পুরুষকে আমরা সাধারণত বাবা-ভাই-পুত্র হিসেবে দেখি না। পুরুষ নেতা হয়, বিজ্ঞানী হয়, খেলোয়াড় হয়, দার্শনিক হয়, কিষাণ হয়। অন্যদিকে নারী মাত্রই মা-বোন-কন্যা। কেউ পুরুষকে অপমান করলে আমরা বাবা-ভাই-পুত্রকে অপমান করেছে বলে ক্ষেপি না, কিন্তু নারীকে অপমান করলে মা-বোন-কন্যাকে অপমান করেছে বলে ক্ষেপে যাই – পুরুষ হল একজন ধীমান-শক্তিমান মানুষ যে নিজেই নিজেকে হেফাজত করতে পারে, অন্যদিকে আমাদের মা-বোন-কন্যারা কোন না কোন পুরুষের সম্পত্তি, তাদেরকে অপমান করা মানে আসলে তাদের মালিক পুরুষকেই অপমান করা। মেয়েদেরকে এরকম অবলা মনে করে যেই পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধ(প্রসঙ্গত, বোর্ডের মাধ্যমিক বাংলা ব্যাকরণ বইতে “নারী” এর প্রতিশব্দগুলোর মধ্যে “অবলা” দেখেছিলাম), সেই মূল্যবোধ নারীর ব্যক্তিসত্ত্বাকে অস্বীকার করে। একজন মানুষের চুড়ান্ত অপমান বোধ করি তার ব্যক্তিসত্ত্বাকে অস্বীকার করা; আপনি চিন্তা-চেতনায় স্বশাসিত না হলে আপনার মনুষত্ব্যের বাকি থাকল কী?

পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষ হয় পণ্যের ও ভাবের উৎপাদক, নারী কেবলই সন্তানের উৎপাদক। নারী যখন উৎপাদনের দু’টো বলয়েই নিজের স্বাক্ষর রাখার চেষ্টা করে, তখন পুরুষ বিপন্ন বোধ করে। এই বিপন্নতা প্রতিরোধেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে এক পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধ, যেখানে পুরুষের জন্য চাকরি করাটা বাধ্যতামূলক ও প্রত্যাশিত হলেও নারীর জন্য চাকরি করা কেবলই উচ্চাভিলাষ! পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধ এমন মিথেরও প্রচার করে যে পিতার উপস্থিতি শিশুর সুস্থ স্বাভাবিক বিকাশের জন্য আবশ্যক না, কিন্তু শৈশবের প্রতিটা মুহুর্তে মায়ের শাসন না থাকলে সন্তান বিগড়ে যাবে! সন্তান লালনের গুরুভার পুরাটাই নারীর উপর চাপিয়ে দিয়ে পুরুষকে দায়মুক্তি দেওয়ার সংস্কৃতিতে কর্মজীবি নারীদের শাসন করার জন্য শিশুদের ব্যবহার করে তাদের উপর guilt bomb ফেলা হয়, শিশুদেরকে শেখানো হয় যে আম্মু যেহেতু চাকরি করে, তার মানে আম্মু তাদেরকে ভালবাসে না! এরুপ পুরুষতান্ত্রিক ব্ল্যাকমেইলিংয়ের জবাব দিয়ে এক কর্মজীবি মা হাফিংটন পোস্টে তাঁর কন্যাকে একটি চিঠি লিখেছেন। এদেশে মাঠে-কারখানায় নারী কর্মীদের উপস্থিতির অপরিহার্যতা ও প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করে মোল্লারা লাফালাফি করছে অনেকদিন ধরেই, তাদের প্রতি অনেক প্রগতিশীল মুখোশের পুরুষেরও যে নীরব সমর্থন নেই তা বলা যাবে না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই চিঠিটার গুরুত্ব অনুধাবন করে অনুবাদ করে ফেললাম।

:line:

প্রিয় ক্লো,

খুব বেশি দিন হয়নি তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করেছ তোমাদের দুই ভাই-বোনকে আমি আমার চাকরির চেয়েও বেশি ভালবাসি কিনা।

প্রশ্নটা শুনে আমি প্রায় ভেঙে পড়েছিলাম। তোমার বয়স মাত্র ৮, তাই আমি কিছু মনে করিনি। কন্যারা সবসময় তাদের মায়ের দুর্বলতাগুলো সম্পর্কে অবহিত থাকে, মা-মেয়ের সম্পর্কের এটা অন্যতম বিশেষত্ব। আমি আমার মায়ের সাথেও একই কাজ করেছিলাম। বছরের পর বছর ঘরে বসে আমাদের দুই ভাই-বোনকে বড় করার পর যখন তিনি আবার কর্মক্ষেত্রে যোগ দিয়েছিলেন, তখন আমিও তোমার মত তাঁকে এই প্রশ্ন করেছিলাম। তুমি যখন ভবিষ্যতে তোমার কন্যার কাছে একই প্রশ্ন শুনবে, তখন আমাদের এই আলাপ স্মরণ করে নিও।

তুমি আসলে কখনওই আমাকে ঘরে থাকতে দেখনি। তোমার যখন তিন মাস বয়স তখন আমি কর্মক্ষেত্রে আবার যোগ দিই, এর পর তোমার ভাইয়ের জন্মের সময় ৮ মাস কেবল আমাকে টানা ঘরে থাকতে দেখেছ। তোমার জন্মের সময় আমার জীবনে যে বিশাল পরিবর্তন এসেছিল, তোমাকে ছেড়ে প্রথমবারের মত অফিসে যাওয়ার সময় স্বাভাবিক জীবনে প্রত্যাবর্তনের শান্তি কিছুটা হলেও আমাকে গ্রাস করেছিল, সে ছিল এক পরাবাস্তব অভিজ্ঞতা।

কেউ কেউ অন্নের জোগানের জন্য কাজ করে, আবার কিছু সৌভাগ্যবানও আছে যারা তাদের পছন্দের কাজ করেই অন্ন জুটায়। আমি সেরকমই একজন সৌভাগ্যবতী। যেদিন আমার অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষক শ্রেণীকক্ষে আমার লেখা গল্প পাঠ করে আমাকে একজন লেখিকা আখ্যা দিয়েছিলেন, সেদিনই আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমি ভবিষ্যতে কী করতে চাই। যখন অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আমার চিন্তা প্রকাশ করার জন্য শব্দগুলো খুঁজে পাই, তখন খুশিতে আমার গাল লাল হয়ে যায়, বুকের ভেতর এক অদ্ভুত উত্তেজনা অনুভব করি। তুমি যখন ছবি আঁকো, তখন আমি যেন তোমার মুখে সেই একই অভিব্যক্তি দেখতে পাই, এমনও হতে পারে ভবিষ্যতে তুমি নিজের মাঝে আরও বড় কিছু আবিস্কার করবে।
কেমন হত যদি আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করতাম – তুমি কাকে বেছে নিবে, তোমার শিল্পকে নাকি তোমার মাকে? আমি প্রাণপণে চাই তুমি আমাকেই বেছে নিবে, কিন্তু তোমার কি মনে হয় না এটা খুবই অন্যায্য একটি প্রশ্ন? এখন তুমি বলছ যে তুমি মা হতে চাও না, তোমার ছোট্ট ভাইয়ের কীর্তিকলাপ দেখে তোমার “শিক্ষা” হয়ে গেছে। হয়ত তুমি পরে তোমার মত বদলাবে। যদি তুমি ভবিষ্যতে মা হও, আমি কামনা করি তুমি তোমার প্রিয় মানুষদের জন্য তোমার সৃজনশীলতা বিসর্জন দিবে না। এমন একজন জীবনসঙ্গী বেছে নিও যে তোমাকে এই কাজ করতে বাধ্য করবে না।

তোমার মূল প্রশ্নে ফিরে আসি। মায়েরা অনেক কারণেই ঘরের বাইরে কাজ করেন, তোমার মনে হতে পারে তুমি তাদের উদ্দেশ্যগুলো বুঝো কিন্তু এমনও হতে পারি তুমি আসলে কিছুই বুঝোনি। আমি অন্তত আমার কারণগুলো বলি।

আমি কাজ করি, কারণ আমি আমার কাজ ভালবাসি।

আমি কাজ করি কারণ সৃজনস্পৃহার কন্ডু আঁচড়ে আমি ভীষণ সুখ পাই। আমার জীবনের প্রতিটি বৃত্তে সেই সুখের মোক্ষণ ঘটে। এই সুখ আমাকে মাতৃদায়িত্ব পালনেও সাহায্য করে।

আমি কাজ করি কারণ আমাদের অর্থ প্রয়োজন। সেই অর্থ দিয়ে আমরা এই সুন্দর বাড়িটি কিনেছি, তোমাকে ওই দামী জুতোজোড়া কিনে দিয়েছি, তোমাকে জিমন্যাস্টিক্স ক্লাসে ভর্তি করিয়েছি।

আমি কাজ করি যাতে তোমরা দুই ভাই-বোন আমাকে নিয়ে গর্ব করতে পার।

আমি কাজ করি কারণ তোমার জন্মের আগে থেকেই আমি এটা করে এসেছি, তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য বাড়ি ত্যাগ করার পরও আমি এই কাজ করে যেতে চাই।

আমি কাজ করি কারণ – যদিও আমি প্রতিদিন ঠিক সন্ধ্যা ছয়টায় ঘরে প্রবেশ করি, কখনও কাজের জন্য শহরের বাইরে যাই না, তোমার শিক্ষাসফরের জন্য অনুমতিপত্রটা যে কালকে জমা দিতে হবে সেটা আমিই মনে রাখি – এরপরও তুমি তোমার বাবাকে কখনও জিজ্ঞেস করবে না কেন সে চাকরি করে। সে সর্বক্ষণ কর্মব্যস্ত থাকলেও তার অপত্যস্নেহ প্রমাণিত, কারণ সে পুরুষ। আমাকেই শুধু আমার অপত্যপ্রেম সমাজের কাছে প্রমাণ করতে হবে।

আমি কাজ করি কারণ এই ক্ষুদ্র বয়সেও তুমি এই কুসংস্কারটা শুষে নিয়েছ যে মা’দের চাকরির কোন দাম নেই, যে সন্তানের প্রতি “প্রকৃত” ভালবাসা থাকলে কোন মা চাকরি করবে না।

আমি কাজ করি কারণ আমি আশাবাদী ভবিষ্যতে যখন তুমি মা হবে, তোমাকে তোমার কন্যার মুখে এরকম প্রশ্ন শুনতে হবে না।

তো, তোমার প্রশ্নের উত্তরে বলি: হ্যাঁ, আমি আমার চাকরি ভালবাসি, কিন্তু আমি তোমাদের দুই ভাই-বোনকে তার চেয়েও অনেক অনেক বেশি ভালবাসি। যদি নিতান্তই আমাকে যেকোন একটি বেছে নিতে হয়, আমি তোমাদের দু’জনকেই বেছে নিব।

কিন্তু জানো, আমি অনেক খুশি যে আমাকে যেকোন একটি বেছে নিতে হচ্ছে না। এবং আমি আশা করি তোমাকেও কখনও এই কূটসিদ্ধান্ত নিতে হবে না।

ইতি,
আম্মু