লেখাটি ১৬ জুন দেওয়ার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিল। কিন্তু পোস্ট করতে একটু দেরি হয়ে গেলো।

মানবসভ্যতার অগ্রযাত্রার শুরুতে নারী-পুরুষের অগ্রাধিকার ছিল প্রায় সমান। ধারণা করা হয় কৃষিকাজ করার পদ্ধতি, মৃতপাত্র তৈরি, সুতা তৈরি এমনকি আগুন জ্বালানোর কৌশলও নারীরাই উদ্ভাবন করেছিল। তাছাড়া পরিবার প্রথার শুরুতে নারীরাই পরিবার নিয়ন্ত্রণ করতো এবং প্রতিষ্ঠিত ছিল মাতৃতান্ত্রিক পরিবার প্রথা। এরপর প্রয়োজন ও সময়ের আবর্তে বিভিন্ন ধর্মের আবির্ভাব, সামাজিক শৃঙ্খল, চাপিয়ে দেয়া পারিবারিক দায়িত্ব-বিশেষ করে সন্তান জন্মদান ও একহাতে তাদের লালন-পালন, অর্থ উপার্জনে প্রতিবন্ধকতা, শিক্ষায় বৈষম্য ইত্যাদি নানা প্রতিকূল কারণে নারীরা শিকার হয় লিঙ্গ বৈষম্যের। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও নানা আঙ্গিকে, বিশেষ ঘরানায় চলছে নারী-পুরুষের এই লিঙ্গযুদ্ধ।

তবে যেকোনো বিপ্লবই সূচনা করে নতুন পথের। যেজন্য থেমে থাকেনি নারীর অগ্রগতি। নানা প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ফেলে অনেক বৈষম্যের মাঝেও স্ব-স্ব অবস্থানে অনড় থেকেছেন অনেক নারী। সেই সকল স্বপ্রতিভ নারীদেরই একজন হলেন ভ্যালেন্তিনা তেরেসকোভা। সোভিয়েত বংশোদ্ভুত এই নারীই প্রথম মহাকাশ পাড়ি দেন ১৯৬৩ সালের ১৬জুন। তার ভ্রমনকাল ছিল তিনদিনের। গত ১৬ জুন ছিল তার মহাকাশ যাত্রার ৫০ বছর পূর্তি; যেজন্য ইতিহাসের এই স্বর্ণোজ্বল দিনের স্মরণাপন্ন হওয়া।
ভ্যালেন্তিনা ১৯৩৭ সালের ৬মার্চ রাশিয়ার ইয়ারোস্লাভের একটি ছোট্ট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন একজন সামান্ন ট্রাক ড্রাইভার যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত হন এবং মা ছিলেন একজন ক্ষুদ্র টেক্সটাইল কর্মকর্তা। স্কুলে ভর্তি করানো হলেও গৎবাধা শিক্ষাব্যবস্থা ভালো না লাগায় শৈশবেই তিনি স্কুল ছাড়েন এবং অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিজের শিক্ষা চালিয়ে যান। আর শৈশব থেকেই উড়ে বেড়ানোর অদম্য আগ্রহ আর একপেশে স্বপ্ন তাকে একজন প্যারস্যুট পারদর্শী এবং পরবর্তীতে বিমান বাহিনীর একজন চৌকশ পাইলটে পরিণত করে। পাশাপাশি তিনি টেক্সটাইল প্রতিষ্ঠানে সমন্বয়ক হিসেবেও কাজ করেন। তার প্রাণান্ত চেষ্টা আর অদম্য আগ্রহ তার স্বপ্নকে প্রতিহত করতে পারেনি। এরপর ১৯৬১ সালে ইউরি গ্যাগরিনের সফল কক্ষপথ বিচরণের পর ১৯৬২ সালে ডাক পড়ে নারী মহাকাশচারী পাঠানোর। এতে প্রায় চার শতাধিক নারী আবেদন করেন। সেখান থেকে প্রাথমিক নির্বাচন শেষে চুড়ান্ত নির্বাচনে মাত্র ৫জনের মধ্যে ভ্যালেন্তিনাই এই লোভনীয় ও বিশেষ সুযোগটি পান। সেইসাথে ১৯৬৩ সালের ১৬ জুন মহাকাশ বিজয় করে ফিরে আসেন এবং অবসান ঘটান নানা জল্পনা-কল্পনার। পরবর্তী সময়ে এই নারী সোভিয়েত কমিউনিস্ট রাজনীতির পাশাপাশি বিমান বাহিনীর একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

ভ্যালেন্তিনার পথ ধরে গত ৫০ বছরের পথ ধরে মহাকাশযাত্রায় বেড়িয়ে পড়েছেন ক্রমান্বয়ে অনেক নারী প্রায় ৫৭ নারী। তারা হলেন ইরানের আনুশেহ আনসারি, জাপানের চিয়াকি মুকাই, ভারতের কল্পনা চাওলা, কানাডার রবার্টা বন্ডার, কোরিয়ার লিও ইয়াং চুক, ফ্রান্সের হেউগনেরে ক্লডি, আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ নারী ড. মে জেমিসন। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের কল্পনা চাওলা ২০০৩ সালের ১ ফেব্র“য়ারি কলম্বিয়ায় করে মহাকাশ যাত্রা করেন এবং বিজয় শেষে ফিরে আসার সময় ৭ জন নভোচারী নিয়ে কলম্বিয়ার আকস্মিক বিস্ফোরণে নিহত হন। মহাকাশযাত্রার ইতিহাসে এ ধরনের বিয়োগান্তক বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে।
এবারে বিশ্ব বাবা দিবসের আড়ালে পরে যায় ১৬ জুন ভ্যালেন্টিনার মহাকাশে অভিযানের ৫০ বছর। মুখে আমরা নারী জাগরণ, নারীবাদ, সমঅধিকারের কথা বললেও নারী সংগঠনগুলোরও কোনো উদ্যোগ নেই। এদিন বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো নারীর এত বড়ো উত্তোরণের তেমন কোনো কাভারেজই দেয়নি। তবে বিভিন্ন দিবসের রোগে পাওয়া পৃথিবীর বাবা দিবসের মেকি ছবি এবং অনুষ্ঠান দিয়ে ভরে ফেলেছে। অথচ গণমাধ্যমগুলো নারীকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করে হরদম নারীর ছবি ছাপছে। পুরুষ ভোগ্যপণ্যে নারীদের ছবি এবং কোনো অনুষ্ঠানে মেয়েদের অংশগ্রহণ থাকলে এমনভাবে ছবিগুলো প্রদর্শন করে যেন এটা এককভাবে নারীদের অনুষ্ঠান।

এরমধ্যে ১৬ জুন ভ্যালেন্টিনা তেরেস্কোভার মহাকাশে ৫০ বছর উপলক্ষ্যে ডিসকাশন প্রজেক্ট ঢাকা ইমপেরিয়াল কলেজের সাথে যৌথভাবে এক সেমিনারের আয়োজন করে। শিক্ষার্থীরাসহ বিজ্ঞানকর্মীরা এতে অংশগ্রহণ করে। সেমিনারে বিজ্ঞানকর্মীরা ভ্যালেন্টিনা তেরেস্কোভার সংগ্রামের নানাদিক তুলে ধরেন। তারা বলেন, ভ্যালেন্তিনার মহাকাশযাত্রা নারীদের চিরকাল অনুপেরণা জোগাবে। ডিসকাশন প্রজেক্ট এর উদ্যোগে মহাকাশে নারীর ৫০ বছরকে কেন্দ্র করে ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়া এটিএন নিউজের ১৮ জুনের ইয়ং নাইটেও ডিসকাশন প্রজেক্ট এর কর্মীরা অংশগ্রহণ করে। অনুষ্ঠানটির শিরোনাম দ্ওেয়া বিজ্ঞানের আলোয় নারীদের পথচলা। ভ্যালেন্টিনা জীবন ও কর্মসহ বিজ্ঞানের ইতিহাসে নারীদের সংগ্রামের কথাও তুলে ধরা হয়।

এটা পৃথিবীর জন্য সত্যি সৌভাগ্য যে অন্য জায়গাগুলোর মতো মহাকাশযাত্রায় নারীপুরুষের বৈষম্যের ততটা প্রবল নয়। সূচনা পর্বে গ্যাগারিনের ৬১ সালে যাত্রার পরেই ৬৩ সালে ভ্যালেন্তিনা তেরেস্কোভ যেতে পেরেছিলেন। মহাকাশের এই অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়? এই প্রশ্নের কোনো সদোত্তর জানা নেই। কেননা এদেশে বিজ্ঞান গবেষণা ও মৌলিক জ্ঞান চর্চার পাশাপাশি তরুণ প্রজন্মের জ্যোতির্বিজ্ঞান ও মহাকাশবিজ্ঞানে বিশেষ আগ্রহ থাকলেও নেই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার সুযোগ। এমনকি নেই কোনো বেসরকারি সঠিক উদ্যোগ। যদিও তরুণ প্রজন্মকে উৎসাহিত করার জন্য কয়েকটি বিজ্ঞান সংগঠন নিরলস কাজ করে যাচ্ছে ২০/২৫ বছর। তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশ এস্ট্রোনোমিক্যাল সোসাইটি, এস্ট্রোনোমিক্যাল এসোসিয়েশন, ডিসকাশন প্রজেক্ট এবং অনুসন্ধিৎসু চক্র। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক প্লাটফর্ম না থাকায় মহাকাশযাত্রা এদেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে এখনও এক ধরনের স্বপ্নবিলাস।

সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক ধরণের বাণিজ্যিক বিষয় চালু হলেও এস্ট্রোফিজক্স বা এস্ট্রোনমির মতো বিষয়গুলো হালে পানি পায়নি। আমার মতো অনেক নারীই হয়তো মহাকাশে উড়ার স্বপ্ন দেখেছে যা শুধু ছিল বিলাসিতা! কিন্তু আমরা না পারলেও এই প্রজন্মের অনেকেই এস্ট্রোফিজিক্স বা এস্ট্রোনমি নিয়ে ভারতে বা অন্যকোনো দেশে পড়াশুনা করছে। এমনকি নাসাতেও কাজ করার সুযোগ পাবেন তারা। তবে এভাবে ব্যাক্তিউদ্যোগে নয়; আমরা চাই সময়োপযোগী সরকারি উদ্যোগ যেন জোড়ালো হয়। যেই পরিকল্পনা বাস্তবে রূপ নেয়ার জন্য আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাবে। মনে রাখতে হবে দৈনন্দিন কাজেরও বাইরে এক বিশাল জগত তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। বাংলাদেশের নারীরা মহাজাগতিক পথে নিজেদের প্রবাহিত করবে।

খালেদা ইয়াসমিন ইতি
বিজ্ঞান লেখক ও উন্নয়নকর্মী