এই বড় হলরুমটার ভিতরে একটা রুদ্ধদ্বার বৈঠক হচ্ছে। শাব্দিক অর্থে সত্যি সত্যি রুদ্ধদ্বার বৈঠক। কারণ এই বৈঠক সবার জন্যে না, শুধু মাত্র মেম্বরদের জন্য- পোশাক সমিতির সদস্যদের জন্য। কোন সংবাদকর্মী তো নয়ই, কারো বন্ধু-স্বজনও অনুমতি পায়নি এখানে, এই বদ্ধ কক্ষে। কারণ এটা একটা অন্য রকম সভা। এখানে শুধু খাড়া দেয়ালগুলোকেই পরিপূর্ণ বিশ্বাস করা যায়। সভাপতি সাহেবের বক্তৃতা এইমাত্র শেষ হয়েছে, কিন্তু তার রেশ জারি আছে সদস্যদের চোখে মুখে চেহারায়। সেখানে কারও মুখে হালকা আতঙ্কের চিহ্ন, আবার কারো চেহারায় বিদ্রূপ, উপেক্ষা, আর বিরক্তির ভারী প্রলেপ। এদেশের মানুষগুলোই এমন- তিলকে তাল করা তাদের হাড়ের দোষ। কোন দেশে না ভবন ধ্বসে পড়ে! আমেরিকা থেকে লুক্সেমবার্গ-নরওয়ে সব জায়গায় এই সব দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। তাতে কম-বেশী মানুষ মরেও থাকে। এসব নেহাতই দৈব-দুর্ঘটনা। কারো হাত আছে এতে? এই সভায় সমিতি প্রধান শক্ত আশ্বাস দিয়েছেন- সরকার কোন সমস্যা না, আদালতও না। সব সমস্যা ঐ লোকগুলো, কিছু ঘাড় বাঁকা লোক, যারা বনের মোষ ধরে বেড়ায়। সব কিছু মিটে যাক, এইসব লোকদের টাইট দিতে সময় লাগবে না- আশ্বাস পেয়েছে সমিতির সদস্যরা। যে সে ব্যাপার না, দেশের সত্যিকারের উন্নতির ব্যাপার জড়িয়ে আছে এই শিল্পের সাথে। কোন শিল্প যা করে দেখাতে পারেনি, পোশাক শিল্প তা পেরেছে। লক্ষ লক্ষ মানুষকে কাজ দিতে পেরেছে, বস্তা বস্তা বিদেশী মুদ্রা আনতে পেরেছে। কোথায় নিয়ে গেছে দেশকে এই শিল্প! দেশের ষোল কোটি মানুষ তা মানে। শুধু সমস্যা ঐ কিছু লোক। আসলে যে মূল কথাটা বলবার জন্যে সভাপতি সাহেব ডেকেছিলেন সবাইকে এই রুদ্ধ কক্ষে তা ঐ সবার সামনের দশাসই টিভি পর্দাটায় দেখা গেছে- সবাইকে দেখানো হয়েছে। এই ঘণ্টা কয়েক আগে রেকর্ড করে রাখা হয়েছিল ওটা সবার জন্যে। আবার চলছে ওটা, বারবার চলছে। আশুলিয়ার ঘানী প্লাজার ধ্বংসের ভিতরে একটা সুস্থ এবং অনাহত আস্ত মেয়ে পাওয়া গেছে- নাম তার নাজমা। সে এক বিরাট ব্যাপার! সমস্ত দেশ যেন হুমড়ি খেয়ে পড়েছে মেয়েটার উপর। টিভির লোক আর সাংবাদিকদের প্রায় উন্মাদ অবস্থা। কেউ বলছে অলৌকিক, কেউ বলছে আল্লা নিজের হাতে এমনটা করে রেখেছেন- তা না হলে দানা-পানি ছাড়া আঠেরো দিন কোন মানুষ এমন যমপুরীতে বেচে থাকতে পারে? কেউবা পূব-পশ্চিম তোয়াক্কা না করেই টুপী ছাড়া ভক্তিতে মাটিতে মাথা ঠুকছে। দেশের মাথা স্বয়ং দৌড়ে এসেছেন ব্যাপারটা দেখতে। তবে সভাপতি সাহেব পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, ছোট-খাট কোন সুযোগই হাতছাড়া করা যাবে না। পোশাক-পতিদের শত্রুর অভাব নেই। শত্রুদের হাতে মেয়েটা পড়ার আগেই তার জন্য আমাদের দৃষ্টান্তমূলক কিছু করতে হবে।

সভাপতির অদৃশ্য হাতের ইশারায় সবকিছু হচ্ছে, যেমন করে হয় এই বিশ্বের সবকিছু ঈশ্বরের গায়েবী ইঙ্গিতে। সেইমতো বিস্ময়-কন্যা নাজমার ধ্রুপদী চিকিৎসা শেষ হয়েছে সফল ভাবে। হাসপাতালের বেডে শুয়েই রহস্য-কন্যার ট্রেনিং চলছে, স্টেজে দাড়িয়ে মাইক্রোফোনে কথা বলার ট্রেনিং। মা-বাবা স্বজন, সবাইকে দেখা হয়েছে। কথা হয়েছে সবার সাথে, তবে অল্প সময়ের জন্য। কারণ, সে এখন বিস্ময়-কন্যা। সারা দেশের কৌতূহলী মানুষের বিস্ময় দূর করা এখন তার অন্যতম কাজ- তাদেরকেও সময় দিতে হবে। আগে তার সময় যেত ভয়ানক ধীরে। মাসের পুরা মাইনেটা হাতের তালু স্পর্শ করতে না করতে যখন স্বামী এসে তা চিলের মতন ছো মেরে নিয়ে যেত তখন থেকে পরের একমাস সময় যেত তার কুড়ে শামুকের গতিতে। হায়রে ভাগ্য! আর এখন? চার দিন হয়ে গেছে এই রাজপুরীর হাসপাতালে, মনে হচ্ছে- এই তো ঘণ্টা চারেক গেল মাত্র। মানুষ-জন এসে আজব সব কথা বলে। মানুষের আসা কি আর থামবে? এই তো, এই মাত্র এক ভদ্দরলোক ছবি তোলা শেষে জিজ্ঞেস করলো- ‘এমন একটা দুর্ঘটনায় আপনি বেঁচে গেছেন, নিশ্বাস নিচ্ছেন, কি আশ্চর্য। আপনার অনুভূতি এখন কেমন? লোকটার কথার আগা-মাথা কিচ্ছু বোঝেনি নাজমা। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকেছে কালো কালো ক্যামেরার দিকে। কি যন্ত্রণা! মেজাজটাকে যেন খিচড়ায়ে দিয়ে যায় মানুষগুলো। লোকগুলোর আর কি কোন কাজ নেই?

নাজমা খাতুন বেঁচে আছে- বিস্ময়-কন্যা হয়েই বেচে আছে এখনও। বেঁচে থাকার পুরস্কারটুকু তাকে নিতেই হবে, ইচ্ছে করে হাসিমুখে নিতে হবে। সেইমতো সব এগুচ্ছে। তার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে সেই রুদ্ধদ্বার বৈঠকের কক্ষে। ঠিক সেই কক্ষটার ভিতরে এখন সবাই অপেক্ষা করছে মাহেন্দ্রক্ষণের। তবে কক্ষটার দরজাগুলো আগের মতো রুদ্ধ নেই। তারা খোলা আছে বিদেশী দূতদের জন্য, দেশী-বিদেশী সংবাদকর্মীদের জন্যে এবং আরও অনেক বিদগ্ধজনের জন্যে। কখন মঞ্চে আসবে বিস্ময়-কন্যা! কখন হাতে ধরিয়ে দেয়া হবে তার প্রাপ্য- তার অর্ধ লক্ষ টাকার চাকুরী আর খিলাত! দেরী যে আর সহ্য হয় না। এমন সময় মাইকে ঘোষিত হলো- এবার বিস্ময়-কন্যা তার পুরস্কার নিতে এবং অনুভূতি জানাতে মঞ্চে আসছেন। ঐ তো দেখা যায়, দুজন সুসজ্জিত নারী রহস্যকন্যার দুবাহু ধরে অনেকটা টেনে এনে দাড় করিয়ে দিয়ে গেল মঞ্চে। সুধীজন একটু নড়েচড়ে বসলেন। মাইক্রোফোনের সামনে এখন পোশাক কর্মী নাজমা দাড়িয়ে পাঁচতারা হোটেলের কর্মকর্তাদের পোশাক গায়ে চাপিয়ে।
-সালামালাইকুম। আমি কি বলবো ঠিক বুজতারছি না। তয় আপনেরা আমারে যে এত বড় একখান চাকরী দিছেন সেইজন্য আমি খুশী। এহন আমার মনে হইতাছে আরও কিছু বলবার আছে আমার। দয়া করে আমারে যদি দুই মিনিট সময় দেন, তাইলে আমি কৃতজ্ঞ হইতাম।
আর কিছু না বলে তখনই নিজের কালো কাপড়ের ব্যাগটা নিয়ে দ্রুত বাথরুমে ঢুকে পড়ে বিস্ময়-কন্যা। কি হলো, সবার মনে প্রশ্ন। হয়তো জরুরী প্রকৃতির ডাক। ঠিক দুই মিনিট পরে ফিরে এলো নাজমা, পরনে তার কাজের পোশাক- হোটেলের নয়, পোশাক কারখানার আটপৌরে শেলোয়ার-কামিজ। কাঁধে ঝোলানো কালো কাপড়ের ব্যাগ আর হাতে ধরা হোটেলের ধ্রুপদী পোশাক নিয়ে আবার মঞ্চে এসে দাঁড়ালো সে। কি হতে যাচ্ছে, সবার মনে তখন আরও বড় প্রশ্ন।
-আমার বেয়াদবি নিবেন না। আমি আমার এই খুশির চাকরীটা নিতে পারতাছি না। আমারে মাফ কইরা দিয়েন। এনাম হাসপাতালের বেডে হাত-পা কাডা মানুষগুলারে আমি দেইখা আইছি জাহান্নামের আজাব খাইতাছে। অগো দেইখা আমার মনডা জখম হইছে। মঞ্চে উইডা মাথাডায় আমার হঠাৎ কি জানি হইলো- চক্ষে দেহি খালি লাশ আর লাশ- হাজার হাজার লাশ। মাফ চাই, চাকরীর আমার দরকার নাই। এমুন চাকরী দিলে সবাইরে দেন, লগে আমারও দেন। খাইলে সবাই মিল্লা খামু, নাইলে নাই। এইবার আমি যামুগা।
কথাগুলো বলতে বলতে বিস্ময়কন্যার কণ্ঠ কেঁপে যায়। শরীর আর মুখ তার কেঁদে উঠে, কিন্তু চোখ কাঁদে না। আঠেরো দিন মাটির চাপে-তাপে পড়ে বিস্ময়কন্যার দেহে মনে কি এক রাসায়নিক পরিবর্তন হয়েছে পিট কয়লার পরিণতির মতো। ‘মুখচোরা’ নাজমা হঠাত করে হয়ে উঠেছে মুখরা। হাতে ধরে রাখা পাঁচতারা লেবাসটা আস্তে করে মঞ্চে রেখে চলে যেতে উদ্যত হয় নাজমা খাতুন। পোশাক কর্মীর একরোখা উচ্চারণে খুব কাছে যেন আকাশটা ভেঙ্গে পড়ে সহসা। বিস্ময়ে সুধীজনের চোখ কপালে উঠে। এত সাহস কোথায় পেল আটপৌরে মেয়েটা।
জান বাচাতে মৌ-লোভী ভাল্লুক-তস্করকে যেভাবে মৌমাছির ঝাঁক চারদিক দিয়ে জাপটে ধরে ঠিক সেইভাবে কয়েক ডজন সংবাদকর্মী রহস্যকন্যাকে ঘিরে ধরে। তাদের নানামুখী প্রশ্নের হুলে জর্জরিত করে তোলে তাকে।
-আপনি কেন এমন একটা সিদ্ধান্ত নিলেন?
-কিভাবে এমন একটা মহান কাজ আপনি করতে পারলেন?
-এই আকর্ষণীয় চাকুরীর প্রলোভন আপনি কিভাবে ত্যাগ করতে পারলেন?
ইত্যাদি। ইত্যাদি। সওয়ালের যেন শেষ নেই। প্রতিটা সওয়ালের জবাব তাদের চাইই। চারদিক থেকে ক্যামেরার ঝলকানিতে চোখ অন্ধ হবার যোগাড়। এখানে আর এক মুহূর্ত নয়। তাড়াতাড়ি পা চালায় নাজমা। কয়েকজন সংবাদ কর্মী বড় দাবী নিয়ে পথ আটকায় তার। তাদের একজন গড় গড় করে বলে চলে।
-আপনি যে কত বড় একটা কাজ করেছেন, তা কি আপনি জানেন? আপনি চলুন, আপনাকে গাড়িতে করে পৌঁছে দিয়ে আসি।
সাংবাদিকের পুতুপুতু কথায় অনেকটা জ্বলে উঠে বিস্ময়-কন্যা।
-দেহেন, বহুত জ্বালাইছেন এতদিন, আর না। আমার পিছে পিছে ঘুরেন ক্যান? আমার হাত-পা আছে দেহেন না? আমি তো নিজেই একখান কাম জোগার কইরা নিতে পারি। যাদের হাত-পা নেই, পইরা আছে, তাদের কাছে যান না ক্যান? তাগো লাইগা কিছু করতে পারেন না? আর গারী দেহাইয়েন না। সারা জনম পায়ে হাইটা পিপড়ার লাহান লাইন ধইরা কামে গেছি আর আইছি। এহনও পারুম। গারী লাগবো না। সারা দুইন্যা এক ভাও, মোরা বাই উল্টা নাও। যান, পথ ছারেন।
রহস্যকন্যার ধাতানি খেয়ে সাংবাদিকরা রাস্তা ছেড়ে দেয়। তাদের ভিতর দিয়ে সতর্কে পথ করে নেয় নাজমা খাতুন। মানুষ জনের ভিড় ছেড়ে দ্রুত পা চালিয়ে সোজা পূর্ব দিকে হাটতে হাটতে কোন এক রাস্তার বাকে একসময় হারিয়ে যায় বিস্ময়-কন্যা।

ওদিকে বড় বড় ঝড় উঠে সারা দেশের সব গণমাধ্যমে আর মানুষের মুখে মুখে। সবাই খুঁজে ফেরে বিস্ময়কর সাহসী সেই প্রতিবাদী মুখখানা। কিন্তু হারানো জিনিস আর খুঁজে পাওয়া যায় না। তাৎক্ষণিক ভাবে প্রতিশ্রুতির পর প্রতিশ্রুতি জমা হতে থাকে ঘানি প্লাজার কলুদের পদভারে পিষ্ট খোঁড়া পঙ্গু মানুষগুলোর জন্য। সময় খুব মস্ত হেকিম। আস্তে আস্ত সে প্রতিবাদের সিডর, আর মহাসেনকে দুর্বল করতে করতে একসময় মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়। চিকিৎসার ধরন তার এমনই। সময়ের সেই সম্মোহনী সেবায় পোশাকপতিদের জয় হয় এই জনপদে অনেকটা ইতিহাসের ধারাবাহিকতায়। প্রতিশ্রুতির ভারে চাপা পড়ে যায় পোশাক কর্মীদের সব অধিকার।