আমি কেন নারীবাদী? মাঝে মাঝেই আমাকে এধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। আমি যদিও কোনো লেখকের তালিকায় পড়ি না, কারণ এত কম পরিমানে লেখার জন্যে কেউ লেখক হয় না। তারপরেও যতটুকুই লিখেছি তাতে অনেক পাঠকই আমাকে উপরোক্ত প্রশ্নটি করেছেন। কেউ কেউ ফোন করেছেন আমার কণ্ঠ শুনে নিশ্চিত হওয়ার জন্য যে, আমি সত্যি সত্যিই পুরুষ কি-না। কেউ আবার ফোনে আমার কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছেন তারপরও জিজ্ঞেস করেছেন, ‘আপনি আসলেই কি একজন পুরুষ?’ আমার নারীবাদী মনোভাবের জন্য অনেকেই আমাকে ধন্যবাদ দিয়েছেন বটে, তবে এজন্যে যারা আমাকে হেয় করার চেষ্টা করেছেন তাদের সংখ্যাও একেবারে কম নয়। যাইহোক ব্যক্তিগতভাবে আমি পুরুষ, কিন্তু দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করছি আমি একজন নারীবাদী। আমি আরও মনেকরি নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল সুস্থ মস্তিস্কের মানুষেরই বর্তমান বাস্তবতায় নারীবাদী হওয়া উচিত। আমার যুক্তিগুলি সংক্ষেপে উল্লেখ করলাম।

প্রথমত: আমি একজন মানুষ। মানুষ হওয়ার কারণে স্বভাবতই আমি মানবতায় বিশ্বাস করি। সেকারণে মানবাধিকার কোথায় এবং কিভাবে লুণ্ঠিত হচ্ছে তা আমার অন্ততঃ কিছুটা জানা উচিত। আমি দেখতে পাচ্ছি সমগ্র বিশ্বের সকল সম্পদের শতকরা ৯৪ ভাগ ভোগ করছে মাত্র ১৭ শতাংশ মানুষ। বাকি ৮৩ শতাংশ অসহায় মানুষের ভাগ্যে জুটছে বিশ্ব-সম্পদের মাত্র ০৬ শতাংশ। একই কারণে ৭০০ কোটি মানুষের পৃথিবীতে খাদ্যদ্রব্য উদ্বৃত্ত রয়েছে বটে কিন্তু প্রতি পাঁচ সেকেন্ডে একজন করে মানবশিশু অনাহারে মারা যাচ্ছে। অনাহারী লোকদের ৯৮ শতাংশই উন্নয়নশীল দেশ সমূহের, পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে সেইসব দেশসমূহে নারীরাই সবচেয়ে বেশি পিছিয়ে রয়েছে এবং তারাই বেশি আক্রান্ত। সমগ্র বিশ্বকে যদি একটি পরিবার ধরি, তবে সে পরিবারে খাদ্যের কোনো ঘাটতি নেই অথচ শুধুমাত্র এশিয়া-প্রশান্ত এলাকাতেই ৫৮ কোটি মানুষ অনাহারে অথবা অর্ধাহারে রাত্রি যাপন করছে। আমার মধ্যে মানবতাবাদের বিন্দুমাত্র ছোঁয়া যদি থাকে, তবে আমি অবশ্যই এসব অপ্রাকৃতিক এবং অযৌক্তিকভাবে সৃষ্ট আকাশ-পাতাল বৈষম্যের বিরুদ্ধে অবস্থান করবো, ইহাই স্বাভাবিক। তাই যদি হয় তবে আমাকে সনাক্ত করতে হবে অবহেলিত ৮৩ শতাংশ মানুষের তালিকায় কারা রয়েছে। আমি জানি এবং ভালমতোই জানি যে বঞ্চিতদের প্রায় শতভাগই নারী। ২০১২ সালের জাতিসংঘের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী পৃথিবী নামক এই গ্রহটির ৯৮ শতাংশেরও অধিক ভূমি এবং সম্পদের নিয়ন্ত্রণকারী পুরুষ। সংখ্যায় সমগ্র জনসংখ্যার অর্ধেক হওয়া সত্ত্বেও নারী এই পৃথিবীর মাত্র ২ শতাংশেরও কম সম্পদের মালিক। এইযে সমগ্র নারীজাতির উপর এক প্রকারের অসম্ভব দাসত্ব জেঁকে বসেছে, এই অবস্থায় কেউ যদি নারীবাদী না হয় তবে তাকে কোনোমতেই আমি বিবেকবান এবং সভ্য মানুষ হিসেবে বিবেচনা করতে পারি না। কাজেই আমার নারীবাদীতার কারণ কিছুটা পরিস্কার।

দ্বিতীয়ত: আমি লিঙ্গ-সমতায় বিশ্বাসী। পুরুষ-আধিপত্য অথবা নারী-আধিপত্য এই দুইয়ের কোনোটাতেই আমি বিশ্বাস করি না। অথচ বাংলাদেশ নামক যে দেশটিতে আমার জন্ম, সেই দেশটি ভয়ঙ্কর পুরুষতান্ত্রিক। বাংলাপিডিয়ার তথ্যমতে ‘এদেশের নারীরা পুরুষের তুলনায় সপ্তাহে গড়ে ২১ ঘন্টা বেশি পরিশ্রম করে বটে কিন্তু ঘর গৃহস্থালীর কাজের অর্থনৈতিক মূল্য না দেয়ায় নারীর শ্রমকে করে রাখা হয়েছে অর্থহীন। তাছাড়া সরকারী খাতের মোট ৯,৭১,০২৮ জন চাকরিজীবির মধ্যে মাত্র ৮৩,১৫৬ জন মহিলা, শতকরা হিসাবে যা দাঁড়ায় মাত্র ৮.৫৬ শতাংশ। আবার ৮৩,১৫৬ জন মহিলা চাকরিজীবির মধ্যে ৭৪,৮৮৪ জনই(৯০ শতাংশের অধিক) তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত। সচিবালয়ে মহিলা কর্মচারীর সংখ্যা নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলিতে ৮,৬১১ জন কর্মচারীর মধ্যে মাত্র ৭৮৪ জন মহিলা(প্রায় ৯.১ শতাংশ)। ২,০৭০ জন গেজেটেড কর্মকর্তার মধ্যে মাত্র ২১২ জন মহিলা।’ এসবই পুরুষতান্ত্রিকতার প্রতিফলন। এই পুরুষতান্ত্রিকতা গ্রাস করছে মনুষ্যত্বকে, রুখে দিচ্ছে সকল জাতীয় অগ্রগতিকে। আমি মনেকরি শিল্প-সাহিত্য-দর্শন-বিজ্ঞান-সংস্কৃতি-সভ্যতার সকল ক্ষেত্রে পুরুষ এবং নারীর সমান অংশগ্রহণের মাধ্যমেই কেবল অভীষ্ট জাতীয় লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব। আমি আমার নিজের ভাল চাই, আমার সন্তানদের ভাল চাই। আমি চাই আমার প্রিয় বাংলাদেশের সকল মানুষ ভাল থাকুক। আমি এদেশের একজন মানুষ, সেকারণে দেশ এবং দেশের মানুষ সম্পর্কে আমার মত থাকবে। এদেশের কোটি কোটি গৃহবধূর করুণ আর্তনাদ আমার কানে বাজে। আমি দেখতে পাই এদেশের নারীরা পরিগণিত হচ্ছে পুরুষের যৌন-সামগ্রী হিসেবে, নারীকে মনে করা হচ্ছে শুধুমাত্র সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র-বিশেষ হিসেবে, ভয়াবহ পারিবারিক সহিংসতা সারা দেশে ব্যাপকভাবে বিরাজমান, নারী আজ শিকার হচ্ছে গণধর্ষণের, ধর্ষণ থেকে রেহায় পাচ্ছে না শিশু, এখনও র্দোরা মারার খবর আসছে, পুরুষের বহুবিবাহের মতো ঘৃণ্য প্রথা এদেশে খুবই স্বাভাবিক বিষয় এবং তা সমর্থন করছে রাষ্ট্রীয় আইন, বাল্যবিবাহ চলছে অতিমাত্রায়, যৌতুক প্রথা আজ নারীর জীবনকে বিভীষিকাময় করে তুলেছে, এসিড নিক্ষেপ করে ঝলসে দেয়া হচ্ছে নারীর মুখমন্ডলসহ সারা শরীর, দেদারছে পাচার হচ্ছে নারী নামক পণ্য, পতিতালয়ে বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে নারীকে। কাজেই এই বাস্তবতায়ও যে নিজেকে নারীবাদী মনে করবে না তাকে আমি সুস্থ মানুষ ভাবতে পারি না।

তৃতীয়ত: আমি ব্যাক্তিস্বাত্যন্ত্রবাদে বিশ্বাসী। কিন্তু এদেশে ব্যাক্তির মৌলিক অধিকারের কোনো মূল্য নেই। এখানে নারীকে মানুষের মর্যাদা দেয়া হয় না। বিয়ে মানে ধরে নেয়া হয় স্ত্রীর সকল কিছুরই মালিক তার স্বামী, স্বামীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়েও মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত স্বামীকে তালাক দেয়া এদেশের সংস্কৃতি বিরোধী। সভ্য দেশসমূহে যেখানে শতকরা ৫৫ ভাগ বিয়েই বিচ্ছেদ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু এদেশে তার হার মাত্র ১ শতাংশের মতো। অমানবিকভাবে দুর্বিসহ জীবন যাপন করছে এদেশের কোটি কোটি গৃহবধূ। এমন কোনো দিন আমি খুঁজে পাই না যেদিন স্বামীর দ্বারা কোনো গৃহবধূ খুন হলো না। অনেক চালাক স্বামীরা আইনের হাত থেকে বাঁচার জন্যে নিজে খুন করে না ; বরং এমন অত্যাচার করে যাতে বধূ নিজেই আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। সে কারণে হত্যার সাথে সাথে সমান্তরাল ভাবে চলছে আত্মহত্যার ঘটনা। সন্তানের প্রতি মায়ের ভালবাসাও আজ পদদলিত, সীমাহীন নির্যাতনে জীবনকে যখন কোনোমতেই বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না, তখন মা তার বুকের ধনকে সাথে নিয়ে আত্মহত্যা করছে। গত তিনদিন আগের সকল খবরের কাগজেই উল্লে¬খ ছিল রাজধানীর কাফরুলে দুই সন্তান হাওয়া আক্তার(১১) ও শারমিন আক্তার(৭) কে সাথে নিয়ে জাহানারা বেগম(৩৬) এর বিষপানে আত্মহত্যার খবর। কয়েকদিন না যেতেই আবার আজকের বাংলাদেশ প্রতিদিনে দেখতে পাচ্ছি একই জাতীয আরেকটি খবর। গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার শিমলাপাড়ায় পারিবারিক নির্যাতনের কারণে আট-মাস বয়সের সন্তানকে সাথে নিয়ে বিষপান করে আত্মহত্যা করলো গৃহবধূ সালমা(২৫)। প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া এসব ঘটনা অনেকেরই গা-সওয়া ব্যাপার হলেও আমি তা কিছুতেই মানতে পারি না। আমি পরিস্কারভাবে বুঝতে পারি রাষ্ট্রীয় বৈষম্যনীতি, ধর্মীয় অন্ধত্ব এবং সামাজিক কু-সংস্কারই এসব হৃদয়বিদারক ঘটনার জন্য দায়ী। এসব নির্মমতার শিকার যদি পুরুষ হত, তবে সন্দেহ নেই আমি পুরুষবাদী হতাম। সেই যুক্তিতেই আমি নিরঙ্কুশ নারীবাদী।

চতুর্থত: আমি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যশীল। ত্রিশ লক্ষ মানুষের জীবন দিয়ে এবং তিন লক্ষ নারীর শরীর দিয়ে যুদ্ধ করে এই দেশটি আমরা পেয়েছি। আমি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী এবং সেই চেতনা-সমৃদ্ধ সংবিধানকে আমি পবিত্র মনেকরি। সংবিধানে পরিস্কারভাবে নারী ও পুরুষের সমতার বাণী উল্লেখ রয়েছে। সে কারণে পাকিস্তানী সামরিক সরকারের তৈরি পারিবারিক আইন, যা কি-না আজও অশ্লীল দাঁত বের করে স্বাধীন বাংলাদেশের সকল নারীকে খামছে ধরে আছে, যে আইন নারীকে পরিণত করে রেখেছে অর্ধেক-মানুষে, তাকে আমি থু থু দিই। আসুন, আমার কন্ঠের সাথে কন্ঠ মিলিয়ে বলি ‘পিতার সম্পত্তিতে পুত্র-কন্যার সমান অংশীদারিত্বের আইন চালু করুন’। এখনই করুন। এই মুহূর্ত থেকেই করতে হবে। কারণ বিদ্যমান আইন অনুযায়ী নারী আজও আংশিক মানুষ!

লেখকঃ মিলন আহমেদ।
কলেজশিক্ষক এবং নারীবাদী কলামিস্ট, ঈশ্বরদী, বাংলাদেশ।
যোগাযোগঃ [email protected]