ভদ্রপাড়ার কুম্ভিলকেরা

ইংরেজিতে প্লেজিয়েরিজম (plagiarism) বলে একটা কথা আছে, যার বাংলা তরজমা, ভদ্র ভাষাতে, কুম্ভিলকতা, অনতিভদ্রতে সোজা চৌর্যবৃত্তি। তবে এটা সাধারণ পকেটমারা বা সিঁদকাটা চৌর্যবৃত্তি নয়, বুদ্ধিজগতের শিক্ষিত চৌর্য। জ্ঞানবিজ্ঞানের জগতে এর মানে দাঁড়ায়ঃ একজনের গবেষণালব্ধ মৌলিক কাজ আরেকজন তার নিজের বলে চালিয়ে দেওয়া, এবং ফলতঃ রীতিমত নাম করে ফেলা। এরকম ঘটনা অহরহই ঘটত আগেকার দিনে। ছাত্রের লেখা অভিসন্ধর্ভের পুরো কৃতিত্বটাই হয়ত অবেক্ষকসাহেব আত্মসাৎ করে ছাপিয়ে দিলেন নামকরা জার্নালে, আর ছাত্র বেচারা ঘরে বসে রাগে দুঃখে নিজের চুল ছেঁড়া ছাড়া আর কোন পথ খুঁজে পেল না, এধরণের অবিশ্বাস্য ঘটনাও যে ঘটেনি তা নয়। তবে বর্তমান যুগের “চৌর্যবৃত্তি” একটু ভিন্নরকম। ইন্টারনেটের কল্যানে যেহেতু কেউ কারো কাছ থেকে সহজে কিছু লুকিয়ে রাখতে পারে না, সেহেতু “চুরি”টা হয় প্রধানত সেই ইন্টারনেটেরই কাছ থেকে। যেমন, গুগলের মারফতে ইন্টারনেট থেকে একটা তথ্য “ধার” করার পর গবেষণাপত্রে সেই তথ্যসূত্রটি বেমালুম চেপে গিয়ে নিজের বলে দাবি করার চেষ্টা। মানবচিরত্রের এই ছোটখাটো হীনতাগুলো চিরকালই ছিল, চিরকাল থাকবেও। তবে উঁচুমানের গবেষক-সাধকদের মধ্যে এই দুর্বলতাগুলো খুব কমই দেখা গেছে। যা অনেক ক্ষেত্রেই ঘটেছে তা হল একের কাজ সম্বন্ধে অন্যজন সম্পূর্ণ অনবহিত হয়েই তার নিজের কাজটি কোনও পত্রিকায় প্রকাশ করে ফেলেছেন, যদিও সেই একই কাজ হয়ত অন্য লোকটি অন্য কোন দেশের অন্য কোন পত্রিকায় তার আগেই প্রকাশ করে ফেলেছিলেন। সেটা “চৌর্যবৃত্তি” নয়, এমনকি অনিচ্ছাকৃত ভুলও নয়, সেটা স্বাধীন ও যুগপৎ গবেষণা। দুজনেরই সমান অধিকার গবেষণার কৃতিত্ব দাবি করার।

পদার্থবিজ্ঞান আর গণিতশাস্ত্রে এর ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত ( যদিও আমি নিঃসন্দেহ যে বিজ্ঞানের প্রায় প্রতিটি শাখাতেই অল্পবিস্তর একই দৃশ্য)। আলোকরশ্মির প্রতিসরণ বিষয়টিতে Snell’s Law বলে একটা বিখ্যাত সূত্র আছে, যা পদার্থবিজ্ঞানের প্রাবেশিক ছাত্রছাত্রীদের সবাইকেই মুখস্থ করতে হয়। স্নেল সাহেব, যার পুরো নাম William Snellius (1580-1626) নিশ্চয়ই নিজের মেধার গুণ আর সাধনা দিয়েই আবিষ্কার করেছিলেন এই মূল্যবান সূত্রটি, এবং হয়ত জানতেনই না যে প্রায় একই সময়, ইতিহাসের অন্যতম বিখ্যাত দার্শনিক-বিজ্ঞানী-গাণিতিক রেনে দেকার্ট (১৫৯৬-১৬৫০) ঠিক একই সূত্র প্রমাণ করে গেছেন (যদিও তার প্রমাণটিতে বিস্তর ফাঁকফোকড় ছিল)। সেকারণে আধুনিক পাঠ্যপুস্তকপ্রণেতাদের অনেকেই সূত্রটিকে কেবল স্নেলসূত্র আখ্যায়িত না করে বলেনঃ Snell-Descartes Law.

মজার ব্যাপার হল যে তাতেও ঐতিহাসিক ন্যায়বিচারের প্রয়াসটি পুরোপুরি সফল হয়নি। দেকার্ট বা স্নেল, দুজনের কারুরই হয়ত জানা ছিল না যে প্রায় ৬০০ বছর আগে মুসলিম বিজ্ঞানী ইবনে সা’ল (৯৪০-১০০০) প্রতিসরণ সমস্যা নিয়ে গবেষণা করে হুবহু একই সূত্র আবিষ্কার করেছিলেন, এবং তার প্রমাণের যুক্তিতে দেকার্টের মত কোন ভুলত্রুটি ছিল না। শুধু তাই নয়। ঐ সময়কার বেশ কিছু আরব এবং ইরাণী পদার্থবিদ আলোকরশ্মির প্রতিফলন আর প্রতিসরণ বিষয় নিয়ে অত্যন্ত মূল্যবান কাজ করে গেছেন যা দীর্ঘকাল অজ্ঞাত ছিল বিজ্ঞানজগতে। সেই বিজ্ঞানীদের মধ্যে আল-কিণ্ডি (৮০১-৮৭৩), ইবনে আল-হাইথাম ( ৯৬৫-১০৪০), আল-বিরুনী (৯৭৩-১০৪৬), এঁরা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রতিসরণ সূত্রের নামটি স্নেল আর দেকার্টের যুগ্ম আবিষ্কার না বলে, আমার মতে, হওয়া উচিত Sahl-Snell Law। দেকার্টের নামটি থাকলে থাকতেও পারে, তবে সা’ল সাহেবেরই অগ্রাধিকার তার চেয়ে বেশি, বিশেষ করে যখন ধরা হয় যে সা’লের প্রমাণে কোনও ভুল ছিল না, যা দেকার্ট সাহেবের বেলায় দাবি করা যাবে না।

আরেকটি বিখ্যাত উদাহরণ হল গণিতের অন্তর্কলন শাখাটির ‘লোপিতাল’ সূত্রের মালিকানা ব্যাপারটি। সূত্রটি এতই বিখ্যাত যে কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের যে কোন ছাত্রছাত্রী গড়গড় করে বলে দিতে পারবে লোপিতাল সূত্র বলতে কি বোঝায়। কথা হল ‘লোপিতাল সূত্রে’র আবিষ্কারক কি সত্যি সত্যি ফ্রান্সের বড়লোক সামন্তসন্তান Guillaume-Fracois-Antoine de L’Hopital (1661-1704), না অন্য কেউ? আমরা যতটুকু জানি, ঘটনাটি এরকম। বাপ চেয়েছিলেন ছেলে সৈন্যবাহিনীতে প্রশিক্ষণ নিয়ে একসময় সেনাপতি হবে। কিন্তু ছেলের মন বুট আর বন্দুকে নয়, গণিতের রঙ্গিন রহস্যের জগতে। যদিও সৈন্যবাহিনীতে ক্যাপ্টেন পদ পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিলেন, কিন্তু মাঝখানে সব ছেড়েছুড়ে একেবারে গলা ডুবিয়ে ঢুকে গেলেন গণিতচর্চায়। তার শিক্ষক নির্বাচিত হলেন সেসময়কার অন্যতম বিখ্যাত গাণিতিক ইউহান বার্ণুলি (১৬৬৭-১৭৪৮)। বার্ণুলি সাহেব, তার বড়ভাই জ্যাকব বার্ণুলি (১৬৫৪-১৭০৫), ছেলে ড্যানিয়েল বার্ণুলি (১৭০০-১৭৮২), এঁরা সবাই ইউরোপের সর্বোচ্চ মানের গাণিতিক ছিলেন—–বার্ণুলি পরিবারের নাম গণিতের নানা শাখাপ্রশাখাতে রীতিমত কিংবদন্তীয়। যাই হোক, লোপিতাল সাহেবের শিক্ষক সেসময়কার অত্যাধুনিক গণিত, অর্থাৎ নিউটন ও লাইবনিৎসের কলনশাস্ত্র খুব ভাল করেই আয়ত্ত করে নিয়েছিলেন। এমনকি ওসব বিষয় নিয়ে তিনি নিজেই অনেক চিন্তাভাবনা করে কিছু মৌলিক কাজ করেও ফেলেছিলেন যার মধ্যে এই “লোপিতাল সূত্র”টি ছিল অন্যতম। প্রশ্ন হল, সেটা বার্ণুলি সূত্র না হয়ে লোপিতাল সূত্র হয়ে গেল কেমন করে? উত্তরঃ দারিদ্র্য। ইউহান বার্ণুলি লোপিতালের মত বড়লোকের ছেলে ছিলেন না, বড় কষ্ট করে তার জীবিকা অর্জন করতে হত। বর্তমান যুগের গৃহশিক্ষকদের মত সেকালের গৃহশিক্ষকদেরও বলতে গেলে একইরকম সংগ্রামের জীবন ছিল। ইউহান বার্ণুলি ছিলেন সেরকমই একজন সংগ্রামী শিক্ষক। তার একটা খাতা ছিল যা’তে অনেক মৌলিক গবেষণালব্ধ ফলাফল তিনি লিপিবদ্ধ করে রেখেছিলেন। টাকার অভাবে, বা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয় ভেবেও হয়তবা, সেগুলোর অধিকাংশই অপ্রকাশিত থেকে গিয়েছিল। ধনী ছাত্র লোপিতাল তখন এক অদ্ভুত প্রস্তাব করেন তাঁকেঃ আপনার তো টাকার টানাটানি, স্যার, এক কাজ করুণ, আপনার এই অঙ্কের খাতাটি আমার কাছে বিক্রি করে দিন, যা চান তা’ই দেব। শুধু আপনার আবিষ্কৃত ফলাফলগুলো আমার নিজের নামে প্রকাশ করার অধিকার দিতে হবে। বার্ণুলি ভাবলেন, এমন আর কি? ভীষণ দামি কোন কাজ তো আর নয়, ছাত্রের নামে বেরুলেই কি আর আমার নিজের নামে বেরুলেই কি। তিনি সানন্দে বিক্রি করে ফেললেন তার সেই আপাত মূল্যহীন (অথচ আসলে দারুণ মূল্যবান) সূত্রটির প্রণয়নন্স্বত্ব। কালে কালে যখন তার খাতার সেই “বিক্রিত” সূত্র স্কুলকলেজের পাঠ্যপুস্তকে প্রবেশ করতে শুরু করল তখন বেচারি মাথায় হাত দিয়ে আফসোস করতে থাকলেনঃ হায় হায়, এ কি করলাম আমি। নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারলাম! বিলম্বিত হলেও এর সংশোধন যে তিনি করার চেষ্টা করেননি তা নয়। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। ততদিনে লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে “লোপিতাল সূত্রের” জাদুকরি শক্তির খবর। তবুও হয়ত জোর প্রচার চালাতে পারলে লোকে তাঁর কথা শুনতে চাইত, কিন্তু ভদ্রলোক নিজেই তাঁর ভাবমূর্তি নষ্ট করে ফেলেছিলেন একবার তাঁর বড়ভাই জেকবের কাজ নিজের নামে চালাবার চেষ্টা করে।

গণিতের মত এক গুরুগম্ভীর বিষয়ের জগতেও চাঞ্চল্যকর ঘটনা যে একেবারে ঘটেনা তা নয়। কারণ গণিতের লোকেরাও সাধারণ রক্তমাংস অস্থিমজ্জার উপাদানেই তৈরি, অতএব সাধারণ মানুষের সাধারণ দুর্বলতাগুলো তাদের মাঝেও মাঝে মাঝে উঁকি দিতে পারে বইকি।

খরগোশজাতির পরিবার পরিকল্পনা
দ্বাদশ শতাব্দীতে ইতালির পিসা শহরে গুগলিমা বোনাচি নামক এক প্রতিপত্তিশীল ব্যবসায়ী ছিলেন। ১১৭০ সালে তাঁর এক পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করে, যার নামকরণ করা হয় লেনার্ডো প্যাসানো বিগলো। পরবর্তীকালে শিশুটির নাম পরিবর্তন হতে হতে শেষে লেনার্ডো ফিবুনাচিতে পরিণত হয়—-ফিবুনাচির ‘বুনাচি’ অংশটুকু হয়ত বাবার নামের সঙ্গে খাপ খায় বলেই ইতিহাস এ-নামটিকে বাছাই করে নিয়েছে।

গুগলিমা বোনাচির ব্যবসা কেবল ইতালির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলেও তাঁর বিস্তর ব্যবসায়িক যোগাযোগ ও কর্মলিপ্ততা ছিল। বিশেষ করে আলজিয়ার্সের নিকটবর্তী শহর বুগিয়াতে। বালক ফিবুনাচি সুযোগ পেলেই বাবার সঙ্গে উত্তর আফ্রিকাতে বেড়াতে যেতেন। ছোটবেলা থেকেই ছেলেটার অঙ্কের মাথা অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সেসময় গণিতের জগতে সবচেয়ে উন্নত এবং বিশ্বমাপের জ্ঞানসমৃদ্ধ সভ্যতা ছিল মুসলমানদের—–বাগদাদ থেকে শুরু করে মিশর, মরক্কো, আলজিরিয়া, টিউনিশিয়া, সমস্ত এলাকাটি জুড়ে। আরব পণ্ডিতরা ভারতীয় সংখ্যালিখন পদ্ধতি পুরোপুরি আয়ত্ত করে তাঁদের গাণিতিক গবেষণাতে নতুন উত্তেজনা ও প্রাবল্য সৃষ্টি করে ফেলেছিলেন। বোনাচি তার মেধাবী ছেলেকে উন্নত মানের গণিত শিক্ষার সুযোগ দেওয়ার খাতিরে ফিবুনাচিকে উত্তর আফ্রিকাতে রেখে ফিরে গেলেন পিসাতে। ফিবুনাচির তীক্ষ্ণ, কৌতূহলী মন সহজেই আকৃষ্ট হয়ে পড়ে আরব গণিতের নতুনত্ব ও গভীরতার প্রতি। লেনার্ডো ফিবুনাচির গণিতশিক্ষার পুরোটাই বলতে গেলে আরব শিক্ষকদের কাছ থেকে প্রাপ্ত।

ফিবুনাচি

অধ্যয়নপর্ব সমাপ্ত হলে ফিবুনাচি তার জন্মভূমিতে প্রত্যাবর্তন করেন, এবং অল্প সময়ের মাঝেই একজন সুপ্রতিষ্ঠ গাণিতিক হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। ১২০২ খৃষ্টাব্দে, মাত্র ৩২ বছর বয়সে, তিনি Liber Abaci (গণনাগ্রন্থ) নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেন যার প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল আরবি-ভারতীয় সংখ্যা লিখনপদ্ধতিকে ইউরোপের গণিতামোদীদের কাছে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। সেকালে ইউরোপে রোমান লিপি ব্যবহার করা হত (যেমন I, II, III, IV, V, ….,) যা গণিতসাধনার পথে রীতিমত বিরক্তিকর। সে তুলনায় আরবি-ভারতীয় লিখনপদ্ধতি (সেটা ইউরোপিয়ান গাণিতিকিদের কল্যানে আরবি পদ্ধতি বলে পরিচিত হলেও আসলে যে এটি হিন্দু-আরবি পদ্ধতি নামেই পরিচিত হওয়া উচিত ছিল সেদিকে কিছু কিছু সমসাময়িক ইউরোপিয়ান গণিতজ্ঞ মানুষের দৃষ্টি করবার চেষ্টা করছেন) যে কতখানি অগ্রসর এবং উন্নত, এবং তার সাহায্যে যে কত শক্ত শক্ত গাণিতিক সমস্যার সমাধান বের করা সম্ভব কত সহজে, সেটা দেখাতে গিয়ে তিনি বেশ ক’টি উদাহরণ দাঁড় করিয়েছিলেন। তার একটি উদাহরণ আমাদের আজকের আলোচনার জন্য বিশেষভাবে প্রাসংগিক। কিন্তু তার আগে আমার অগাণিতিক পাঠকদের কিঞ্চিত মানসিক প্রস্তুতি দরকার। ধরুণ নিচের সংখ্যামালাটিঃ

১, ২, ৩, ৪, ৫,………

এতে একটা সহজ প্যাটার্ণ বা ধারাবাহিকতা আছে, তাই না? আপনি অনায়সে বলে দিতে পারবেন রাশিটির পরের সংখ্যাটি কিঃ ৬। এবং তার পরেরটি ৭, ইত্যাদি। এগুলোকে অঙ্কের ভাষায় বলা হয় ন্যাচুরেল নাম্বার, বা প্রাকৃতিক সংখ্যা। মানবসভ্যতার প্রাচীনতম আবিষ্কারগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম, যদিও ঠিক এরকম নিখুঁত সাঙ্কেতিক ভাষাতে ব্যক্ত করার পদ্ধতি আমরা শিখেছিলাম মূলত ভারত উপমহাদেশের আর্য শিক্ষকদের কাছে। সেটা অপেক্ষেকৃত আধুনিক।

এবার ধরুণ আরেকটি সংখ্যামালাঃ
০, ১, ১, ২, ৩, ৫, ৮, ১৩, ২১, ৩৪,………,

অনুমান করতে পারেন ৩৪-এর পরের সংখ্যাটি কি হবে? না, এত সহজ নয়। অন্তত আগেরটির মত সহজ তো নয়ই। তবে এটা অসাধ্যও কিছু নয়। একটু ভাবতে হবে, এই যা। খেয়াল করে দেখুন বাম থেকে ডানে যেতে সংখ্যাগুলোর মধ্যে কোনও সম্পর্ক খুঁজে পান কিনা। প্রথমে হয়ত চোখে পড়বে না। তারপর একটু মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করলে হয়ত হঠাৎ করেই চোখে পড়বেঃ ওমা, তাই তো, তৃতীয় সংখ্যাটি প্রথম দুটির যোগফল, চতুর্থটি দ্বিতীয় ও তৃতীয়ের যোগফল, পঞ্চমটি তৃতীয় ও চতুর্থের যোগফল। এভাবে এগুতে থাকলে আপনি ঠিকই ধরে ফেলতে পারবেন ব্যাপারটা। তখন আপনি নিজেই গড়গড় করে বলে দিতে পারবেন পরের সংখ্যাগুলি—–একের পর এক। কৌতূহলী মন তখন জিজ্ঞেস করবেঃ বেশ তো, ধাঁধা ভাঙ্গা হল, কিন্তু দুনিয়ার আর সব সংখ্যামালা ছেড়ে ফিবুনাচি সাহেব একেই বাছাই করলেন কেন?

কারণ আছে।

খরগোশজাতির বংশবৃদ্ধি হয় কিভাবে? ফিবুনাচিসাহেব খরগোশদের সাথে কোনরকম আলাপ আলোচনা না করে নিজে থেকেই একটা মডেল তৈরি করে নিলেন। সেটা যে কত অবাস্তব নিচের বর্ণনা থেকেই পাঠক তা টের পেয়ে যাবেন। ধরুণ এক কৃষকের সখ হল তিনি খরগোশের ব্যবসা করবেন। বাজারে গেলেন একজোড়া খরগোশ কিনে আনার জন্য, অর্থাৎ বাজারে যাওয়াকালে তার হাতে ছিল 0-সংখ্যক খরগোশ। বাজার থেকে ফেরার পর হল ১ জোড়া খরগোশ। গোণার সুবিধার জন্যে ধরা যাক সেটা ঘটে মাসের ঠিক প্রথম দিনটিতে। এবং খরগোশ জাতির প্রজনন রীতি অনুযায়ী ওদের প্রসবক্ষম হতে পাকা দুমাস লেগে যায়। তাহলে দ্বিতীয় মাসের এক তারিখে সেই খরগোশ জোড়ার সংখ্যাবৃদ্ধি না হয়ে ১-তেই রয়ে গেল। এতে করে আমরা মোট তিনটে সংখ্যা পেলামঃ 0, ১,১ ।

দ্বিতীয় মাসের প্রথমে একজোড়া নবজাত খরগোশ এল কৃষকের বাড়িতে। এবার সংখ্যাটি দাঁড়ালো ২-তে। তৃতীয় মাসের প্রথমে দ্বিতীয় জোড়াটি প্রসবক্ষম হয়ে ওঠেনি, কিন্তু প্রথম জোড়াটি আবারো একজোড়া সন্তান প্রসব করল। তাহলে তৃতীয় মাসের গোড়াতে মোট ক’জোড়া খরগোশ পাওয়া গেল? ৩ । ঠিক একই নিয়মে গুণতে থাকলে আপনি পাবেন, প্রথমে ৫, তারপর ৮, তারপর ১৩, —–। আগের পৃষ্ঠাতে যে দুটি রাশি দেওয়া হল তার দ্বিতীয়টির সঙ্গে মিলিয়ে দেখুন। হুবহু এক। এই সংখ্যামালাকেই বলা হয় ফিবুনাচি রাশি ( Fibonacci Sequence, or, Fibonacci Numbers)।

রাশিটি এত বিখ্যাত যে ৮০০ বছর পর লোকে এখনো এটা নিয়ে আলোচনা করে, প্রয়োজনে ব্যবহারও করে অনেক জায়গায়। ফিবুনাচি সাহেব যে এছাড়া আর কোন কাজ করেননি তা নয়, কিন্তু লোকে ওসব কিছুই মনে রাখেনি, কেবল এটিকে নিয়েই বোধ হয় মানুষ চিরকালই বলাবলি করবে। কিন্তু কেন? সবাই জানে, খরগোশজাতি কখনোই এভাবে বংশবৃদ্ধি করেনা, কিন্তু তা সত্ত্বেও কেন এটা টিকে থাকল এতকাল?
তার কারণ, খরগোশদের কথা বলতে গিয়ে ফিবুনাচিসাহেব, সম্ভবত নিজের অজান্তে, প্রকৃতিরই একটা গূঢ় প্রজননরহস্য আবিষ্কার করে ফেলেছেন। সেপ্রসংগ নিয়ে আলাপ করার আগে আমার আজকের নিবন্ধের মূল বিষয়টির একটু আভাষ দেওয়া যাক।
বড় প্রশ্ন: ‘ফিবুনাচি সংখ্যামালা’ কি সত্যি সত্যি ফিবুনাচিরই আবিষ্কার? না, তিনিই প্রথম সূচনা করেছিলেন একে গুণিজনদের কাছে?

আমি তাই জানতাম। আমরা সবাই তা জানতাম। অঙ্কশাস্ত্রের সঙ্গে জড়িত এমন কাউকে হয়ত পাওয়া যাবে না পৃথিবীতে যে দ্বিমত পোষণ করবে এর সংগে।

খরগোশের খাঁচায় সংস্কৃত কবি?

একদিন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় অফিসের কফিরুমে বসে এক সহকর্মী বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করছিলাম কফি খেতে খেতে। কথা উঠল ফিবুনাচি সংখ্যা নিয়। বন্ধুটি গণিতের বীজগণিত শাখার একজন বিশ্বমাপের পণ্ডিত। হেসে বললেনঃ আরে কিসের ফিবুনাচি। তার বহু আগেই ভারতীয় গাণিতিকরা করে গেছেন সেটা। বন্ধুটি চেকোশ্লাভিয়ার অভিবাসী, আমারই মত দীর্ঘকাল ক্যানাডায়। তিনি একজন ইউরোপিয়ানকে ইতিহাসের পাতা থেকে সরিয়ে ভারতের এক হিন্দু গাণিতিককে বসিয়ে দেবেন সেটা একটু আশ্চর্যজনক মনে হতে পারে আমাদের কাছে, কিন্তু আসলে জ্ঞানবিজ্ঞানের জগতে এই সততাটুকু কাম্যই কেবল নয়, সচরাচর তা’ই দেখা যায়। ওর কাছ থেকে এর সূত্র কোথায় তার খবর নিয়ে আমি ইন্টারনেট থেকে পেলাম পরমানন্দ সিংহ নামক এক গাণিতিকের লেখা নিবন্ধ যার শিরোনামঃ The so-called Fibonacci Numbers in Ancient and Medieval India. প্রকাশকাল ও অন্যান্য তথ্যাবলীঃ 1985, Historia Mathematica, 12, pp 229-244। লেখাটির ভূমিকাতে তিনি তার বক্তব্যের মূল বিষয়টি মোট পাঁচটি ভাষাতে ব্যক্ত করেছেনঃ ইংরেজি, ফরাসী, জার্ম্নান, হিন্দি ও বাংলা। তার বাংলা অনুবাদটি আমি এখানে হুবহু তুলে দিচ্ছিঃ

“ এল ফিবুনাচির (১২০২ খৃষ্টাব্দ) পূর্বে বিরহাঙ্ক (খৃঃ ৫০০-খৃঃ ৬০০ এর মধ্যে), গোপাল (১১৩৫ খৃষ্টাব্দের আগে), এবং হেমচন্দ্রের (১১৫০ খৃষ্টাব্দের নিকট) সকলেই তথাকথিত ফিবুনাচি সংখ্যা এবং তার নির্মাণ বিধির বর্ণনা করে গেছেন। নারায়ন পণ্ডিত (১৩৫৬ খৃষ্টাব্দ) সামাসিক পংক্তি, যার এক বিশেষ রূপ হচ্ছে ফিবুনাচি সংখ্যা, এবং বহুপদী গুণকের মধ্যে সম্বন্ধ স্থাপন করেছেন”।

বিরহাঙ্ক বাবু ছিলেন সংস্কৃত কাব্যের ছন্দজ্ঞান বিশেষজ্ঞ, যা আমি নই। বরং খোলশা করে বলা যায়, সংস্কৃত বা যে-কোনও ভাষার কাব্যরচনা বিধি বিষয়টিতে আমি রীতিমত গণ্ডমূর্খ। অতএব নিচে যে আলোচনাটুকু নিবেদন করছি পাঠকের সুবিধা হবে ভেবে, তাতে যদি সুবিধার পরিবর্তে আরো ধাঁধার ভেতরে পড়ে যান পাঠক তাহলে আমাকে ক্ষমা করতে হবে।

পরমানন্দ মহাশয়ের ভূমিকা অনুযায়ী সংস্কৃত কাব্যে ছন্দের একমাত্রিক ধ্বনি বা স্বরকে (Syllable) বলা হয় ‘লঘু’, আর দ্বিমাত্রিক ধ্বনিকে বলা হয় ‘গুরু’ । ধরা হোক যে প্রথমটির ওজন ১, আর দ্বিতীয়টির ২। লেখক বলছেন যে, সংস্কৃত আর প্রাকৃত কাব্যে তিনপ্রকারের ছন্দরীতিঃ এক, বর্ণবৃত্ত, যাতে অক্ষরসংখ্যা বদলাবে না, তবে ধ্বনিসংখ্যা পারবে। দুই, মাত্রাবৃত্ত, যেখানে ধ্বনিসংখ্যা অপরিবর্তিত, তবে অক্ষরসংখ্যা বদলাতে পারবে। তিন, গণ- বা গুচ্ছ-বৃত্ত, যেখানে একই গুচ্ছের ভেতর প্রথম বা দ্বিতীয়টির বৈশিষ্ট্য বজায় থাকবে, তবে গুচ্ছে গুচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের সমাবেশ থাকা সম্ভব। আমাদের বর্তমান আলোচনার জন্যে দ্বিতীয়টিরই গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। এখানে তৃতীয়টি একেবারেই নিষ্প্রয়োজন বলে এর আলোচনা স্থগিত রাখব—-এটা গণিতের বিষয় তত না, যতটা ছন্দবিন্যাসের।

প্রথমটির উদাহরণঃ
১ অক্ষর — ল (লঘু) বা গ (গুরু) — মোট সংখ্যা ২ =২
২ অক্ষর — লল, লঘ,ঘঘ, ঘল — মোট সংখ্যা ৪ =২×২
৩ অক্ষর — ললল, লগল, ললগ, লগগ, গগগ, গগল, গলগ, গগগ– মোট সংখ্যা ৮=২×২×২

সজাগ পাঠকের কাছে ধারাটি বেশ পরিষ্কারভাবেই ফুটে উঠেছে, তাই না? এখন যে-কেউ বলে দিতে পারবে n অক্ষরবিশিষ্ট লাইনের মোট ক’টি সংখ্যা দাঁড়াবেঃ ২ কে n বার ২ দিয়েই গুণ করলে যা পাওয়া যায়। অর্থাৎ ৪ অক্ষর হলে ১৬ বার, ৫ হলে ৩২ বার,—– এভাবে চলবে।

২, ৪, ৮, ১৬, —-এই সংখ্যামালাটি যে ফিবুনাচি রাশির সঙ্গে একেবারেই সম্পর্কহীন সেটা স্পষ্ট। তবে এটা যে গণিতে অন্য কোন শাখার সংগে সংশ্লিষ্টতাহীন তা কিন্তু মোটেও নয়। যেমন, একটা মুদ্রা একবার ছুড়লে হয় মাথা আসবে, নয় লেজ আসবে, অর্থাৎ ২ টি সম্ভাব্য ফলাফল। ২ বার ছুড়লে ২×২ =৪ টি, ৩ বার ছুড়লে ২×২×২=৮ টি, —-অবিকল উপরের উদাহরণটির মত। এই মুদ্রানিক্ষেপের উদাহরণটি কিন্তু কোনও ছেলেখেলা নয়, পরিসংখ্যান-শাস্ত্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মডেল একটি। অতএব ছন্দব্যাকরণের সঙ্গে গণিতের একাধিক শাখার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। যাই হোক বর্তমান নিবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বর্ণবৃত্তের আলোচনাতে এখানেই যতি টানব।

দ্বিতীয়টির উদাহরণঃ
১ অক্ষর ল (গ সম্ভব নয়, কারণ গ’তে দুই মাত্রা), –মোট সংখ্যা ১
২ অক্ষর লল, গ– মোট সংখ্যা ২
৩ অক্ষর ললল, লগ, গল– মোট সংখ্যা ৩
৪ অক্ষর লললল, লগল, ললগ, গলল, গগ– মোট সংখ্যা ৫
৫ অক্ষর ললললল, লললগ, ললগল, লগলল, গললল, গলগ, গগল,লগগ– মোট সংখ্যা ৮

নিয়মটা নিশ্চয়ই বেশ পরিষ্কার হয়ে উঠছে ? এবং এটাও নিশ্চয়ই প্রতীয়মান হয়ে উঠছে যে ডানদিকের সংখ্যাগুলোকে পাশাপাশি দাঁড় করালে দেখা যাবে এরা সেই ফিবুনাচি রাশিঃ

১, ২, ৩, ৫, ৮, ১৩, ——

তার অর্থ কবিতার মাত্রাবৃত্ত ছন্দের সাথে গণিতের ফিবুনাচি রাশি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এবং যেহেতু এই সম্পর্কটি অত্যন্ত সরাসরি, এবং বিরহাঙ্ক বাবু ফিবুনাচি থেকে অন্তত ৬ শ’ বছর আগে এটি আবিষ্কার করেছিলেন, সেহেতু আমার মনে হয় ঐতিহাসিক ন্যায়বিচারের কথা ভেবে এই গুরুত্বপূর্ণ রাশিটিকে এখন থেকে বিরহাঙ্ক-ফিবুনাচি রাশি বলে অভিহিত করা উচিত।

আশা করি আমার পাঠকদের কেউই ভাববেন না যে ফিবুনাচি সাহেব জেনেশুনেই বিরহাঙ্কের নামটি চেপে গিয়ে নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছিলেন। না, আমার মনে হয়না যে লোকটা ওরকম অসাধু ছিলেন। যদি হতেন তাহলে তিনি কেন গায়ে পড়ে ভারতীয় গণিত প্রচার করার উদ্দেশ্য নিয়ে রীতমত একটা বই লিখে ফেলবেন? শুধু তাই নয়। রাশিটি যে ফিবুনাচির নামে ভূষিত হয়ে গেছে সেটা কিন্তু তিনি নিজে করেননি, নামকরণটি করেছিলেন এডুয়ার্ড লুকাস (১৮৪২-১৮৯১) নামক এক অনতিবিখ্যাত গাণিতিক ফিবুনাচির মৃত্যুর প্রায় সাড়ে ছ’শ বছর পর। না, এটা চোর্যবৃত্তির ব্যাপার নিশ্চয়ই নয়, নেহাৎ অনবহিততার বিষয়।
এবার আমি বিরহাঙ্ক-ফিবুনাচি রাশির আরো অনেক প্রয়োগশীলতা বিষয়ে পাঠককে নিয়ে চলে যাব প্রকৃতির একটি গোপন প্রকোষ্ঠে। কিন্তু তার আগে, পেশাদার গাণিতিক হিসেবে, সংস্কৃত-প্রাকৃত-বাংলা কাব্যের ছন্দশাস্ত্রের সঙ্গে গণিতের যে আরো ক’টি শাখার চমকপ্রদ সম্পর্ক আছে তার সামান্য আভাষ দেবার লোভ সংবরণ করতে পারছি না।

অঙ্কের রাণী

গণিতের একটি প্রাচীন শাখার নাম সংখ্যাতত্ব—-Theory of Numbers. সংখ্যা বলতে এখানে কেবল প্রাকৃতিক সংখ্যাই বুঝাচ্ছে—–১, ২, ৩, ৪, ——। তত্বটির মূল বিষয়বস্তুই হল এই প্রাকৃতিক সংখ্যাগুলো, বিশেষ করে যাদের বলা হয় মৌলিক সংখ্যা ( অর্থাৎ যেসমস্ত সংখ্যা এমনই স্বাধীনচেতা যে একমাত্র ১ আর তারা নিজেরা ছাড়া অন্য কোন সংখ্যা দ্বারা তাদের ভাগ করা যাবে না। আপনি জোর করে চেষ্টা করতে পারেন, তবে একটা অবশিষ্ট থেকেই যাবে)। উদাহরণঃ ২, ৩, ৫, ৭, ১১, ১৩, ——-। এদের নিয়ে গল্প বলতে শুরু করলে দিন ফুরিয়ে রাত হবে, রাত ফুরিয়ে আবার হবে দিন, তবুও আরবোপন্যাসের গল্পের মত গল্প কখনোই ফুরাবে না। অনভিজ্ঞ পাঠক হয়ত কপাল কুঁচকে বলবেন, এ আবার কেমন কথা। হাতে গুণেই তো বলা যায় একের পর এক মৌলিক সংখ্যাগুলো—–১৭, ১৯, ২৩, ২৯, ৩১,——। আপনি নিজেকে বাহবা দিতে শুরু করেছেন, হয়তবা এই ভেবে যে “মূর্খ গাণিতিক”রা যেখানে “দিনের পর দিন আর রাতের পর রাত” কাটিয়ে দেয় যার গল্প বলাতে সেবিষয়টি আপনি আনাড়ি মানুষ হয়েও গড়গড় করে আওড়ে যেতে পারছেন। আপনি অতিশয় তীক্ষ্ণ মেধার মানুষ তাতে হয়ত সন্দেহ নেই, কিন্তু আপনাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, এই আপাত সহজ সংখ্যাগুলো যখন ১০০ এর উপরে চলে যায় তখনও কি এত সহজে বলতে পারবেন কোনটা মৌলিক, কোনটা মৌলিক নয়? বড় কথা আপনি কি নিশ্চিতভাবে বলতে পারবেন এই মৌলিক সংখ্যাগুলো শেষ পর্যন্ত একটা জায়গায় গিয়ে থেমে যায়, না, তারা অনন্তকাল ধরে চলতে থাকে? না, পারবেন না।

বড় বড় গাণিতিকদের মাথা ঘেমে গিয়েছিল এ-প্রশ্নের জবাব দিতে। তিনচারজন ভদ্রলোক শেষে এ-প্রশ্নের চূড়ান্ত সমাধান পেয়েছিলেন বটে, এবং পাওয়ার ফলে তাঁরা গণিত জগতে বিস্তর যশ-খ্যাতি অর্জন করে গেছেন। তাঁদের আবিষ্কৃত তথ্য অনুযায়ী মৌলিক সংখ্যা সীমাহীন, তবে যতই উপরের দিকে উঠতে থাকে তারা, ততই তাদের পারস্পরিক দূরত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। অনেকটা পাহাড়ের গা বেয়ে ওপরে ওঠার সময় যেমন বায়ুর ঘনত্ব ক্রমশ কমতে থাকার ফলে বায়ুচাপও কেবলই নিম্নমুখি হতে থাকে। কৌতূহলী গণিতবিদদের জন্যে অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও গভীর চিন্তাভাবনার বিষয় ছিল যে, ঠিক আছে, তারা দূরে দূরে থাকে, কিন্তু কারো যদি একটা বড়সড় মৌলিক সংখ্যা দরকার পড়ে (যেমন বর্তমান যুগের নিরাপত্তা ব্যবসায়ীরা, ব্যাঙ্ক-কর্তৃপক্ষরা, সরকারি-বেসরকারি কোষাগাররক্ষকরা) তাহলে তারা কোথায় খুঁজবে সেই সংখ্যাগুলো? তাছাড়া, বাস্তব জীবনের প্রয়োজনীয়তার কথা বাদ দিলেও একটা গাণিতিক কৌতূহল থেকেই যায়, তাইতো, এরা কোথায় থাকে, এদের ঠিকানা কি? পাঠক হয়ত বিশ্বাসই করতে চাইবেন না যে এ-প্রশ্নের উত্তর তো এখনো কেউ আবিষ্কার করতেই পারেনি, অদূর ভাবিষ্যতেও কেউ পারবে কিনা সন্দেহ—-এতই অবিশ্বাস্যরকম শক্ত এই প্রশ্নটি। তবে ১৮৫৯ সালে জার্মানীর বার্নার্ড রিম্যান নামক এক তেত্রিশ বছর বয়স্ক যুবক, ইতিহাসে যিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন, এবং যাঁর অকাল মৃত্যু ঘটেছিল মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে, এবিষয়ে অনেক গভীর গবেষণা করে গেছেন। তিনি এর পূর্ণ সমাধান লাভ করতে সক্ষম হননি বটে, তবে একটা আন্দাজ রেখে গিয়েছিলেন ভবিষ্যতের গাণিতিক প্রজন্মের জন্যে, যেটাকে বলা হয় “রিম্যান কঞ্জেকচার” —–কঞ্জেকচার বলতে বোঝায় একটা সম্ভাব্য ফলাফল যা শুধু অনুমান করে বলা গুটিকয় সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে, কিন্তু যার ত্রুটিহীন প্রামাণিক সত্যতা এখনো অপ্রতিষ্ঠিত। গণিতের গবেষণাক্ষেত্রে এর চেয়ে “দাঁত-বসানো-দায়” সমস্যা আর দ্বিতীয়টি নেই। এই কঞ্জেকচারের সমাধান যে দিতে পারবে সে চিরজীবি হয়ে থাকবে, এটা একরকম গ্যারান্টিড। এই বিশাল সাগর পাড়ি দেবার চেষ্টা করতে গিয়ে কত বড় বড় নাবিক (মানে গণিতসায়রের নাবিক) যে দিশা হারিয়ে ভরাডুবি খেয়েছেন তার সীমা নেই। মজার ব্যাপার কি জানেন? একটা বড় স্বপ্নকে লক্ষ্য করে যখন একজন দুঃসাহসী মেধাবী যাত্রী চলতে শুরু করে কোনও দুর্গম অজানা পথের ওপর দিয়ে, তখন শেষ গন্তব্যে পৌঁছুতে সক্ষম না হলেও পথিমধ্যেই এমন সব চমকপ্রদ দৃশ্যের অস্তিত্ব ধরা দেয় তার কাছে যে সেই তথ্যগুলিও পৃথিবীকে আগের চেয়ে অনেকটাই সমৃদ্ধ করে যায়।

রিম্যান কঞ্জেকচার প্রমাণ করবার চেষ্টা করতে আজ পর্যন্ত কেউই পুরোপুরি সফল হননি, কিন্তু সেই চেষ্টা থেকেই বেরিয়ে এসেছে গণিতের আরো কত বিচিত্র রহস্যাবলী। গত রঙ, কত বর্ণশোভাতে দীপ্যমান কত নব নব কুঞ্জকানন আবিষ্কৃত হয়ে গণিতকে করেছে রূপবান, ধনাঢ্য, বর্ণাঢ্য। তাই বলি, একটা বড় ব্যর্থতাও অনেক সময় অনেক গুপ্তধনের সন্ধান দেয়। রিম্যান কঞ্জেকচার এবং তার আনুসঙ্গিক বিষয়াদি নিয়ে কৌতূহলী পাঠক যদি কোনও সহজপাঠ্য বই পড়তে চান তাহলে আমি তাকে মার্কাস ডু সটয়ের অসাধারণ গ্রন্থ “ The Music of the Primes” (published by Harper Collins Publishers, 2003; first paperback Perennial edition published in 2004)- টি সংগ্রহ করার চেষ্টা করতে বলব। মূলত অঙ্কের বই হলেও এটা রহস্যোপন্যাসের মতই মনে হবে পড়বার সময়—-একবার পড়তে শুরু করলে শেষ না করে ওঠা শক্ত।

যাই হোক, আমার আজকের প্রসংগ এতটা উচ্চাভিলাসী নয়—-রীতমত সাদামাটাই বলতে পারেন তুলনামূলকভাবে। সংখ্যাগণিতের আরেকটি শাখার নাম হলঃ Partition Theory. না, দেশ ভাগাভাগি নয়, সম্পত্তি ভাগাভাগিও নয়। পূর্ণ সংখ্যার ভাগাভাগি। একটা প্রাকৃতিক, বা পূর্ণ সংখ্যাকে নিম্নতর সংখ্যাগুলো দ্বারা কতভাবে ভাগ করা যায়—-গোড়ার প্রশ্নটা হল এই। বাস্তব জগতের প্রয়োগশীলতা নিয়ে অতিরিক্ত উদ্বিগ্ন যারা তারা হয়ত বলবেন, এমন একটা নীরস জিনিস নিয়ে অনর্থক সময় নষ্ট করার দরকারটা কি? দরকার আছে বইকি। আপনি যদি কোনও ক্যাসিনোতে যান কখনো, জুয়ার চাকাতে নিজের ভাগ্যপরীক্ষা করার জন্যে, তাহলে এই সংখ্যা ভাগাভাগির ব্যাপারটি একটু আয়ত্ত করে গেলে উপকার হতে পারে। কারণ সেখানে ‘সম্ভাবনা’ বা প্রবাবিলিটি গণনার ক্ষমতা কার কত তার ওপরই নির্ভর করে খেলোয়াড়ের জুয়ার ভাগ্য। এই গণনার পেছনে রয়েছে এই সংখ্যা-বিভক্তির সমস্যাটি।

তাছাড়া ব্যবহারিক প্রয়োগ বাদ দিলেও কৌতূহলী মনের একটা স্বাভাবিক তাড়না তো আছেই—-এই তাড়না থেকেই তো জন্ম নিয়েছে পৃথিবীর কত না অমর সৃষ্টি।
উদারণ স্বরূপ ধরা যাক ৬ সংখ্যাটি। অন্য যে-কোনও ছোটখাট সংখ্যা হলেও চলত, তবে ৬ টিকে বাছাই করার উদ্দেশ্য জুয়াড়ির গুটিতে সাধারণত ১ থেকে ৬ পর্যন্ত সংখ্যাগুলোই থাকে। ৬ এর নিচে মোট পাঁচটি পূর্ণ সংখ্যাঃ ১, ২, ৩, ৪, ৫ । প্রশ্ন হল এই পাঁচটি সংখ্যা “কতভাবে” ব্যবহার করে তাদের যোগফল ৬ পাওয়া যাবে? এই যে “কতভাবে” প্রশ্নটি, তাকেই বলা হয় পার্টিশন, বা বিভক্তি। সজাগ পাঠক হয়ত তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন তুলবেন, সংখ্যাগুলো কিভাবে ব্যবহার করা হবে তার কোনও নিয়মকানুন নেই? অবশ্যই আছে। এবং একেক নিয়ম অনুযায়ী আমরা একেক ফল পাব। যেমন, যদি বলা হয় কোন সংখ্যা দুবার ব্যবহার করা যাবে না, এবং দুটি বা তিনটি সংখ্যা আগে-পরে ব্যবহার করার পর সেগুলোকে ওলট-পালট করে লিখলে কোনও ভিন্ন সংখ্যা ধরা হবে না, তাহলে হিসাবটা হবে এরকমঃ

৬=১+২+৩=২+৪=১+৫ঃ অর্থাৎ মোটমাট ৩টে। ৬=১+১+৪=২+২+২=৩+৩ এগুলো নিষিদ্ধ, এবং ২+৪ একবার গোণা হলে ৪+২ কে ভিন্ন বিভাগ ধরা যাবে না। অতএব এই হিসেব অনুযায়ী ৬ এর বিভক্তিসংখ্যা হল ৩ ।

এবার ধরুণ ওপরের নিয়মটি একটু শিথিল করে বলা হলঃ সংখ্যাগুলো আলাদাই থাকবে, তবে তাদের বিন্যাস, অর্থাৎ কোনটা আগে কোনটা পরে সেটা পরিবর্তন করা হলে বিভক্তিটাও সম্পূর্ণ ভিন্ন হয়ে যাবে। তাহলে মোট কটা বিভক্তি পেতে পারি আমরা? নিচে তার পুরো তালিকাটিই দিয়ে দিলামঃ

৬= ২+৪=৪+২=১+৫=৫+১=১+২+৩=১+৩+২=২+৩+১=২+১+৩=৩+১+২=৩+২+১;

মোট কটা হল? হাতে গুণেই পাবেন ১০ টা। ৩ থেকে এক লাফে চলে গেল ১০এ তে!
এখন আরেকটি নিয়ম আরোপ করা হবে ৬ এর বিভক্তির ওপরঃ কেবল ১ আর ২, এদুটি সংখ্যাই ব্যবহার করার অনুমতি আছে, তবে তাদের ভিন্ন বিন্যাসকে ভিন্ন বিভক্তি বলেই গণ্য করা হবে। শুধু তাই নয়, ১ আর ২ এর ব্যবহার যতবার ইচ্ছা ততবারই করা যাবে, এবং প্রতিবারই তাতে একটা নতুন বিভক্তি পাওয়া যাবে। ভীষণ অবাস্তব বলে মনে হচ্ছে বুঝি? তাহলে একটা “বাস্তব” উদাহরণ দেওয়া যাক, ধরুণ একটি শিল্পমনা মেয়ের খুব ফুলের সখ, অথচ ফ্ল্যাটবাসী হবার ফলে বাইরের বাগানে গাছ লাগানোর উপায় নেই তার। অতএব ফুলের পটে গাছ লাগিয়ে দুধের সাধ ঘোলে মেটানো ছাড়া বেচারার সখ মেটানোর অন্য কোন পথ নেই। সে বাজার থেকে ৬ টি পট কিনে নিয়ে এল, সাথে সাথে ৬ টি ফুলের চারা। ঘরে এনে খুব খাটাখুটি করে পটগুলোর গায়ে আলপনা এঁকে বেশ আকর্ষণীয় করে তুলল। এখন তার মনে প্রশ্নঃ কোন পটে কোন চারাগুলো লাগাবে। একটা পটে সে ১টা বা বড়জোর ২ টে চারা লাগাতে প্রস্তুত, কিন্তু তার বেশি নয়। যেহেতু পটগুলোতে আলপনা আঁকা সেহেতু ১ নম্বর পটে ১ নম্বর চারা ও ২ নম্বর পটে ২ নম্বর চারা, আর ১ নম্বর পটে ২ নম্বর চারা ও ২ নম্বর পটে ১ নম্বর চারা ঠিক একই বিভক্তি নয়। কথা হল এই নিয়ম অনুসারে মোট কতগুলো বিভক্তি সম্ভব যাতে তার রুচির খেলাপ না হয়?

প্রশ্নটা পাঠকের কাছে যত সহজ মনে হচ্ছে আসলে হয়ত ততটা সহজ নয়। সুতরাং পাঠকের সুবিধার জন্য আমরা প্রথমেই ৬ তে না গিয়ে ১ থেকে শুরু করব।
১: ১=১ বিভক্তিসংখ্যা= ১
২: ২=১+১=২ ,, =২
৩: ৩=১+১+১=১+২=২+১ ,, =৩
৪: ৪=১+১+১+১=১+১+২=১+২+১=২+১+১=২+২ বিভক্তিসংখ্যা=৫
৫: ৫=১+১+১+১+১
=১+১+১+২=১+১+২+১=১+২+১+১=২+১+১+১ ,, =৮
=২+২+১=২+১+২=১+২+২

ধারাটি পরিচিত মনে হচ্ছে? অবশ্যই হবে। এ তো সেই বিরহাঙ্ক-ফিবুনাচি সংখ্যামালা। তাহলে ৬টি পটের ভেতর ৬টি ফুলের চারা বসাতে হলে (যাতে কোনটিতে ১ টি কি ২টির বেশি চারা থাকবে না) কতরকমভাবে সেটা সাজানো সম্ভব? একটু ধৈর্য ধরে গুণতে থাকলে অনায়াসে পেয়ে যাবেন সেই সংখ্যাটি—-১৩; ৮ এর পরে ঠিক যে সংখ্যাটি পাবার কথা বিরহাঙ্ক-ফিবুনাচি রাশিতে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, প্রতি পটে ০, ১, বা ২ সংখ্যক চারা বসানোর নিয়ম অনুযায়ী ক-সংখ্যক পটে ক-সংখ্যক চারা লাগাতে হলে কতভাবে তা করা যেতে পারে সেটা বের করতে হলে উপরোক্ত রাশিটির দিকে তাকালেই হয়।

সজাগ পাঠক এখানে প্রশ্ন তুলতে পারেনঃ ৬ টি পটের জন্য আমাদের এত মাথা ঘামাতে হল, ১০ টা কি ৫০ টা পট আর পঞ্চাশটা চারা লাগাতে হলে তো সব্বনাশ—-সারাদিন সারারাত লেগে যাবে এই গোণার কাজে, দুনিয়ার আর সব কাজ তখন ভেস্তে যাবার অবস্থা হবে। হ্যাঁ, যথার্থ অভিযোগ। সেজন্যে গাণিতিক হিসেবে আমার একটা সোজা দাওয়াই যে নেই তা নয়। স্কুল-কলেজে পড়াকালে আপনি নিশ্চয়ই অঙ্কের বিন্যাস (Permutations) আর সমাহার (Combinations) বিষয়দুটো পড়েছিলেন। এদুটোর ব্যবহার তো সম্ভাবনা শাস্ত্রে (Probability Theory) তে রীতিমত অপরিহার্য। বীজগণিতেও তাই। এবং এখানে যে ফুলের চারা আর পটবিন্যাসের কথা বললাম এখানেও এ-দুটি বিষয় জানা থাকলে গুণতে খুব সুবিধা হয়। তাহলে ওপরের সংখ্যাগুলো আপনি চোখের পলকে বের করে ফেলতে পারতেন।

এই সংখ্যাবিভক্তি, যার অন্যতম উদাহরণ থেকে বেরিয়ে এসেছে ফিবুনাচি-বিরহাঙ্ক সংখ্যামালা, তার প্রয়োগশীলতা আরো অনেক জায়গাতেই। পদার্থবিজ্ঞান আর রসায়নশাস্ত্র দুটিতেই ব্যবহৃত একটি শাখার নাম পরিসাংখ্যানিক বলবিদ্যা (Statistical Mechanics), যেখানে কোন্‌ প্রকারের অণু কোন্‌ খোপে যাবে (খোপ বলতে কি বোঝায় সেটা একেক ক্ষেত্রে একেক রকম—-কখনো ঘনত্ব, কখনো শক্তি, কখনোবা পরমাণুর বিশেষ ধর্মনির্ভর), এবং কতগুলো, সে অনুযায়ী একেক গণনাপদ্ধতি থেকে বেরিয়ে আসবে একেকটি সংখ্যা—–ঠিক পার্টিশন তত্বেরই মত। কথাগুলো উল্লেখ করলাম এই জন্য যে গণিতের বিমূর্ত রূপ অনেক সময় সাধারণ পাঠককে ভাবিয়ে তোলে বাস্তব জীবনে এসবের আদৌ কোন প্রয়োজন আছে কিনা। আমার উপরোক্ত মন্তব্যগুলোতে আশা করি এটুকু বোঝাতে পারলাম যে, এই আপাত-শুষ্ক, অর্থহীন সংখ্যামালা কেবল শ্বেতপ্রস্তরের অট্টালিকাবাসী অলস গাণিতিকদের সুখবিলাসের প্রমোদাগার নয়, এর একটা বাস্তব প্রয়োগশীলতাও আছে। গণিতের প্রকৃতিটাই এরকম। দেখতে মনে হয় বাস্তবতার সঙ্গে এগুলোর কোন সম্পর্ক নেই—-এবং গোড়াতে হয়ত প্রয়োগযোগ্যতার কথা ভেবেই তার আবিষ্কারক এটা নিয়ে আসেননি আমাদের কাছে, কিন্তু কালে কালে দেখা গেল ঠিক এই জিনিসটাই ভীষণ জটিল একটা সমস্যার সমাধান করে দিয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা ব্যবহারিক শাখাতে। ফলিত বিজ্ঞান আর বিমূর্ত গণিতের মাঝে এ এক বিচিত্র সখাসখীর সম্পর্ক—-কখনো বিজ্ঞান নতুন পথের ইঙ্গিত দেয় গণিতকে, আবার গণিতই কখনো বিজ্ঞানকে হাত ধরে নিয়ে যায় সামনে। এ-কারণেই লিওনার্ডো দ্য ভিঞ্চি আর গ্যালিলিও গ্যালিলি, দুই মহাপুরুষ ঠিক একই কথা বলেছিলেন গণিত সম্বন্ধে—–‘গণিত হল প্রকৃতির ভাষা’।

আমরা যারা মূলত গণিতের ছাত্র, তাদের কাছে “ফিবুনাচি” সংখ্যা একটি অতিপরিচিত, অতিপ্রিয় ও বহুলব্যবহৃত সংখ্যা। আমরা ভাবতাম এমন একটা অসাধারণ জিনিস কেমন করে এক দ্বাদশ শতাব্দীর ইতালিয়ান গাণিতিকের মাথায় ঢুকেছিল—–অবাক হয়ে যেতাম লোকটার ধীশক্তির কথা চিন্তা করে। তারপর যখন জানলাম, না, এটা ভারতীয় পণ্ডিতরাই প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন ফিবুনাচিরও ৬০০-৭০০ বছর আগে, এবং অঙ্কের ভেতর দিয়ে নয়, কবিতার ভেতর দিয়ে, তখন বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে থাকা আর কি করার আছে বলুন। এখন আমার সন্দেহ হচ্ছে, হয়ত সঙ্গীত আর নৃত্যশিল্পতেও ফিবুনাচি-বিরহাঙ্ককে পাওয়া যাবে, কারণ সেখানে তো প্রথম শিক্ষাটাই হল কিভাবে গুণতে হয়। নৃত্যশিল্পের খবর আমি এখনো জানিনা, তবে সঙ্গীতে যে ফিবুনাচি-বিরহাঙ্ক আছে তার প্রমাণ তো আমি নিজেই দেখেছি। পাঠকের সুবিধার জন্যে রাশিটিকে দ্বিতীয়বার লেখা যাক নিচেঃ

০, ১, ১, ২, ৩, ৫, ৮, ১৩, ২১, ৩৪, ৫৫, ৮৯, ১৪৪, ——-

সংখ্যাগুলো যে বেড়ে বেড়ে একেবারে সীমার বাইরে চলে যাচ্ছে সেটা তো পরিষ্কার বুঝাই যাচ্ছে। তবে দেখা যাক এদের অনুপাতগুলো কিভাবে এগুচ্ছে।

২/১=২; ৩/২=১.৫; ৫/৩=১.৬৬৬; ৮/৫=১.৬০০; ১৩/৮=১.৬২৫; ২১/১৩=১.৬১৫; ৩৪/২১=১.৬১৯; ৫৫/৩৪=১.৬১৭;—-

একটা প্যাটার্ণ বেরিয়ে আসছে, তাই না? সংখ্যাটি ১.৬ এর কাছাকাছি ঘোরাঘুরি করছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। আসলে গণিতের লোকেরা খুব সহজেই প্রমাণ করে দিয়েছেন যে চূড়ান্ত সীমায় গিয়ে সংখ্যাটি ১.৬১৮ এর খুব সন্নিকটে একবারে স্থির হয়ে বসে, যদিও দশমিক সংখ্যাগুলো কখনোই শেষ হয়ে যায় না। তার অর্থ সংখ্যাটি অমূলদ! তবে অমূলক নয়। এর একটা গভীর তাৎপর্য আছে। দেখা যায় যে সংখ্যাটি আসলে প্রকৃতিরই একটি গোপন কোডের মত—-একটা সঙ্কেতসংখ্যা। রহস্যটি সর্বপ্রথম উদ্ধার করেছিলেন গ্রীক দার্শনিক-গাণিতিক পাইথাগোরাস (খৃঃপূঃ ৫৬৯-৫০০), অনেকটা ঘটনাক্রমে এবং তাঁর নিজেরই পরম অনিচ্ছাবশত। একটা একতারা বাদ্যযন্ত্র নিয়ে সুর তোলার খেলা খেলতে খেলতে হঠাৎ আবিষ্কার করে ফেললেন যে তারের যে-জায়গাটিতে টোকা দিলে সবচেয়ে মধুর সুরটি বেরিয়ে আসে তার সঙ্গে এই সংখ্যাটির ওতপ্রোত সম্পর্ক। এটি অমূলদ সংখ্যা ঠিকই, কিন্তু সেসময়কার অমূলদ-বিরোধী চিন্তাধারার কথা ভেবে তিনি সেটা কারো কাছে ফাঁস করতে চাননি। যাই হোক, কালক্রমে রহস্যটা আর গোপন থাকে না, এবং তার একটি শিরোনামও তৈরি হয়ে যায়ঃ সুবর্ণ অনুপাত (The Golden Ratio)। অনেকের ধারণা এই সুবর্ণ সংখ্যাটি শিল্পকলার একাধিক শাখাতে আত্মপ্রকাশ করে শিল্পীর অজান্তেই। অঙ্কন-শিল্পের কর্মীরা যখন জ্যামিতিক অনুপাত ব্যবহার করেন তাঁদের কাজে তখন দেখা যায় যে এই অনুপাতটিই তাঁদের ভাবপ্রকাশের জন্য সবচেয়ে উপযোগী সংখ্যা। স্থাপত্যশিল্পেরও নাকি একই ধারা—-অন্তত তাই শোনা যায় অনেকের মুখে, যদিও সেটা একেবারে অবিতর্কিত নয়।

ফিবুনাচির সঙ্গে বিরহাঙ্কের সম্পর্ক বিষয়ে ইন্টারনেট ঘেঁটে আমি আবিষ্কার করলাম যে ব্যাপারটি পশ্চিম জগতে এখন খুব অজানা কিছু নয়। পিটার ক্যামেরন বলে এক ভদ্রলোক তাঁর ব্যক্তিগত ব্লগে ফিবুনাচি রাশির ওপর ধারাবাহিকভাবে বেশ কটি লেখা প্রকাশ করেছেন (http// cameroncounts.wordpress.com/2012/06-18fibonacci-numbers-I/) । এতে তিনি বিরহাঙ্ক পণ্ডিতের কথা সসম্মানে উল্লেখ করেছেন, এবং পাশ্চাত্য পাঠকদের কাছে সেটা উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন। সে সুযোগে বিরহাঙ্ক রাশির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটা মডেল তিনি নিজে থেকেই তৈরি করে নিয়েছেন যা সাধারণ পাঠকদের কাছে বেশ সহজবোধ্য হওয়া উচিত।

ধরুণ আপনি একটা দোতলা বাড়ির একতলার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছেন, দোতলাতে উঠবার বাসনাতে। ধরা যাক একেক ধাপে আপনি হয় একটা সিঁড়ি বা দুটো সিঁড়ি উঠতে পারবেন, তার বেশি নয়। তাহলে মোট ক-সংখ্যাক সিঁড়ি অতিক্রম করতে হলে আপনি কতভাবে তা পারবেন? সিঁড়ির সংখ্যা যদি ১ হয়, তাহলে স্পষ্টতই ১ উপায়ে। ২ হলে ২ ভাবে (হয় ১, ১ করে বা একবারেই ২), ৩ হলে ১,১,১; ১;২; ২,১—-অর্থাৎ ৩ উপায়ে। সিঁড়িসংখ্যা যদি ৪ হয় তাহলে ১,১,১,১; ১,২,২;২,১,১;১,২,১; ২,২—-মোট ৫ উপায়ে। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে সেই আগের সংখ্যাগুলি। ক-সংখ্যাক সিঁড়ি অতিক্রম করতে হলে ঠিক কতভাবে তা করা যেতে পারে তার একটা গাণিতিক ফর্মুলা আছে—সেটা নাহয় না’ই উল্লেখ করলাম। এমনিতেই আমার অগাণিতিক পাঠকরা হয়ত একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন।
পরের অধ্যায়গুলোতে আমি ফিবুনাচি আর বিরহাঙ্ক বাবুর সংগ নিয়ে সংগ নিয়ে প্রকৃতির এক গোপন রহস্যপুরিতে চলে যাব।

শম্বুকশাবকের ক্রমবৃদ্ধি

শৈশব থেকে প্রাপ্ত বয়সে পৌঁছানোর প্রক্রিয়াটি সম্বন্ধে আমাদের সবারই একটা মোটামুটি ধারণা আছে, যদিও সে-ধারণার সাথে বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের কোনও তুলনাই হয় না। কিন্তু কেউ কি কখনো ভেবে দেখেছেন সমুদ্র উপকূলে এই যে এত এত শামুক চোখে পড়ে আমাদের, এবং দেখার পর নানাবিধ রোমান্টিক ভাবনাতে নিমগ্ন হয়ে পড়ি মাঝে মাঝে, তারা আসলে কিভাবে ক্ষুদ্র কণার মত অস্তিত্ব নিয়ে জন্মানোর পর আস্তে আস্তে পূর্ণাঙ্গ শম্বুকে পরিণত হয়? সঠিক প্রক্রিয়াটি হয়ত শামুকবিশারদ প্রাণীবিজ্ঞানীরা ছাড়া আর কেউ পুরোপুরি বলতে পারবে না, তবে মূল ঘটনাটি অনেকটা এরকমঃশুরুতে তার ছোট্ট ১×১ মাপের কামরা।

শামুকের ক্রমবৃদ্ধি

 

আস্তে আস্তে বাড়তে থাকলে আরেকটা ঘরের দরকার হয়ে পড়ে। কিন্তু নতুন জায়গাতে নতুন কোনও ঘর তৈরি করার সামর্থ্য নেই বলে সে আগের ঘরের দেয়াল ধরেই ঠিক একই মাপের আরেকটা ঘর তৈরি করে নেয়। পরের দফাতে প্রথম আর দ্বিতীয় দফার মাপ যোগ করে যা পাওয়া যায়, অর্থাৎ ৩, তাই দিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। এবং তারও পরেরটিতে সেই একই ফর্মুলা ব্যবহার করে সে পায় ৫ মাপের ঘর। এভাবে যেতে যেতে পূর্ণাংগ দেহে পৌঁছাতে তাকে নির্মাণ করতে হয় একটি ফিবুনাচি-বিরহাঙ্ক মাপের গৃহঃ

১, ২, ৩, ৫, ৮, ১৩, ২১, ৩৪, ৫৫, ৮৯, ১৪৪,——-

শেষমেশ তার বাড়িটা নেহাৎ মন্দ দেখায় না, কি বলেন? প্রতিসাম্য আছে এর গঠনে। অঙ্কের ভাষায় একে বলা হয় Outward Spiral বা বহির্মুখি চক্র।
এবার একটি উদাহরণ দেব, প্রকৃতির কাছ থেকেই ধার করা, যাতে বহির্মুখি এবং অন্তর্মুখি, উভয়প্রকারের চক্র পাওয়া যাবে একই জিনিসের ভেতরঃ সূর্যমুখি ফুল!

ফুল আমরা সবাই ভালোবাসি। কিন্তু কেউ কি কখনো খেয়াল করে দেখেছেন কোন ফুলের পাপড়িসংখ্যা কত। উদ্ভিদবিদদের গণনা অনুযায়ী মেরিগোল্ড বা গাঁদাফুলের পাপড়িসংখ্যা ১৩, এস্টারফুলের পাপড়ি ২১, কোন কোন ডেইজির ৩৪, বেশির ভাগেরই ৫৫ বা ৮৯।

 

পূর্ণাংগ শামুকের অভ্যন্তর

ফুলের চাষাবাদ করে যারা জীবিকা অর্জন করেন তারা অনেকসময় কৃত্রিম উপায়ে পাপড়ির সংখ্যা বাড়িয়ে দ্বিগুণ করে তোলেন। সাধারণত ডেইজি ফুলের পাপড়িসংখ্যা ৩৭ বা ৩৩ এম্নন দৃশ্য খুবই বিরল—-যদি হয় সেটা নেহাৎই ব্যতিক্রম। নিচের সূর্যমুখিটার দিকে খুব মনোযোগ দিয়ে তাকালে বোঝা যাবে দুটি পরিষ্কার ধারা।

একটি অন্তর্মুখি, আরেকটি বহির্মুখি চক্র বেরিয়ে এসেছে এর ভেতর থেকে। অনেকটা বাইসাইকেলের চাকার মত। ধৈর্য ধরে, বীক্ষণযন্ত্রের সাহায্য নিয়ে যদি দেখেন তাহলে হয়ত একটা পরিণত ডেইজি পরিবারের অন্তর্গত সূর্যমুখির একদিকের পাপড়িসংখ্যা ২১ হলে আরেকদিকে হবে ৩৪; একদিকে ৫৫ হলে আরেকদিকে হবে ৮৯,—-।

পূর্ণাঙ্গ ডেইজি-সূর্যমুখি

প্রথম থেকে প্রাপ্ত অবস্থা অবধি ঠিক কি নিয়মে তারা ক্রমে ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে তার একটা জ্যামিতিক আভাষ দেওয়া হল নিচে। প্রথমে ১, তারপর ২, পরে ৩, তারপর ৫, ৮,
১৩, ২১, ৩৪, ৫৫, ৮৯,—–, অর্থাৎ ঠিক ফিবুনাচি-বিরহাঙ্ককে অনুসরণ করে। এখানে বলে রাখা ভালো যে চক্রদুটিকে বহির্মুখি আর অন্তর্মুখি না বলে ঘড়ির কাঁটার বিপরীত (Anticlockwise or Positive), বা সমদিকও (Clockwise or Negative) বলা যেতে পারত। বাংলাতে এদের ধনাত্মক আর ঋণাত্মক দিকও বলা যায়। পদার্থবিজ্ঞানে, বিশেষ করে আধুনিক আণবিক-পরমাণবিক বিজ্ঞানে, এই দুটি দিকের পার্থক্য খুবই মৌলিক একটি বিষয়। যাই হোক, উদ্ভিদজগতের এই তথ্যগুলি আমি সংগ্রহ করেছি “The Mathematics of Life” by Ian Stewart, Published in the United States by Basic Books, in 2011, সূত্রটি থেকে।

ধনাত্মক ও ঋণাত্মক চক্র

ধনাত্মক ও ঋণাত্মক চক্র

বাস্তব জীবনে গণিতের স্থান কোথায় সেবিষয়ে অনেকেরই প্রচুর কৌতূহল, সেটা বোধ হয় অত্যুক্তি নয়। এ বইটিতে পাঠক আরো দেখতে পাবেন ফিবুনাচি-বিরহাঙ্ক রাশিটি কি আশ্চর্য উপায়ে একটি আনারসের গায়ের ওপর আঁকা (আক্ষরিক অর্থে নয় যদিও) রয়েছে।

আমার শেষ উদাহরণ হবে একটা গাছ কিভাবে চারা থেকে ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। সবরকম গাছ হয়ত নয় ফিবুনাচি-বিরহাঙ্কের আওতায়, তবে কোন কোন গাছ অবশ্যই। বিশেষ করে বিলেতে একটা ফুল আছে যার নাম Sneezewort বা Sneezeweed (যার আক্ষরিক বাংলা করলে দাঁড়ায় হাঁচিগাছ বা হাঁচিগুল্ম)। এগাছের ফুলগুলোর পাপড়ি সাদা, তবে মাঝখানের কোষটুকু সবুজ বা বাদামি রঙের, আকারে বেশ ছোটই বলা চলে, দেখতে অনেকটা বোতামের মত। চারা থেকে আস্তে আস্তে বেড়ে ওঠার নিয়মটা খানিক এরকমঃ প্রথম যখন একটা কুঁড়ি গজায়, সেকুঁড়ি থেকে নতুন কুঁড়ি বেরুতে সাধারণত মাসদুয়েক সময় লাগে (আনুমানিক)।

হাঁচিগাছ

তখন তার গায়ে যথেষ্ঠ শক্তি এসে যায় শাখাপ্রশাখার ভার বহন করবার। তাহলে যদি ধরা হয় যে প্রতি মাসের শেষে নতুন শাখা গজাতে শুরু করে, দেখা যাবে ৫-৬ মাস পরে গাছটা শাখাপ্রশাখায় বিস্তৃত হয়ে ওপরের ছবিটার মত দাঁড়িয়ে গেছে। এবার একটু মনোযোগ দিয়ে গুণে দেখুন, ফিবুনাচি-বিরহাঙ্ককে খুঁজে পান কিনা। প্রথম মাসে ১টি, দ্বিতীয় মাসে ১টি, তৃতীয় মাসে ২টি, চতুর্থ মাসে ৩টি, পঞ্চম মাসে ৫টি,——ঠিক যেভাবে শামুকের শরীর বাড়ে, ডেইজিফুলের পাপড়ি ছড়ায়, এবং সংস্কৃত-প্রাকৃত কবিতার ছন্দবিন্যাস করা হয়। বিরহাঙ্ক বা ফিবুনাচি, তাঁরা কি কেউ কল্পনা করেছিলেন যে তাঁদের এই খেলাচ্ছলে আবিষ্কার করা সংখ্যামালার মধ্যে আত্মগোপন করে ছিল প্রকৃতির প্রজননসূত্রের এক গূঢ়, গুপ্ত, রহস্য?

অটোয়া,
১১ই এপ্রিল, ‘১৩
মুক্তিসন ৪২