বেহুলা-লখিন্দর

আকাশ মালিক

৩য় পর্ব-

২য় পর্বে বলেছিলাম মনসা আদিবাসী দেবতা। পূর্বে শুধু নিম্নবর্ণীয় হিন্দুদের মধ্যে তাঁর পূজা প্রচলিত ছিল। পরবর্তীকালে উচ্চবর্ণীয় হিন্দুসমাজেও মনসা পূজা প্রচলন লাভ করে। মনসার সাথে উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণদের আত্বীয়তা কীভাবে গড়ে উঠলো সেই কথাটা একটু বলি। বর্তমানে মনসা আর আদিবাসী দেবতা নন, বরং তিনি একজন হিন্দু দেবীতে রূপান্তরিত হয়েছেন। হিন্দু দেবী হিসেবে তাঁকে নাগ বা সর্পজাতির পিতা কশ্যপ ও মাতা কদ্রুর সন্তান রূপে কল্পনা করা হয়েছে। খ্রিষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দী নাগাদ, মনসাকে শিবের কন্যারূপে কল্পনা করে তাঁকে শৈবধর্মের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই সময় থেকেই প্রজনন ও বিবাহরীতির দেবী হিসেবেও মনসা স্বীকৃতি লাভ করেন। কিংবদন্তি অনুযায়ী, শিব বিষপান করলে মনসা তাঁকে রক্ষা করেন; সেই থেকে তিনি বিষহরি নামে পরিচিতা হন। তাঁর জনপ্রিয়তা দক্ষিণ ভারত পর্যন্ত প্রসারিত হয়। মনসার পূজকেরা শৈবধর্মের প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেও অবতীর্ণ হন। শিবের কন্যারূপে মনসার জন্মকাহিনি এরই ফলশ্রুতি। এর পরেই হিন্দুধর্মের ব্রাহ্মণ্যবাদী মূলধারায় মনসা দেবীরূপে স্বীকৃতিলাভ করেন। (তথ্য-উইকি থেকে)

শ্রী আশুতোষ ভট্রাচার্য তার মনসামঙ্গল নামক সংকলন গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন-

‘’এখন দেখিতে হয় পশ্চিম-ভারতের ‘মনসা’ নামটি কখন হইতে জাঙ্গুলী দেবীর পরিবর্তে ব্যবহৃত হইতে আরম্ভ হয়। পূর্বেই বলিয়াছি জাঙ্গুলির সঙ্গে বৌদ্ধ সমাজের সম্পর্ক ছিল, তিনি তান্ত্রিক বৌদ্ধ দেবী ছিলেন। পাল রাজত্বের অবসানে সেন রাজত্বের যখন প্রতিষ্ঠা হইল, তখন এদেশে বৌদ্ধ ধর্মের বিলোপ ও তাহার স্থানে হিন্দুধর্মের পুনরাভ্যুত্থান হইয়াছিল, সেই সময়ে যে সকল বৌদ্ধ দেবদেবীকে নুতন নাম দিয়া হিন্দুসমাজের মধ্যে গ্রহণ করা হইয়াছিল, এই সর্পদেবী তাহাদের অন্যতম। বৌদ্ধ সংস্রবের জন্য তাঁহার জাঙ্গুলী নাম পরিত্যাক্ত হয় এবং তাহার পরিবর্তে মনসা নামকরণ হয়। বাংলার পূর্বোক্ত অর্বাচীন পুরাণগুলি ইহার কিছুকাল মধ্যেই রচিত হয় এবং তাহার মধ্য দিয়া মনসাকে শিবের কন্যারুপে দাবী করিয়া হিন্দু-সমাজের মধ্যে গ্রহণ করা হয়’’।

জাঙ্গুলী থেকে মনসা, রুদ্র থেকে শিব আর সতী থেকে পার্বতী, যে যেভাবেই আমাদের গল্পে আসুন না কেন তাদের মাঝে আমরা খুঁজে পাই ভারত মাতার সন্তানাদির আচার আচরণ, ক্ষোভ ভালবাসা, আশা প্রত্যাশা, সুখ দুঃখের জীবনকাহিনি। আর্যরা কালো না লাল ছিলেন, বৌদ্ধ থেকে ব্রাহ্মণ, নাকি আর্য থেকে ব্রাহ্মণ সে সব ইতিহাস লেখকদের জন্যেই থাক। এই খাল-বিল, নদী-নালা, এই কৃষিভিত্তিক অঞ্চলের সর্প, ভেলা সব আমাদের, বেহুলা-লখিন্দর, মনসা, চাঁদ সওদাগর শিব-পার্বতি আমাদের নিকটাত্মীয়, এই মনসামঙ্গলও শুধুই আমাদের। এক কথায় মনসামঙ্গল আমাদের সুখ-দুঃখ, ঝগড়া-বিবাদ, প্রেম-ভালবাসা আমাদের এক জীবনগাঁথা।

যাক, এখন কথা হলো মনসার প্রতি দেবী পার্বতীর এতো ক্ষোভ এতো ঘৃণা কিসের কারণ। মনসার জন্ম প্রক্রীয়া? পার্বতীর ছেলে গনেশের জন্ম কি স্বাভাবিক প্রক্রীয়ায় হয়েছিল? দেখি এ ব্যাপারে কিতাবে কী লেখা আছে-

শিব পুরানঃ
পার্বতী একদিন নন্দীকে দ্বারী নিযুক্ত করে স্নান করতে যান। এমন সময় শিব সেখানে উপস্থিত হলে, তিনি নন্দীকে তিরষ্কার করে পার্বতীর স্নানাগারে প্রবেশ করেন। এতে পার্বতী অপমানিত ও ক্ষুব্ধ হন। (হবেন না কেন? একেবারে বাথরুমে পারমিশন ছাড়াই?) পার্বতী তার সখী জয়া ও বিজয়ার সঙ্গে পরামর্শ করে জল থেকে পাঁক তুলে একটি সুন্দর পুত্রের মূর্তি নির্মান করেন ও সেই মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন এবং তাকে নিজের বিশ্বস্ত অনুচর নিয়োগ করেন। এরপর একদিন এই কুমারকে দ্বারী নিয়োগ করে পার্বতী স্নানে গমন করলে শিব তথায় উপস্থিত হন। কুমার শিবকে যেতে বাধা দেন। এতে প্রথমে প্রমথগণের সঙ্গে তার বিবাদ ও পরে পার্বতীর ইঙ্গিতে যুদ্ধ হয়। প্রমথগণ, শিব ও সকল দেবতা এই যুদ্ধে পরাজিত হন। তখন নারদের পরামর্শে বিষ্ণু কুমারকে মোহাচ্ছন্ন করেন ও শিব শূলের দ্বারা তাঁর মস্তক ছিন্ন করেন। এই সংবাদ শুনে পার্বতি ক্রুদ্ধ হয়ে বিশ্বসৃষ্টি বিনষ্ট করতে উদ্যোগী হন। নারদ ও দেবগণ তাঁকে শান্ত করেন। পার্বতী তাঁর পুত্রের পুনর্জীবন দাবি করেন ও ইচ্ছা প্রকাশ করেন যেন এই পুত্র সকলের পূজ্য হয়। কিন্তু কুমারের মুণ্ডটি তখন আর পাওয়া যায় না। শিব তখন প্রমথগণকে উত্তরমুখে প্রেরণ করেন এবং যাকে প্রথমে দেখা যাবে তারই মস্তক নিয়ে আসতে বলেন। তারা একটি একদন্ত হস্তিমুণ্ড নিয়ে উপস্থিত হন ও দেবগণ এই হস্তিমুণ্ডের সাহায্যেই তাঁকে জীবিত করেন। অনন্তর শিব তাঁকে নিজপুত্র রূপে স্বীকার করেন। দেবগণের আশীর্বাদে এই কুমার সকলের পূজ্য হন ও গণেশ নামে আখ্যাত হন।

স্কন্দ পুরানঃ
সিন্দূর নামে এক দৈত্য পার্বতীর গর্ভে প্রবেশ করে গণেশের মস্তক ছিন্ন করে। কিন্তু এতে শিশুটির মৃত্যু ঘটে না, বরং সে মুণ্ডহীন অবস্থাতেই ভূমিষ্ট হয়। জন্মের পরে, নারদ এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে গণেশ তাঁকে ঘটনাটি জানান। নারদ
এরপর তাকে এর একটি বিহিত করতে বললে, সে নিজের তেজে গজাসুরের মস্তক ছিন্ন করে নিজের দেহে যুক্ত করে।

বৃহদ্ধর্মপুরাণঃ
পার্বতী পুত্রলাভে ইচ্ছুক হলে শিব অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। অগত্যা পার্বতীর পীড়াপীড়িতে শিব পার্বতীর বস্ত্র টেনে সেটিকেই পুত্রজ্ঞানে চুম্বন করতে বলেন। পার্বতী সেই বস্ত্রকে পুত্রের আকার দিয়ে কোলে নিতেই সেটি জীবিত হয়ে ওঠে। তখন শিব পুত্রকে কোলে নিয়ে বলেন, এই পুত্র স্বল্পায়ু। উত্তরদিকে মাথা করে শায়িত এই শিশুর মস্তকও তৎক্ষণাৎ ছিন্ন হয়ে যায়। পার্বতী শোকাকুল হন। এমন সময় দৈববাণী হয় যে উত্তরদিকে মাথা করে শুয়ে আছে এমন কারোর মাথা এনে জুড়ে দিলে তবেই এই পুত্র বাঁচবে। পার্বতী তখন নন্দীকে মস্তকের সন্ধানে পাঠান। নন্দী ইন্দ্রের বাহন ঐরাবতের মাথা কেটে আনেন। দেবতারা বাধা দিয়েও ব্যর্থ হন। এই মাথাটি জুড়ে শিব পুত্রকে জীবিত করেন। শিবের বরে, ইন্দ্র ঐরাবতকে সমুদ্রে ফেলে দিলে সে আবার মস্তক প্রাপ্ত হয়।
পদ্মপুরাণঃ হরপার্বতী ঐরাবতের বেশে বনে বিহার করছিলেন, তাঁদের সেই মিলনের ফলে গণেশের জন্ম হয়।

লিঙ্গপুরাণঃ
দেবগণ শিবের নিকট উপস্থিত হন ও ব্রহ্মা অসুরদের হাত থেকে নিরাপত্তা চান। শিব তখন নিজ দেহ থেকে গণেশের জন্ম দেন।

দেবীপুরাণঃ
শিবের রাজসিক ভাব দেখা দিলে তাঁর দুই হাত ঘামতে থাকে এবং সেই ঘাম থেকে গনেশের জন্ম হয়।

মৎসপুরাণঃ
পার্বতী চূর্ণক বা বেসম দিয়ে নিজের গাত্রমার্জনা করছিলেন। সেই সময় এই চূর্ণক দিয়ে একটি হাতির মাথা ওয়ালা মূর্তি নির্মান করে তা গঙ্গাজলে ফেলে দেন। পুতুলটি বিরাট হয়ে পৃথিবী পূর্ণ করতে উদ্যত হলে পার্বতী ও গঙ্গা একে পুত্র সম্বোধন করেন ও ব্রহ্মা একে গণাধিপতি করে দেন।

বামনপুরাণঃ
পার্বতী স্নানের সময় নিজের গাত্রমল দিয়ে চতুর্ভূজ গজানন মূর্তি নির্মান করলে মহাদেব তাকে পুত্ররূপে গ্রহণ করেন। বলেন, যেহেতু আমাকে ছাড়াই পুত্রের জন্ম হয়েছে সেহেতু এ বিনায়ক নামে প্রসিদ্ধ হবে এবং বিঘ্ননাশকারী হবে।

শিব ছাড়া গনেশের জন্ম আর পার্বতী ছাড়া মনসার জন্ম বুঝলাম, তাহলে মনসার দোষটা কোথায়? তো এই জনম দুঃখিনী বাপ হারা, মা হারা স্বামী হারা মনসা, রাগী, বদমেজাজী, প্রতিশোধ পরায়ণ, বিদ্রোহী হয়ে উঠলে তাকে আর দোষ দেয়া যায় কি? পিতা তাকে ফুলের ভিতরে লুকিয়ে শিবলোকে নিলেন কিন্তু পার্বতী মনসাকে সেখানে থাকতে দিলেন না। দেবী পার্বতী মহাদেবকে জানিয়ে দিলেন, মনসাকে তিনি স্বর্গলোকে কোনদিনই ঢুকতে দেবেন না, এ তার পণ। দেবগণ সংবিধানে আইন করে রেখে দিয়েছেন, স্বর্গলোকে স্থান পেতে হলে মর্ত্যলোকে মানুষের পূজো অর্ঘ্য পেতে হবে। মহাদেব মনসার উপর শর্ত আরোপ করেছেন, স্বর্গলোকে আসতে হলে তাকে চম্পক নগরীর প্রবল প্রতাপশালী ব্যক্তি চন্দ্রধর বণিকের পূজো পেতে হবে। চন্দ্রধর বণিক, দেবী পার্বতী ও মহাদেবের একনিষ্ঠ পূজারী। এদিকে চন্দ্রধর বণিকের (চাঁদ সওদাগর) পণ তিনি নিম্ন বর্ণের জাতপাতহীন নিকৃষ্ট মনসার পূজো দিবেন না। চাঁদ সওদাগর জানেন দেবী পার্বতী মনসাকে ঘৃণা করেন। মনসাকে তাড়ানোর জন্যে পার্বতী চাঁদের হাতে হাতাল বৃক্ষের যষ্টি দিয়ে রেখেছেন। দেখা মাত্র চাঁদ সওদাগর যষ্টির এক আঘাতে মনসাকে মেরে ফেলবেন। চাঁদ জানেন তার মহাদেবী পার্বতী মনসার একটি চোখ দগ্ধ করেছিলেন আর সেই কারণেই চাঁদ কথায় কথায় মনসাকে পাতালপূরী চ্যাংমুড়ী কানি বলে ব্যঙ্গ করেন। করবেন ই তো, ধন-সম্পধ, মান-সম্মান কিসের অভাব চাঁদ সওদাগরের? তার হাত যে অনেক উপরে। যে হাত দিয়ে সর্বোচ্চ দেবতার চরণে অর্ঘ প্রদান করেন সেই হাত এতো নিচে নামিয়ে মনসাকে তিনি ফুল দিবেন না, এ তার প্রতিজ্ঞা। আর মনসারও পণ, চাঁদের সকল দম্ভ-অহংকার ভেঙ্গে চুর্ণ-বিচুর্ণ করে তার হাত দুটোকে নিচে নামিয়ে ছাড়বেন, মনসার সামনে চাঁদ সওদাগরকে মাথা নত করতেই হবে। এখানে একটা কথা জেনে রাখা ভাল যে, মনসা কোনদিনই বিনা দোষে বা অকারণে কাউকে আঘাত করেন না। কারো অপকার করার জন্যে মনসার জন্ম হয়নি, মনসা তার স্বাভাবিক জীবন যাপনের অধিকারটুকুই চান। এতে কেউ বাঁধার সৃষ্টি করলে, প্রতিপক্ষ হয়ে তার পথ আটকে দাঁড়ালে তিনি অবশ্যই ভয়ংকর ভুমিকা নিতে দ্বিধাবোধ করেন না।

চলবে-

১ম পর্ব-

২য় পর্ব-

দ্বিতীয় পর্বের দুটো লিংক আবশ্যিক হিসেবে এখানে পুনর্বার দেয়া হলো।

দেবী পার্বতী মহাদেবের আদেশ অমান্য করলেন-
http://www.youtube.com/watch?v=pbcRFiPYZM8

দুই দেবীর মধ্যকার যুদ্ধে বলি হচ্ছেন মর্ত্যের নারী
http://www.youtube.com/watch?v=_3l0TqSOULU