১৯৮১ সালের গোঁড়ার দিককার কথা। লন্ডনের জেলে কয়েকজন কয়েদি আমরণ অনশন করছে। পত্র-পত্রিকায় খবর এটুকুই। আর একটু বিস্তারিত জানা গেল আরও দুদিন পর। আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির (আইআরএ) গ্রেপ্তারকৃত যে যোদ্ধারা অনশন করছিল তাদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ছেলেটির নাম ববি স্যান্ডস। বয়স মাত্র সতের! সেই সতের বছরের কিশোর অনশণ করছিল রাজবন্দী ঘোষণার দাবীতে! থ্যাচার সরকার তাদের গ্রেপ্তার করেছিল ‘সন্ত্রাসী’ বলে। তারা সেটি মানতে নারাজ। তাদের দাবী তারা আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির সদস্য, এবং ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতার দাবীতে। সুতরাং তারা রাজবন্দী কেন নয়? কিন্তু মার্গারেট থ্যাচার সরকার কিছুতেই ওই আইআরএ যোদ্ধাদের রাজবন্দীর মর্যাদা দেবেনা। টানা অনশন করতে করতে একসময় মৃত্যুবরণ করলেন ববি স্যান্ডস। ওই কিশোরের মৃত্যুর পর পরই সারা বিশ্বে এ নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। একের এর পর এক আরও কয়েকজন বন্দীর মৃত্যু হয়েছিল। বলা ভালো ওই কিশোররা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিল। কিন্তু লৌহমানবী খ্যাত থ্যাচারের লৌহহৃদয় তাতে এতটুকুও গলেনি। শেষ পর্যন্ত তাদের রাজবন্দীর ‘মর্যাদা’ দেয়া হয়নি।

এ তো গেল সেই আমলের মার্গারেট থ্যাচারের কথা। আমাদের দেশের সরকার প্রধান শেখ হাসিনা কি মার্গারেট থ্যাচারের মত ‘লৌহমানবী’? তিনিও কি থ্যাচারের মত নিজের জিদে অটল থেকে একের পর এক অনশনরতদের মৃত্যু দেখবেন? প্রধানমন্ত্রীর অতীত ইতিহাস আর জীবন চরিত ঘাটলে তেমন কোনো উদাহরণ মেলে না। কিন্তু অনশন শুরুর প্রায় ৯০ ঘন্টা পার হওয়ার পরও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো রকম সাড়া-শব্দ মেলেনি। এখন পর্যন্ত সরকারের দায়িত্বশীল কেউ অনশনরতদের কাছে গিয়ে তাদের বক্তব্য শোনার চেষ্টা করেননি। তার মানে কি তারা জানেন না? নিশ্চয়ই জানেন। পত্র-পত্রিকা এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে তারা, মানে সরকার পূর্ণ ওয়াকিবহাল। প্রশ্ন উঠছে তাহলে সরকার এখনো কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন? এর সহজ উত্তর হচ্ছে – সরকারের ‘নেগোশিয়েটররা’ নিশ্চই কোনো না কোনো মাধ্যমে ‘নেগোশিয়েট’ করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু শেষ খবর হচ্ছে অনশনরতদের চার জন ইতিমধ্যে গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে স্থানন্তরিত হয়েছেন। তাদের মধ্যে একজন যার নাম নিলয় তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। এই লেখার সময় অর্থাৎ একত্রিশ তারিখ মাঝ রাতেও ওই আশঙ্কাজনক নিলয়ের খোঁজ খবর নিতে সরকারি কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি শাহবাগে যাননি।

অথচ এই শাহবাগের তরুণরা যখন সেই ফেব্রুয়ারি মাসের ৫ তারিখে মানবতাবিরোধী অপরাধী কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন সাজার বিরোধীতা করে ফাঁসির দাবীতে সমবেত হন, তখন থেকেই সরকারের একাধিক কর্তাব্যক্তি নামে-বেনামে, নিজ পরিচয়ে বা দলগত পরিচয়ে শাহবাগে উপস্থিত থেকে আন্দোলনকে ‘বেগবান’ করতে সাহায্য করেছেন। এর পর জামাতের সশস্ত্র হিংস্রতা শুরু হলে এবং ব্লগার রাজীবকে হত্যা করা হলে সরকার আন্দোলনকারীদের পুলিশি নিরাপত্তা দিয়েছেন। ফেব্রুয়ারির ২৮ তারিখে আর এক মানবতাবিরোধী অপরাধী সাঈদির ফাঁসির রায় হলে জামাত সরাসরি ঘোষণা দিয়ে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তাণ্ডব শুরু করলে শাহবাগের আন্দোলনরতদের নিরাপত্তা জোরদার করতে তিন স্তরের নিরাপত্তা বেষ্টনি দিয়েছেন। নিন্দুকেরা বলে সরকার নাকি আন্দোলকারীদের ‘পক্ষে’ রাখার জন্য ‘সব ধরণের’ সহায়তা দিয়েছেন। চ্যানেলগুলোর ভিডিও ক্লিপিংসে দেখা গেছে সরকারের একাধিক কর্তাব্যক্তি শাহবাগের তরুণদের পাশে পাশে আছেন। তারা তাদের এজেন্ডা ধরিয়ে দিয়েছেন। তাদের ‘নিজেদের লোক’ ডা. ইমরান সরকারকে দিয়ে তোতাপাখির মত তারা নিজেদের এজেন্ডা প্রচার করে আন্দোলনকে এক ধরণের ‘স্পিডব্রেকারের’ আওতায় এনেছেন। তার পর থেকে সেই আন্দোলন ততটুকুই প্রচারিত বা বেগবান হয়েছে যতটুকু সরকার চেয়েছে। আন্দোলন সেভাবেই এগিয়েছে যেভাবে এগুলে সরকার ‘সন্তুষ্ট’ হয়। সেই থেকেই এই আন্দোলন নিয়ে ‘আমার দেশ’, ‘নয়া দিগন্ত’, ‘সংগ্রাম’-পত্রিকাগুলো নির্লজ্জ মিথ্যাচার করে আসছে। এক পর্যায়ে তাদের মিথ্যাচার সীমাহীন হলে আন্দোলনকারীরা ‘আমার দেশ’ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিচার দাবী করেও আলটিমেটাম দিয়েছে। ওই পত্রিকা নিষিদ্ধ করার জন্যও আলটিমিটাম দিয়েছে। যদিও শেষ পর্যন্ত জামাত-শিবির বা ‘আমার দেশ’ কোনোটিই বাতিল বা নিষিদ্ধ হয়নি। কেন হয়নি সেটি সরকারে যারা আছেন তারাই ভালো বলতে পারবেন। তবে সাধারণ মানুষ আড়ালে-আবডালে যেটুকু বুঝেছে তা হলো – এই আন্দোলনকে নিয়ে সরকারের নানা ধরণের ‘এক্সপেরিমেন্ট’ রয়েছে! সেই এক্সপেরিমেন্ট হতে পারে আগামী নির্বাচনের হিসেব নিকেশ, হতে পারে জামাতকে নিষিদ্ধ করার হুমকির ভেতর অন্য কোনো রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চিন্তা। আবার এও হতে পারে সরকার সত্যি সত্যি একা একা (যতই সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকুক) জামাত-শিবির নিষিদ্ধের মত জটিল সিদ্ধান্ত নেবে না বা নিতে চায় না। সে কারণেই প্রথম দিকে তারা চাইছিল বিএনপি যেন এই ইস্যুতে তাদেরকে সহায়তা দেয়। কিন্তু বিএনপি তা তো দেয়নি-ই বরং নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে আরও দৃঢ়ভাবে জামাত-শিবিরের সঙ্গে জড়িয়েছে। এমন ভাবে জড়িয়েছে যে এখন বিএনপি আর জামাতকে দুটি ভিন্ন দল হিসেবে পৃথক করা সাদা চোখে দুষ্কর মনে হচ্ছে। বিএনপি যখন জামাত-শিবির নিষিদ্ধের বদলে তাদের রক্ষা করতে মরিয়া হয়ে একের পর এক হরতাল এবং সেই হরতালে ইতিহাসের ভয়াবহতম হিংস্রতা আর বর্বরতা দেখিয়েছে তখনই সরকার বুঝে নিয়েছে এভাবে আর জামাত নিষিদ্ধের বিষয়টির ফয়সালা হবেনা।

তাহলে কীভাবে হবে? না। সে বিষয়েও সরকার এখন পর্যন্ত কোনো দিকনির্দেশনা দেয়নি। সর্ব শেষ সরকারপ্রধান এক ঘোষণায় বলেছেন ‘জামাত-শিবির নিষিদ্ধের জন্য আরও ধৈর্য্য ধরতে হবে’। জনগণ না হয় ধৈর্য ধরলোই, কিন্তু তাই বলে সরকার কি সেই নিষিদ্ধের বিষয়ে কানো কার্যকর আইনী পদক্ষেপ নিয়েছেন? এখন পর্যন্ত খবর হচ্ছে- না। তাহলে কি সরকার একেবারেই চুপচাপ বসে আছেন? তাও নয়। এর পর থেকেই সরকাররের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা শাহবাগের তরুণদের আন্দোলনকে দীর্ঘমেয়াদী রূপ দেয়ার জন্য আন্দোলনের ‘গিয়ার’ সেট করে দিয়েছেন, এবং আন্দোলন নিরুপদ্রবভাবে সেভাবেই এগুচ্ছে। মিহি সুরে স্লোগান, বেলুন ওড়ানো, মোমবাতি প্রজ্জলন, তিন মিনিট নিরবতা এবং এখানে ওখানে সমাবেশ করেই আন্দোলন এক ধরণের ‘কার্নিভাল মুডে’ চলছে। এর ফল যা হওয়া উচিত তা-ই হয়েছে। শাহবাগ থেকে উচ্ছ্বসিত তরুণরা একটু একটু করে সরে আসতে শুরু করেছে। ২৬ মার্চ ছিল জামাত-শিবির নিষিদ্ধের সরকারি উদ্যোগের শেষ আলটিমেটাম। ওই দিন শাহবাগে আন্দোলনকারীদের মুখপাত্র ডা. ইমরান কী ঘোষণা দেবেন সেটাই হয়ে উঠেছিল টক অব দ্য কান্ট্রি! তো তিনি ঘোষণা দিলেন আগামী মাসের ৪ তারিখে তারা প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে গিয়ে স্মারকলিপি দেবেন। কোনো আন্দোলনের কোনো আলটিমেটাম পার হয়ে গেলে আর স্মারকলিপির মত আন্দোলন বিলাসের দরকার করে না, এই সত্যটি সরকারের যারা এই আন্দোলনে আঁঠার মত লেপ্টে আছেন তারা এবং আন্দোলনের মুখপাত্র বা নেতৃস্থানীয়রা বুঝতে পারেননি। তাই তারা তাদের সেই নিরীহ স্মারকলিপির ঘোষণা দিয়ে ওই দিনের মত কর্মসূচী শেষ করেছিলেন।

তার পর থেকেই নতুন ইতিহাসে বাঁক নিয়েছে শাহবাদের আন্দোলন। ৯ জন তরুণ সব বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে জামাত-শিবির নিষিদ্ধের দাবীতে ওই দিন থেকেই আমরণ অনশন শুরু করেছেন। এই তরুণরা এমনই একটি ব্যানার ব্যবহার করছে যার সঙ্গে জামাত-শিবির নিষিদ্ধের আন্দোলনের গোঁড়ার ইতিহাস মিশে আছে। শহীদজননী জাহানারা ইমামের সন্তান শহীদ রুমীর নামে তাদের সংগঠন- ‘শহীদ রুমী স্কোয়াড’। প্রথমে মাত্র ৯ জন থাকলেও এর পর একে একে অনশন কর্মসূচীতে যোগ দেয়া তরুণ-তরুণীর সংখ্যা বেড়েছে। একের পর এক সুযোগ সন্ধানী অ্যাটেনশনসিকাররা আন্দোলনে ‘একাত্মতা’ ঘোষণা করে দেশোদ্ধার করেছেন! এই সকল ক্যামেরাসিকারদের তথাকথিত একাত্মতা ওই অনশনরতদের অসুস্থ হয়ে পড়াকে ঠেকাতে পারেনি। পারেনি সরকারের কানে এই অনশনের আত্মত্যাগ কিংবা ওই তরুণদের জীবন-মৃত্যুর পরোয়া না করার দুঃসাহসী সিদ্ধান্তটি পৌঁছুতে। তারা যদি শাহবাগে ক্যামেরার সামনে কাঁদো কাঁদো মুখে ‘পোজ’ না দিয়ে তাদের সামাজিক বিশাল অবস্থান দিয়ে সরকারকে এটা বোঝাতেন যে এই তরুণদের এক জনেরও মৃত্যু হলে দেশের রাজনীতিতে এক ভয়াবহ উথাল-পাতাল শুরু হয়ে যেতে পারে। হতে পারে সেটা এতটাই ভয়াবহ এবং অবশ্যম্ভাবি যে তা সামাল দেয়ার ক্ষমতা সরকারের থাকবে না।

আমরা এখনো জানিনা রাজনীতির ‘বল’ কার কোটে? কে বা কারা সেই ‘বল’ নিয়ে ‘খেলছেন’। তবে এটা এখন দিবালোকের মত পষ্ট যে শাহবাগের আন্দোলন নিয়ে ‘কার্নিভাল মুডে খেলা’ শেষ হয়েছে। এবার সরাসরি শাহবাগের শহীদ রুমী স্কোয়াডের তরুণরা সরকারকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। হয় জামাত-শিবির নিষিদ্ধ করতে হবে, নতুবা একের পর এক তরুণের মৃতদেহ কাঁধে করে ‘পাপের বোঝা’ বাড়াতে হবে। এর মাঝামাঝি কোনো পথ আর খোলা নেই। এই পয়েন্ট অব নো রিটার্ন অবস্থা থেকেও যদি কেউ রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের দুরভীসন্ধিমূলক চেষ্টা চালাতে চান, তাহলে তাদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আর দূরদর্শিতা নিয়ে শুধু প্রশ্ন নয় রিতিমত মোটা দাগে বলে দেয়া যাবে যে তারা সারা দেশের মানুষের প্রাণের ভাষা আর সংকল্প পড়তে তো পারেনি-ই বরং সকল ক্ষমতার উৎস যে জনগণ সেই কথাটিকেই খেলো করে নিজেদের পায়ে নিজেরাই কুড়ুল মারছেন, সেই সঙ্গে দেশকে অস্থিরতার অতল গহ্বরে ঠেলে দিচ্ছেন। যে দেশটা তাদের একার নয়।।


৩১ মার্চ ২০১৩

লেখকঃ মনজুরুল হক।
প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থঃ আ লিটল ফাইটার স্লিপিং উইথ আর্মস, শকুমেন্টারি শকোথেরাপি, কর্পোরেট ডেমোক্রেসি, অসমাপ্ত বিপ্লব-অমর বিপ্লবী কমরেড চারু মজুমদার ইত্যাদি।