ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী (জন্ম:১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৭ ) বাংলাদেশের প্রখ্যাত ভাস্কর। যিনি কপালে লাল টকটকে টিপ দিয়ে লাল-বৃত্ত ধারণ করেন। যার জীবনের সাথে মিশে আছে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস, মিশে আছে বীরাঙ্গনাদের দুর্বিষহ জীবন কাহিনী। তার জীবনের সাথে মুক্তিযুদ্ধ খুব ঘনিষ্ঠভাবে মিশে আছে।

ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী বলেন-

যুদ্ধের শিকার হয়েছে যে নারী তার তো নিজের কোনো লজ্জা নেই। তিনিই প্রথম বীরাঙ্গনা যিনি পাকিস্তান হানাদার বাহিনী নির্মম নির্যাতন সম্পর্কে মুখ খোলেন। তিনি আশা করেছিলেন; তার দেখা-দেখি হয়তো অনেকেই মুখ খুলবেন কিন্তু তিনি তেমন কাউকে পাশে পান নি।

একাত্তরের ভয়াবহ ধর্ষণ সম্পর্কে একমাত্র জবানবন্দি-দানকারী সাহসিক ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী তার সাক্ষাৎকারে (একাত্তরের দুঃসহ স্মৃতি, সম্পাদনা শাহরিয়ার কবির) জানান, “রাতে ফিদাইর (উচ্চ পদস্থ পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা) চিঠি নিয়ে ক্যাপ্টেন সুলতান, লে. কোরবান আর বেঙ্গল ট্রেডার্সও অবাঙালি মালিক ইউসুফ এরা আমাকে যশোরে নিয়ে যেত। যাওয়ার পথে গাড়ির ভেতরে তারা আমাকে ধর্ষণ করেছে। নির্মম, নৃশংস নির্যাতনের পর এক পর্যায়ে আমার বোধশক্তি লোপ পায়। ২৮ ঘণ্টা চেতনাহীন ছিলাম”।

একাত্তরে পুরো ৯ মাস পাকিস্তানি সৈন্যরা অতর্কিত হামলা চালিয়ে ঘটনাস্থলে, কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বাঙালি নারীদের ধরে নিয়ে গিয়ে দিনের পর দিন আটকে রেখে ধর্ষণের যে ঘটনা ঘটিয়েছে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা গণ-ধর্ষণ। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে বাড়ির পুরুষ সদস্য, স্বামীদের হত্যা করার পর নারীদের উপর ধর্ষণ নির্যাতন চালাত পাকিস্তানী সৈন্যরা। ৯ থেকে শুরু করে ৭৫ বছরের বৃদ্ধা কেউই পাকিস্তানী সৈন্য বা তাদের দোসরদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। সুসান ব্রাউনি মিলার তার গ্রন্থের ৮৩ পাতায় উল্লেখ করেছেন, কোন কোন মেয়েকে পাকসেনারা এক রাতে ৮০ বারও ধর্ষণ করেছে। ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির “যুদ্ধ ও নারী” গ্রন্থ থেকে জানা যায়, এক একটি গণ-ধর্ষণে ৮/১০ থেকে শুরু করে ১০০ জন পাকসেনাও অংশ নিয়েছে।

বিদেশী একটা টিভি চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মুক্তিযোদ্ধা প্রিয়ভাষিণী বলেন-

আমি তো সহসাই ঝড়ের মুখে পড়েছিলাম। মানুষ যেমন ঝড়ের কবলে পড়ে রাস্তা থেকে দৌড়ে পালিয়ে যায় তবে একা একজন পড়ে যায়। আমিও ঠিক যে কোন ভাবে একা হয়ে গিয়েছিলাম এবং আমি সেখানে; আমার বয়স তখন তেইশ বছর। আমি এই যুদ্ধের কবলে যে কোন ভাবে একা হয়ে পড়েছিলাম। এই একা হয়ে যাওয়ার কারণেই আমি পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর দ্বারা নির্যাতিত এবং এসব সেনা বাহিনীকে যারা সহায়তা করেছিল তাদের দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।……আমাকে ধরে নিয়ে গেল এবং ছুটল গাড়ি। আমি যেহেতু জায়গা গুলো চিনি। তো নওয়া পাড়ার কাছে এসে তখন আমি গ্যাং রেপ হলাম। ওখানে একটা নওয়া পাড়া জায়গাতে থামি। এগুলো বলতে যত সোজা কিন্তু ভাবতে গেলে অনেক ব্যাপার হয়ে যায়।

বিপ্লবী ও মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী’র সাক্ষাৎকার-

প্রশ্ন- একাত্তরে দুই লক্ষ নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছে, আপনি কী এই সংখ্যার সাথে একমত ?

প্রিয়ভাষিণী- খুব একটা একমত নই কারণ অস্ট্রেলীয় চিকিৎসক ড. জিওফ্রে ডেভিস উনি যখন রেড ক্রস থেকে বাংলাদেশের হাসপাতালে এসেছিলেন একাত্তরের পরিবর্তী বীরাঙ্গনাদের সহায়তা দেবার জন্য। হাসপাতালে যত রোগীকে এম.আর. করানো হয়েছে সে সব ডাক্তারদের কাছ থেকে যে জরিপ উনি করেছিলেন উনি ফিরে গিয়ে বলেছিলেন যে; এর সংখ্যা চার লক্ষ ছাড়াতে পারে। আমরা সেটাও ভাবছি না। চার লক্ষ না হলেও তিন থেকে সাড়ে তিন লক্ষ হতেই পারে।

প্রশ্ন- ৭১’এ পাকিস্তান-বাহিনী ও রাজাকার-বাহিনীর মূল ভূমিকা কী ছিল?

প্রিয়ভাষিণী- তাদের মূল ভূমিকা ছিল; তারা পাকিস্তানকে সার্বভৌম হিসেবে পেতে চেয়েছিল, বাঙালিকে ও বাঙালি সত্তাকে তারা মানতে চায় নি। সমগ্র দেশকে তারা পাকিস্তান বানাতে চেয়েছিল এবং বাঙালি সত্তাকে তারা পুরাপুরি ধ্বংস করতে চেয়েছিল। বাঙালি সত্তাকে ধ্বংস করার জন্য তারা যে বর্বরোচিত ভূমিকা রেখেছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। আর যাদের স্মৃতিতে ঐ দিন গুলো আজো রয়ে গেছে তারাই কেবল উপলব্ধি করতে পারে তা কতোটা ভয়ংকর ছিল। বুকের রক্তক্ষরণ আজো আমাদের চলছে। আজো ঐ ক্ষতগুলি শুকায় নি আমাদের হৃদয় থেকে।

প্রশ্ন- আপনি তো ঐ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন; আপনি কাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন? কী কী অভিযোগ ছিল তাদের বিরুদ্ধে? রাজাকারদের কর্মকাণ্ড কী কখনো সরাসরি দেখেছিলেন?

প্রিয়ভাষিণী- আমি মূলত রাজাকারদের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়েছি। আদালতে তাদের নাম বলেছিলাম; যারা আমাদের বাড়িতে পাকিস্তানি সৈন্য নিয়ে গিয়েছিল। খুলনার সবুর খানের কিছু চামুণ্ডা ছিল। বাঘের হাটের রজব আলী বলে আমরা জানতাম। যিনি স্বাধীনতা পরবর্তীতে আত্মহত্যা করেছিলেন। এই রজব আলীর অত্যাচার সবচেয়ে ভয়ানক ছিল, চতুর আলী মোল্লা ছিল ওখানে। ওখানে মতি গুণ্ডা ছিল আরও অনেকে ছিল। অনেকের নাম মনে নেই। নিজামীর নাম আমি কানে শুনেছি। তারা যে রাজাকার বাহিনী গঠন করেছিল তারাই মানুষের বাড়িতে গিয়ে গিয়ে হামলা করত আর পাকিস্তানীদের বাড়ি দেখিয়ে দিত।

একবার এক নিম্ন গোছের এক রাজাকারের সাথে আমার দেখা হয়েছিল। আমি বাসে আসার সময় সাবদুল্লাহ নামের ঐ রাজাকারের সাথে দেখা হয়। সারা বাসে আমি একা একটা মেয়ে ছিলাম। রাজাকারটি আমার গা ঘেঁষে বসেছিল। আমি তখন হলিডে পত্রিকায় মুখ লুকিয়ে বসেছিলাম যেন কারো সাথে আমার কথা বলতে না হয়। আমি বললাম আপনি আমার গা ঘেঁষে বসছেন কেন? তিনি আমাকে বলেন; আপনাকে আমার সন্দেহ হল; আপনাকে তো নকশালের মতন লাগছে। আমি তখন বললাম আপনি আমার সাথে কথা বলবেন না, আমি আপনাকে চিনি না। তখন রাজাকারটি বলল- আপনি আমার সাথে কথা বলবেন না তবে কীভাবে কথা বলাতে হয় তা আমার জানা আছে। ঐ যে শহিদ মিনারে তিনটা মুণ্ডু ঝুলিয়েছি দেখেন। তখন নোয়া পাড়া ইস্টিশন আসছে। প্রথম আমি বুঝি নি লোকটি কী বলছে। পরে শহিদ মিনারের দিকে তাকিয়ে দেখি; তিনটা মুণ্ডু ঝুলিয়েছে- একটা মেয়ের একটা ছেলের আর আরেকটা আমি দেখতে পারি নি। আসলে দেখার চেষ্টা করি নি কারণ এতো আমি শিহরিত হয়েছিলাম তখন। তখন ঐ রাজাকারটি বলে; আপনাকে ওখানে দিলে বেশ মানাবে।

পরে রাজাকারটি বাস থামায় এবং ড্রাইভারকে তখন খুব বাজে বাজে কথা বলছিল, ড্রাইভারকে বলছিল ঐ ছেমরি যতক্ষণ না নামবে ততক্ষণ আমি যাব না বলে আমাকে বন্দুক দিয়ে ধাক্কা দিতে দিতে বাসের দরজা পর্যন্ত নিয়ে আসে। আমার হাত ফোঁসকে যাচ্ছিল। তখন আমি বললাম- আমি নামব না, যদি দরকার হয় আমাকে গুলি করুন। আমি গুলি খেলে সবার সামনে গুলি খাব তবুও বাস থেকে নামব না। পরে বাসের ২২ জন যাত্রী তার হাতে পায়ে ধরে মাপ করে দেন বলল। আমাকে সবাই বলতে লাগল; আপা মাপ চান তার কাছে তিনি সাংঘাতিক রাজাকার কিন্তু। আমি বললাম- তিনি যতোই সাংঘাতিক হোক না কেন আমি মাপ চাইব না, আমি কী করেছি যে মাপ চাইব? এরি মধ্যে ইস্টিশনে অনেক লোক জমে যাওয়াতে সেই রাজাকারটি পরে চলে যায়। আমি মুখোমুখি শুধু এই একজন রাজাকারের মুখোমুখিই হয়েছিলাম।

১৬ ডিসেম্বরে সমস্ত মুক্তিবাহিনী মিলে সেলিম হোটেলের সামনে এক রাজাকারকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল। নাম মনে হয় আবদুল্লাহ ছিল। সেলিম হোটেলে সে পালাতে গিয়েছিল। যুগান্তরের ফটো-সাংবাদিক ছবি তুলছিল সে সময় সেও সেখানে উপস্থিত ছিল। সে রাজাকারটি ভুলে গিয়েছিল যে; তার বিরুদ্ধে হুলিয়া চলছিল। শতশত মুক্তিবাহিনী তাকে ছিঁড়ে ফেলেছিল। কারণ তার অপরাধ ছিল সাংঘাতিক তাই ওর উপর মুক্তিবাহিনীর ক্ষোভ ছিল অনেক বেশি। ফলে মুক্তিবাহিনী ও জনতা তাকে ছিঁড়ে ফেলে।

প্রশ্ন- আপনার বাসায় পাকিস্তানী সৈন্যরা কত তারিখে এসেছিল? কতদিন বন্দি ছিলেন?

প্রিয়ভাষিণী- পাকিস্তানী সৈন্যরা কতো তারিখে আমার বাসায় এসেছিল তা আমার মনে নেই কারণ আমি যখন ডায়রি লিখতে শুরু করেছিলাম কিন্তু সেটা আমাকে ফেরত দেওয়া হয় নি ফলে আমি মনে করতে পারছি না। তবে সম্ভবত এটা অক্টোবরের প্রথম দিকে হয়েছিল। ২৮ ঘণ্টা বন্দি ছিলাম ক্যাম্পে।

আমার বাসায় একটা মেয়ে আমাকে দেখাশুনা করার জন্য থাকত। রাত তিনটার সময় সে বলছে; আপা আপনার বাড়ি একদম ঘেরাও। ছয় সাতটা গাড়ীর সাথে পাঞ্জাবি ও পাকিস্তানিরা এসে আমার বাসা ঘিরে ফেলেছে। আমার ভীষণ ঘুম আসছিল তাই আমি ওকে বলছিলাম; ঘুমা তো, ওরকম অনেক গাড়ি-ই আসে। ও তখন বলল; আরে ওরা চিৎকার করছে, হল্লা করছে, কাকে যেন নামতে বলতেছে। এটা বলার পর আমি চিন্তা করলাম দেখা দরকার। তাই আমি মাথায় কাপড় দিয়ে উঁকি মেরে দেখি; ছয়টা গাড়ি থেকে প্রায় চার পাঁচ জন করে নেমেছে। আর আমার দিকে তাকিয়ে বলছে আমরা ফেরদৌসিকে চাই। ফেরদৌসি উপর থেকে নামো। আমি তখন উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে আমি তাদের ঠেকাতে চাইলাম এছাড়া আমার অন্য কোন পথ নেই। তাই আমি তখন বললাম; ফেরদৌসি তো নেই, সে তো খুলনায় গিয়েছে। আমি তার আয়া। তখন ওখান থেকে একজন বলে উঠল; তুমিই তো ফেরদৌসি, আমি তোমাকে চিনি। তুমি উপর থেকে নামো তখন আমি বললাম কেন নামবো? তখন তারা আমাকে বলল তোমার নামে ওয়ারেন্ট আছে। একটা হত্যা মামলার ওয়ারেন্ট আছে। আমি তাদের ওয়েরেন্ট দেখাতে বললাম না কারণ দেখাতে গেলেও তারা উপরে চলে আসবে। তাই তখন আমি বললাম এতো রাতে কেউ কাউকে এরেস্ট করে না, তোমরা সকালে এসে আমাকে নিয়ে যাও। তখন তারা আমাকে বলে তোমাকে নামতেই হবে আর যদি না নামো তাহলে আমরা তোমাকে নামিয়ে নেব।

কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা উপরে চলে আসল। আর যে ফ্ল্যাটে আমি থাকতাম সেই ফ্ল্যাটের দরজা জানালাও ভাল ছিল না কারণ এর আগেও এই ফ্ল্যাট লুট হয়েছিল। পরে আমি তাদের বললাম; আমার সাথে একটা মেয়ে আছে তাকে আমি তার বাড়িতে নামিয়ে দিতে চাই। তখন ভোরের আলো ফুটে উঠছে তাই তারা তখন অর্ধেক সিঁড়িতে উঠে আবার চলে যায়।

পরে আমি আমার কাজের মেয়ে আলেয়াকে দিয়ে আসলাম। কারণ ও আমার সাথে নিরাপদ না। যাই হোক কোন ভাবে আলেয়াকে তার বাড়িতে দিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হল। পরের দিন পাকিস্তানীরা আবার এসেছে। তারা এসে বলল তুমি নিচে নামো। তখন দেখি সৈন্যদের বেশির ভাগই ড্রাংক। অনেকে দাঁড়াতেই পারছে না। অনেকেই দরজা ধাক্কাধাক্কি শুরু করে দিল। আমি দরজা খুলে দিই। আমাকে তাদের সাথে যেতে বলল। আমি তাদেরকে বললাম আমি আমার ড্রেসটা চেঞ্জ করে আসি তারপর যাচ্ছি তোমাদের সাথে। তারা আমার কথা না শুনে বলল আমরা তোমার ড্রেস চেঞ্জ করে দেব।
পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে এসেছিল বেঙ্গল ট্রের্ডাসের ইউসুফ, ওখানকার একজন ব্যবসায়ী আগাখানি সম্প্রদায়ের, ল্যাফটেনেন্ট কোরবান, ক্যাপ্টেন ইউসুফ, ক্যাপ্টেন ইসতেহার, ইসতেহার নামের দুইজন লোক ছিল। তিনি মাঝে মধ্যে আমার অফিসে আসতেন। ঐ ইসতেহার মুক্তিবাহিনীর হাতে নিহত হয়।

তারা আমাকে বলছে; ইসতেহার হত্যার পেছনে তোমার হাত আছে। আমি বললাম; আমি কীভাবে জানব সে কীভাবে মরছে? সে তো রণাঙ্গনে যুদ্ধ করছে। তখন তারা আমাকে বলছে- তুমি জানলে কী করে সে রণক্ষেত্রে যুদ্ধ করছে? তখন বললাম- আমার জানার কথা না। সেই আমাকে বলছে; কালকে বা পরশু চলে যাব অপারেশনে তুমি আমার সাথে সিনেমায় চল। তখন এই অফারটাই সবাই দিত যে; সিনেমা দেখ, মুভি দেখ।

এরপরে তারা আমাকে এক ঘণ্টা ধরে গালাগালি করে, শারীরিক নির্যাতন করে গাড়িতে করে নিয়ে চলল। আসলে এগুলো বলতে ইচ্ছে করে না।
আমি যখন নোয়া পাড়ার ওদিকে যাই তখন হোটেল আল-হেলাল ছিল। একটা কফি দোকার ছিল। আমাকে ওখানে নিয়ে গিয়ে বলল- কফি খাবে? তখন আমার ভেতরটা কলঙ্কিত তখন আমি নিজের সাথে নিজেই দেখা করতে ভয় পেতাম। অন্ধকারের সাথে দেখা করতেও ভয় পেতাম, আলোর সাথেও দেখা করতে ভয় পেতাম। সবসময় আমার মধ্যে সংকোচ কাজ করত। পেছনে দাঁড়ানো ছাড়া আর সামনে দাঁড়াতাম না। এমনই মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েছিলাম।

এরপর তারা হুইস্কি কুলি করে আমার মুখে ছিটিয়ে দিচ্ছিল। আর বলছিল- “she should co-operate us otherwise puts on dick on her private parts” এই উক্তিটা আমার এখনো মনে আছে। এই কথাটা বলার সাথে সাথে আমি অনেক ভয় পেয়েছিলাম। তখন আমি বললাম- প্লিজ তোমারা আমাকে একটা উপকার কর আমি তোমাদের কে সকল সহযোগিতা দেব শুধু তোমরা আমাকে হত্যা কর। আমি উর্দুতে একবার ইংরেজিতে একবার বলছিলাম প্লিজ আমাকে হত্যা কর। তোমাদের সকল সহযোগিতা করব। আমাকে রেপ কর আমার আপত্তি নেই তবে আমাকে হত্যা কর। তবু আমাকে ক্যাম্পে নিয়ে যেও না। তারপরেও ক্যান্টনমেন্টে তারা আমাকে নিয়ে গেল।

ওখানে নিয়ে যাওয়ার পর একজন মেজর আসল। তিনি এসে বললেন- কেসে হে আপ? তারপর আমাকে বলল; শোনা যায় তুমি অফিসার ভূঁইয়াকে হত্যা করেছ। এই অফিসার ভূঁইয়া ছিল আমার বাবার কলেজের কলিগ ছিলেন। তিনি হত্যা হয়েছেন আমারি সামনে। দৌলতপুর মোড়ে আপিল উদ্দিন সাহেবের একটা বাড়ি ছিল। শিল্পপতি ছিলেন। পিস কমিটি করলেও তিনি ভাল মানুষ ছিলেন। এরকম অনেকেই আছেন; যারা পিস কমিটি করলেও ভাল লোক ছিলেন। আপিল উদ্দিন সাহেব তাদের মধ্যে একজন। তিনি পাকিস্তান সাপোর্টার কিন্তু বাঙালি হত্যার পক্ষে না। আমি ওনার বাড়ির সামনে থেকে গাড়িতে উঠতাম। একদিন তিনি আমাকে ডেকে বললেন আপনি দাঁড়িয়ে কেন আপনি আমার বাসায় আসুন। তিনি একা থাকতেন। তার বাড়িতে কেউ থাকত না কাজের লোক ছাড়া। তিনি ততটা থাকতেন না ঐ বাড়িতে তাই তিনি দারোয়ানকে বলেছিলেন; তিনি আসলেই গেট খুলে দেবে আর ওয়াশ রুমটা দেখিয়ে দেবে। বহু পথ পাড়ি দিয়ে আমাকে আসতে হতো গাড়িতে ওঠার জন্য। বৃষ্টির সময় গায়ে কাঁদাও লেগে যেত। বিশেষ কারণে গেটে একদিন টেলিফোন করতে যাব; হঠাৎ দেখি আলো জ্বলে উঠল। একজন মোটর সাইকেল করে আসছিল আর কালো পোশাক পরিহিত কয়েকজন ছেলে, মনে হয় নকশাল। তারা ভূঁইয়া চাচাকে মেরে দিল। তখন হঠাৎ বুঝতে পারি নি কাকে মেরেছে। পরে দেখি ভূঁইয়া চাচাকে মেরে ফেলেছে। অনেক মানুষ জড় হয়, ওখানে ডাক্তার হেনা ছিলেন কিন্তু তিনিও কোন সহযোগিতা করেন নি।

তিনি মেহশ্বর পাশায় বক্তৃতা রেখেছিলেন যে; এই এলাকার নাম কামাল পাশা হবে। হিন্দুদের এলাকা ছিল তাই নাম পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। তার এরকম সিদ্ধান্ত নকশালরা পছন্দ করে নি। ধর্ম নিরপেক্ষতার বাহিরে বিষয়টি নিয়ে আসাতে তাকে মারা হয়েছিল। তিনি কোলাবরেট ছিলেন বিধায় পাকিস্তানীরা দুঃখ পায় তাই তারা আমাকে ধরে আনে এবং ধারনা করে ঐ এলাকার যতো হত্যা হত্যা হচ্ছে সব আমি পরিকল্পনা ও সহযোগিতা করে করেছিলাম। এই হত্যা মামলার নাম করে তারা আমাকে নয় মাস তাড়া করে বেরিয়েছিল। আমার চাকরীস্থলেও তারা আমাকে নজরদারিতে রেখেছিল।

ঐ ক্যাম্পটা ছিল অস্থায়ী ক্যাম্প। কথাগুলো আমি স্মৃতি কথাতে লিখেছি যদি বের হয় তাহলে ছেলে মেয়েরা পেয়ে যাবে।

প্রশ্ন- অস্থায়ী ক্যাম্পের কথা বললেন; ওখানে আপনি যাওয়ার পর কী দেখেছিলেন?

প্রিয়ভাষিণী- ওখানে বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা বড় রুমের মতন । একটা তালাও লাগানো ছিল সেখানে। সেই রুমে আমাকে ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে তালা মেরে দিল। আমি ভয়ে চিৎকার করতে শুরু করি যে; আমাকে বের করে দাও। তারপর কিছুটা পথ আমি হেঁটে গিয়েছ দেখি; ওখানে গ্রাম থেকে ধরে আনা অনেক মেয়ে বন্দি অবস্থায় আছে এবং ঐ সব মেয়েদেরকে অর্ধ পোশাকে, কেউ বা বিবস্ত্র কেউবা ক্ষত-বিক্ষত। অনেককে দেখলাম হাসছে। কী যেন তাদের খাইয়ে দিয়েছে যার ফলে তারা শুধু হাসছিল। সেটা যে সত্যিকারের হাসি না তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কী বলল ঐ পরিবেশটা রীতি মতন আতঙ্কজনক। অনেকে রোগে শোকে কাতরাচ্ছে। কোন কোন জায়গায় পাকিস্তানি জোয়ানরা তাদের সাথে কথাবার্তা বলছে। আর মেয়ে গুলো কেমন করে যেন তাদের সাথে তাল মিলিয়ে নিয়ে তা সহ্য করার চেষ্টা করছে। ওখানে অনেক পাশবিকতার ছাপ ছিল যা দেখা মাত্রই বোঝা যায়। আলাদা কয়েকটা রুম ছিল ওখানে যেখানে পাশবিক অত্যাচার করা হতো। অন্ধকার থাকায় খুব ভাল মতন আমি দেখতে পারি নি। তবে বোঝা যাচ্ছিল ওখানেই মেয়ে গুলোর উপর পাশবিক অত্যাচার হতো। আমি যে প্রাণে বেঁচে যাব সে দিন বুঝি নি। তাহলে অনেক ভাল করেই হয়তো দেখার চেষ্টা করতাম।

প্রশ্ন- ক্যাম্প থেকে কী ভাবে মুক্তি পান?

প্রিয়ভাষিণী- একজন অফিসার আসল ক্যাম্পে কাদের ধরে আনা হল তা দেখার জন্য। তার নাম হল- মেজর করিম। তিনি এসে বললেন- আমি কিছু করব না আমি শুধু রির্পোটিংটা নেব। তিনি আমাকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে যেতে এসেছিলেন। তবে তিনি আমাকে বললেন তুমি ভয় পেও না, আমি তোমাকে ওখান থেকে ফেরত আনব। এখন তুমি আমাকে বল- তুমি হত্যার ষড়যন্ত্রে ছিলে কিনা? তখন আমি বললাম- আমি যদি হত্যার ষড়যন্ত্রে থাকতাম তাহলে আমি এই বয়সে সামান্য চাকরি নিয়ে দৌড়চ্ছি কেন? আমাকে তো প্রতিদিনই ফলো করা হচ্ছে। আমার স্বাভাবিক জীবন ব্যহত হচ্ছে। সব পাকিস্তানীদের মধ্যে তাকে সামান্য অনুকূল মনে হয়েছিল আমার। পরে তিনি আমাকে বলল- তুমি যাও আমি আসছি। কিন্তু তিনি যে আমাকে পাঠিয়ে দিয়ে আসবেন তা ভাবতে পারি নি। কারণ ওখানে কোন আর্মিকে দয়ালু পাই নি। তিনি তার কথা রেখেছিলেন। পরে তিনি আসার পর আমি তার পা জড়িয়ে ধরলাম। কান্না কাটি করে বলছি; তুমি আমাকে এখান থেকে বের কর। তিনি কেমন যেন নরম হয়ে গেলেন। তিনি আমাকে বলছেন; আচ্ছা মা আপনি আমার পা ধরছেন কেন? প্লিজ আপনি একটু বসেন। আমি দেখছি কী করা যায়। তিনি চলে যাওয়ার সময় আমি চিৎকার করে বলছিলাম- মেজর আমাকে নিয়ে যাও। পরে তিনি আমার জন্য একটা জিপ পাঠিয়ে দিয়েছেন এবং তাদের বলেছেন- তোমরা আসামীকে পাঠিয়ে দাও। ওনার কাছে আমার আরও অনেক কিছু জিজ্ঞেস করার আছে। তখন ওরা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে ওখানে আমাকে পাঠাল। প্রায় নয় ঘণ্টা আমি ওখানে ছিলাম। এবং ঐ মেজর-ই বলে গেছেন যে; ওনার উপর যেন কোন বাজে ব্যবহার না করা হয়। তিনি আমাদের জিজ্ঞাসাবাদে মধ্যে আছেন। পরে যখন পাঠাব তখন তোমরা যা খুশি তা কর। মেজর সাহেবের পা আবারো জড়িয়ে ধরলাম। আমার মা ছোট বেলা থেকে বলে আসছেন- জীবনে কারো পা ধরবে না। কিন্তু তখন কেমন যেন আমার অভ্যাস হয়ে গেল আমি শুধু পা-ই জড়িয়ে ধরছি। আমার যে অসম্মান হচ্ছে এই বোধটাও চলে গেছে। যাকে পেয়েছি তারই পা ধরেছি এমনকি সেন্ট্রিরও পা ধরেছিলাম। এরকম আমার অবস্থা হয়েছে আমার। আমার একটাই ভাষা ছিল- আমাকে এখান থেকে বের কর। আমার মেজর কে বলেছি- আমার সমাজে তো আমাকে নেবে না। অলরেডি রাত কেটে গেছে। তবুও সে নিশ্চয়তা দেয় নি বলেছে সে দেখবে বিষয়টা। তখন তিনি আমাকে বললেন তুমি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে যাও কেউ তোমাকে কিছু বলবে না। তখন আমি বললাম- তুমি অন্তত ওখানে আমাকে যেতে বল না। পরে দেখলাম যে তিনি রাতেও ডিউটিতে আছেন। হয়তো তিনি কিছু একটা করেছিলেন কারণ আমার ঘরে কাউকে আসতে দেন নি। যদিও প্রথম পর্যায়ে আমি রেপ হয়েছি।

প্রথম পর্যায়ে আমি দুই থেকে তিনজন অফিসার দ্বারা রেপ হয়েছি এবং আমি কিছু বলতে পারি নি। আমি যেন নির্বোধ একটা জীব জন্তুতে পরিণত হয়েছিলাম। এখানে আমার কোন শক্তিও ছিল না আমার কোন সাহসও ছিল না।

তিনি আমাকে বললেন- আমাদের কাছে তথ্য প্রমাণ আছে যে; সে যশোর টেলিফোনের বিরাট টাওয়ারটি উড়িয়ে দিয়েছে তাতে তোমার ভাই যুক্ত আছে, সেও মুক্তিবাহিনীতে আছে; এটা সত্য কিনা?

এটা খুবই সত্য। আমার ভাই সেই অপারেশনে লিড দিয়েছিল। কিন্তু এই সত্য কথা বলে দিলে কী আমি মাইর খাব নাকি আমাকে মেরে ফেলবে তা ভেবে পাচ্ছি না। তাই আমি বললাম- তোমরা আমাকে মেরে ফেল কারণ তোমরা আমাকে এমনিতেই ছাড়বে না।

তারা বলে; তুমি কথা ঘুরচ্ছ। তোমার ভাই সেখানে ছিল কিনা তা তুমি বল। যদি থাকে তাহলে আমি তাকে বাঁচাবো। তাকে বল- আপনার বাঁচাকে কাম কারনা। আমি তখন বুঝলাম তিনি আমাদের সাপোর্ট দিচ্ছেন। তিনি আমাকে বলছেন- ভুট্টো বা আইযুব যা করছে তা ঠিক করছে না। তারা যে নির্যাতন করছে তা উচিত নয়। আমি একজন শিক্ষকের ছেলে আমি আর্মিতে আসতে চাই নি। আমি এখন বুঝতে পারছি আমার আসাটা ভুল হয়েছে। আমি ফিরে গিয়ে আমার আগের পেশাতে ফিরে যাব। পরে আমি ঐ মেজরের সহযোগিতায় মুক্তি লাভ করি।

প্রশ্ন- মুক্তি পাওয়ার পর আপনার পরিবার কী আপনাকে স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ করেছিল?

প্রিয়ভাষিণী- পরিবার বলতে; আমার মাও একজন প্রগতিশীল মহিলা ছিলেন। বলা চলে তিনি নিজেও একজন মুক্তিযোদ্ধা। কারণ তিনি ছোট্ট আকারে একটা হোম খুলে ছিলেন । মুক্তিযোদ্ধাদের খাবারের দাওয়াত দেওয়ার জন্য। আমার মা আর তার বান্ধবী মিলে যশোরের রেল রোডে একটা বাড়িতে চিলে কোঠায় মুক্তিযোদ্ধাদের নাস্তা দিতেন। তিনি তার ছেলেকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন। আমার ভাই শিবলি কোন দিন বিয়ে করে নি সেও পূর্ণদমে মুক্তিযুদ্ধ যোগ দিল টেলিফোনে চাকরি করা কালিন। তখন একটা সুবিধা ছিল অনেক কমুনিকেশন তার ছিল। ফলে সে অনেক খবর আনতে পারব। ডিনামাইড আনা ও এগুলোতে লিড দেওয়ার মধ্যে আমার ভাই শিবলী একজন ছিল। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের লিস্টেও তার নাম আছে। যুদ্ধের বিষয়ে তারা ঠিক ছিল কিন্তু আমার বিষয়ে তারা একটু নড়ে গিয়েছিল যে; আমাকে বাসায় গ্রহণ করা যাবে না। খুব অবাধে বাড়িতে যেতে পারি নি আসলে। আমার নিজের মধ্যেও সংকোচ ছিল যে; আসলে আমি বিশাল কলঙ্কের বোঝা নিয়ে কারো সামনে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারতাম না যদিও আমার মা কোন কালেই এসব নিয়ে প্রশ্ন করেন নি।

প্রশ্ন- মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীরা যুদ্ধ পরবর্তী অর্থাৎ স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার থেকে কোন সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছিল? নির্যাতিত নারীদের পরিণতি কী হয়েছিল?

প্রিয়ভাষিণী- মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীতে সমাজ অনেক ভাবে তাদের নিগৃহীত হতে হয়েছিল। বলা চলে তাদেরকে নতুন করে যুদ্ধ শুরু করতে হয়েছিল। সমাজ পরিবার তাদের গ্রহণ করে নি। আমাদের বীরাঙ্গনাদের মধ্যেও আছেন তাদের পরিবার তাদের গ্রহণ করেন নি। অনেকে গ্রহণ না করার জন্য হিন্দু থেকে মুসলিম হয়ে বিয়ে করেছিলেন। তবে অনেক মুক্তিযোদ্ধাও বীরাঙ্গনাদের বিয়ে করেন।

আর সরকার থেকে কে কী পেয়েছে তা ভাল মতন বলতে পারি না তবে এতোটুকু জানি তারা বীরাঙ্গনাদের হোম খুলেছিলেন। দেশের যুদ্ধ শিশুদের বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষ এ সংস্থা এসে নিয়ে গিয়েছিল। ব্যক্তিগত জীবনে তাদের যে খুব একটা সহায়তা ও মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল তা কিন্তু নয়। বরং তাদের মর্যাদাটুকুও ঠিক মতন দেওয়া হয় নি।

প্রশ্ন- এ দেশ কী বীরাঙ্গনাদের সঠিক সম্মান দিতে পেরেছে বলে আপনি মনে করেন?

প্রিয়ভাষিণী- আমি যদি নিজে বীরাঙ্গনা হই, বীরাঙ্গনা হিসেবে নিজে সম্মান না পেলেও আদর্শে এবং আমি যেহেতু ভাস্কর্য শিল্পী সেই জায়গায় আমি আজো সম্মান পেয়ে যাচ্ছি। সরকারও সেই শিল্প পেশায় নিয়োজিত বলেই আমাকে স্বাধীনতার পদক দিয়েছেন। এর জন্য আমি কৃতজ্ঞ। তবে স্বাধীনতা সময়ের বীরাঙ্গনা বা যুদ্ধের বিষয়ে আমাকে পদক দান করেন নি। তবে তারা আমাকে আমার শিল্পকর্মের জন্য পদক দিয়েছেন।

প্রশ্ন- একাত্তরের নির্যাতিত নারীদের কথা জানলেও একাত্তরের যুদ্ধ-শিশুদের কথা তেমনিভাবে আমাদের জানানো হয় না বা জানি না। সরকারও হয়তো জানানোর বোধ করে না। যুদ্ধ শিশুদের কী পরিণতি হয়েছিল? রাষ্ট্র কী তাদের গ্রহণ করতে চায় নি?

প্রিয়ভাষিণী- আসলে সেই সময় যুদ্ধ-শিশুদের গ্রহণ করার জন্য অনুকূল পরিবেশ ছিল না। সময়টাও ছিল ভিন্ন। যুদ্ধে এই দেশ ধ্বংস হয়ে যায় তখন যুদ্ধ-শিশুদের গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত অনেক কঠিন ছিল রাষ্ট্রের জন্য। যুদ্ধ শিশুদের বিদেশে পাঠানো হয়েছিল এবং তাদেরকে অনেকেই এসে নিয়ে গিয়েছিল। তারা আজ দেশে থাকলে কী করত? হয়তো কারো বাসায় কাজ করত, না হয় পিয়নের চাকরি জুটত। কিন্তু বাহিরে তো তারা তাদের নিজের যোগ্যতায় মানুষের মর্যাদা পাচ্ছে। বাঙালি হিসেবে মর্যাদা না পেলেও মানুষ হিসেবে তারা একটা মর্যাদা পাচ্ছে, শিক্ষা পাচ্ছে, বড় হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।

এই যুদ্ধ শিশুদের আমি একবার দেখেছি। তারা যুদ্ধের পরে তারা তাদের মা’দের হোম খুঁজে বেড়াচ্ছে। ডেনর্মাক একটা হল্যান্ডের দুইটি বাস এসে দাঁড়িয়েছিল। আমি তাদের জিজ্ঞেস করি তোমরা কাকে খুঁজছ? তারা যে যুদ্ধ শিশু তা তাদের গাইডরা জানায় নি। তারা বলল আমাদের কিছু ছাত্র-ছাত্রী মায়ের হোম খুঁজতে এসেছে। তাদেরকে হোম থেকে নেওয়া হয়েছিল।তারা ছিল পঁচিশ জন। তাদের চেহারা দেখে বুঝেছিলাম তারা প্রত্যেকে যুদ্ধ শিশু। তাঁদের দেখে আমি আমি আমার কান্না থামাতে পারি নি। আমি তাদের সাথে পরিচিত হই। আমার বাসায় তাদের নিয়ে আসি। আমি বলেছি আমিও একজন যোদ্ধা, আমার ভিকটিম পরিচয় দিই নি। আমি তাদের একজন অভিভাবককে বললাম আমিও একজন বীরাঙ্গনা আমার গর্ভেও যুদ্ধ শিশু এসেছিল তবে আমি রাখি নি। তবে আমি এদের চিনতে পেরেছি, এরাই যুদ্ধ শিশু।

প্রশ্ন- একাত্তরের যুদ্ধ-শিশুদের সংখ্যা কতো ছিল? সে সম্পর্কে কী কিছু জানেন?

প্রিয়ভাষিণী- মোস্তফা চৌধুরী তিনি বর্তমানে কানাডায় থাকেন। তিনি যুদ্ধ শিশুদের নিয়ে গত ত্রিশ বছর ধরে কাজ করছেন। তিনি হয়তো সংখ্যাটা জানতে পারেন।

প্রশ্ন- এতোটা কষ্ট অভিমান নিয়ে আপনি সামনে দিকে এগিয়ে গেছেন আপনার অনুপ্রেরণা ও শক্তি কোন জায়গায়?

প্রিয়ভাষিণী- অপরিণত বয়সে যে বিষয়টি আমি সবার কাছ থেকে লুকাতে চেয়েছিলাম; ভাবতাম আমার ছোঁয়া লাগলে সব কিছু অপবিত্র হয়ে যাবে। এই সমাজ আমাকে আঙুল তুলে কথা বলছে আর আমি সেই অপমান গুলো সহ্য করছি। আমার মনে হয় আমার সেই দিনের অপমান-ই আমাকে অনুপ্রেরণা করছে।

প্রশ্ন- কাদের মোল্লার রায়ে আপনার অভিমত কী? রাষ্ট্র পক্ষের দুর্বলতা ছিল বলে আপনি মনে করেন?

প্রিয়ভাষিণী– কাদের মোল্লা রায় নিয়ে কী বললে সঠিক হবে তা বুঝতে পারছি না তবে ট্রাইব্যুনাল প্রভাবিত হয়েছে কিনা তা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতে হচ্ছে। ৩০০ হত্যার জন্য তার ফাঁসি ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। এতো সাক্ষী প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তার কী ফাঁসি হওয়া উচিত ছিল না। মুক্তিযুদ্ধই তো সব চেয়ে বড় সাক্ষী। শত মানুষ হত্যার করেছে, কবি মেহেরুন কে হত্যা করেছে এই কাদের মোল্লা। এমনকি মা বোনের উপর অত্যাচারের প্রমাণ মেলে। এতো কিছু হওয়ার পরও তার কী ফাঁসি হতে পারত না। আমরা প্রতিটি যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাই। এবং ফাঁসি ছাড়া দ্বিতীয় কোন রাস্তা খোলা নেই।

প্রশ্ন- শাহবাগে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবীতে তরুণ প্রজন্মের যে আন্দোলন তা আপনি কীভাবে দেখছেন?

প্রিয়ভাষিণী- তরুণদের এই আন্দোলন আমার কাছে বৃহত্তর পাওয়া। এর থেকে বড় কিছু কী আর আশা করতে পারি। সব জায়গা থেকেই একটা কথা শোনা যেন; তরুণ সমাজ নষ্ট হয়ে গেছে, তারা শুধু ফেসবুকে বসে থাকে। আমি তাদের প্রতি খুবই শ্রদ্ধাশীল ও কৃতজ্ঞ। তারা আমাদের সম্মান ফেরত দিতে এসেছেন। বর্তমান তরুণ প্রজন্ম যুক্তি-যুদ্ধের আদর্শকে বুকে ধারণ করেই আন্দোলনে নেমেছে। তারাও যোদ্ধা আমার চোখে।

প্রশ্ন- বর্তমানে যারা কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী তাদের বিচারের আওতায় আনা হয়েছে খুবই ভাল উদ্যোগ। কিন্তু এর বাহিরে যারা আছে তাদেরও বিচার প্রক্রিয়ায় আনা উচিত বলে মনে করেন?

প্রিয়ভাষিণী- নিশ্চয়ই। যুদ্ধে যারা অপরাধ করেছে। কেউ কেউ সমর্থন দিতে পারে হয়তো মতভেদ আছে কিন্তু হত্যা, লুট, ধর্ষণের সাথে যুক্ত নয় তাদেরকে ফাঁসি দেতে বলছি না তবে যারা সক্রিয় ভাবে হত্যা, ধর্ষণের সাথে যুক্ত তাদের কঠিন শাস্তির দাবী করি। এমনকি একটি হত্যাও যদি কেউ করে থাকে তাকে আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দেওয়া হোক।

প্রশ্ন- স্বাধীন বাংলাদেশে জামাত-শিবিরের রাজনীতি করার কী কোন অধিকার আছে বলে মনে করেন? আপনি কী মনে করেন এখনই তাদের নিষিদ্ধ করা উচিত?

প্রিয়ভাষিণী– প্রথম কথা হল জামাত-শিবির আমাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হতে পারে না। কারণ তারা তো দেশদ্রোহী। এ দেশে তো দেশদ্রোহী রাজনীতি করার কথা ছিল না। এমনকি তাদের কোন নাগরিক অধিকার পর্যন্ত থাকা উচিত নয়। আমি তাদের কে রাস্তা ঘাটের কীটপতঙ্গ মনে করি। কিন্তু আমাদের দেশের কিছু বুদ্ধিজীবীদের কল্যাণে তারা আজ এই পর্যন্ত এসেছে। আমি মনে করি তাদের জন্য কোন মেধা খরচ করার কোন দরকার নেই। দেশে জামাত-শিবিরের কোন অস্তিত্বই রাখা উচিত নয় বলে আমি মনে করি। নিষিদ্ধ করার প্রশ্ন তো দূরের কথা, আমরা তো তাদের অস্তিত্বই স্বীকার করছি না। যারা মানবতা পোষণ করেন; তারা কোন ভাবেই এই যুদ্ধাপরাধীদের সাথে থাকতে পারেন না। জামাত-শিবির এখনই নিষিদ্ধ করতে হবে এবং এর জন্য আইনের কোন ঝামেলাও নেই বলে আমি মনে করি।

প্রশ্ন- জামাতের বিরুদ্ধে আপনার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ কী কী?

প্রিয়ভাষিণী- জামাত দলটি মূলত পাকিস্তানী উগ্রপন্থী দল। তারা একটা হত্যাকারী, ধর্ষণ ও লুণ্ঠনকারী দল। তারা কী করে একটা মানবতামূলক স্বদেশের ভাল করতে পারে? তারা যদি কখনো নির্বাচিত হয় যদিও জানা কথা তা তারা পারবে না তখন তারা কী শিক্ষাটাই বা দিতে পারবে বা কী ভালইটা বা করতে পারবে। প্রথমেই তো হত্যা করার শিক্ষা দেবে এরা। ইতিহাস তাই বলে। হত্যা ও লুণ্ঠন করার শিক্ষার জন্য তারা স্কুল খুলবে তারা। এখন তো স্কুলে গোপনে কার্যক্রম চালাচ্ছে আর তখন প্রকাশ্যে কার্যক্রম চালাবে। এই বিএনপি একদিন বুঝতে পারবে; বাঘের পিঠে চরলে কী হয়। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া একদিন বুঝতে পারবে; ডান হাতে মুজাহিদ আর বাম হাতে নিজামী কে নিয়ে তিনি দেশের ভাগ্য বিধাতা হয়েছেন, কিন্তু দেশের কী ক্ষতিটা করলেন তা তিনি একদিন বুঝবেন। এই জিয়াউর রহমান এই এরশাদ এর জন্য আমরা সোনার বাংলাদেশ গড়তে পারি নি। এরাও হত্যাকারী।

জামাত হল গণহত্যাকারী, গণ-ধর্ষণকারী। এরা পরিকল্পনা মাফিক সব কিছু করেছে। এদেরকে এই দেশ থেকে এখনই নিষিদ্ধ করা হোক। এমন দলের রাজনীতি করার সুযোগ নেই।

প্রশ্ন- যারা এই বাংলাদেশে জামাত-শিবিরকে রাজনীতি করার সুযোগ দিল তাদেরও কী বিচার করা উচিত বলে মনে করেন?

প্রিয়ভাষিণী- অবশ্যই। এরাই জ্ঞান পাপী। এই জ্ঞান পাপীরা যুদ্ধাপরাধীদের পবিত্র সংসদে বসিয়েছে। তারাই শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে তা কলঙ্কিত করেছে। এই জ্ঞান পাপীরাই যুদ্ধাপরাধীদের এই দেশে রাজনীতি করার সুযোগ দিয়েছে। তাই তাদের বিচারও হওয়া উচিত। তাদেরকেও বিচারের আওতায় এসে বিচার করা উচিত।

প্রশ্ন- বীরাঙ্গনা নয় বরং সকল বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃত দেওয়া উচিত- এই সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?

প্রিয়ভাষিণী– সকল বীরাঙ্গনা নারী জাতির পক্ষ থেকে বলব- যারা সে দিন নীরবে যুদ্ধ করেছেন, অত্যাচারের মধ্য দিয়ে যুদ্ধ করেছেন, ধর্ষণের মধ্য দিয়ে, অসহায়ত্বের মধ্য নিয়ে যুদ্ধ করেছেন তাদেরকেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃত দেওয়া উচিত।

প্রশ্ন- মুক্তিযোদ্ধাদের তো সার্টিফিকেট দেওয়া আছে, আপনাদের কী দেওয়া হয়েছে ?

প্রিয়ভাষিণী- আমি কোন কিছুই চাই নি। প্রত্যাশা-হীন সব কিছুই আমার ভাল লাগে। সরকার আমাকে পুরস্কৃত করেছেন তবে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে করেন নাই। আমাকে সম্মান দেওয়া হয় আমার শিল্পকর্মের জন্য।

প্রশ্ন- তরুণ প্রজন্ম সম্পর্কে আপনার মনোভাব কী?

প্রিয়ভাষিণী- সকল বিশেষণের ঊর্ধ্বে এই তরুণ প্রজন্ম। এই তরুণ প্রজন্ম আমাকেও অনেক কিছু শিখিয়েছে। তারা যুদ্ধ দেখে নি কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষেই তারা মাঠে নেমেছে, মুক্তিযুদ্ধকেই তারা অনুভব করেছে। তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তাদের শক্তির সাথে আমি নিজেকে আরেকবার মেলাতে চাই।

http://imageshack.us/a/img560/2812/90356621.jpg

শিরোনাম : প্রিয়ভাষিণী
শিল্পী : আসমা সুলতানা মিতা
সময় : ২০১৩
মাধ্যম : ডিজিটাল
আকার : ৩.২ বাই ৫.৫ ইঞ্চি
————————————–
সাক্ষাৎকার গ্রহণ- সুব্রত শুভ, ফড়িং ক্যামেলিয়া
সহযোগিতায়- রুদ্র সাইফুল, মো: তারিক হাসান।
২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৩
স্থান- ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী’র বাসায়।

মুক্তিযুদ্ধ, রাজাকার ও গণজাগরণ নিয়ে মামা বাহিনীর প্রধান শহিদুল হক মামার সাক্ষাৎকারের লিংক- এখানে