গত দুমাসে ভারতীয় রাজনীতির বৃহত্তম খাশ খবর আগামী প্রধানমন্ত্রী পদের দাবীদার হিসাবে মোদির উত্থান। শুধু তাই না -শাইনিং ইন্ডিয়ানদের মধ্যে তার এপ্রুভাল রেটিং ৮৫% ! আর বাংলাদেশের মিউনিসিপাল ইলেকশনে বিএনপি এবং তার মৌলবাদি দোশরদের বিজয়রথ অব্যাহত। ইসলাম বিপন্ন এই আওয়াজ তুলেই তারা সফল!

মৌলবাদ ভারত পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের সব থেকে বড় শত্রু। রাজনৈতিক কারনে ভারতে কংগ্রেস জনসংঘ এবং কমিনিউস্ট দলগুলিও মৌলবাদি শক্তিকে প্রশ্র্য় দিয়েছে। পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ মৌলবাদের জন্য দ্রুত গোল্লায় গেছে-ভারতে এই শক্তি দানা বাঁধছে গত দুই তিন দশক জুরে। মৌলবাদ রুখতে সব ধর্মের মৌলবাদি শক্তির বিরুদ্ধেই গোলা দাগতে হবে। সিপিএম বিজেপির বিরুদ্ধে গোলা দেগেছে ঠিক- আবার ইসলামিক মৌলবাদিদের উস্কে দিতে মাদ্রাসার সংখ্যাও বৃদ্ধি করেছে। সিপিএমের আরো গর্হিত কাজ হল, প্রকৃত সেকুলার মুসলিম কমরেডদের সাইডলাইন করে দেওয়া। সিপিএম দলের প্রতিষ্ঠা লগ্নে যেসব মুসলিম কমরেডরা ছিলেন, তারা ছিলেন হিন্দু কমরেডদের থেকেও বেশি সেকুলার। ন্যারেটিভটা এই অর্থে-বর্তমানে এই পতিত কমিনিউস্ট দলের নেতাদের মধ্যে কালীভক্ত এবং হাজি গাজি নেতারদের ভীর বেশি। তাদের সবাইকে বসিয়ে আজকে সিপিএমের নেতা হয়েছে হাজি রেজ্জাক মোল্লা। যিনি জলেও আছেন, তেলেও আছেন। মহম্মদের প্রতিক্রিয়শীলতা আর মার্ক্সের প্রগতিশীলতা -মুদ্রার দুই পিঠ যার কাছে সমান সত্য! এইসব নিয়ে কিছু বলার নেই। কংগ্রেস যেভাবে মৌলবাদি শক্তিকে মদত দিয়ে থাকে-ওরাও তাই করছে। অর্থাৎ সমস্যা হচ্ছে ভারতের রাজনীতিতে সেকুলার আব ধর্মনিরেপেক্ষ অবস্থান বলতে কিছু নেই।

কারন ও স্বাভাবিক-ধর্মের সুরসুরি দিয়ে সহজে ভোট পেলে কে আর তার বিরুদ্ধে যাবে। এই করুন অবস্থাটা আমি ছোটবেলায় শিখেছিলেম কমরেড আবদুল বারির কাছ থেকে। উনি মুর্শিবাদ জেলাতে সিপিএমের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক এবং ওর মতন সাচ্চা সেকুলার লোক জীবনে দেখি নি। মুর্শিদাবাদের মতন ৮০% মুসলিম প্রধান জেলাতে ওরমতন সাচ্চা কমরেড চলবেনা বলে উনাকে দ্রুত সরিয়ে মৃগাঙ্ক বাবুকে পরে আনা হয় যার পেছনে ছিল মুর্শিবাদের বারি বিরোধি সিপিএম কমরেডরা যারা আধাসাম্প্রদায়িক। বারিচাচা পারিবারিক বন্ধু হওয়াতে খুব ভাল ভাবে বুঝেছিলাম ভারতে সেকুলার নেতাদের ভবিষ্যত নেই-আর যদি মুসলিম নেতা হয়, তার সেকুলার থাকা আরো কঠিন।

এটাত গেল হতাশার কথা। পরিত্রানের উপায় কি? ভারতে বাম, ডান মধ্যম রাজনীতি- সবাই সাম্প্রদায়িতা উস্কানি দেয়। না হলে ভোট পাবে না। উপায় খুঁজতে হবে না হলে ভারতের রাজনীতির হাল পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের দিকেই যাবে-ইউরোপের উন্নত দেশের দিকে যাবে না। বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি চিন্তার প্রসার ঘটানো একটা কাজ হতে পারে -কিন্ত করবে কে? ইউটিউবে এসব যুক্তিবাদি বিজ্ঞানবাদি আলোচনা অনেক আছে কিন্ত সেগুলি যদি ৫০০০ হিট পায়, জাকির নায়েকের অর্ধশিক্ষিত লেকচার পায় ৩০০০,০০০ হিট। নাম্বারের নিরিখে এই ত অবস্থা যুক্তিবাদের।

আমি মনে করি সমাধান ভারতের উৎপাদন ব্যবস্থাতেই লুকিয়ে আছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর জন্য ভারতের গাঙ্গেয় উপত্যকা আর ২০ বছরে শুকিয়ে যাবে যেহেতু হিমালয়ান গ্লাসিয়ার আস্তে আস্তে ফিকে হচ্ছে। বিজ্ঞানীদের অনুমান ২০৩৫ সালের মধ্যে গঙ্গা নদীটা পুরোটাই শুকিয়ে যাবে হয়ত। ১৯৫০ সালের পর থেকে ভারতের নদীগুলির জল কমেছে ৬০%।

এর পেছনে গ্লোবাল ওয়ামিং ও যেমন কার্যকর, তেমন উচ্চফলনশীল চাষের জন্য জলের চাহিদা বৃদ্ধিও সমান ভাবে দায়ী। জলের স্তর মেট্রোগুলিতে এত নেমেছে, দিল্লী মুম্বাই শহর গুলি জল রেশন করবে আর দুদিন বাদে। মাদ্রাস বা দিল্লীতে এখনই তা হচ্ছে। একটা বিরাট প্রাকৃতিক বিপর্য্য় ভারতের ঘারে গ্লোবাল ওয়ারর্মিং এর হাত ধরে আস্তে আস্তে আসছে। গ্লোবাল ওয়ামিং,জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং আনসাসটেনেবল উচ্চফলনশীল কৃষির যৌথ চাপে, ২০২০ সাল থেকে ভারতে খাদ্য উৎপাদন আস্তে আস্তে কমবে।

বাংলাদেশ অবশ্য এখনি বিপর্যস্ত। ভারত থেকে জলের অসম বন্টনে বাংলাদেশে নদীগুলি মৃত বা রুগ্ন। ফলে বাংলাদেশের বৃহৎ অঞ্চল জুরে দেখা দিয়েছে পরিবেশ বিপর্যয়। যার সাথে আর্সেনিকের সমস্যা থেকে লাগাতার বন্যা এবং খরা বাংলাদেশের বিস্তীর্ন অঞ্চলকে গ্রাস করেছে।

পরিবেগত কারনে ভারত এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যত খুব অন্ধকার। এর থেকে উদ্ধার পেতে, বা লোককে বাঁচাতে বিজ্ঞান এবং উন্নত রিনিউয়েবল প্রযুক্তির কাছে আশ্রয় নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। সরকার এই কাজ একা পারবে না। লাখে লাখে এন জি ও চাই। প্রতিটা গ্রাম এবং শহরে সবুজ প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসারের জন্য মনের মধ্যেও বিজ্ঞান মনস্কতার প্রচারের একটা সুযোগ আসবে। এক্ষেত্রে এই এন জি ও গুলি জনগনের মধ্যে বিজ্ঞানের প্রচার করতে পারে । এই সুযোগ আসছে এবং বিজ্ঞান আন্দোলনের শরিকদের তা হারালে চলবে না।

মৌলবাদের সাথে পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্পর্কটা বা মিসিং লিংকটা একটু বোঝা শক্ত হতে পারে। এর কারন আমাদের অধিকাংশ পাঠক, মৌলবাদকে বস্তুবাদি সমস্যা হিসাবে ভাবে না। বাংলাদেশ থেকে হিন্দু বিতারন মৌলবাদি বা সাম্প্রদায়িক কারনে না । বাংলাদেশের হিন্দুরা ভিখিরি হলে ওদের পেছনে কেও লাগত না, আবার বাংলাদেশে তেল থাকলে, পশ্চিম বঙ্গ থেকে হিন্দুরা বাংলাদেশে যেত। আসল সমস্যা বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ এত কম, লোকেরা প্রায় খেতেই পাচ্ছে না -এই অবস্থায় হিন্দুদের সম্পতি দখল করে কেও যদি খেতে পায় ত খাবে। সেটা সাম্প্রদায়িক না -বস্তুবাদি কারন। সব জাতিদাঙ্গার পেছনে বস্তুবাদি কারনটাই মুখ্য-আর সেটা হচ্ছে সম্পদ এবং খাদ্যের অপ্রতুলতা। এই যে আজ মিশরের আন্দোলন এবং তার থেকে মুসলিম ব্রাদারহুডের উত্থান আমরা দেখলাম বা দেখছি এর পেছনে মূল কারন মিশরের হাঙ্গার ইন্ডেক্স বা পেটের জ্বালা গত ৫ বছরে লাফিয়ে লাফিতে বেড়েছে। মিশরে দাঙ্গা এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের মূল কারন পেটের জ্বালা।

কালকে লেনিনগ্রাড সিনেমাটা দেখছিলাম। জার্মানি তখন লেনিনগ্রাদ ঘিরে ফেলেছে। ডিসেম্বরে লেনিনগ্রাদে একফোঁটা খাবার নেই। পেটের ক্ষিদেয় লেনিনগ্রাডের নাগরিকরা তখন ক্যানিবাল। মৃতদেহের হাত পা কেটে খাচ্ছে। একটা এয়ার রেড হল। কিছু লোক মৃতদেহের হাত পা কেটে মাংস তুলতে ঘোটলা করছে রাজপথে। হঠাৎ একজন দেখল একটা বোমা ফাটে নি। বোমাটা চিনির প্যাকেটের মতন দেখতে। হঠাৎ গুজব উঠল ওটা বোম না – চিনির প্যাকেট। সোভিয়েত প্লেন ফুড ড্রপ করেছে কাল রাতে। ওখানে আসলে চিনি আছে। লোকে তখন খিদেতে এত কাতর বোমাটাকে চিনির বস্তা ড্রপ করা হয়েছে ভেবে বোমাটা খুলতে দৌড়ল। হাত দিতেই, বোমটা ফেটে ওদের সবার বোমসমাধি।

মৌলবাদ হচ্ছে সেই বোমা-যখন লোকে খেতে পাবে না -ওটাকেই চিনির বস্তা বলে খেতে যাবে এবং সেটা ওদের মধ্যে ফাটবে। পাকিস্তানে এটাই হয়েছে। বাংলাদেশে এটা ক্রমবর্ধমান পরিণতি। ভারতে প্রাকৃতিক বিপর্যয় এড়াতে না পারলে বিরাট খাদ্য সংকট এগিয়ে আসছে। খাদ্য এবং পানীয় হবে অপ্রতুল। এগুলি যখন হবে-মৌলবাদি বোমাটা বলবে আসলে আমরাই তোমাদের জল আর খাবার দেব- লোকে সেটা বিশ্বাস করবে এবং বোমাটা ফাটবে।

একটি প্রকৃত বিজ্ঞান মনস্ক মনই বুঝতে সক্ষম, আমরা কেও হিন্দু মুসলমান বা কমিনিউস্ট নই । যখন আমরা নিজেকে হিন্দু, মুসলমান বা কমিনিউস্ট ভাবছি, আসলে নিজেদের অজান্তে আমরা শাসক শ্রেনীর বোরেতে পরিণত হচ্ছি। যদি আমাদের জীবনে সাধনাটা মানুষের জন্য,সমাজের উপকারের জন্য হত-এই ধরনের বিভাজনের রাজনীতির বিষ ভারতের রক্তকে নীল করতে পারত না।