় মানুষ সম্পর্কিত তৎকালীন সময়ের জ্ঞান এবং বিশ্বাস। কিন্তু এইসব বেশিরভাগ বর্ণনায় ‘অন্য’-দের ভূমিকা ছিল নিষ্ক্রিয়। এই লেখকেরা অ-ইয়রোপিয়দের জীবনযাত্রার দিকে দৃষ্টিপাতের থেকে ইউরোপিয় সমাজের প্রচলিত ইউরোপিয় বিতর্কের আলঙ্কারিক জ্বালানি হিশেবে তাঁদের ব্যবহার করতেই বেশি সজাগ ছিলেন।

এটার বড় একটা উদাহরণ হিশেবে বলা যায় সতেরো আঠারো শতকের অভিজ্ঞতাবাদী (empiricist) বনাম যুক্তিবাদীদের (rationalist) সেই বিখ্যাত দার্শনিক বিতর্ক। ব্রিটিশ দার্শনিকেরা যেমন জন লক (১৬৩২-১৭০৪) ছিলেন উল্লেখিত প্রথম ঘরানার দার্শনিক। লক মনে করতেন জন্মের সময় মানুষের মন হচ্ছে শূন্য স্লেটের মতো (tabula rasa); আমাদের সকল চিন্তাভাবনা, মূল্যবোধ এবং ধারণা হচ্ছে আমাদের অভিজ্ঞতার ফসল অথবা বিশ্ব সম্পর্কিত ইন্দ্রিয়লব্ধ অভিজ্ঞতা (sense impression)। মানুষ অভিন্ন হয়ে জন্মগ্রহণ করে, কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তারা ভিন্নতা লাভ করে। এখানে লক সামাজিক বিজ্ঞানের জ্ঞানতাত্ত্বিক ভূমিতে একইসাথে বৈশ্বিকতাবাদী নীতি (আমরা অভিন্ন হয়ে জন্ম গ্রহণ করেছিলাম) এবং আপেক্ষবাদী নীতির (আমাদের অভিজ্ঞতা সবাইকে ভিন্ন করে দেয়) সমন্বয় ঘটান। কিন্তু সতেরশো শতাব্দীতে দার্শনিকেরা আমাদের থেকে কম অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হওয়ার কারণে লকের মতো মানুষের পক্ষে তত্ত্ববিদ্যার আলোচনা থেকে রাজনৈতিক ভাষ্যে সরাসরি পদক্ষেপ নেয়ার মতো ঘটনা বেশ স্বাভাবিক ছিল। ফলে লকের অভিজ্ঞতাবাদ ক্রমসূত্রে সরাসরি তার রাজনৈতিক ভাষ্যে ‘প্রাকৃতিক নিয়ম’ (natural law) এর নীতি প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করে যেটাকে বলা হয় মানবাধিকার সম্পর্কিত সার্বজনীন আধুনিক ধারণার স্তম্ভ। প্রত্যেক মানুষ জন্মগ্রহণের সাথে সাথে কিছু সহজাত অধিকার নিয়ে জন্মায়- এই ধারণা আমাদের মধ্যযুগের কথা মনে করিয়ে দেয় যখন টমাস অ্যাকুইনাস বলেছিলেন (১২২৫-৭৪) মানুষের অধিকার ঈশ্বর কর্তৃক প্রদত্ত। কিন্তু সতেরো শতাব্দীতে জন লক কিংবা টমাস হবসের (১৫৮৮-১৬৭৯) মতো দার্শনিকেরা দ্বিমত প্রত্যয় করে বললেন- প্রাকৃতিক নিয়মগুলো আসমান ‘প্রদত্ত’ নয়, বরং ব্যক্তির জৈবিক বৈশিষ্ট্যেই তা বিদ্যমান। ফলে এই বিতর্ক মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে- স্বর্গীয় (কিংবা রাজকীয়) কোন অনুগ্রহে নয়, মানুষ হওয়া মাত্রই একজন মানুষের অধিকার আছে। এটা ছিল তখনকার সময়ের মৌলিক একটা অবস্থান। এই অবস্থানকে সরাসরি স্বৈরাচারতন্ত্রের সমর্থক হিশেবে দাঁড়া করানো হলেও (হবস যেটা করেছিলেন) এটার একটা বৈপ্লবিক সম্ভাবনা ছিল। সমগ্র ইউরোপজুড়ে রাজা-রাজপুত্ররা অশান্ত, ক্রমসঞ্চারণশীল ক্ষমতাবান, উদারনৈতিক বুর্জোয়াদের সম্মুখীন হওয়া শুরু করে। তাঁদের দাবি ছিল সম্পত্তির ব্যাপারে ব্যক্তির অধিকার, ব্যক্তির নিরাপত্তা এবং যুক্তিপূর্ণ গণবিতর্কের প্রতি সম্মান দেখিয়ে শাসকদেরও আইন-নিয়ম-নীতি মেনে চলতে হবে। এটা ভাবা নিরাপদ যে, দূরবর্তী মানুষের জীবনযাত্রার থেকে এই ব্যাপারগুলোই লকের কাছে গুরুত্ববাহী ছিল এবং তার দার্শনিক নৃবিজ্ঞান ছিল এর দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত।

আমরা এই বইয়ের পরবর্তী অংশে দেখবো, ব্রিটিশ নৃবিজ্ঞানে ব্রিটিশ অভিজ্ঞতাবাদের প্রভাব আজো প্রাসঙ্গিক। এই ধারার দর্শন স্কটিশ এনলাইটেন্মেন্ট, বিশেষ করে ডেভিড হিউমের দর্শনের মাধ্যমে উৎকর্ষের শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিল। একইভাবে ফরাসি এবং জার্মান নৃবিজ্ঞান ধারাও ইউরোপিয় যুক্তিবাদের স্বাক্ষর বহন করে। এই যুক্তিবাদের প্রধান প্রবক্তা ছিলেন রেনে দেকার্ত। দেকার্ত ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। শরীর-বিদ্যা এবং গণিতেও তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল এবং তাকে বলা হয়ে থাকে আধুনিক দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা। নৃবিজ্ঞানে তাকে স্মরণ করা হয় একদিকে চেতনা ও আধ্যাত্মিক জীবনের এবং অপরদিকে বস্তুগত পৃথিবী ও মানবশরীরের মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য নিরূপণের কারণে। যেখানে ব্রিটিশ অভিজ্ঞতাবাদীরা মনে করেছিল ইন্দ্রিয়ই হচ্ছে বাইরের জগত সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের একমাত্র উৎস, দেকার্ত সেখানে ইন্দ্রিয়কে অস্বীকার করতে চাইলেন। বাইরের জগত সম্পর্কে আমরা যে ধারণা পাই তা শুধুই ধারণা এবং সেই বস্তু সম্পর্কে আমাদের পূর্ববর্তী ধারণার সাপেক্ষে সেটাকে নির্ণয় করতে পারি। জগতকে আমরা দেখি একগুচ্ছ ধারণার মাধ্যমে পরিশুদ্ধ করে। দর্শনের প্রধান কাজ হচ্ছে এটা নিশ্চিত করা যে এমন কোন ধারণা আছে কী না যা প্রত্যক্ষ জ্ঞানের পক্ষে অকাট্য। এই সূত্রধরে তিনি ‘মৌলিক পদ্ধতিগত সন্দেহ’ (radical methodological doubt) মনোভাবের ধারণা পোষণ করেছিলেন। যেসব ধারণা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করা যায় তা সবই অনিশ্চিত এবং কখনোই তা বিজ্ঞানের ভিত্তি হতে পারে না। খুব বেশি ধারণা দেকার্তের এই কঠিন অম্লপরীক্ষা থেকে পার পেতে পারে নি। তাঁর বিখ্যাত বাণী ‘আমি চিন্তা করি, তাই আমি আছি’ (I think, therefore I am) প্রাথমিক নিশ্চয়তা সম্পর্কে ধারণা প্রকাশ করে- আমি নিশ্চিত হতে পারি আমার অস্তিত্ব আছে কেননা আমি জানি আমি ভাবছি। কিন্তু দেকার্ত তাঁর এই নিশ্চয়তা থেকে পরবর্তী সিদ্ধান্তের জন্যে প্রচুর জোর দেন; সেটা হচ্ছে ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কিত নিশ্চয়তা এবং এবং গাণিতিক বিবৃতি সম্পর্কিত নিশ্চয়তা।

লকের মতো দেকার্ত কোন সমাজ-দার্শনিক ছিলেন না, যদিও সে তাঁর সময়েরই সন্তান ছিলেন। তাঁর যুক্তিবাদী জ্ঞানতত্ত্ব জোরালোভাবে অভিজ্ঞতাবাদীদের বিরুদ্ধাচারণ করলেও হবস কিংবা লকের মতো তিনিও ব্যক্তিকে তাঁর জিজ্ঞাস্যের কেন্দ্রে স্থাপন করেছেন এবং ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কিত তাঁর প্রমাণ ব্যক্তির আত্মস্বীকৃতি থেকেই বিকশিত হয়েছে। অভিজ্ঞতাবাদীরাও দেকার্তের মানবিক বৃত্তির যুক্তিকে গ্রহণ করেছিল। অভিজ্ঞতাবাদী এবং যুক্তিবাদী উভয় পক্ষই ধর্মনিরপেক্ষ বিজ্ঞানের প্রস্তাবনা নির্মাণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন এবং এই দুইজনকেই বলা যায় তৎকালীন পশ্চিম ইউরোপের ক্রমবিকাশমান বুর্জোয়াভিত্তিক সমাজকাঠামোর প্রতিনিধি।

তারপরেও এইসবকে কেন নৃবিজ্ঞান বলা যায় না?

প্রাক নৃবিজ্ঞানের ইতিহাস সম্পর্কে অবগত হওয়ার পর আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি, কিছু কিছু ব্যাপার যেগুলো আজকের দিনের নৃবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়- তা প্রাচীনকাল থেকেই নানাভাবে বিতর্কের বিষয় হিশেবে আলোচিত হয়ে এসেছে। অন্যদের সম্পর্কে বহিরাগতরা না হয় আদর্শিক জায়গা থেকে (স্বজাত্যকেন্দ্রিক), আর তা না হলে চিত্রানুগ (সাংস্কৃতিক আপেক্ষবাদী) বর্ণনা দিয়েছেন। এই প্রশ্নটা ঘুরেফিরে বারবার উচ্চারিত হয়েছে- সবজায়গার এবং সবসময়ের মানুষেরা কি মূলত একই রকম (বৈশ্বিকতাবাদ) না কী গভীরভাবে ভিন্ন (আপেক্ষবাদ)। প্রাণী এবং মানুষ, প্রকৃতি এবং সংস্কৃতি, জন্মগত এবং শিক্ষাপ্রাপ্ত, ইন্দ্রিয়গত শরীর এবং চেতন মন- এই ধরণের পার্থক্যগুলো নিরূপণের জন্য মানুষ সবসময়ই সচেষ্ট ছিল। ভিনদেশী মানুষদের খুঁটিনাটি বর্ণনা নিয়ে অনেক বই প্রকাশিত হয়েছে এবং তার মধ্যে কিছু বই মুদ্রিত হয়েছে খুবই সতর্কতা এবং পাণ্ডিত্যপূর্ণ পদ্ধতিতে।

ইতিহাসের এই ধারাক্রম সত্ত্বেও আমরা জানি, নৃবিজ্ঞানের বিকাশ হয়েছে এর থেকেও অনেক পরে । সত্য হলো, আমরা নৃবিজ্ঞানের বিকাশ সম্পর্কে যা ধারণা করি, এটা ছিল তার থেকেও ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। কারণ এ পর্যন্ত আমরা যেসব বর্ণনার কথা পড়ে এসেছি তা মূলত দুই ধরনেরঃ ভ্রমণকথা অথবা সমাজদর্শন। নৃবিজ্ঞানের দুটি আজ্ঞা যখন একীভূত হয় অর্থাৎ তথ্য এবং তত্ত্ব যখন সংহতি লাভ করে, তখনই একটা নৃবৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের সূচনা হয়। দ্বিতীয়ত এবং সম্ভবত সবচেয়ে বিতর্কিত ব্যাপার হচ্ছে, এপর্যন্ত যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তারা সবাই তাঁদের সময় এবং সমাজ দ্বারা প্রভাবিত- এটাও লক্ষ্য করা উচিত। সেটা অবশ্য সমসাময়িক নৃবিজ্ঞানীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কিন্তু আধুনিক নৃবিজ্ঞানীরা একটা আধুনিক পৃথিবীতে বাস করেন এবং আধুনিক প্রকরণের বাইরে নৃবিজ্ঞানের কোন অর্থ নেই। উল্লিখিত নামগুলোর মতো একক কোন চিন্তা থেকে এই শাস্ত্রের বিকাশ হয় নি। এটা একটা সৃষ্ট শাস্ত্র, যার শৃঙ্খল সংগঠিত হয়েছে যখন পুঁজিবাদ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, ধর্মনিরপেক্ষ বিজ্ঞান, দেশপ্রেমমূলক জাতীয়তাবাদ এবং সাংস্কৃতিক আত্মবাচকতার মধ্য দিয়ে ইউরোপিয় সমাজে বড় ধরণের সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক পরিবর্তন সংগঠিত হচ্ছিল।

অন্যদিকে, নির্দিষ্ট কিছু বিষয় সবসময়ই আমাদের আলোচনার কেন্দ্রে ছিল। পনেরো শতকের পর থেকে, নতুন ধারার কিছু চিন্তা এবং সামাজিক কাঠামোর উদ্ভব হয় যা নৃবিজ্ঞান এবং অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের ভিত্তিভূমি নির্মাণে সহায়তা করে।
এই নতুন ঘরানার দুটি ধারণা নিয়ে উপরে আলোচনা করা হয়েছে। প্রথমত, আমরা দেখেছি ‘অন্য’-দের সাথে ইউরোপিয়দের বৈপরীত্যের সম্মুখীন হওয়ার পর ইউরোপিয়ান বুদ্ধিজীবীরা সমাজকে একটা সত্তা হিশেবে দেখার প্রয়াস পেল যেখানে পরিবর্তন এবং বৃদ্ধি ছিল সাধারণ ঘটনা। তারা অনুরণিত হয়ে চোখ মেলে বুঝতে পারল, কম হারে অপেক্ষাকৃত সরল, ছোট ছোট গোত্রের মধ্যে থেকে শুরু করে জটিল এবং শিল্পপণ্যোৎপাদী বড় বড় জাতির মধ্যেও এই ধরণের প্রক্রিয়া বিদ্যমান। কিন্তু উন্নয়ন কিংবা প্রগতির ধারণা সামাজিক পরিবর্তনের প্রবণতার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। ব্যক্তি নিজেও নিজের শিক্ষা এবং জীবিকার মাধ্যমে নিজেকে বিকশিত করে প্রকৃত আত্মানুসন্ধান করতে পারত। ব্রুনো লাটরের (১৯৯১) মতে, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী মানুষের বিকাশ ছিল সমাজ ধারণার পূর্বশর্ত। স্বাধীন ব্যক্তিমানুষ যখন ‘সবকিছুর বিচার্যমান’ হয়ে ওঠেন, তখনই নিয়মতান্ত্রিক বিষয়ের প্রতিফলনরুপে ব্যক্তিমানুষের সংগঠন হিশেবে সমাজ তার ভিত্তিভূমি বিস্তৃত করতে পেরেছিল। ক্রমান্বয়ে উন্নতি এবং পুনর্নির্মাণের মাধ্যমে যেহেতু আরও অগ্রগামী সমাজের উদ্ভব ঘটছিল, সেই সূত্রে তখন স্বাধীন এবং যৌক্তিক ব্যক্তিসত্তার আরও নতুন এবং ভিন্ন কিছুতে রুপান্তরিত হওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেল, এমন কি নারীর প্রতিও সত্য মুখাপেক্ষিতাও বিচার্যবিষয় হয়ে উঠল। এসব সম্পর্কে বিস্তৃত জ্ঞানভাষ্য ছাড়া, নৃবিজ্ঞানের মতো একটা বিষয়ের বিকাশ কখনোই সম্ভব না। আধুনিক দর্শনেই এই ধারনাগুলোর বীজ বপন করা ছিল এবং আঠারো শতাব্দীতে এসে ধারণাগুলোর উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়। কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীতেই নৃবিজ্ঞান একটা একাডেমিক শাস্ত্র হিশেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং আজকের দিনে শিক্ষার্থীরা যে শিক্ষা লাভ করে, সেই কাঠামোর ভিত্তি তৈরি হয়েছিল বিংশ শতাব্দীতেই। আমাদের পরবর্তী অধ্যায়ে আলোচ্য বিষয় হচ্ছে নৃবিজ্ঞান কীভাবে একটা পরিণত শাস্ত্র হিশেবে সংগঠিত হলো। তবে সেই আলোচনায় প্রবেশের পূর্বে আমরা এখন আঠারো এবং উনিশ শতকের প্রথমদিকে প্রচলিত বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন নিয়ে আলোচনা করব।

এনলাইটেনমেন্ট/ আলোকায়ন/ চেরাগি/ দীপায়ন

আঠারো শতকের ইউরোপে বিজ্ঞান এবং দর্শনের একটা অভূতপূর্ব জোয়ার লক্ষ্য করা গিয়েছিল। এই সময়ে, বুর্জোয়ারা আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে এবং এই বিশ্বাসের মাঝে নাগরিকেরা তাঁদের বিশ্ব এবং স্থানের প্রতিফলন ঘটানোর উদ্যোগ নেয়। তারা শীঘ্রই যৌক্তিক, সঠিক, সম্ভাব্য এবং স্বচ্ছ সমাজের পক্ষে রাজনৈতিক দাবি জানায় এবং এইসব দাবিদাওয়ার চাবিশব্দ ছিল এনলাইটেন্মেণ্ট (আলোকায়ন)। হবস, লক এবং দেকার্ত যে দাবি করেছিলেন- স্বাধীন ব্যক্তিসত্তাই জ্ঞান এবং সামাজিক কাঠামোর প্রধান বিচার্য বিষয় , সে দাবির বাস্তবায়ন অনুসারে ঈশ্বর এবং শাসকের কর্তৃত্ব কার্যকারিতা হারায়। কিন্তু নতুন প্রজন্মের বুদ্ধিজীবীরা তাঁদের ধারণাকে আরেকটু শাণিত করার পন্থা বের করেন। সাধারণ ক্লাব এবং বৈঠকখানাগুলো হয়ে ওঠে কলা, দর্শন এবং সামাজিক বিষয় নিয়ে আলোচনায় করার কেন্দ্রস্থল এবং এভাবে ব্যক্তিগত চিঠি এবং ডায়রিগুলো আস্তে আস্তে সংবাদপত্র, সাময়িকী এবং উপন্যাস হিশেবে প্রকাশিত হওয়া শুরু করে। ইউরোপের কড়া সেন্সরশিপ ব্যবস্থ থাকা সত্ত্বেও নতুন মাধ্যমগুলোর স্বাধীনতা এবং ব্যাপক ব্যপ্তি লাভ করার মধ্যে তা কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে নি। বুর্জোয়ারা চার্চ এবং অভিজাতদের থেকে নিজেদের মুক্ত করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত হ’য়ে তার পরিবর্তে একটা ধর্মনিরপেক্ষ গনতন্ত্রের বিধিবদ্ধতা স্থাপন করার প্রয়াস নেয়। প্রথাগত ধর্মীয় বিশ্বাস ক্রমেই উন্নত সমাজ যা কী না যুক্তি দ্বারা পরিচালিত হবে, তার পক্ষে বাঁধা হিশেবে কুসংস্কারের আখ্যা পাওয়া শুরু করে। তখন উন্নয়নের ধারণা প্রযুক্তির উৎকর্ষের মান দ্বারা সূচিত হতো এবং প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ তার প্রথম ব্যাপক অগ্রগতি সাধন করে এই সময়েই। সময়ের প্রভাবে নতুন প্রযুক্তি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরিক্ষা সম্পর্কে আরও সূক্ষ্ম ফলাফল প্রাপ্তির হাতিয়ার হিশেবে ব্যবহৃত হওয়া শুরু হয় এবং শিল্পায়নের যন্ত্রপাতিও দৃষ্টিগোচর হয়ে ওঠে। দেকার্তের গণিত সম্পর্কিত বৈশ্বিক সত্য নিরূপণের তাত্ত্বিক প্রয়াস এইবার বাস্তবিক ব্যাপারগুলোতে প্রাসঙ্গিকতা লাভ করে। গণিতশাস্ত্র, যাকে বলা হয় যুক্তির ভাষা- তা কি নিউটনের সূত্রের মতো এমন কোন সত্য নিরূপণ করতে পারে? প্রকৃতি যে যুক্তিমুখী কিংবা এই শাস্ত্র কি এমন কোন যুক্তিআরোহী সিদ্ধান্ত দিতে পারে যা সাফল্যের দিকে ধাবিত হয়? এই চাহিদাগুলো ফরাসি বিপ্লবের মাধ্যমে হুট করেই আকাশচুম্বি সফলতা পায় কিন্তু বিচারশক্তিহীন প্রতিপক্ষের মাধ্যমে তা বাতিলও হয়ে যায়; বিপ্লব তার সন্তানকেই গ্রাস করে ফেলে। ১৮০০ শতাব্দির নেপোলনিয় যুদ্ধের সময় সব স্বপ্ন, হতাশা, বিপ্লবের কূটাভাস সারা ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মের সমাজ বিষয়ক ধারণাকে চরমভাবে প্রভাবিত করেছিল।

কিন্তু আঠারো শতাব্দীতেই, যুক্তির যুগেই (age of reason) নৃবিজ্ঞানকে একটা শাস্ত্র হিশেবে গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এই সময়ের শুরুর দিকের একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে ভিকো’র (১৬৮৮-১৭৪৪) ‘নতুন বিজ্ঞান’ (The New Science)। এটা ছিল এথনোগ্রাফি, ধর্মের ইতিহাস, দর্শন এবং প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের পূর্ণ বিশ্লেষণ এবং ভিকো ছিল সামাজিক অগ্রগতি ধারণা ব্যাপকভাবে গ্রহণ করার প্রথম দিকের ব্যক্তিদের মধ্যে একজন। সে সামাজিক অগ্রগতি বিষয়ক ধারণার একটা প্রস্তাবনা দেয়, যেখানে বলা হয়েছিল প্রত্যেক সমাজ নির্দিষ্ট এবং সংজ্ঞায়িত বৈশিষ্ট্যের তিনটা স্তরের মাধ্যমে এগোয়। প্রথম স্তর ছিল ‘ঈশ্বরের যুগ’ (age of god), যখন প্রকৃতি পূজা করা হতো। অপরিণত এই সামাজিক কাঠামো এবং বৈশিষ্ট্যগুলোকে ভিকো ‘আদিম’ মানুষের লক্ষণ হিশেবে চিহ্নিত করেছিলেন। তারপর আসে ‘বীরের যুগ’ (age of heroes), যখন সামাজিক অসাম্যের জন্যে সর্বব্যাপী অশান্তি বিরাজমান ছিল। ইউরোপিয় মধ্যযুগ এবং ভিকোর নিজের সময় এই যুগকে প্রতিনিধিত্ব করেছে। সামাজিক অগ্রগতির কল্পিত চূড়ান্ত ধাপ হচ্ছে যুক্তির যুগ, যাকে ভিকো অভিহিত করেছিলেন মানুষের যুগ (age of man) বলে। এই ধারণার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ অনেক ইঊটোপিয়ান উন্নয়ন পরিকল্পনাই উনিশ শতকে কমবেশি প্রস্তাবিত হয়েছে। এর অন্তর্নিহিত ধারণা হচ্ছে, এর মাধ্যমে শুধু ইউরোপিয়রা নয়, ‘আদিম’ মানুষেরাও সঠিক দিকনির্দেশনার মাধ্যমে নিজেদের উন্নতি সাধন করতে পারে। সঙ্গত কারণেই এই ধারণার মাধ্যমে ইউরোপিয়রা খুবই খুবই স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করেছিল কেননা এই সময়ে তারা উপনিবেশিক শাসনের যুগে প্রবেশ করতে শুরু করে।

ভিকো ছিল একজন ইতালিয়, কিন্তু ফ্রান্সে বসে তিনি প্রথমবারের মতো নৃবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান হিশেবে প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ১৭৪৮ সালে মন্টেস্কু (১৬৮৯-১৭৫৫) তার ‘দা স্পিরিট অফ ল’ প্রকাশ করেন। এটা আইন প্রণয়ন সম্পর্কিত সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের একটা তুলনামূলক পাঠ যা সম্পর্কে তার মৌলিক কিংবা পরোক্ষ জ্ঞান ছিল। এর থেকেই তিনি আইনের সাধারণ নিয়মগুলো প্রতিপাদনের চেষ্টা করেছিলেন যেটার মাধ্যমে সংস্কৃতি নির্বিশেষে আইনি ব্যবস্থার ভিত্তি তৈরি করা সম্ভব। তিনি আইনি ব্যবস্থাকে চিত্রিত করেছিলেন সমাজ কাঠামোর ব্যাপক দৃষ্টি থেকে যাতে করে রাজনীতি, অর্থনীতি, জ্ঞাতিত্ব, জনতত্ত্ব, ধর্ম সবকিছুকেই এর অন্তর্ভুক্ত করা যায়। এরকম দৃষ্টিভঙ্গির জন্যে কেউ কেউ তাকে আদি-ক্রিয়াবাদী (pro-functionalist) বলে অভিহিত করেন (তৃতীয় অধ্যায় দ্রষ্টব্য)। মন্টেস্কুর মতে, বহুবিবাহ, নরমাংসভক্ষণপ্রথা, পৌত্তলিকতা, দাসপ্রথা এবং অন্যান্য বর্বর প্রথাগুলোর ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব, যদি সমাজের ভেতর তার ক্রিয়াগুলো জানা যায়। মন্টেস্কুর আরেকটা বিখ্যাত কাজ হচ্ছে ‘পারস্য চিঠি’ (the Persian letter, 1722), এটা হচ্ছে পারস্য দেশের দুই অধিবাসীর তার দেশের মানুষের কাছে ফ্রান্স সম্পর্কিত তাঁদের বর্ণনার সংগ্রহ। লুই চতুর্দশের সময়কার ফ্রান্সের প্যারোডি করতে গিয়ে তিনি ‘অবিদিত’ সাংস্কৃতিক ভিন্নতার বর্ণনা দিয়েছেন এখানে। এই বইটা ছিল কৌতূহলোদ্দীপক এবং পারস্যবাসিদের অসঙ্গতভাবে উদ্ভট হিশেবে উপস্থাপন করায় মন্টেস্কুকে একজন আদি ওরেন্টালিস্ট হিশেবে অভিযুক্ত করা হয় (সাইদ, ১৯৭৮, ১৯৯৩)- যার কারণে বইটা এখনো বিতর্কিত । সমালোচনাটা সঠিক ছিল, কেননা পরিষ্কারভাবেই এটা বলা যায় যে, মন্টেস্কুর আসল উদ্দেশ্য পারস্যের বর্ণনা দেয়া ছিল না বরং ফ্রান্সকে নিন্দা করাই ছিল তার লক্ষ্য। কিন্তু পারস্যের চিঠি আরেকটা বাস্তবিক উপলব্ধির সমস্যা চিত্রিত করে যাকে সমসাময়িককালে নৃবিজ্ঞানে বলা হয় ‘হোম ব্লাইন্ডনেস’ অর্থাৎ নিজস্ব সংস্কৃতিকে ‘বাইরে থেকে’ কিংবা ‘নৈর্ব্যক্তিক’ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার অক্ষমতা। মন্টেস্কু এই সমস্যা থেকে উত্তরনের জন্যে একটা কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি তার নিজের সমাজকে একজন আগন্তুকের দৃষ্টিকোণ থেকে বর্ণনা দিয়েছিলেন, যে কৌশলটা আজকেও সমালোচনামূলক নৃবিজ্ঞানীরা ব্যবহার করে থাকেন।

নৃবিজ্ঞানের দিকে আরেকটা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল ফ্রান্সের একদল তরুণ, আদর্শবাদী দলের মাধ্যমে। ডেনিস ডাইডেরট (১৭১৭-৮৩) এবং গনিতবিদ জঁ ল্য রঁন দ্য আলেম্বার্টের (১৭১৭-৮৩) দ্বারা অনুপ্রাণিত এই দলটি ছিল জ্ঞানকোষবাদী (encyclopaedists)। তাঁদের লক্ষ্য ছিল যুক্তি, প্রগতি,বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির লক্ষ্যে যতদূর সম্ভব জ্ঞানকে সংগ্রহ করা এবং তারপর তাকে শ্রেণিবদ্ধ করে কাঠামো তৈরি করা। ডাইডেরটের এন্সাইক্লপিডিয়া প্রকাশিত হয় ১৭৫১-৫২ সালে এবং সেখানে রুশো, ভলতেয়ার এবং মন্টেস্কুর মতো জ্যোতির্ময় বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। এই এনসাক্লোপিডিয়া পরবর্তীতে এই ধরণের কার্যক্রমের জন্যে আদর্শ হয়ে দাঁড়ায়। হয়তো এই কাজকে বৈপ্লবিক বলা যাবে না, কিন্তু এটা ছিল উদারনৈতিক এবং এর ব্যপ্তি ছিল বিশাল। চার্চের কঠোর সমালোচনা থাকার দরুন ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় এই বইয়ের কিছু অংশ সেন্সর করে প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু ১৭ খণ্ডের লেখা আর ১১ খণ্ডের চিত্রণ সম্বলিত এই সংগ্রহ অনান্য বিতর্কিত জিনিশও অন্তর্ভুক্ত করেছিল; যেমন সাধারণ কৃষক এবং কারুকারদের দ্বারা সৃষ্ট যান্ত্রিক অনুষঙ্গের বিষদ বিবরণ। এই ধরণের জিনিশগুলো একাডেমীক কাজে তখনকার সময় অপ্রচলিত থাকার দরুন প্রথমবার সবাই এই ইঙ্গিত পেল যে, ভবিষ্যতে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি বর্ণনাও পাঠের বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়াবে। এই এনসাইক্লোপিডিয়ায় বিশ্বের সব সমাজ এবং সংস্কৃতির খুঁটিনাটি বিষয় সম্পর্কে তথ্য সংগৃহীত ছিল। এর তরুণ অবদানকারীদের মধ্যে একজনের নাম মার্কুইস দ্যা কনডরস্যাট, যিনি জ্যাকোবিন জেলে অকালমৃত্যু লাভ করেন। মারকুইস বিভিন্ন সামাজিক ব্যবস্থা নিয়ে একটা নিয়মতান্ত্রিক তুলনা করেছিলেন এবং গণিত ও সামাজিক বিজ্ঞানের সংশ্লেষ ঘটিয়ে সামাজিক উন্নতির স্বপক্ষে নৈর্ব্যক্তিক আইন প্রণয়ন করতে চেয়েছিলেন।

নিঃসন্দেহে এই এনসাইক্লোপিডিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী অবদানকারী ছিলেন জ্যা জ্যাকস রুশো (১৭১২-৭৮)। তার সমসাময়িক বেশিরভাগ মানুষের সাথে মতানৈক্যে ঘটিয়ে রুশো বলেছিলেন, উৎকর্ষ প্রগতিশীল কোন ধারণা নয়, বরং এটা ক্ষয়িষ্ণু এবং এই ক্ষয়ের প্রধান কারণ সমাজ নিজেই। প্রকৃতি যখন প্রাথমিক ও নিষ্পাপ অবস্থায় ছিল, তখন প্রত্যেক ব্যক্তি অন্যদের সাথে নিজের মতো করে স্বাধীনভাবে জীবনধারণ করত। তারপর তারা বিবাহ, জ্ঞাতিত্বের মতো প্রতিষ্ঠানের জন্ম দেয় এবং নিজেদেরকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোত্রে আসীন করে। আস্তে আস্তে এই গোত্রগুলো জটিলতার সৃষ্টি করে এবং ভালো এবং মুক্ত আত্মার মানুষ সামাজিক অসাম্যের ভারে পতিত হওয়ার আগেই পাদ্রি এবং সর্দার, রাজা এবং রাজকুমার, ব্যক্তিগত সম্পত্তি, পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেটের মতো ব্যবস্থা আবিষ্কৃত হয়। সকল মানবিক দোষ ছিল সামাজিক অসাম্য দ্বারা উৎপাদিত এবং এবং রুশো সাম্যাবস্থা থেকে পতিত হওয়ার সূচনার থেকে শুরু করে পৃথিবীতে দ্বেষের আগমনের শেকড় অনুসন্ধানে মগ্ন ছিলেন। ‘মানুষ স্বাধীন হয়ে জন্মগ্রহণ করে, কিন্তু সে পদে পদে শৃঙ্খলিত’- সে তার বই ‘সামাজিক চুক্তি’-তে (the social contract) এই ঘোষণা দেন। কিন্তু রুশো আরও বলেন আসল স্বাধীনতা এবং গনতন্ত্রের চুক্তির মাধ্যমে ভুল সামাজিক চুক্তি (false social contract) প্রতিস্থাপন করা সম্ভব। চলতি সময় নিয়ে তার সংশয়ী দৃষ্টিভঙ্গি থাকা সত্ত্বেও রুশো ইউটোপিয়ান সমাজের স্বপ্নই দেখেছিলেন, যেমনটা ভেবেছিলেন ভিকো কিংবা কনডরসেট।

রুশোর আদর্শ সমাজের মডেল পাওয়া যায় মুক্ত, রাষ্ট্রহীন ‘মহান অসভ্য’-দের মাঝে। সাধারণ সমাজের প্রতি এই পুনর্বিচার সাংস্কৃতিক আপেক্ষবাদের দিক থেকে ছিল গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, কিন্তু তা সত্ত্বেও রুশোর এই আপেক্ষবাদ ছিল অগভীর। তার জন্যে ‘আদিম মানুষ’ উৎসাহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল কেননা এটা ছিল তার সময়ের পুরোপুরি বিপরীত। তারা ছিল যৌক্তিক মানুষের প্রতীক যারা ভবিষ্যতের আদর্শ সমাজে পুনর্জন্ম গ্রহণ করবে। মানুষ না হয় মুক্ত ও যৌক্তিক, তা না হলে তারা পরাধীন ও দুর্নীতিগ্রস্ত- এই আপ্তবাক্য গ্রহণের মাধ্যমে অভিজ্ঞতাবাদী দিক থেকে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের ব্যাপারটা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। তারপরেও রুশো মার্ক্স থেকে শুরু করে লেভি স্ট্রাউসের মতো সমাজবিজ্ঞানীদের জন্যে অনুপ্রেরণার উৎস এবং তাকে মাঝে মাঝে ফরাসি আলোকায়ন এবং জার্মান রোমান্টিসিজমের মধ্যপুরুষ বলা হয়ে থাকে। জার্মান রোমান্টিসিজম উদ্ভব হয়েছিল আলোকায়ন দর্শনের প্রতিক্রিয়া হিশেবে, ১৭০০ শতাব্দির শেষের দিকে । এই আন্দোলনে রুশোর ‘বিশুদ্ধ মানুষ’ (authentic man) সম্পর্কিত ধারণার চর্চা বহমান ছিল এবং সংস্কৃতি সম্পর্কিত প্রথম ধারণা ব্যাপকভাবে উপস্থাপিত হয়েছিল।

রোম্যান্টিকতাবাদ

আলোকায়ন ব্যক্তিসত্তা এবং যৌক্তিক মননে বিশ্বাসী ছিল। রোম্যান্টিক চেতনা এই ধারণার বৈপরীত্যে ব্যক্তিসত্তা থেকে গোত্র, যুক্তি থেকে আবেগের দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করল। রাজনীতিতে এই পরিবর্তনটা ছিল স্বাধীন ব্যক্তিসত্তা ও গনতন্ত্র সম্পর্কিত বৈশ্বিক একটা জ্ঞানভাষ্য থেকে জাতিগঠন ও জাতীয় আবেগ সম্পর্কিত নির্দিষ্টতাজ্ঞাপক জ্ঞানভাষ্যে রুপান্তর। সাধারণভাবে রোম্যান্টিকতাবাদকে দেখা হয় ফরাসি বিপ্লবের পর আলোকায়নের প্রতিস্থাপনরূপে। কিন্তু সম্ভবত আরও পরিষ্কারভাবে আর্নেস্ট গ্যালনার (১৯৯১) এই সম্পর্কে বলেন, এই দুটো আন্দোলন ছিল সমান্তরাল ধারার, সময়ের সাথে সাথে বিকীর্ণকারী ও প্রতিদ্বন্দ্বী; বিভক্তকারী ও একই সাথে মিশ্রিত। পরেরটা নৃবিজ্ঞানে সাধারণ নির্বচন, যার লক্ষ্য শুধু সামগ্রিক সংস্কৃতি বোঝা নয় (রোম্যান্টিক চেতনা), একই সাথে তার ব্যবচ্ছেদ, বিশ্লেষণ ও তুলনাও (আলোকায়ন ধারণা) যার লক্ষ্য।

জার্মানি ছিল রোম্যান্টিক আন্দোলনের উৎসভূমি। আঠারো শতকে জার্মানি ছিল ‘পবিত্র রোম্যান সাম্রাজ্য’- এর অন্তর্ভুক্ত, জোড়াতালি দিয়ে গড়া স্বাধীন নৃপতি এবং স্বায়ত্তশাসিত নগরের অধিকর্তারা যাকে আলগাভাবে একীভূত করে রেখেছিলেন। এই সম্পর্কে ভলতেয়ার একবার বলেছিলেন, এটা পবিত্র ছিল না, রোম্যানও ছিল না কিংবা সাম্রাজ্যও ছিল না। জার্মান জাতিতত্ত্ব ফরাসিদের সমাজ এবং নাগরিক সম্বন্ধীয় রাজনীতিমুখী ধারণা ছিল না, বরং তাঁদের জাতি সম্পর্কিত ধারণার ভিত্তি ছিল ভাষা এবং সংস্কৃতি। ফ্রান্স ছিল বিশাল এবং শক্তিশালী রাষ্ট্র যার ফ্যাশন, কবিতা এবং রাজকীয়তা পশ্চিমা বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করত। ফরাসি ভাষা বলতে পারাটা একসময় সংস্কৃতিমনা দৃষ্টির পরিচায়ক ছিল। উদাহরণস্বরূপ, অন্যতম এক জার্মান রোম্যান্টিক ফ্রেডরিখ রিখটার তাঁর ছদ্মনাম নিয়েছিলেন ফরাসিদের থেকে- জ্যাঁ পল। রাজনৈতিকভাবে বিক্ষিপ্ত কিন্তু সাংস্কৃতিকভাবে একীভূত জার্মানরা স্বভাবতই ফ্রান্সের খবরদারির বিরুদ্ধে ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে এবং কেন্দ্রীয় ফ্রান্সের থেকে জার্মানরাও তাঁদের জাতির একীভূত করার আদর্শিক যুক্তির দিকে লক্ষ্য করেছিল। ১৭৬৪ সালে তরুণ জোহান গটফ্রিড ভন হার্ডার(১৭৪৪-১৮০৩) তাঁর ‘ইতিহাসের আরও একটি দর্শন’ (yet another philosophy of history) প্রকাশ করেন যেখানে তাঁর আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ছিল ফরাসি বৈশ্বিকতাবাদীর সমর্থকেরা; যেমন ভলতেয়ার (১৬৯৪-১৭৭৮)। হার্ডার আবেগ এবং ভাষার মৌলিকত্বের ঘোষণা দিয়ে সমাজকে একটা গভীর, পৌরাণিক গোত্র বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। সে বলেছিলেন, মানুষ নিজেরাই নিজস্ব মূল্যবোধ, প্রথা, ভাষা এবং মননের অধিকারী। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে ভলতেয়ারের বৈশ্বিকতাবাদ ছিল ছদ্মবেশী প্রাদেশিকতা এবং তাঁর বিশ্বসভ্যতা আসলে ছিল ফরাসি সংস্কৃতির ধারণা।

ভলতেয়ার- হার্ডারের এই বিতর্ক আজো আমাদেরকে প্রশ্নের সম্মুখীন করে। ভলতেয়ারের উদারঅন্ত এবং পরিবর্তনসূচক বৈশ্বিকতাবাদের বিরুদ্ধে হার্ডারের তীক্ষ্ণ আক্রমণ বিংশ শতাব্দির নৃবিজ্ঞানীদের সমালোচনা, উন্নয়নসেবা, সংখ্যালঘু নীতি এবং বিশ্বায়নের সমালোচনা বিষয়ক স্মারক হিশেবে পরিগণিত হয়েছে। এটা নৃবিজ্ঞান সমালোচনায় সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চারিত মানদণ্ডের কথা মনে করিয়ে দেয়। একাডেমিক ক্ষেত্রে সীমিত সাফল্যের পরেও জার্মানভাষী পৃথিবীতে সংস্কৃতি এবং সভ্যতার একটা পার্থক্যের সূচনা করেছিল; সংস্কৃতি ছিল পরীক্ষামূলক এবং জীবন্ত, যেখানে সভ্যতা হচ্ছে জ্ঞান সম্বন্ধীয় ও বাহ্যিক।

হার্ডারের ‘ভোক’ (volk) ধারণা পরবর্তীতে ফিখটে(১৭৬২-১৮১৪) এবং শেলিং (১৭৫৫-১৮৫৪)এর মতো কিছু দার্শনিকদের দ্বারা আরও পরিশুদ্ধ এবং রাজনৈতিক রূপ ধারণ করে। নেপোলিয় যুদ্ধের শুরুতে এটা ক্রমেই বুর্জোয়াবাদী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ক্ষেত্রে একটা হাতিয়ারে রুপান্তরিত হয়ে ওঠে এবং একাডেমিক জগতে বিংশ শতাব্দির শুরুতে এই ধারণা সাংস্কৃতিক আপেক্ষবাদের তত্ত্বের মাধ্যমে পুনরাবির্ভূত হয়। এর ফলে আপেক্ষবাদ এবং জাতীয়তাবাদ- এই দুই বিপরীত মতবাদ সংস্কৃতি সম্পর্কিত তার ধারণার আদিম অবস্থায় ফিরে যায়, যার উৎস ছিল জার্মান রোম্যান্টিকতাবাদ।

নিঃসন্দেহে এই সময়ের সবচেয়ে মহান দার্শনিক ছিলেন ইমানুয়েল কান্ট (১৭২৪-১৮০৪)। কান্টের দর্শন এতোটা মৌলিক ছিল যে তা একটা নতুন দার্শনিক ধারাকে সিদ্ধ করার যোগ্যতা রাখে। বলা হয়ে থাকে, অভিজ্ঞতাবাদী এবং যুক্তিবাদীদের মধ্যকার বিতর্কের মতো অনেক বিতর্কিত আলোচনার সমাপ্তি তাঁর মাধ্যমেই সূচিত হয়। তাঁর ‘বিশুদ্ধযুক্তির সম্যক বিচার’ (critique of pure reason) গ্রন্থে তিনি লক এবং হিউমের সাথে একমত হয়ে সিদ্ধান্তে আসেন, প্রকৃত জ্ঞান আসলে ইন্দ্রিয়জাত উপলব্ধি থেকেই লাভ করা যায়, কিন্তু এখানেই শেষ না করে দেকার্তের মতো তিনি আরও বলেন- ইন্দ্রিয়জাত সেইসব তথ্য চেতনার কাঠামো দ্বারাই পরিশুদ্ধ এবং আকারপ্রাপ্ত হয়। জ্ঞান একইসাথে ইন্দ্রিয়জাত ও গাণিতিক, প্রত্যক্ষবাদ ও দূরকল্পনাভিত্তিক এবং নৈর্ব্যক্তিক ও বৈষয়িক। কান্টের সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল তিনি দেখাতে পেরেছিলেন, চিন্তা এবং অভিজ্ঞতা একই সাথে গতিশীলভাবে সম্পর্কিত এবং জ্ঞানার্জনের ধারা একটা মননশীল প্রক্রিয়া। জগত সম্পর্কে জ্ঞান লাভের অর্থ হচ্ছে এমন একটা জগত তৈরি করা যা জ্ঞান দ্বারা উপলব্ধি করা যায়। এভাবে দেখলে মানুষ জগত সম্পর্কে কিছু জানতে অক্ষম কারণ এটা এর ভেতরেই আছে কিন্তু সে জগত সম্পর্কে জানতে পারে জগত যেভাবে নিজেকে তাঁর সামনে উপস্থাপন করেছে; সেই হেতু জগত সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করাও সম্ভব।

জগতকে জানার মানে হচ্ছে এর সৃষ্টিকে সহায়তা করা, যেমনটা একজন মাঠকর্মী নৃবিজ্ঞানী জানেন। আমরা তথ্য সংগ্রহ করে সেই তথ্যকে আকার দেই এবং বাস্তবতাকে ব্যাখ্যা করি, যার সম্পর্কে কান্ট সর্বপ্রথম উপলব্ধি করেছিলেন এবং এটা আজো নতুন নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কান্টের কাঠামো সরাসরি সমাজবিজ্ঞানে প্রয়োগ করা সম্ভব ছিল না। তাঁর উত্তরসূরি ফ্রেডরিখ হেগেল(১৭৭০-১৮৩১) যুক্তি সম্বন্ধীয় তাঁর ধারণাকে শানিত রূপদান করেন। কান্টের মতে, জ্ঞান হচ্ছে একটা প্রক্রিয়া, একটা অশেষ অপসরণ এবং ব্যক্তিমানুষকে কেন্দ্র করে এই নির্দিষ্ট অপসরণ কেন্দ্রীভূত। কিন্তু হেগেলের মতে, এই নির্দিষ্ট অপসরণ সঠিক নয় এবং ব্যক্তিসত্তা নিজেও জানার এই প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত। তাঁর মানে দাঁড়াচ্ছে, জগতকে জানার মাধ্যমে আমরা শুধু একটা পরিচিত জগত সম্পর্কেই ধারণা লাভ করি না, আমরা নিজেদেরও জানতে পারি। কিন্তু যদি নির্দিষ্ট কোন বিন্দু না থাকে, তাহলে সকল জ্ঞান কীভাবে অর্জন করা সম্ভব? যদি ব্যক্তিসত্তাই না থাকে তাহলে সবকিছুর বিচার্য বিষয় কী হবে? হেগেল এর উত্তর দিলেন, আমরা এই পৃথিবীতে একা নই। ব্যক্তিসত্তা যোগাযোগমূলক একটা সম্পর্কে সবার সাথে অংশগ্রহণ করে। তাঁর মানে দাঁড়াচ্ছে, জানার মাধ্যমে যে জগতকে আমরা পাচ্ছি তা আদতে সমন্বিত এবং ব্যক্তিসত্তা কোন ‘কারণ’ নয়, বরং তারই একটা ‘ফলাফল’।

তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, হেগেলের জটিল এবং খানিকটা ধোঁয়াশাপূর্ণ কাঠামোর মাধ্যমে পদ্ধতিগত মৌলিক সন্দেহ ‘radical methodological doubt’ এর উদ্ভব হ’লো, সেই তত্ত্ব যেখানে ব্যক্তিসত্তার থেকে সমাজ বেশি মৌলিকত্বের দাবিদার। এর বিপরীতে কান্ট তাঁর পদ্ধতিগত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদে (methodological individualism) ব্যক্তিমানুষকেই তাঁর সূচনাবিন্দুতে আসীন করেছেন। আজকের দিনেও নৃবিজ্ঞানে এই অবস্থানগুলো সুগঠিতভাবে সংজ্ঞায়িত। কিন্তু হেগেলের মাধ্যমে সমন্বিতবাদ বহু দূরে চলে যায় এবং তিনি একটা ‘বৈশ্বিক অধিসত্তা’-র কথা উল্লেখ করেন যা স্বাধীনভাবে ব্যক্তিসত্তা থেকে বিকশিত হয় কিন্তু নিজেকে তার মাধ্যমেই বাস্তবায়ন করে। এই অধিসত্তার নিজস্ব কেন্দ্র এবং সীমানা আছে, এবং বিবর্তনের কিছু আইনের মাধ্যমে তা প্রসারিত হয়। এই ধারণার জন্যে , গ্যয়না (১৯৯৫) হেগেলকে বৈশ্বিক মানবতাবাদী ধারণা সূচকের প্রথম দার্শনিক হিশেবে অভিহিত করেন।

আজকের দিনে আধুনিক সামাজিক তত্ত্বের জ্ঞানতাত্ত্বিক ভিত্তিভূমির ধারণা সিদ্ধ হয়েছে। জ্ঞান যদি একটা সমন্বিত প্রক্রিয়া হয়ে থাকে যা কী না সামগ্রিক বিশ্ব সৃষ্টি করে, তা ব্যক্তির দ্বারা জানা সম্ভব। ব্যক্তিমানুষের মধ্যে যোগাযোগের বিশ্বকে কমবেশি আরও সংগঠিত পন্থায় কল্পনা করা আমাদের পক্ষে আরও সহজ হয়ে উঠেছে। এই ধারাগুলোকে তাত্ত্বিকেরা বিভিন্ন ধারণাদ্বারা ব্যাখ্যা করেছেন, যেমনঃ কাঠামো, ক্রিয়া, সংহতি, ক্ষমতা, প্রক্রিয়া এবং সমষ্টি। হেগেল নিজেও বৈশ্বিক মনীষার বিকাশ সম্পর্কে সজাগ ছিলেন এবং এর পাটভাঙাকে ব্যাখ্যা করেছিলেন দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ার একটা সংঘর্ষ এবং সংশ্লেষণরূপে। কিন্তু দ্বান্দ্বিকতার এই ধারণা পরবর্তীতে মার্ক্সের মতো সমাজতাত্ত্বিক আরও উৎকর্ষের সাথে ব্যাখ্যা করেছেন এবং কান্ট এবং হেগেলের পরে ‘বাস্তবতার সামাজিক নির্মাণ’ হয়ে ওঠে হয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা।

কিন্তু এই ধারণা ১৮০০ শতকের পরে সারা ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে পড়া হার্ডারের প্রেরণাসম্বলিত জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ক্ষেত্রেও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। জাতি ছিল ‘বাস্তবতার সামাজিক নির্মাণ’- এবং যোগাযোগমূলক সংহতির পক্ষে এর আরও সুগঠিত জায়গা; প্রত্যেক জাতিই নিজের ধারা এবং বৈশিষ্ট্যে ছিল সমুজ্জ্বল- ঠিক যেমনটা হেগেল ব্যাখ্যা করেছিলেন। আসলে জাতি ছিল মানুষের সাধারণ আকাঙ্ক্ষা এবং চাহিদার দ্বারা সৃষ্ট মানুষের সমন্বয়, যা সাধারণ মানুষ দ্বারা পরিচালিত। জাতীয়তাবাদ আসলে রোম্যান্টিকতাবাদ দ্বারা অনুপ্রাণিত হলেও এটা ইতিহাসের ধারাবাহিকতারও একটা অংশ; নেপোলিয় যুদ্ধের সূচনাপর্বে সৃষ্ট রাজনৈতিক বিপর্যয়, শিল্পায়নের মাধ্যমে বিচ্ছিন্নতাবোধের ধারণা এবং স্বাধীনতা, সাম্য এবং ভ্রাতৃত্ববাদী চিন্তার বৈপ্লবিক প্রসার- সবই এর অন্তর্ভুক্ত।

পৃথিবীর এই বিপর্যয় এবং পরিবর্তনমূলক সময়েই নৃবিজ্ঞান একটা শাস্ত্র হিশেবে বিকাশ লাভ করে এবং প্রথম এথনোগ্রাফিক মিউজিয়ামের স্থাপনা ছিল এর বিকাশের অন্যতম পূর্বশর্ত। বিচারগৃহে বিচিত্র সব জিনিশের সম্ভার মজুদ রাখা ইউরোপের আগেই প্রচলিত ছিল। ১৬৫০ সালের আগে ডেনিশ রাজা ফ্রেডরিখ ৩ এরকম একটা স্থাপনা তৈরি করেন যা পরবর্তীতে ডেনিশ জাতীয় জাদুঘরের ভিত্তি তৈরি করে দেয়।

কিন্তু এথনোগ্রাফিকার নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রহ শুরু হয় ১৮০০ সালের পর থেকে এবং বড় বড় জাদুঘরগুলো তৈরি হয়েছিল; লন্ডন (১৭৫৩), প্যারিস (১৮০১), ওয়াশিংটন ডিসি (১৮৪৩) এবং এই সবগুলোই পরবর্তীতে এথনোগ্রাফিক বিভাগ হিশেবে গুরুত্ব লাভ করে। এখন পর্যন্ত, প্রথম দিকের বিশেষায়িত এথনোগ্রাফিক জাদুঘরগুলো স্থাপিত হয়েছিল জার্মান ভাষাভাষী অঞ্চলে- ভিয়েনা( ১৮০৬০, মিউনিখ(১৮৫৬) এবং বার্লিন(১৮৬৮)। এটা ভেবে খুব আশ্চর্য হতে হয় যে, জার্মানির কোন উপনিবেশ ছিল না । কিন্তু হার্ডারের পরিকল্পনামতো জার্মান বুদ্ধিজীবীরা ‘মানুষ’ সম্পর্কে অভিজ্ঞতাবাদী জ্ঞানআরোহণ চালিয়ে যায় এবং তারা উপকথা, কিংবদন্তি,ভূমিদাসদের জীবন, পোশাক, নাচ, কুটিরশিল্প এবং দক্ষতার তথ্য সংগ্রহ করা শুরু করে। তাঁদের প্রথম দিকের জাদুঘরগুলো দূরবর্তী মানুষ (volkerkunde) সম্পর্কিত ছিল না, বরং এগুলো ছিল মূলত ভূমিদাসদের গৃহ জীবন সম্পর্কিত (volkskunde)। আমাদের এটা মনে রাখা দরকার, প্রাতিষ্ঠানিক নৃবিজ্ঞান চর্চার সূচনা হয়েছিল জার্মান ভাষাভাষী অঞ্চলে, ফ্রান্স কিংবা ব্রিটেইনে নয়। এই ব্যাপারটা প্রায়ই নৃবিজ্ঞানের ইতিহাসে উপেক্ষা করা হয়।

আমরা পরবর্তী অধ্যায়ে নৃবিজ্ঞানে জার্মানদের অবদান নিয়ে আলোচনা করবো। পুরো উনবিংশ শতাব্দিজুড়ে নৃবিজ্ঞানে জার্মানদের প্রভাব ছিল খুবই সক্রিয়, যখন একই সময়ে ব্রিটেনে উদ্ভব ঘটেছিল অদ্ভুতুড়ে ভিক্টোরিয় নৃবিজ্ঞানের।

(এই লেখায় ব্যবহৃত দার্শনিক এবং বৈজ্ঞানিক পরিভাষাগুলো মূলত নেয়া হয়েছে সরদার ফজলুল করিমের ‘দর্শনকোষ’ এবং রেহনুমা আহমেদ ও মানস চৌধুরীর লেখা ‘নৃবিজ্ঞানের প্রথম পাঠ’ বই থেকে। কিছু কিছু শব্দের পরিভাষা খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে নি, পরবর্তীতে খুঁজে পাওয়া গেলে সেটা সংশোধন করে দেয়া হবে)