[এটি কোন লেখা নয়। একটি মর্মান্তিক ঘটনা। আমার কষ্টটা লাঘব করার নিমিত্ত নারীবাদী আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত এমন একজনের হাতে ঘটনাটি তুলে ধরতে চেষ্টা করলাম। সাড়া মিলল না। অনেকের সাথে শেয়ার করে যদি কিছুটা যন্ত্রনামুক্ত হতে পারি সেই আশাতেই ঘটনাটি এখানেই শেয়ার করছি। নারীবাদী আন্দোলন কারীরা অনেক সময়েই পুরুষদেরকে প্রতিপক্ষ হিসেবে ধরেন। কিন্তু নারীরাও নারীদের জঘন্যতম শত্রু হতে পারে। শত্রুর কোন লিংগভেদ হয় না]

রিক্সার চাকা ফেটে গেলে সংবাদ পত্রে খবর হয়। কিন্তু যৌতুকের জন্য স্বামী, শাশুড়ী, ননদ, এবং ননদের স্বামীর চাপে একটি গৃহবধু আত্মহত্যার ঘটনাটি কেউ জানল না। গত ৫ই মে ২০১৩ তারিখে ঘটনাটি ঘটল। একজন বিশেষ নাগরিক বলল – ওর আত্মহত্যা তো অনেক আগেই ওভারডিউ হয়ে ছিল। আর একজন বিশেষ নাগরিক বলল – বাংলাদেশে এরকম কত আত্মহত্যা হয় কে কার খবর রাখে!

তা হলে, স্বামী-শাশুড়ী-ননদের পীড়নে আত্মহত্যা কোন ব্যাপারই না! রিক্সার চাকা ফেটে যাওয়াই ব্যাপার?

মেয়েটি আত্মহত্যা করল ৫ তারিখে। কোন ময়নাতদন্ত হল না। স্রেফ গ্রামে এনে মাটি চাপা দেওয়া হল। সাথে সাথে ঘটনাটিও মাটি চাপা পড়ে গেল। স্বামীটি এখন দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। সব কিছুই স্বাভাবিক। কিন্তু পৃথিবীর উলটো পিঠে অবস্থান করেও স্বাভাবিক হতে পারলাম না আমি এবং আমার স্ত্রী মিনু। ছেলেটি মিনুর জেঠতুত ভাইএর ছেলে। একেবারে নিজেদের লোক। ঘটনা মাটি চাপা পড়ে গেছে। আমাদের তো খুশী হওয়ারই কথা। কিন্তু তা হতে পারলাম না।

যৌতুকের কারণে কত গৃহবধুই তো আত্মহত্যা করে। কিন্তু বাবা এবং মায়ের কাছে মাত্র একটিই মেয়ে। তিল তিল করে স্নেহসূধা দিয়ে বড় করে তোলা মেয়েটিকে খুন করে ফেলল একটি পাষন্ড। কীভাবে এটাকে স্বাভাবিক মেনে নেওয়া যায়! মা-বাবা কীভাবে গ্রহণ করবে – “বাংলাদেশে এরকম কত আত্মহত্যা হয় কে কার খবর রাখে!”

আমার একমাত্র মেয়ে প্রায় দশ বছর আগে বিয়ে হয়ে গেছে। হিউস্টন শহরে ভীড়ের মধ্যে একহাতে গাড়ী রেখে অন্য হাতে টেক্সট মেসেজিং করে। তাই প্রতিদিন অফিস থেকে বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত আমরা নিশ্চিন্ত হতে পারি না। একটি মেয়ের মা-বাবা হয়ে এই হতভাগা বাবা-মার কথা অনুভব করেই শোকাহত হচ্ছি। মেয়েটির বাবা-মাকে দেখিনি। শুনেছি এদেশ থেকে ভারতে চলে যাওয়া একটি পরিবার। মেয়েটিকে এদেশে এনে বিয়ে দিয়েছিল। কোর্ট ম্যারেজ।

স্বামীটি তো আমাদের নিজেদেরই ছেলে। এত লাজুক, চুপচাপ, নিরীহ গোবেচারা যে কোন দিন তার গলাটি শুনেছি মনে পড়ে না। লম্বা এবং দেখতে ভারী সুদর্শন। এটাই তার নিজের এবং ভগ্নিপতির ব্যবসায়ের মূলধন। মৃতা মেয়েটিকে বিয়ে করে পায় ১০ ভরি ওজনের সোনা এবং নগদ বিশ লাখ টাকা। এর কয়েক মাস আগে আরও একটি বিয়ে থেকে বেশ কিছু টাকা পয়সা এবং সোনা কামিয়েছে এরা। ধুরন্দর ভগ্নিপতিটি টাকা পয়সার একটা ভাল অংশ ভগ্নিপতির হস্তগত করে থাকে।

আমাদের সুদর্শন ছেলেটি ঢাকার অদুরে এক ছোট শহরের এক ধনাঢ্য ব্যক্তির মেয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্ক (ব্যবসার অভিনয়) গড়ে তুলে। ছেলে নিজেও ধনবান উঠতি ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দেয়। মা দীর্ঘাংগী এবং এখনও সুন্দরী। এটি একটি বাড়তি সহায়ক। দেখলে মনে হবে তিনি নিশ্চিত এক ধনী পরিবারের মাতা বটেন। তিনিও মেয়ের বাড়ীতে যাতায়াত করেছেন। মেয়েকে “মা, আমার মা” বলে জড়িয়ে ধরে ভিজিয়ে দিয়েছেন। আজকালকার স্মার্ট ছেলেরা বাংলা ভাষায় সম্বোধন করে না। মেসোমশাই বা মামা-কাকা ইত্যাদি বড্ড গেঁয়ো। । সম্পর্ক তৈরী হয় “আঙ্কেল” দিয়ে। একটা ঘটনা এরকম – আমাদের এই সুদর্শন ছেলেটি হঠাৎ একদিন আঙ্কেলের বাড়ীতে এসে অভিনয় শুরু করল। মন বেজায় খারাপ। ভগ্নিপতি এপোলো হসপিটালে আইসিইউ-তে আছে। বার লাখ টাকা দরকার। এই মূহুর্তে নিজের বিজনেস থেকে সবটা বের করা গেল না। আট লাখ টাকা হয়ে গেছে। আর চার লাখ লাগবে। মায়ের এফডিয়ার ক্যাশ করা গেলনা।

এভাবেই টাকা আসত। এবং সব টাকার অংশীদার ভগ্নিপতি। কারন নেপথ্যে তিনিই কলকাঠি নাড়াচাড়া করেন। শুনেছি এভাবে কয়েকটা ক্যাবও নাকি রাস্তায় নেমেছে। এই দুজন এবং ভগ্নি মিলিয়ে ত্রি-রত্ন বলা চলে। প্রতিবারই ব্যবসায় সফল যে হত, তা নয়। যখনই ঝামেলা হত, সুদর্শন ছেলেটির বাবাকে জমি বিক্রি করতে হত। জমি বিক্রি হলেই ভগ্নিপতির বাড়তি ইনকাম মিলত।

বাবা ভিসা ছাড়া ভারত-বাংলাদেশ সীমানা অতিক্রম করে এসেছে। মৃত মেয়েকে শেষবারের মত জড়িয়ে ধরে পাগলের গলা ফাটিয়ে চিৎকার করেছে। এ ছাড়া কীইবা তিনি করতে পারেন। পুলিশ, কেস, বিচার করে ত মেয়েকে পাওয়া যাবে না। রিক্তহাতে দেশে ফিরে যাওয়া ছাড়া কিছুই করার নেই।

আজ সাতদিন অতিবাহিত হল। ঘটনাটিকে মাটি চাপা দেওয়া হয়ে গেছে। জীবন স্বাভাবিক হয়ে গেছে। সুদর্শনের একটু বিশ্রাম দরকার। হাত খাট হবে। তখন আবার পথে বেরোতে হবে। ফাঁদ পাততে হবে অন্য এক ধনাঢ্য ব্যক্তির মেয়ের জন্য – ভগ্নিপতি এপোলো হসপিটালে আইসিউতে। আট লাখ টাকার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। আর মাত্র চার লাখ লাগবে আজই। মায়ের কতগুলো এফডিআর পড়ে আছে। কিন্তু ক্যাশ করতে পারলাম না।

এভাবেই কত আত্নহত্যার ঘটনা মাটিচাপা পড়ে যায়। বাংলাদেশে এরকম কত আত্মহত্যা হয় কে কার খবর রাখে!