ফুটপাথ দিয়ে আনমনে হেটে চলা শওকতের পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভিজিয়ে দিয়ে গেল একটা হলুদ টেক্সি ক্যাব। নির্দোষ পানি হলে কোন কথা ছিল না। রাস্তার গর্তে জমে থাকা কালো কাদা আর বালুর তরল মিশ্রন এক মুহুর্তে শওকতের সাদা প্যান্ট জামায় রং করে দিয়ে গেল। সেই সাথে মনটাকেও একেবারে চুপসে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে গেল যেন। কিচ্ছু করার নেই। এটা নিউইয়র্ক শহর। এখানে যার গতিবেগ যত বেশী সে ততো এগিয়ে আছে জীবনের দৌড়ে। আজকে কপালটা তার খারাপ, তা না হলে এত লোক হেটে যাচ্ছে কারো গায়ে পড়ল না, পড়লো গিয়ে তার গায়ে? এই বিদঘুটে চেহারায় খাবারের টোপলা খরিদ্দারকে দিতে গেলে নির্ঘাৎ তারা ভয় পেয়ে দৌড়ে পালাবে, আবার রেস্তোরায় ফেরত গেলে তার পেটে পড়বে লাথি। এক কাজ করা যায়- শুকনো টোপলাটা রেখে ঐ গোল চত্তরের ফোয়ারায় শরীরটারে পাক-সাফ করে নেয়া যেতে পারে। যে কথা সেই কাজ। এই তো সব কেমন ঠিক হয়ে গেল। শরীরটা এখন তার কেমন পরিস্কার ফিটফাট। একটু ঠান্ডা লাগলে গ্রীম্মের দিনে, তেমন কোন ক্ষতি নেই। এইতো এইভাবেইতো ভাগ্য বদলাতে হয়। খরিদ্দার, চাকরী কোনটাই নষ্ট হলো না। কিন্তু এমন উদাহরন শওকতের জীবনে একশটায় একটা। জীবনের চল্লিশটা বছর ভাগ্য তার সাথে শুধু প্রতারনাই করেছে। ভাগ্য তাকে দিতে পারেনি উল্লেখ করার মত কিছুই। ধরতে গেলে জীবনটা এখন তার ঘোলা জলের ডোবা ছাড়া আর কিছুই না।

বাবা-মা পরিজন সহ সকল বংশ প্রশাখার উজ্জল ঠিকুজি থাকা সত্ত্বেও শওকত এখানে, এই শহরে অবৈধ। এই দেশের অবৈধ নাগরিক। সব কাগজ পত্রের মেয়াদ সেই কবে শেষ হয়ে গেছে মেয়াদোত্তীর্ন ওষুধের মত। ওসব এখন পরিত্যক্ত আবর্জনা। কাজ কামের কথা না হয় বাদ। তার পরেও মাথায় এসে যায় সব। প্রথম শ্রেণী থেকে বিশ্বাবিদ্যালয় জীবনের ষোলটা বছর কঠোর নিষ্ঠা আর অধ্যবসায় দিয়ে বিদ্যাশিক্ষা করে দেশে একটা চাকরীতো জুটেছিল তার। সেখানে একটা চেয়ার ছিল, টেবিল ছিল তার জন্য। কেউনা কেউ স্যার বলে সম্মান টুকুতো করতো। তুলনা এসে যায়, মাথা একটু ডাইনে বায়ে ঘুরালেই তুলনা চলে আসে। এসব অনেক বড় বোধ, দেরীতে পাওয়া বোধ। এখন আর সে সব কাসুন্দী ঘেটে কোন লাভ নেই। এখন যা পাওয়া গেছে তাই সই। রেস্তোরার এই ডেলিভারী বয়ের কাজটাই বা কে দেয় তাকে! সারাটা দিন দুই পায়ের উপর থাকতে হয়- চষে বেড়াতে হয় সারাটা শহর। তাতে ডলার আসে হাতে- অল্প অল্প করে হলেও আসে। সেসব আবার সত্তর গুণ হয়ে টাকা নাম নিয়ে জমা হয়ে যায় দেশে। সত্তর গুণ সম্মান দেশে জমা হয় কিনা জানে না শওকত, তবে সত্তর গুন ইজ্জত যে খরচ হয়ে যায় এই শহরে তা সে বুঝতে পারে হাড়ে হাড়ে। সব এখানে এমন। কারণ এটা নিউইয়র্ক শহর। কথায় বলে এই শহরে যত মানুষ, তার থেকেও বেশী নাকি ইঁদুর। পোষ্য প্রাণী হিসাবে অনেকে ইঁদুর ঘরে রাখে। আবার এই ইঁদূর যখন ভয়াবহ সংখ্যায় বাড়ে তা হয়ে যায় ক্ষতির কারণ। সংখ্যায় বাড়াতে ‘পেটস’ হয়ে যায় ‘পেস্ট’। এই শহরে মানুষের সংখ্যাও ভয়াবহ। তাই বলে তারা পেস্ট নয়। মানুষের থেকে বুদ্ধিমান কোন প্রাণী এই শহরে থাকলে তারা কি মানুষকে পেস্ট ঘোষণা দিতো? মনে হয় করতো। মানুষের ভেতরেও কিছু কিছু মানুষ খুব বেশী বুদ্ধিমান। তারা কি অল্প বুদ্ধির মানুষদের ক্ষতিকর ভাবে? ভাবলেও ভাবতে পারে। সেই কারণেই হয়তো শওকতকে দুই পায়ের উপর থাকতে হয় সারাটা দিন। পায়ে পায়ে চষে বেড়াতে হয় সারা শহর। মাথার অন্ধগলির ভিতরে চলমান ভাবনাগুলোকে এভাবেই অনুভব করতে অভ্যাস্ত হয়ে গেছে সে এখন। এভাবে ভাবলে তার অনেক অজানা প্রশ্নের উত্তর সে একসাথে পেয়ে যায়।

ভাগ্য এক মস্ত খল নায়ক। তার উপরে নির্ভর করা যায় না। তারপরেও ভবিষ্যতের হিসাব নিকাশ করতে গেলে তাকেতো একটু তোয়াজ করতেই হয়। সেই দিক দিয়ে চিন্তা করলে, শওকত ভাগ্য মানে। তবে অতীতে ফিরে তাকালে অদৃষ্টকে তিরস্কার ছাড়া আর কিছু দিতে পারে না সে। বর্তমানও তার কাছে অতীতের মতই তিতা। তাই অতীত আর বর্তমানের সব অপ্রাপ্তি, অপপ্রাপ্তির দায় কপালের উপর আছড়ে পড়ে। এই শহরে বলা যায় দেশী লোকের মচ্ছব। তাদের প্রত্যেকে বলে শওকত সাহেব মহা ভাগ্যবান। ভাগ্যবান না হলে তার ঘরে অমন চান্দের আলোর মত সুন্দরী বউ থাকে? বউতো না যেন সাক্ষাৎ অপ্সরা। শওকত এসব কথা মানতে নারাজ। কারণ সে জানে সুন্দরী স্ত্রী থাকাটা কতটা ঝামেলা আর ঝুকির। বিশেষ করে ট্যাকে যদি পয়সা না থাকে। আর তাই সময়ের গতিকে একটা জলজ্যান্ত সৌভাগ্য দুর্ভাগ্য হয়ে যায়। কথায় বলে গরীবের বউ সবার ভাবী। শওকতের বউ দিলরুবা একসময় হয়ে যায় সবার রুবা ভাবী। কারনে অকারনে দেশী মচ্ছবে রুবা ভাবীর দেবর আর ভাসুরের সংখ্যা বাড়তে থাকে জ্যামিতিক হারে। সেই সাথে বাড়তে থাকে তাদের আবদার আর দাবী। সব কিছুর একটা সীমা থাকা উচিত। শওকতের সহ্যের সীমা কতটা, তা জানেনা সে। তবে সে এটা ভাল করেই জানে কারও দাবী অথবা আবদার যেন স্বামীত্বের দাবীর সাথে সাংঘর্ষিক না হয়। অথচ তাই হচ্ছে। ভেবে পায় না সে, কেন হচ্ছে এসব?

জনে জনে খাবার পৌছে দেয়া শওকতের কাজ। যত হাটে তত ভারী হয় পা। মনের ভারও বাড়তে থাকে সমান তালে। তবে মন্দ হতো না, যদি প্রতিটা প্যাকেটের সাথে ভারী মনের এক একটা খন্ড ছেড়ে আসতে পারতো। হালকা হতো মনটা। কিন্তু তা তো সম্ভব না। তবে হাটতে তার এখন মন্দ লাগে না। যত সময় হাটে অন্য এক নেশা চেপে ধরে তারে। পায়ের উপরে থাকলেই মাথা কাজ করে, চিন্তার নেশা ধরে- তাবৎ চিন্তা। বাড়ীতে গেলে সেগুলো উড়ে যায় কর্পুরের মত। তখন চাপা কবরের দমবন্ধ এক বন্দীত্বের অনুভূতি পাথরের মত চেপে থাকে মাথার ভিতরে, মনের ভেতরে। তার থেকে এই খোলা পথ, ছাড়া হাওয়া অনেক ভালো। ভাল লাগে শওকতের। এখানে সে অনেক বেশী মূক্ত। হাটে সে, হাটে আর ভাবে। অনেক কিছুর কারণ অনুসন্ধান করে তার মন। কিছু জিনিসের সমীকরণ মিলে যায় অনুভবে, তবে মাথায় ঠিক মত আসেনা। না আসলে কিছু করার নেই তার। এই যেমন- রূবার অভিযোগ একেবারে উড়িয়ে দেবে সে কিভাবে? কোন আবেগী রাতই এখন তার আর সফল হয় না। পৌরুষ ফিরে আসে জৈবিক ব্যর্থতায়। মনটাকে কেন্দ্রীভুত করতে পারে না সে শরীরে, নারীতে। বিমুর্ত কোন সেই অশরীরি তাকে এই অপপ্রাপ্তি চাপিয়ে দিল! আগের সময়ের সাথে কিছুই মেলে না। অবশেষে সব ব্যর্থতা শব্দ হয়ে বেজে ওঠে রূবার কন্ঠে, “হায়রে পৌরুষ, আমার যৌবন মরার আগেই মারা যাবে পক্ষাঘাতে।” রূবার উচ্চারিত শব্দগুলো যেন অমর। যেখানেই যায় শওকত সেগুলোর গন্ধ পায়- নিখুত গন্ধ। কারণ খোজার চেষ্টা খুব বেশী করে না সে, তবুও সমাধান মিলে যায় প্রশ্নের। অনেকগুলো সম্ভাব্য সমাধান মাথায় আসে হঠাৎ করে। ভাবে সে- জীবন ধরে রাখার মৌলিক উপকরনগুলোর একটা অনিশ্চয়তা আছে এই শহরে- শেকড় উপড়ানো এইসব বৃক্ষ-মানবদের জন্য কথাটা খুব বেশী খাটে। মন তার কথা বলে চুপি চুপি মাথার ভেতরে- কেন নয় বিবর্ণ বৃক্ষ, অনেকের মত সেও? সব সওয়ার স্বভাব মাটির মত তারও আছে। পুরনো পরিচিত সব বোধ আর চেতনা গুলো কে যেন অদ্ভুত নৈপুন্যে রক্তের ভেতর থেকে ছেকে বের করে নিয়েছে। হারাবার কষ্টটাই শুধু পড়ে আছে ভেতরে তলানী হয়ে। তবে কি সেটাই তার চৈতন্য ছিন্ন ভিন্ন করে ছড়িয়ে দিয়েছে? না কি অন্য কিছু? ভাবে শওকত- বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শওকত। ভেবে অবাক হয়, জীবনের সরস অংশটাকে ধরে রাখার ক্ষমতা, উপকরণ তার এত কম, অথচ সে সেটা ধরে রেখেছে নামকাওয়াস্তে, রাখতে হয়েছে। এটা এক ধরণের অপরাধ- অন্তত রূবার চোখে। সেই অপরাধেই তো রূবা এখন তার ভেতরে আর যৌবনের বাতাস খোজে না। এটা কি সম্ভব, অন্য কারও ভেতরে রুবা সে বাতাসের সন্ধান পেয়ে গেছে? কথাটা মাথার ভেতর থেকে হঠাৎ করে মনের গহনে চলে যায় শওকতের। কৃতদাসের পিঠে যেন শপাং শপাং চাবুক পড়ে একটানা। ক্রুদ্ধ সাপের হিসি শব্দ শুনতে পায় যেন সে। গভীর একটা মোচড়ানো যন্ত্রনা একটু একটু করে তাকে রাস্তার পঁচা কাদা আর পানির সাথে মিশায়ে দেয়। তার পরেও ভেবে চলে শওকত- হাটে আর ভাবে। ভাবনার তার বুঝি শেষ নেই। একবার ভাবে সে- তার স্ত্রী রুবা তাকে ভালবাসে, আবার বাসেও না। মাঝে মাঝে মনে হয় রূবা যেন তাকে রসিয়ে রসিয়ে খুন করার মত কিছু করতে ভালবাসে। তা না হলে সে তাকে গতরাতে অমন একটা খবর দিত না। একমাত্র গতরাতেই শওকত তার বউয়ের মুখে অদ্ভুত এক হাসি দেখেছিল। আলো নিভিয়ে কানের কাছে মুখ এনে বলেছিল রুবা, “আমার কিন্তু ছেলে হবে।” তারপরে আর কোন কথা নেই- নিরবতা আর অন্ধকার। খবর শুনে কেমন লেগেছিল মনে নেই শওকতের, তবে এই মুহুর্তে রাস্তায় হাটতে হাটতে যেন তার বিবস্ত্র পিঠের উপরে অনেকগুলো চাবুক পড়লো- সপাং বাড়ি পড়লো গত রাতের কথাটা সহসা মনে হওয়ায় । আবারও আশ্রয় মিললো তার রাস্তার পাঁকে। পাঁকেও স্বস্তি নেই। সেখানেও মন প্রশ্ন ছুড়ে মারে- তুমি কি জনক?

ভাবনায় ছাড়ে না শওকতকে। সাপের মত পেচিয়ে থাকে মাথার ভেতরে। হাটার সাথে সাথে শরীরে বাতাস পায় ভাবনাগুলো। মনে মনে ধরতে পারে, বোধে আসে- সে আসলে এক আজব প্রাণী। উল্টো বিবর্তন হয়েছে তার। পরিস্কার হয়ে যায় সব দিবালোকের মত তার কাছে। আগে মানুষ ছিল, এখন হয়ে গেছে পোকা- দেহে নয় মনে। অদ্ভুত প্রাণী বটে- দেহটা মানুষের, অথচ মনটা পোকা মাকড়ের! এই আজব অস্তিত্ব নিয়ে চলা ফেরা করে শওকত- বাজার করে, ব্যাংকে যায়, মসজিদেও যেতে হয় কখনও কখনও। দেশি মচ্ছবে সস্ত্রীক যেতে হয় দাওয়াত খেতে। খাবার টেবিলে তুলতে হয় দেশী রাজনীতির তুবড়ি। আবার ঘরে ফিরে সুখী দম্পতির মত জড়াজড়ি করে শুয়ে পড়তে হয় মিথ্যা অভিনয়ে। ব্যর্থতার দায়ে গোপনে মনে মনে মেনে নিতে হয় অন্যের পিতৃত্বকে নিজের বলে। বুঝতে পারে শওকত, খুব ভাল করে বুঝতে পারে- পোকামাকড়ের জীবনের সাথে তার অনেক মিল। দেহটাই শুধু মানুষের। তার মনের ভেতরে এখন অনেক ইদুর দৌড়ে বেড়ায় অথবা তার পুরা মনটাই ইদুর হয়ে গেছে। পুরান পরিচিত সেই ঘরে ফেরার কোন পথ নেই আর। একদিন যেখান থেকে মানুষের চেহারা নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল, সেখানে ইঁদূর হয়ে ঢুকবে কিভাবে সে? তাই সব কিছুতে সহজ হয়ে যায় শওকত। সহজ হতে হয় তাকে। বোধে পায় সে- অতি গোপনে কিভাবে জানি পিতা হওয়ার অন্ধ প্যঁচানো সুখ জমা হয়ে গেছে মনে- অনিবার্য্য অর্কিড-সুখ। সে সুখে থাকে ছদ্ম অমরতাও। তাই এখন তাকে নিখুত ভাবে সুখী উজ্জল মানুষের অভিনয় করতে হয়- নিখুত ভাবে।