আইয়ামে জাহেলিয়াত যুগে কন্যা সন্তানদের জীবিত কবর দেওয়া হত (female Infanticide), ইউরোপে নারীদের বিনা কারণে কিংবা বানানো কারণে ডাকিনী হবার মিথ্যা অভিযোগে জীবিত আগুনে পোড়ানো হত (Witch hunt)। তাছাড়া আমাদের এই ভারতীয় উপমহাদেশেও সতীদাহ প্রথার মাধ্যমে বিধবা নারীদের মৃত স্বামীর সঙ্গে আত্মাহুতি দিতে বাধ্য করা হত (Sati)।

আবার এসব যুগেও আমরা শুনতে পাই আরবের বিবি খাদিজার কথা, যিনি বড় ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন কিংবা বিখ্যাত মহিলা কবি আল খানাস, তাঁদের মত সেই যুগে আরও মহিলা ছিলেন যাদের প্রভাব তৎকালীন সমাজে ছিল। ইউরোপে ইংল্যান্ডের রাণী এলিজাবেথ কিংবা রাণী স্পেনের রাণী ইসাবেলা “উইচহান্ট” যুগে দাপটের সাথে রাজ্য শাসন করেছেন। কিংবা রাজপুত রাণী দূর্গাবতী কিংবা মারাঠা রাণী জিজাবাই ভোসলের কথা বলা যায়, যাদের সমাজে সতীদাহ প্রথা থাকলেও এতে তাদের এ ব্যাপারে কেউ জোর করতে পারেনি।

তথা আমরা দেখতে পাই প্রভাবশালী, ধনাঢ্য কিংবা খ্যাতিমান পরিবারে জন্মগ্রহণকারী নারীগণ কখনো সেই অর্থে অত্যাচারিত ছিলেননা। বর্তমান বিশ্বে নারী অধিকার এবং নারী স্বাধীনতার সূচকে তলানিতে থাকা দেশ গুলোর মধ্য পাকিস্তান কিংবা আরবের বিভিন্ন দেশগুলো অন্যতম। কিন্তু সেখানে আমরা বেনজির ভুট্টোর মত জাঁদরেল নারী নেত্রীর সাক্ষাৎ পাই। পাকিস্তানের শীর্ষ নারী নেত্রীদের সংখ্যা মনে হয় বাংলাদেশ থেকেও বেশি। পাকিস্তানের বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রাব্বানি খার এবং স্পিকার ডঃ ফাহমিদা মির্জা নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে চলছেন। আগের তথ্য মন্ত্রী শেহের বানু রহমানের কথাও বলা যায়, যার পশ্চিমা ধারায় চলা ফেরা সর্বজনবিদিত; তবে কাঠ মোল্লাদের তাদের নিয়ে মন্তব্য করার সাহস তেমন নেই, কারণ তাঁরা প্রত্যেকই অনেক প্রভাবশালী পরিবারের সদস্য। যেমন বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্ম ভিত্তিক দল নারী নেতৃত্ব কিংবা পর্দা নিয়ে বিভিন্ন কিছু দাবী করলেও বিএনপি এবং বিএএল এর বিভিন্ন ব্যাপারে (বিশেষত এর বিভিন্ন নারী নেতার পর্দা) মুখে কুলুপ এঁটে রাখে কারণ তারা জানে তাহলে তাদের পায়ের তলায় আর মাটি থাকবেনা!!

আরবদেশের কথা কি আর বলা যায়!! ঐগুলোর বাদশা-শেখের বউ-কন্যারা হলেন উনাদের (শাসক গোষ্ঠীর) চরম হিপোক্রেসির মূর্ত প্রতীক। সাধারণ ঘরের মেয়েদের পান থেকে চুন খসলেই যেখানে সবক শুনতে হয় এবং ক্ষেত্র বিশেষে শাস্তি পেতে হয় সেখানে তাদের পরিবারের কন্যাগণ সেই পান মাটিতে ফেলে দিলেও মাফ।

একটি বিষয়ে তাদের সবারই মিল আছে, আর তা হল- তারা প্রায় (সামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদে) প্রভাবশালী, ধনী কিংবা নিদেন পক্ষে এন্টাইটেল্ড পিতা মাতার কন্যা এবং এ জন্য তাদের অনেক রকম সামাজিক নিঃস্পৃহ থেকে মুক্ত থাকতে পেরেছেন, যা একজন সাধারণ ঘরের কন্যা পদে পদে মোকাবেলা করে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নারী অধিকার এবং নারী ক্ষমতায়নের সার্বিক চিত্র

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নারীর অধিকার এবং ক্ষমতায়ন এই নিম্নক্ত প্রধান প্রধান গবেষণাধর্মী ডাটা গুলো হতে একটি ধারনা পাওয়া যেতে পারে-

১.Gender-Related Development Index by UNDP
২.Gender Empowerment Measure by UNDP
৩.Gender Inequality Index by UNDP
৪.Gender Parity Index by UNESCO
৫.Gender Gap Index by WEForum
৬.Gender Equity Index by Social Watch

আগে থেকে পরিচয় না থাকলে উপরোক্ত ডাটা গুলোর ইনডেক্স এবং ডাটার ফ্যাক্টর গুলো বোঝার জন্য অন্তত ১০-২০ মিনিট সময় ব্যায় করতে হতে পারে। উপরোক্ত তালিকা সহ আরও অনেক তালিকা হতে ডাটা নিয়ে একটি অনলাইন পত্রিকা (Newsweek/The Daily Beast) ২০১১ সালে ১৬৫ টি দেশ নিয়ে একটি সার্বিক সারাংশ (The Best and Worst Places for Women) তৈরী করেছে যা সাধারণ পাঠকের জন্য সহজবোধ্য। উক্ত তালিকায় সার্বিক ভাবে ২০১১ সালে নারীর অধিকার নিশ্চিতকারী –

প্রথম দশটি দেশ (প্রথম থেকে ১-১০)- আইসল্যান্ড, সুইডেন, কানাডা, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে, যুক্তরাষ্ট্র অস্ট্রেলিয়া এবং নেদারল্যান্ড।

শেষ দশটি দেশ (শেষের থেকে ১৬৫-১৫৬) – চাদ, আফগানিস্তান, ইয়েমেন, কঙ্গো, মালি, সলোমন আইল্যান্ড,নাইজার, পাকিস্তান, ইথিওপিয়া এবং সুদান।

তালিকায় পাকিস্তান শেষের দশটিতেই আছে ১৫৮ নম্বরে, ভারতের অবস্থান ১৪১ এবং বাংলাদেশের ১৩৯।
নারীর ক্ষমতায়ন বনাম নারীর অধিকার এবং বাংলাদেশ

বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন

২০০৯ হতে- গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী তথা প্রধানমন্ত্রী নারী, রাষ্ট্র-যন্ত্র পরিচালনার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের চারটির তিনটি – প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী (২০০৯-১২), পররাষ্ট্র মন্ত্রী নারী। তাছাড়া সংসদে সরকার দলীয় নেত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী এবং সংসদ উপনেতা সবাই নারী। বিশ্বের ইতিহাসে এমন নজির আছে কিনা আমার আসলেই জানা নাই। হয়ত একমাত্র কাল্পনিক রাজ্য অ্যামাজনে এমন ছিল। বাস্তবে আমি পাইনাই। এটা অবশ্যই একটা গর্বের বিষয় এবং বিশ্বের ইতিহাসে একটা অনন্য উদাহরণ।

তাহলে আমাদের দেশে নারী সমাজ কি সামগ্রিক ভাবে ভালো অবস্থায় আছেন ?

ভালো অবস্থায় আছেন নেই।

কেন নেই ?

কারণ দেশে সরকারের কিংবা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে নারী থাকা মানেই নারীর অধিকার সমাজে নিশ্চিত নয়, ঠিক যেমন পাকিস্তানে নেই সামগ্রিক ভাবে এবং অনেক ক্ষেত্রে, বিশেষত নারীদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ভারতেও নেই । আমাদের দেশের সংরক্ষিত নারী আসনের কথাই ধরি, বেশিরভাগেরই স্বামী কিংবা পিতা এন্টাইটেল্ড। অনেক ক্ষেত্রে এসব আসন ক্রয় বিক্রয়ের খবরও পাওয়া যায়। তবে দুয়েকজন ব্যতিক্রম অবশ্যই আছেন। যুগে যুগে এমনি ছিল। আমাদের বৃহত্তর সাধারণ ঘরের নারীগণের ন্যায্য অধিকার যতদিন নিশ্চিত হবেনা ততদিন সামগ্রিক নারী অধিকার নিশ্চিত হবেনা। এক্ষেত্রে আমাদের বটম-আপ দিকে ভাবতে হবে। আপ-বটম সেই প্রাচীন কালেই ছিল।

নারীর ক্ষমতায়ন বনাম বাংলাদেশের নারী স্পীকার

২০১৩ সালে নির্বাচিত (নিয়োগপ্রাপ্ত?) শিরীন শারমিন চৌধুরী কি যোগ্য নন ?

অবশ্যই যোগ্য। তিনি একজন আইনজীবী এবং ছাত্র জীবনে শীর্ষ মেধার সাক্ষরতা রেখেছিলেন। পৃথিবীর অনেক মহান রাজনীতিবিদ তাঁর মতই শীর্ষ একাডেমিক পারফরমেন্সের অধিকারী ছিলেন। তবে আবার অনেকেই মধ্যম মানের ছিলেন কিংবা অনেকের একাডেমিক পারফরমেন্স তেমন ভালোও ছিলনা না। আসলে সফল রাজনৈতিক নেতৃত্বে অনেক ফ্যাক্টর কাজ করে। একাডেমিক শিক্ষা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ এবং অনেক গুলো ফ্যাক্টরের মধ্য এটা বেশি ওয়েট বহন করা ফ্যাক্টর গুলোর অন্যতম। তবে আরও অনেক যোগ্যতা / ফ্যাক্টরও আছে যেমন নেতৃত্ব প্রদানের দক্ষতা, নৈতিকতা, বুদ্ধি-বিবেচনাবোধ, ক্যারিজমা ইত্যাদি ইত্যাদি। এজন্যই অত্যন্ত সাধারণ মানের ছাত্র শেখ মুজিব হলেন প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবনে শীর্ষ মেধার সাক্ষর রাখা কামাল হোসেন হলেন সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার কামাল হোসেন।

শিরীন শারমিন চৌধুরী কি স্পিকারের দায়িত্ব পালন করতে পারবেননা ?

অবশ্যই পারবেন। একটা ন্যূনতম যোগ্যতা এবং বুদ্ধিবিবেচনা থাকলে অল্পকালেই যেকোনো নন ট্যাকনিক্যাল রুটিন কাজ সবাই করতে পারেন, যেমন পেরেছেন পররাষ্ট্র ডাঃ মন্ত্রী দিপুমনি এবং যেমন ভাবে বেশিরভাগ বড় ব্যবসায়ী কিংবা উদ্যোক্তা, প্রথম শ্রেণীর সিনিয়র সরকারী অফিসার, সিনিয়র কর্পোরেট নির্বাহী খুব ভালভাবেই প্রধানমন্ত্রীর “রুটিন” দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। তাছাড়া এসব কাজে সাহায্যর জন্য থাকেন বিভিন্ন ক্যারিয়ার অফিসার কিংবা উপদেষ্টা । এসব শীর্ষ পদে যোগ্যতার পরীক্ষা তখনই প্রমাণিত হয় যখন কোন র‍্যাডিক্যাল সিদ্ধান্ত নিতে হয় কিংবা ক্রাইসিস, তথা, চরম অর্থনৈতিক মন্দা অথবা যুদ্ধাবস্থা শুরু হয়। (যেমন রাষ্ট্রপতি ইয়াজ উদ্দিন আহমেদ প্রথম চার বছর ভালোভাবে রাষ্ট্রপতির “রুটিন দায়িত্ব” পালন করলেও যখনই ক্রাইসিস আসল তখনই আঁচ করা গেল তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রকৃত পরিচয় )

অনেকেই বাংলাদেশে নারী স্পিকার নির্বাচনে ভারত এবং পাকিস্তানের উদাহরণ টানেন। ভারতের মিরা কুমার এবং পাকিস্তানের ডঃ ফাহমিদা মির্জার পোর্টফলিও দেখলেই বুঝতে পারা যাবে শুধু “নারী” হওয়া ছাড়া বাংলাদেশের স্পীকার ডঃ শিরীন শারমীন চৌধুরীর সঙ্গে ঐ দুজনার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার কত যোজন পার্থক্য। ফাহমিদা এবং মিরা এ দুজন হলেন রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতার ভিত্তিতে ন্যাচারাল চয়েস তথা ইলেক্টেড এবং শারমীন হলেন মূলত একজন মানুষের পছন্দ কিংবা সিলেক্টেড।

নারী প্রধানমন্ত্রীর নারী স্পিকার নির্বাচনের ব্যাপারটাতে “নারী-পুরুষের” বিষয় না ভেবে ক্লীব ভাবে যদি দেখি তাহলে দেখব এই সিদ্ধান্ত একটা স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত। আওয়ামীলীগের মূল ধারায় আরও এমন নারী নেত্রী আছেন যারা শিরীন শারমিন থেকে একাডেমিক পারফরমেন্সে খুব বেশি কম নন আবার যাদের রয়েছে দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা। আসলে এটা তাঁর (প্রধানমন্ত্রীর) একান্ত ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত এর দুটি কারণ হতে পারে –

১.দলে অন্ধ আজ্ঞাবাহক মানুষ রাখা কিংবা সৃষ্টি করা এবং দলের মধ্যম এবং শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্বকে সবক দেওয়া যেন তারা আত্মমর্যাদাবোধ বাক্সবন্দি করে রাখেন।

২. কাগজে কলমে নিজের ক্রেডিবিলিটি বাড়ানো এবং ইতিহাস সৃষ্টি করা যে তিনি নারী ক্ষমতায়নের জন্য কাজ করেন।
শিরীন শারমীন ২০০৭-৯ এ শেখ হাসিনার আইনি সহায়তা দানকারী দলের সাথে ছিলেন (বর্তমান আইনমন্ত্রীর মত)। এটা আসলে আওয়ামীলীগের মধ্যম এবং শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে একটু সবক দেওয়া।

মূল প্রেক্ষিত

আবারো প্রকাশ হয়ে পরল আমাদের দেশের বিভিন্ন পার্টির অন্দর মহলের অবস্থা। সব গুলোই de facto PPP তথা (পিপিপি) প্রাইভেট পলিটিকাল পার্টি। (কাকতাল! শব্দ সংক্ষেপণটি “পাকিস্তান পিপলস পার্টির” সাথে মিলে গেল, যদিও এটিই “প্রাইভেট পলিটিকাল পার্টির” সবচাইতে ভালো উদাহরণ, যেখানে পার্টির চেয়ারম্যান পদও ওয়ারিশ গত ভাবে উইলের মাধ্যমে নির্ধারণ হয় এমনকি যাকে উইল করা হয়েছে তার জাতীয় নির্বাচনে দাড়াবার প্রয়োজনীয় বয়স না থাকলেও! )

আমাদের দেশের সবচাইতে বড় দুটি দল দুটিই, দুই শীর্ষ পরিবার কেন্দ্রিক, শুধু পরিবার কেন্দ্রিক না এখানে অলিখিত পিয়ার‍্যাজ (Peerage) ব্যবস্থাও বর্তমান। এজন্য শীর্ষ নেতার সন্তান শীর্ষ নেতা, এমপির সন্তান এমপি, নেতার সন্তান নেতা কিংবা পাতি নেতার সন্তান পাতি নেতা হিসেবে অগ্রাধিকার পান। কুখ্যাত সন্ত্রাসী সোহেল রানার গড ফাদার এবং সাভারের (ঢাকা – ১৯) স্বঘোষিত লিজেন্ড (এবং স্বঘোষিত লিজেন্ড পুত্র) এমপি তৌহিদ জং মুরাদ কিন্তু এই পিয়ারেজ ব্যবস্থার প্রোডাক্ট। অথচ সেখানে অত্যন্ত যোগ্য একজন নারী নেতা মনোনয়ন চাইলেও পাননি, একবার নয়- দুইবার! কেননা নিজ যোগ্যতায় যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও তিনি পিয়ার‍্যাজ (Peerage) সিস্টেমে একধাপ পিছিয়ে ছিলেন।

বড় দল গুলো অনুরূপতায় “লিমিটেড কোম্পানি” সমমানের হলেও আর ছোট দল গুলো হল পুরাই “প্রোপ্রায়েট্রি” যেখানে দলীয় চেয়ারম্যান / প্রধানের মৃত্যু হলে দল থাকে না ভাঙ্গে এটার ঠিক নেই। বড় দুই দলের আভ্যন্তরীণ দলীয় গণতন্ত্রের ব্যাপারে কামাল হোসেন, বদরুদ্দোজা চৌধুরী কিংবা আন্দালিব পার্থ যত বড় বড় কথা বলেননা কেন নিজেদের রাজনৈতিক দলের গণতন্ত্রে তারা নিজেরাই বিশ্বাসী নন। আর কম্যুনিস্ট দলগুলোর কথা না বলাই ভালো। আমাদের দেশে তথাকথিত সাম্যবাদ ভিত্তিক দলগুলো কখনই মূলধারার দল ছিলনা এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রই তাদের নেতৃবৃন্দ শুধু নির্বাচনে হেরে যেতেননা; অতিরিক্ত কম ভোট পাওয়ার কারণে তাঁদের জামানত পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত হত। এখন দেখা যাচ্ছে তারা পরজীবী হিসেবে বড় দলকে বিশেষত আওয়ামীলীগকে ভালোই ম্যানিপ্যুলেট করছেন যেমনটি জামায়াত গত প্রায় ১২-১৩ বছর যাবত বিএনপিকে ম্যানিপ্যুলেট করে যাচ্ছে । সাধারণ ধর্ম ভিত্তিক (মূলত ইসলামিক দল) গুলোর অবস্থাও তেমন খুব ব্যতিক্রম নয়। কম্যুনিস্ট দলগুলোর মূল কর্মকাণ্ড যেমন মূলত ঢাকা কেন্দ্রিক এই ধর্ম ভিত্তিক দলগুলোও বিভিন্ন অঞ্চল ভিত্তিক। অপরদিকে জামায়াত সেই অর্থে যতটা না ইসলামিক দল তার চেয়েও বেশি ইসলাম ব্যবহারকারী এবং “ঐতিহাসিক” ভাবে “পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদী??” দল।

বড় চারটি (সমগ্র বাংলাদেশ ব্যাপী যাদের নেটওয়ার্ক) দলের প্রথম তিনটি দল (সমগ্র বাংলাদেশ ভিত্তিক) আওয়ামীলীগ, জাতীয়তাবাদী দল এবং জাতীয় পার্টি এমপি গণ নিজেরা কোন সিদ্ধান্তই নিতে পারেননা। শুনতে খারাপ লাগলেও সত্য সমগ্র বাংলাদেশ ভিত্তিক চারটি দলের চতুর্থটিতেই তথা জামায়াতই আভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের ব্যাপারে (দলীয় রেজিস্টার্ড/নিয়মিত নেতা কর্মী দের মধ্যে) সবচাইতে এগিয়ে ছিল। তবে যেহেতু তাদের দলটি সার্বজনীন নয় উপরন্তু সাম্প্রদায়িক, তাঁদের এই ক্যাডার ভিত্তিক “বিষয়” কোন সুফলই রাষ্ট্রে রাজনৈতিক জগতে কোনই সফলতার চিহ্ন ফেলতে পারেনি।

বড় তিনটি দলের পার্টি প্রধান যাই বলবেন তাই সিদ্ধান্ত। এমপি গণ সংসদে পর্যন্ত তাঁদের মতামত দিতে পারেননা। করলেই আসন শূন্য। কেননা “পার্টির সিদ্ধান্তের (যা মূলত পার্টি প্রধানের সিদ্ধান্ত) বিরুদ্ধে ভোট / মতামত” আর “পার্টি পরিবর্তন” একই কাতারে রেখে ফ্লোর ক্রসিং আইন করা হয়েছে।

বাংলাদেশের সংবিধানের ৭০ অণুচ্ছেদ অনুযায়ী-

৭০। কোন নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরুপে মনোনীত হইয়া কোন ব্যক্তি সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি-
(ক) উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা
(খ) সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন,
তাহা হইলে সংসদে তাঁহার আসন শূন্য হইবে, তবে তিনি সেই কারণে পরবর্তী কোন নির্বাচনে সংসদ-সদস্য হইবার অযোগ্য হইবেন না।]

একজন ব্যাক্তি একই সাথে একাধিক আসনে নির্বাচন করার বৈধতা দেওয়া হয়েছে! আবার সংবিধানের ৭১ অনুচ্ছেদে বলা-

৭১। (১) কোন ব্যক্তি একই সময়ে দুই বা ততোধিক নির্বাচনী এলাকার সংসদ-সদস্য হইবেন না।
(২) কোন ব্যক্তির একই সময়ে দুই বা ততোধিক নির্বাচনী এলাকা হইতে নির্বাচন প্রার্থী হওয়ায় এই অনুচ্ছেদের (১) দফায় বর্ণিত কোন কিছুই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করিবে না, তবে তিনি যদি একাধিক নির্বাচনী এলাকা হইতে নির্বাচিত হন তাহা হইলে-
(ক) তাঁহার সর্বশেষ নির্বাচনের ত্রিশ দিনের মধ্যে তিনি কোন্ নির্বাচনী এলাকার প্রতিনিধিত্ব করিতে ইচ্ছুক, তাহা জ্ঞাপন করিয়া নির্বাচন কমিশনকে একটি স্বাক্ষরযুক্ত ঘোষণা প্রদান করিবেন এবং তিনি অন্য যে সকল নির্বাচনী এলাকা হইতে নির্বাচিত হইয়াছিলেন, অতঃপর সেই সকল এলাকার আসনসমূহ শূন্য হইবে;
(খ) এই দফার (ক) উপ-দফা মান্য করিতে অসমর্থ হইলে তিনি যে সকল আসনে নির্বাচিত হইয়াছিলেন, সেই সকল আসন শূন্য হইবে; এবং
(গ) এই দফার উপরি-উক্ত বিধানসমূহ যতখানি প্রযোজ্য, ততখানি পালন না করা পর্যন্ত নির্বাচিত ব্যক্তি সংসদ-সদস্যের শপথ গ্রহণ বা ঘোষণা করিতে ও শপথপত্রে বা ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষরদান করিতে পারিবেন না।

একাধিক আসনে নির্বাচন এরপর আসন ছেড়ে দেওয়া! এসব জনগণ এবং সংসদ নির্বাচনের সাথে তামাশা ব্যাতিত আর কিছু নয়। এসব আসলে করা হয়েছে দলীয় শীর্ষ নেতাদের সুবিধার্থে যেন বিব্রতকর অবস্থা এড়ানো যায়। অপরদিকে বাংলাদেশের এমপি গণ এবং বেশীরভাগ স্থানীয় নেতাগণ পরিণত হয়েছে উত্তর কোরিয়ার কিম পরিবার অনুগত রোবট রূপী মানবের মত।

[**অফটপিকঃ “সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল” নামক এক এক আজব সামাজিক বিজ্ঞানীয় আবিষ্কার সংসদের কাছে বিচার বিভাগের কোন দায় নেই। এমন আরও আছে যেমন “বেসিক ডেমোক্রেসিস”, “ডক্ট্রিন অফ নেসেসিটি” কিংবা “থার্ড ইউনিভার্সাল থিউরি”; এসব আসলে অনির্বাচিত সরকার বিশেষত একনায়কতন্ত্র কাগজেকলমে বৈধতা দেবার এক ব্যার্থ প্রয়াস। বাংলাদেশের “জেলার দায়িত্ব প্রাপ্ত মন্ত্রী” অথবা “জেলা গভর্নর” যার মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় একনায়কতন্ত্র সৃষ্টি করা হয়েছিল বিচার বিভাগের স্বাধীনতা যেমন জরুরী তেমন জরুরি বিচারকদের অভিসংশনের ক্ষমতা অবশ্যই পার্লামেন্টের উপর থাকা উচিত।]

তবে পার্টির এসব এমপি সহ অন্যান্য নেত্রীবৃন্দ নিজেরাও কম যান না! যেমন তারা স্থানীয় পদে জগদ্দল পাথরের মত চেপে থাকেন। পার্টির জাতীয় পর্যায়ে যেমন গণতন্ত্র নেই তেমন স্থানীয় পর্যায়ে নেই।পদ পেলেই হল যতদিন পারা যায় জোড় করে ধরে থাকেন তারা। স্থানীয় পর্যায়ে কোন রাজনৈতিক পদ শান্তিপূর্ণ ভাবে বদলেছে এমন উদাহরণ খুবই কম। নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টিতে বাধা প্রদান তো আছেই। কোনভাবে উপরের পদে যে থাকে তাঁর চামচামি করে সবাই আদতে আখের গোছানোর তালে থাকে। অপরদিকে নিজেদের অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধা বাড়ানোর ব্যাপারে সব সাংসদই দল-মত নির্বিশেষে নির্লজ্জ ভাবে এক মত পোষণ করেন।

এসব ব্যাপারে শুধু রাজনীতিবিদদের দোষারোপ করলে এটা তাদের উপর একপেশে দোষারোপ করা হয়ে যায়। আজকের এই অবস্থার জন্য আমরা যারা এই দেশের নাগরিক এবং ভোটার তারাও কম দোষী নয়। দেশের বেশিরভাগ মানুষ এখনো তেমন শিক্ষিত নন। যদিও আমাদের দেশের মানুষ ঐতিহাসিক ভাবেই রাজনীতি সচেতন তবে তাঁরা তারচেয়েও বেশি বেশি আবেগপ্রবণ। কেউ কোন নির্বাচনে দাঁড়ালে ভোটারদের মধ্য আজো অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হল সে কার সন্তান, এমনকি মাঝে মাঝে কারো যোগ্যতা থেকেও কার “উত্তরাধিকার” এটার গুরুত্ব বেড়ে যায়। আবার বাঙ্গালীর স্বভাবও এর জন্য দায়ী। বাংলাতে একটি প্রবাদ আছে যে “নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করা” আশির দশকে বিএনপি এবং আওয়ামীলীগে জিয়া এবং শেখ পরিবারের আগমন মূলত এর অন্যান্য শীর্ষ প্রথম শ্রেণীর নেতৃত্বের মধ্য পারস্পরিক আস্থাহীনতা এবং হিংসা বিদ্বেষ। এই অবস্থা থেকে স্বাভাবিক ভাবে মুক্ত হতে আরও কয়েক যুগ লেগে যাবে যদিনা রাজনীতিতে র‍্যাডিক্যেল কোন কিছু ঘটে।

অনুসিদ্ধান্ত

১. বর্তমানে বাংলাদেশে যা আছে তা মূলত ইলেক্টেড অটোক্রেসি। হালকা ভাবে বললে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, সাম্রাজ্য-পূর্ব প্রাচীন রোমান (প্লুটোক্রেটিক) রিপাবলিকের “কনসাল” এর চেয়েও ক্ষমতাবান। পৃথিবীর যেসব দেশে বর্তমানে মুক্ত গণতন্ত্রের চর্চা আছে বলে ধরে নেওয়া যায় সেসব দেশের মধ্য বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহীই সবচাইতে বেশি অনিরুদ্ধ ক্ষমতা ভোগ করেন। দেশের স্বচ্ছন্দ উন্নয়নের জন্য নির্বাহী বিভাগের হাতে পর্যাপ্ত “নির্বাহী ক্ষমতা” থাকতেই হবে, তবে তা কখনো অবারিত হওয়া উচিত নয়।

প্রধানমন্ত্রীর যতটুকু ক্ষমতা আইনে আছে তিনি তাই পান। কাগজে-কলমে তাকে অতিরিক্ত ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। তবে যেহেতু “সংসদীয় গণতন্ত্রে” আইন বিভাগ এবং নির্বাহী বিভাগ “একাকার” এবং দলের শীর্ষ নেতাই একছত্র ক্ষমতার মালিক এজন্য যে দল নির্বাচিত হয় সেই দলের নেতাই বাস্তবে একছত্র ক্ষমতার মালিক হয়ে যান। দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধান বিচারপতি এবং স্পিকারের নির্বাচন সহ অন্য সব বিষয়ে সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারেন। এজন্যই দেশে কখনোই প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবেনা যতদিন পর্যন্ত দল গুলোর অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা না হয়।

২. রাষ্ট্র কিংবা অন্য কোন গুরুত্বপুর্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষে নারী থাকা মানে কখনই নারী স্বাধীনতা এবং নারী অধিকারের নিশ্চয়তা নয়। দেশের আপামর জনগোষ্ঠীর মধ্য ধনী পরিবার থেকে আসা নারীগণ নয়, যখন একেবারে সাধারন পরিবারের নারীগণ নিজ যোগ্যতায় শীর্ষে পৌঁছবে তখনই নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যাবে। তেমন ভাবে সাধারণ পরিবারের নারীদের যখন সামাজিক ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত হবে তখনই ধরে নেওয়া যাবে সমাজে নারীদের নায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।