আঘাত

আঘাত মূলত দুই প্রকার: শরীরে আঘাত আর সম্পদে আঘাত। শরীরে আঘাত হলো, যেমন, আপনি সজোরে আমার হাতে মারলেন, বা মুখে মারলেন, আমি আহত হলাম, এমন কি আমার শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়ে গেলো। সেটা হতে পারে কাটা দাগ, বা রক্ত জমাট বাঁধা কিংবা হাড় ভাঙা, ইত্যাদি। সম্পদে আঘাত হলো, যেমন, আপনার ঘরে আপনার বিনা অনুমতিতে কেউ জোর করে ঢুকে পড়লো, কিংবা আপনার খাবারটা কেউ আপনার হাত থেকে ছিনিয়ে নিলো। শরীরে আঘাত করা যে খারাপ তা কমনসেন্স থেকে সহজেই উপলব্ধি করা যায়। সম্পদে আঘাতের সমস্যা নিয়ে মানুষের মাঝে দ্বিমত কিছুটা বেশি। তবে এমনও মানুষ আছে যারা অনাক্রমণশীলের শরীর আর সম্পদ উভয়তেই আঘাতের পক্ষপাতী।

এর বাইরে আরেক রকম আছে যাকে অনেক সময়ই আঘাত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যদিও সত্যিকার অর্থে সেটা কোনো আঘাত নয়। কোনো প্রকার স্বাভাবিক সহজাত চিন্তা থেকে একে আমি আঘাত বলে মনে করতে পারি না। কিন্তু অনেকে যেহেতু একে আঘাত বলে, ফলে একে আমি অন্তত ছদ্মআঘাত বলতে রাজি আছি। আর সেটা হলো অনুভূতির ‘আঘাত’।

অনুভূতির নির্ধারণ সমস্যা

হ্যাঁ, মানুষ কষ্ট পায়, নির্ঘাত। আমি তা অস্বীকার করছি না। কিন্তু মানুষের শরীর বা সম্পদে ‘আঘাত’ করাকে যেভাবে সরাসরি চিহ্ণিত করা যায়, মানুষের কষ্ট পাওয়াটা তার চেয়ে অনেক বেশি গোপনীয়, ব্যক্তিক ও অনির্দিষ্ট। অর্থাৎ শরীর কিংবা সম্পদে আঘাতের ঘটনাটার নৈর্ব্যক্তিক আবেদন আছে। দশজন মানুষ সহজে একমত হবে – কীসে শরীর ও সম্পদে আঘাত ঘটে আর কীসে আঘাত ঘটে না সে বিষয়ে। সেটার উচিত অনুচিতের প্রশ্ন উহ্য রেখেই সেটা করা সম্ভব।

যেটা কঠিন ও প্রায় অসম্ভব, সেটা হলো মানুষের ব্যক্তিক যে অনুভূতি, সেটাকে এতোটা নিশ্চিতভাবে চিহ্ণিত করা। আমি কারও কোনো কথায় কষ্ট পেলেই দাবী করতে পারি যে আমার অনুভূতি আহত হয়েছে; যেজন কথাটা বলেছে, সে আমার অনুভূতিতে ‘আঘাত’ করেছে। কিন্তু কষ্টটা আমি হয়তো নাও পেতে পারতাম। এমন কি কষ্টটা না পেলেও আমি একইভাবে বানিয়ে বানিয়ে দাবী করতে পারতাম যে আমার অনুভূতি আহত হয়েছে।

শরীর বা সম্পদ আহত হলে সেটার চিহ্ণ যতোটা সহজে রয়ে যায়, অন্য দশজনে সেটার সাক্ষ্য দিতে পারে, অনুভূতিতে কষ্ট পাবার সাক্ষ্য তার চেয়ে ঢের কঠিন, প্রায় অসম্ভব। দ্বিতীয় আরেকজন কখনো নিশ্চয়তার সাথে সাক্ষ্য দিতে পারে না যে আমি সত্যিই কষ্ট পেয়েছি কি না। এটা একান্তই ব্যক্তিক অনুভূতি।

অনুভূতির কার্যকারণগত অনির্দিষ্টতা

এমন কি প্রযুক্তির অগ্রগতির কারণে অনুভূতির কষ্ট যদি নিশ্চয়তার সাথে নির্ণয় করার যায়ও, ঘটনার সময়ে আমি ওই প্রযুক্তির ব্যবহার যদি না করে থাকি তাহলে সেই অগ্রগতিটা এইক্ষেত্রে কোনো কাজে আসবে না। তার চেয়ে বড়ো কথা, যদি ধরেও নেই যে প্রযুক্তির অগ্রগতির কারণে মস্তিষ্কের অনুরণনের ঠিক বিশেষ কোনো প্যাটার্নকে নিশ্চিতভাবে কষ্ট পাওয়া হিসেবে চিহ্ণিত করা গেলো, একজনের মুখের কথার (বা লেখার বা ছবি আঁকার) সাথে সেই কষ্ট পাওয়াটার কার্যকারণগত সম্পর্ক স্থাপন করাটা তারপরেও অত্যন্ত কঠিন থেকে যায়। এমন হতে পারে যে কষ্ট পাওয়া ব্যক্তিটি অতিরিক্ত সংবেদনশীল, ফলে যেকোনো সামান্য কথাতেই কষ্ট পাওয়াটা তার জন্যে খুব কঠিন নয়। এছাড়া – যার কথায় অনুভূতিতে কষ্ট লেগেছে, কষ্ট দেওয়াটা তার উদ্দেশ্য ছিলো কিনা, সেটাও প্রায় সমান অনির্ণেয়। এর চাইতে মানুষের শরীরে বা সম্পদে অন্য মানুষের সহিংস আক্রমণ বা আঘাতকে ঢের বেশি নিশ্চয়তার সাথে নির্ধারণ করা সম্ভব।

তারপরেও ধরুন – এমন কেইস থাকতেই পারে, যেখানে নিশ্চিতভাবে আমরা জানি যে বক্তা কষ্ট দেয়ার উদ্দেশ্যেই কথাটি বলেছে এবং যে লোকটি কষ্ট পেয়েছে বলে দাবি করছে, তার আচরণ দেখে নিশ্চিতই বোঝা যাচ্ছে যে সে সত্যিই কষ্টটা পেয়েছে। এমন ঘটাটা একেবারে অসম্ভব তো নয়। তো এক্ষেত্রে আমি কি রাজি হবো একে অনুভূতির ‘আঘাত’ হিসেবে মেনে নিতে? হয়তো। কিন্তু ব্যাপারটা তারপরেও মানুষের শরীরে কিংবা সম্পদে আঘাত করার চেয়ে ঢের বেশি ভিন্নই থেকে যায়। কীভাবে ভিন্ন? এটা বোঝার জন্যে আমাদের বুঝতে হবে কোনটার ফলাফল কী? শরীর কিংবা সম্পদে আঘাত করলে কী ঘটে তা অতি সহজেই নির্ণয় করা যায়। আমার হাত ভাঙলে সেটা আগের অবস্থায় ফিরে পাওয়া যে কঠিন সেটা নিয়ে অল্পই সন্দেহ থাকে। আমার হাত থেকে খাবারটি কেড়ে নিলে সেটা আমি খেতে পারবো না, বা বিক্রয় করতে পারবো না। আমাকে অতিরিক্ত শ্রম দিয়ে সেটা পুনরায় অর্জন করতে হবে। ফলে ক্ষতিগুলো খুব সহজেই নির্ণয়যোগ্য।

অনুভূতির ‘আঘাতের’ ক্ষতি?

শরীর ও সম্পদের তুলনায় অনুভূতিতে ‘আঘাত’ দেবার ফলশ্রুতিটা অনেক বেশি অনিশ্চিত। এটা ঠিক যে অনেক ‘অনুভূতিতে কষ্টপ্রাপ্ত’-কেই দেখা গেছে যে তাদের উৎপাদনশীলতা কমে গেছে বা জীবনের পথ পরিবর্তন হয়ে গেছে। এটা অসম্ভব নয়। কিন্তু আবার এমনও দেখা গেছে যে একই পরিস্থিতিতে অন্য অনেকের ব্যাপারটা তেমন গায়েই লাগে নি, বরং সেটা সহজেই এড়িয়ে তারা এগিয়ে গেছে। এই অনিশ্চয়তাগুলো গুরুত্বপূর্ণ। এখানে পরিসংখ্যান ব্যবহার করে সম্ভাব্যতাগুলো হয়তো যাচাই করা সম্ভব, কিন্তু আমরা এখানে মূলত আপেলের সাথে কমলার তুলনা করছি। একজনের শারীরিক আঘাতে অপরজনের শারীরিক ক্ষতিটা নিশ্চিত কার্যকারণ দ্বারা আবদ্ধ, এই পর্যায়ে পরিসংখ্যানের ব্যবহার প্রায় বাতুলতা। অন্যদিকে একজনের মুখের কথার কারণে অনুভূতিতে কষ্ট পেয়ে অপরজনের ক্ষতি হওয়ার আলামত পাওয়াটা বড়জোর একটি পরিসংখ্যানগত সম্পর্ক। এবং আমরা জানি যে পরিসংখ্যানগত সম্পর্ক কোনো কার্যকারণ নয়। ফলে শরীরে বা সম্পদে আঘাত বা বস্তুগত আঘাতের সাথে মনোজাগতিক যে কষ্ট পাওয়ার ঘটনা, এরা তুলনীয় নয়।

ফলে অনুভূতিতে ‘আঘাত’-এর কারণে শাস্তি বা প্রতিকার হিসেবে শারীরিকভাবে প্রত্যাঘাত করাটা একটা অসমানুপাতিক সমাধান। অত্যন্ত অসমানুপাতিক। তথাপি এরকম সমাধান মানুষের অনেক সমাজেই দেখা যায়। কেনো? সেসব সমাজে মানুষের শরীর ও সম্পদে আঘাত করাটাকে কি গুরুত্বের সাথে দেখা হয় না? তা কিন্তু নয়। বরং অধিকাংশ সমাজে সহজাতভাবেই মানুষের শরীর ও সম্পদে আঘাত করাটাকে নির্ঘাত অন্যায় হিসেবে দেখা হয়। কারণ ব্যাপারটা যে খারাপ, অন্যায় বা ক্ষতিকর তা উপলব্ধি করা অত্যন্ত সহজ। আমি মনে করি ওই একই সমাজগুলোতে অনুভূতিতে আঘাতকেও যে অন্যায় হিসেবে নির্ধারণ করা হয়, তার পেছনে ধর্মীয়, সামাজিক মূল্যবোধ ইত্যাদির প্রভাব ছাড়াও বস্তুগত বিবেচনাও অনেকাংশে বিরাজ করে। ধর্মীয় বা সামাজিক মূল্যবোধের অবদান এখানে হয়তো সবচেয়ে বেশি। কিন্তু সমস্যাটা মূলত এখানে হয় যে সেই মূল্যবোধ ধারণকারীরা অনুভূতিতে ‘আক্রান্ত’বোধ করলে সহিংস হয়ে ওঠে, কেননা তাদের মূল্যবোধ অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং সম্ভবত অসহনশীল। আর এই সহিংসতার কারণে সমাজ সার্বিকভাবে আক্রান্ত হয়, বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়, অর্থাৎ সমস্যাটা শেষে গিয়ে বস্তুগতও।

এখন এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে আমি/আমরা (হয়তো সাথে আপনিও) ভাববো – যে ধরনের বায়বীয় মূল্যবোধ মানুষকে বিনা আক্রমণে এমন সহিংস হবার সুযোগ দেয়, সেই মূল্যবোধকে পরিবর্তন করা প্রয়োজন। কিন্তু সেই মূল্যবোধের উপরেই যে সমাজ দাঁড়িয়ে আছে, তার জন্যে তেমনটা ভাবাটা কঠিন। তার জন্যে অনেক সহজ এটা ভাবা যে – সমস্যার ‘সূত্রপাতকারী’, উত্তেজক-কথা বলনেওয়ালাটাকেই শাস্তিযুক্ত করাটা শ্রেয়। কেউ যদি মূল্যবোধে আঘাত না দেয়, তাহলে কেউ উত্তেজিত হবে না, সমাজে অশান্তিও ঘটবে না। কিন্তু ব্যাপারটা তো এতোটা কার্যকারণযুক্ত নয়। যে মূল্যবোধটার অধীনে বিনা আক্রমণে সহিংস হয়ে ওঠাটা এতোটা সহজ, সেখানে চুপ থাকলেও সহিংসতা ঘটবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? উপরে আমরা দেখতেই পেয়েছি যে একজনের মুখের কথার কারণে আরেকজনের অনুভূতিতে কষ্ট লাগা এবং তার ফলশ্রুতিতে বস্তুগত ক্ষতি হওয়ার মাঝখানে অঢেল ও অজস্র অনিশ্চয়তা, অনির্ণয়যোগ্যতা বিরাজ করে। ফলে সহিংসতাবান্ধব মূল্যবোধটির এখানে অঢেল সুযোগ এই অনিশ্চয়তাগুলোকে কাজে লাগিয়ে অনুভূতিতে ‘আঘাতপ্রাপ্ত’ হবার ও ‘ক্ষতিগ্রস্ত’ হবার ভান করার। এবং সেগুলো ব্যবহার করে অন্যের উপর আগ্রাসী হবার। ফলে সমাজ বরং মূল্যবোধের এই অসম ব্যবহারের জন্যেই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মুখের কথার দায় তাতে অল্পই।

উত্তরাধুনিক

ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধগত কারণের বাইরেও আরেকটা কারণে অনুভূতির ‘আঘাতকে’ অধুনা সামনে আনা হয়েছে। যারা এনেছে, তারা মূলগতভাবে কোনো ধর্মীয় বা সামাজিক মূল্যবোধের প্রতি অনুগত নয়। মোরাল রিলেটিভিজম,  কালচারাল মার্ক্সিজম, এন্টি-রিয়েলিজম, পোস্টস্ট্রাকচারালিজম, ক্রিটিকাল থিওরি, ইত্যাদি নানা মতবাদ থেকে এই মুভমেন্টটা দেখা গেছে।

আমরা যে আপেল আর কমলা সমান নয় বলছি, এদের কাছে এসে সে দুটোই একাকার হয়ে গেছে। রিলেটিভিজমের মূলে হলো এই বোধ যে পৃথিবী ও জীবন যদি উদ্দেশ্যহীন হয়, কোনো কিছুরই যদি বিশেষ কোন মাহাত্ব্য না থাকে, তাহলে শরীর ও মনেরও যে পার্থক্য আমরা করি, সে-ও রিলেটিভ, তুলনামূলক। এর কোনো পরমত্ব নেই। আমাদের কাছে লাগছে দেখে আমরা তেমনটা বলছি। অন্য কেউ যদি থাকে যার কাছে ঠিক উল্টোটা সঠিক মনে হয়, তাহলে তার কথাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এখানে একজনকে ভুল বলে অন্যজনকে ঠিক বলার উপায় নেই। এর সাথে কালচারাল মার্ক্সিজম এসে যুক্ত হলে ক্ষমতায় দুর্বলপক্ষের স্বরটিকে সমর্থন করাটা বরং বেশি কাজের বলে প্রতীয়মান। তাতে দুইপক্ষের ক্ষমতার যে অসমতাটা সেটা দূরীভূত হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়।

বস্তুজগতকে মনোজগতের সাথে সমান বিবেচনা করাটা এদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। অনুভূতিতে আঘাতকে হাইলাইট করাটা শরীরে ও সম্পদে আঘাতের গুরুত্বকে দুর্বল করে। বিশেষ করে যখন অনুভূতিতে আঘাতের শাস্তি হিসেবে শরীর বা সম্পদে আক্রমণ করাকে ন্যায় গণ্য করা হয়। এটাকে তাদের গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হিসেবে ভাবা যেতে পারে। অর্থাৎ মূলত শরীর ও সম্পদে আঘাত করাকে খাটো করে দেখার জন্যেই অনুভূতিতে আঘাতকে ফলাও করা বা সামনে নিয়ে আসা।

এই কাজে এরা তাই অনেক সময়েই সহিংস ধর্মীয় বা সামাজিক মূলবোধ সম্পন্ন সমাজের সাথে গাঁটছড়া বাঁধে। অনেক কম্যুনিস্ট চিন্তক তাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্যে অনাক্রমণশীলের শরীরে কিংবা সম্পদে আঘাত করাটা তথা সহিংসতা করাটা গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করেন। এর উদাহরণ ইতিহাসে দেখা গেছে।

অধুনা ফরহাদ মজহার বাংলাদেশে এই মতের একজন চিন্তক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। না, উনি এই চিন্তাধারায় নতুন বলছি না। বরং ব্যক্তির শরীর ও সম্পদ সংরক্ষণের বিরুদ্ধে ওনার লেখনী অনেক আগে থেকেই সোচ্চার। একেবারে সমসাময়িককালেও তিনি অসহিংসতার দর্শনের সমালোচনা করেছেন। এখন ওনাকে আমরা সহিংস ধর্মীয় মূল্যবোধের সাথে গাঁটছড়া বাঁধতেও দেখছি। এইসব অনেকের কাছে খামখেয়ালিপূর্ণ মনে হলেও তাত্ত্বিকভাবে এগুলো অত্যন্ত সঙ্গত গতিবিধি।

শরীর ও সম্পদে আঘাতকে খাটো করে দেখানোর জন্যে অনুভূতিতে আঘাতকে সামনে নিয়ে আসতে গিয়ে সহিংস ধর্মীয় কিংবা সামাজিক মূল্যবোধের সাথে গাঁটছড়া বাঁধাটা অনেকটা ডুবে যাওয়ার কালে খড়কুটো ধরে বাঁচার চেষ্টার মতো। সভ্যতা অত্যন্ত সঙ্গতির সাথে অগ্রসর হচ্ছে, এবং সমাজের উৎপদানশীল অংশ খুব সহজাত উপায়ে সমাজকে বিবর্তিত করছে, যার সাথে সুপ্রাচীন ও বদ্ধ ধর্মীয় বা সামাজিক মূল্যবোধ অসঙ্গতিতে থাকে। ফলে এই দুই অংশের সাময়িক সংঘাত এবং দ্বিতীয় গোষ্ঠির পরিবর্তন কিংবা পতন অনিবার্য। ফলে এদের গোঁড়ামিকে আরও সুপুষ্ট করাটা আত্মহননকে আরও তরান্বিত করার শামিল। তথাপি, এর মোকাবিলায় সমাজের উৎপাদনশীল অংশ দ্বারা চালিত স্বাভাবিক বিবর্তনের উপর নির্ভর না করে যতো বেশি সহিংসতার আশ্রয় নেয়া হবে, সমাজে প্রতিক্রিয়াশীল সদস্যের সংখ্যা বরং তাতে আরও বাড়বে এবং উৎপাদনশীল ও অসহিংস অংশ ততো ক্ষুদ্র হবে।

এখন কথা হচ্ছে রিলেটিভিস্টরা শরীর ও সম্পদের আঘাতকে খাটো করতে চাইলেও যে সহিংস ধর্মীয় বা সামাজিক মূল্যবোধধারীদেরকে তারা ব্যবহার করছে, তারা কিন্তু তেমনটা মোটেও চায় না। স্বাভাবিক সামাজিক বিবর্তনে গড়ে ওঠা প্রায় সকল সমাজই শরীর ও সম্পদ সংরক্ষণের গুরুত্বকে সহজাতভাবে উপলব্ধি করে। এই সহজাত মূল্যটা বর্তমান থাকা তাদের সমাজের সুস্থ বিকাশ ও বর্ধনের জন্যেই জরুরি। ফলে রিলেটিভিস্টদের সাথে গাঁটছড়া বাঁধাটা তাদের জন্যে, তাদের সমাজের জন্যে বরং ক্ষতিকর। তাদের প্রয়োজন পরিবর্তিত এই সমাজের সাথে তাদের পিছিয়ে পড়া মূল্যবোধের সমন্বয় ও অভিযোজন। সংঘাতের হাতছানি তাদেরকে সেই সুযোগ থেকেই বঞ্চিত করছে।

সমাপ্তি

সভ্যতার বিকাশ ও তার অগ্রগতি সভ্যতার ধ্বংসের সাথে সহবাস করবে এমন যদি সত্য না হয়, তাহলে নির্মম সত্য এটাই যে – হয় সভ্যতার বিকাশ সভ্যতার ধ্বংসকারীর উপর জয়লাভ করবে, নয়তো ধ্বংস বিকাশকে গ্রাস করে নেবে। সভ্যতার অগ্রগতি যে অপ্রতিরোধ্য, এ নিয়ে আমি অল্পই সন্দিহান।

আমি মনে করি – বস্তুগত ক্ষতির সাথে অনুভূতিগত ‘ক্ষতি’র সংঘাত অনিবার্য নয়। অনুভূতির সংরক্ষণ নিশ্চয়ই কাম্য। কিন্তু অন্যের লেখা তার সদরে গিয়ে পড়ে কষ্ট পাওয়া, কিংবা সেটা পড়ার পর সহিংসতা করা, এই সবের দায়-দায়িত্ব সরাসরিই লেখাটা যে পড়বে তার। প্রযুক্তি ও অর্থনীতির বিকাশ মানুষকে বস্তু জগতের সাথে মনোজগতের এই সুতীব্র পার্থক্যটা এবং দায়দায়িত্বের এই বোধটা সম্পর্কে স্বাভাবিকভাবেই সচেতন করে তুলবে। সেই বোধ সত্যিই পরম নাকি ‘রিলেটিভ’, সে বিষয়ের ধার না ধেরেই।

পূর্বপাঠ: যে জ্ঞান কাজের: অধিবিদ্যা বনাম বিজ্ঞান