প্রায় আট বছর আগে একটা বিজ্ঞানের বই লিখেছিলাম ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ নামে। আমার প্রথম বই ছিল সেটি। মহাবিশ্বের উৎপত্তির সাম্প্রতিক ধ্যান ধারণাগুলো বই আকারে তুলে ধরার চেষ্টা ছিল এতে। বইটা প্রকাশের কিছুদিন পর এক ছেলে আমাকে ইমেইল করে। ইন্টারমিডিয়েটে পড়ে। নাজিউর রহমান তার নাম।  আমার বইটা পড়ে যত রাজ্যের প্রশ্ন তার মাথায় চিড়বিড় করছে। আপেক্ষিক তত্ত্ব কিভাবে কাজ করে, ভর কিভাবে তৈরি হয় থেকে শুরু করে, বিগ ব্যাং, ব্ল্যাক হোল, মহাবিশ্বের পেছনে ঈশ্বরের ভূমিকা আছে কি নেই – সব ধরনের কিম্ভুতকিমাকার প্রশ্ন করে আমাকে পাগল করে দিল। প্রতিদিন সকালে উঠেই ইমেইল খুলে নাজিউরের একটা না একটা ইমেইল পেতাম। তাতে থাকতো সারা রাত ধরে সে যা ভেবেছে তার সম্পূরক কিছু ভাবনা, আর অবধারিত ভাবে একটা কঠিন প্রশ্ন। আমি যখন পারতাম উত্তর দিতাম, যখন পারতাম না ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করতাম। কিন্তু ছেলেটা নাছোড়বান্দা। উত্তর আদায় করেই ছাড়ত। মনঃপুত না হলে আবারো ছুঁড়ে দিতে আরেকটা প্রশ্ন।

ভাবলাম এভাবে চলতে থাকলে তো পাগল হতে আর বেশি দেরী হবে না। কাজ টাজ সব বাদ দিয়ে নাজিউরকেই সন্তুষ্ট করতে হবে। প্রতিদিন অফিস ইয়েতে যেতে ভাবতাম – না জানি কি বিদঘুটে প্রশ্ন অপেক্ষা করছে নাজিউরের কাছ থেকে। আর কম্পিউটার খুললেই যথারীতি থাকতো প্রশ্নের বেমাক্কা ধাক্কা।

নাজিউরের প্রশ্নখচিত ইমেল পেলেই সুকুমার রায়ের ‘বিষম চিন্তা’ কবিতাটা মনে পড়ে যেত –

 

মাথায় কত প্রশ্ন আসে, দিচ্ছে না কেউ জবাব তার,

সবাই বলে `মিথ্যে বাজে বকিস নে আর খবরদার!’

অমনধারা ধমক দিলে কেমন করে শিখব সব?

বলবে সবাই, `মুখ্যু ছেলে’, বলবে আমায় `গো-গর্দভ’।

কেউ কি জানে দিনের বেলায় কোথায় পালায় ঘুমের ঘোর?

বর্ষা হলেই ব্যাঙের গলায় কোত্থেকে হয় এমন জোর?

গাধার কেন শিং থাকে না? হাতির কেন পালক নেই?

গরম তেলে ফোড়ন দিলে লাফায় কেন তা ধেই-ধেই?

সোডার বোতল খুল্লে কেন ফসফসিয়ে রাগ করে?

কেমন করে রাখবে টিকি মাথায় যাদের টাক পড়ে?

ভূত যদি না থাকবে তবে কোত্থেকে হয় ভূতের ভয়?

মাথায় যাদের গোল বেধেছে তাদের কেন `পাগোল’ কয়?

কতই ভাবি এ-সব কথা, জবাব দেবার মানুষ কই?

বয়স হলে কেতাব খুলে জানতে পাব সমস্তই।

 

একটা সময় পর বললাম বাপু হে, তোমার প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আর দিতে থাকলে আমার আর চাকরী থাকবে না। আমার বস তো আর তোমারে খুশি করার জন্য পয়সা দেয় না। তুমি এক কাজ কর, মুক্তমনা নামে আমাদের একটা ব্লগ সাইট আছে, ওখানে লেখা শুরু করে দাও। ওখানেই প্রশ্ন টশ্ন করতে পার, তোমার ভাবনা চিন্তাগুলো জানাতে থাক, দেখবা সদস্যদের অনেকেই তোমাকে উত্তর দিয়ে শান্ত করতে পারবে।

 

তো ছেলেটা মুক্তমনায় যোগ দিল। ব্লগ লেখা শুরু করল ‘তানভী’ নামে। বাচ্চা একটা ছেলে। ব্লগে তরুণ মনের প্রশ্নগুলো করত, কখনো জরাতো কারো কারো সাথে আলোচনা সমালোচনায়। এক সময় বিবর্তন নিয়েও খুব উৎসাহী হয়ে উঠল। আমিও মাঝে মধ্যে তাকে সাহায্য করতে থাকলাম, তার পোস্টে কমেন্ট টমেন্ট করে। কমেন্ট পেয়ে খুব খুশি। মাঝে দেখলাম আদিল মাহমুদের সাথেও চাচা ভাইস্তার সম্পর্ক পাতিয়ে ফেলেছে।

 

তারপর হঠাৎ শুনলাম ছেলেটার ইন্টারমিডিয়েটের রেজাল্ট বেরিয়েছে। রেজাল্ট খুবই ভাল। তার নাকি বুয়েটে পড়ার শখ। প্রিপারেশন নিচ্ছে। তারপর একদিন হঠাৎ এটাও জানলাম, বুয়েটে পরীক্ষা দিয়ে চান্সও নাকি পেয়ে গেছে। ওরেব্বাপ। চোখে সামনে ছোট্ট ছেলেটা রাতারাতি বড় হয়ে গেল। বুয়েটে পড়াশোনার মাঝেও কখনো সখনো পোস্ট দেয়, সেই পোস্টে বছর আগের সেই চপলতা নেই, বরং আছে দেশ নিয়ে রাজনীতি নিয়ে, যুক্তিবাদ নিয়ে গঠনমূলক চিন্তা। উইকিতেও সে ভুক্তি দেয়, আমাদেরও বলে উইকিতে লিখতে। বলে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভুক্তিগুলো সমৃদ্ধ করা দরকার। আমি হাসি মনে মনে, সেই ছোট্ট তানভী, যাকে আমি ব্লগে লিখতে বলেছিলাম, আজ সে আমাকে লেখায় উজ্জীবিত করছে। ভালই। পে ব্যাক টাইম।

 

আজ হঠাৎ করেই ফেসবুকে পেলাম সৌরভ দ্রিগের একটা ছোট্ট ম্যাসেজ – কাউকে কিছু না বলে তানভী অনশনে যোগ দিয়েছে। ম্যাসেজে সোরভ লিখেছে –

 

দাদা, আমাদের নাজিউর, মানে মুক্তমনার তানভী, আজকে অনশনমঞ্চে যোগ দিসে। সন্ধ্যা ছয়টা থেকে। আজকে দুপুরে ওদের ডিজাইন স্টুডিও কোর্সের জমা ছিলো। জমার কাজ শেষ করে আমাদের কাউকে কিছু না জানিয়ে সে অনশনে যোগ দেয়। রাতে আমাদের এক সিনিয়র ভাই তাকে অনশনস্থলে দেখে যখন জানতে চান, তখন সে জানায় যে সে যোগ দিসে। কাউকে বলতে মানা করতেসিলো, আমি ওরে বললাম, আমি অভিজিৎ’দারে জানাবো। ব্যাটা তাও লজ্জা পায়! দাদা, এই ছেলেগুলা এমন ক্যান!

 

অনেকক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে থাকলাম ম্যাসেজটা পেয়ে। টেকি সাফির অনশনের খবর পেয়ে অবাক হয়েছিলাম। আজ হলাম তানভীর এর খবরটা শুনে।  সৌরভের বলা ‘ দাদা, এই ছেলেগুলা এমন ক্যান!’ কথাটা  ঘুনপোকা হয়ে চড়ে বেড়াতে লাগলো মাথায়।   যে দেশে নিলয়, দীপ, সাফি, তানভীদের মত ছেলের জন্ম হয় সে দেশ পিছিয়ে থাকতে পারে না।  মনে পড়ে যায় গানের চরণগুলো – ‘সার্থক জনম মাগো, জন্মেছি এই দেশে; সার্থক জনম মাগো তোমায় ভালবেসে। ’

আহ – নিলয়, শুভ্র, আকাশ, জয়, আনন্দ, মানিক, দ্বীপ, সাফি, মিতু, হামজা, নদী, সুমি, তানভী- কী বিষন্ন থোকা থোকা নাম। জামাত-শিবিরের সাথে প্রতিদিনের সহবাসের চাইতে মৃত্যুকেই কাংক্ষিত বলে মনে করেছে ওরা। মৃত্যু দিয়ে হলেও বিয়াল্লিশ বছরের জঞ্জাল দূর করার সংকল্প করেছে শহীদ রুমী স্কোয়াডের এই সব সংশপ্তকেরা

যারা ভোর আনবে বলে প্রতিজ্ঞা করেছে, সেই সব মৃত্যুঞ্জয়ী তরুণ তরুনীদের আবারো জানাই আমার প্রাণের প্রণতি।

 

জয় বাংলা।