[মার্চ ১৯৭১]

দাদু যখন চিন্তিত কণ্ঠে বড়দের বলছেন “বেশি করে দরকারি জিনিসপত্র কেনাকাটা করে রাখতে হবে” আর সেটা আমি শুনে ফেললাম তখন আমাকেও তো নিজের জন্য কিছু ভাবতে হয়। কৈশোরের এই এডভেঞ্চারাস সময়ে নিজেকে পরিপূর্ণ একজন মানুষ ভাবি। ছোট ভাই বোনদের সামনে চেষ্টা করে বেশ গম্ভীর থাকি। ভাব আসে না ঠিকঠাক মত, তবু চেষ্টা চালিয়ে যাই। ভাবছি দরকারী জিনিসপত্র ঠিক কী হতে পারে? বুঝতে পারছি না। কেন লাগবে তা’ও বুঝতে পারছি না। বিরক্ত লাগছে। আরো দু’তিন বছর আগে হলে তো অনায়াসে বলতে পারতাম গুরুত্বপূর্ন জিনিসগুলো কী কী, যেমন নাবিস্কোর ক্যন্ডি, মিমি চকলেট, দশ ইঞ্চি ইঁটের ছোট সংস্করণ মত দেখতে আঁখের পাটালি গুড়, কনফেকশনারির মুড়িবিস্কুট, চানাচুর, ফান্টা’র ট্যাবলেট, সদরঘাটের মোড় থেকে আমসত্বের বড় রোল, সূত্রাপুর বাজার থেকে শিং এর লাট্টু, ঘুড্ডির নাটাই সূতা ও আনুসাঙ্গিক সব সরঞ্জাম, সাইকেলের পাম্পার, বাটা’র হকি শু, কিন্তু সেই সব ভাবনা প্রকাশ করা এখন আমার জন্য বিব্রতকর। বড় ভাব ধরবার জন্য ওগুলো বড়ই বিব্রতকর। কিন্তু ঠিক কী যে দরকারি তা বুঝতে না পেরে নিজের উপর বেশ চটে আছি। কুয়াশা বইগুলোর কথা ছাড়া খুব একটা ভাবতে পারছি না, অথচ সেটিকেও দরকারি বলে পুরোপুরি মেনে নিতে পারছি না কারণ সীমান্ত গ্রন্হাগার তো আছেই লন্ফ দূরত্বে, বইটই পাওয়া যাবে, লুকিয়ে কুয়াশা সিরিজের বইও পড়া যাবে। পাওনা পকেট মানির বাইরেও তখন দাদুর আচকানের পকেট টুকটাক করে সঞ্চয়ও খারাপ নয়। সিদ্ধান্তে আসলাম, নো চিন্তা, বিভিন্ন এডভেঞ্চার প্রজেক্ট চালু থাক, এইটাই দরকারি, সুতরাং ডু ফুর্তি। বিকেল বেলা গনগনে মশাল মিছিলে সুড়ুৎ করে ঢুকে পড়বার পর গরম গরম বক্তৃতা স্লোগান শুনে বলে উত্তেজনায় মন মেজাজ এক্কেবারে ফুরফুরে। বাড়িতেও বড়রা কেউ খেয়াল রাখছে না ছোটরা ঠিক কে কখন কী করে বেড়াচ্ছে। পড়তে বসতে বলে না কেউ। সবাই কেমন যেন উদাস। আমি স্বাধীন আছি, বেশ আছি, আমার জন্য মার্চের প্রথম দিনও যা তার আগের দিন মাসগুলোও তা’ই। অনেক দিন থেকেই মিছিল মিটিং হৈচৈ আমাদের দাবি আর নানাবিধ উত্তেজনা নিয়ে খুবই ভালো আছি, সব ঠিক আছে, একদম।

তিন চার দিন ধরে মনে হচ্ছিল টগবগ করে ফুটছে মিছিলগুলো। আগের মশাল মিছিলগুলোর চেয়েও এগুলো বড়। আগেরগুলোতে অনেক অনেক দূর থেকে ভেসে আসতো গুমগুম গুম গুম শব্দ। মানুষগুলো সাধনার মোড় পর্যন্ত এলেই হাজারো মানুষের সম্মিলিত কন্ঠগুলো যেন আকাশ বাতাস গাছপালা দরজা জানালা সবকিছু কাঁপিয়ে ফেলতো। পাখি আর কাকগুলো ভয় পেয়ে চিৎকার করত। সন্ধ্যার মিছিলগুলো যখন পাশ কাটাতে থাকতো, ওরা অনেকটা দৌড়ে ছুটে চলত, জলন্ত মশালগুলো উঁচু নিচু হতে থাকতো, আর থাকতো চরম উত্তেজনা, কণ্ঠে ‘আমাদের দাবি মানতে হবে’ ‘জ্বালিয়ে দাও পুড়িয়ে দাও’ আর কিছুক্ষন পর পর রক্তে গরম করা প্রলম্বিত ‘জয়য়য় বাংলা’ স্লোগান। কাছাকাছি মোড়ে দাঁড়িয়ে থেকে থেকে সুড়ুৎ করে ঢুকে পড়তাম উত্তপ্ত মিছিলে আর বহুদূরে চলে গেলে চট করে বেরিয়ে আবার দৌড় লাগাতাম বাড়ির দিকে। আজ সকাল থেকেই শুরু হয়েছে। অপেক্ষাকৃত ছোট ছোট মিছিল, পাড়াগুলো ঘুরছে না, দূরে কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে। দুপুর নাগাদ সব যেন ঝিম মেরে গেল। আজকেই সাত মার্চ, আজ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সের মাঠে বক্তৃতা দেবে। বড় ভাই আর ভালভাই, মানে মেজ ভাই নেই ঘরে। আজ বাড়িতে দাদু গম্ভীর। চার ব্যান্ডের সনি রেডিও খুলে বসে আছেন তিনি সঙ্গে আমাদের নতুন দুলাভাই।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল, শেখ মুজিবের বক্তৃতা শুনতে পাওয়া গেল না। মনে হল রেডিওটা কিছুক্ষন পর নষ্ট হয়ে গেল। দুলাভাই কাকে যেন বললেন, “বক্তৃতা হয়ে গেছে, ঝামেলা আছে, সাবধান”। শেষ বিকেলে শুনলাম আবার সেই গুমগুম গুম গুম শব্দ। মশাল মিছিল। খুব জোরে দৌড়াচ্ছে সবাই। জয় বাংলা ছাড়া কিছু শুনতে পাচ্ছি না। মিছিলগুলো ছাড়া ছাড়া হয়ে ফিরছিলো, দৌড়াচ্ছিল ওরা, এত উত্তাপ আর রেগে আছে সবাই যে মিছিলের ভেতর ছোটরা ঢুকতেই পারলো না। শুনলাম শেখ মুজিবের বক্তৃতায় সাংঘাতিক কিছু একটা বলেছে তাই সবাই খুব রেগে আছে আজ। রেডিওতে শুনতে পেলাম না কেন ভাবলাম। আমার মনে হল, আরো কিছু হয়েছে, অন্য কিছু, মনে হচ্ছে সবার চোখ লাল, পারলে এক্ষুনি কাউকে ধরে মেরে চারিদিকে আগুন জ্বালিয়ে দেবে। সন্ধ্যার পর বসে পড়লাম পড়তে, শান্ত হয়ে, আসলে ভান করলাম ভাল ছেলের। দাদুর ঘরে রেডিওতে সম্ভবত বিবিসি আর আগরতলা বদলাবদলি হয়ে চলতে লাগলো। রেডিওটা নষ্ট হয়নি, শব্দ পাচ্ছি। শুনলাম, ঢাকা ষ্টেশন শুনতে পাচ্ছিল না।

রাতে সবাই ফিরল যে যার মত। এমন উদ্বিঘ্ন বাড়ি আমি আগে দেখিনি। সবাই চিন্তিত ভঙ্গিতে কথা বলছে, বলছে খুব ভয়ানক কিছু ঘটবে এবার। সাবধান থাকতে হবে, খুব সাবধান। সম্ভবত রাত ন’টার দিকে সবকিছু শান্ত হয়ে গেল। এমন শান্ত রাত কবে ছিল তা মনে করতে পারলাম না।

দাদুর চেম্বারে মানে অফিস ঘরে বেশ সকাল সকালই দুলাভাইকে দেখলাম দাদুর কাছে বসে আছেন। দুলাভাই সাধারণত দাদুর চোখের আড়ালে থাকেন। সকাল সকল চা নিয়ে দুজনকে আজ একসাথে দেখতে পাচ্ছি। দুলাভাই ইশারা করে বসতে বললেন একপাশের চেয়ারে, সামান্য বসে, একটু উশখুশ করেই কেটে পড়লাম কিন্তু আশেপাশেই রইলাম। সব কিছুই অস্বাভাবিক লাগছিল আমার। আবছা মত শুনলাম রেডিওতে কিছু একটা, বলছে শেখ মুজিবর রহমানের বক্তৃতা শোনাবে। আমি চলে গেলাম উপর তলায়। কিছুক্ষন পর নিচে নেমেই শুলাম সেই মহা উত্তেজনাময় সেই বজ্র কণ্ঠ, “আর যদি একটা গুলি চলে,আর যদি আমার লোকদের উপর হত্যা করা হয়, তোমাদের উপর কাছে আমার অনুরোধ রইলো, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল ……………” । রেডিওটা সারাক্ষন চালু রইল। বাংলা উর্দূতে দুপুরের পর কী সব ঘোষণার মত মন দিয়ে শুনছেন দাদু।

কদিন ধরে চারিদিকে অশান্ত একটা অবস্থা শুরু হয়ে গেল। রাতে কারফিউ দিনে হরতাল, চাপা উত্তেজনা চারিদিকে। উদ্দাম উত্তেজনা এসব নেই, নেই, মিছিল নেই, সবাই গেল কোথায়? উদ্বেগ, গম্ভীর আর গলার স্বর নামিয়ে কথা বলছে সবাই। বড়দের আলোচনায় সারাক্ষন কোথাও গুলি হয়েছে, মানুষ মরেছে এই সবই প্রধান হয়ে গেল। ভাল লাগছে না। মনে হল রেডিও পাকিস্তান সারাক্ষন কী কী সব উর্দূতে ধমক ধামকের সুরে বলে চলেছে, দাদু রেডিওটাকে মাঝে মাঝেই বিড়বিড় করে বকছেন। ইয়াহিয়া খান, টিক্কা খান, জুলফিকার আলী ভুট্টো এইসব নাম শুনতে পাওয়া যেতে লাগলো। এদিকে আব্বা আখাউড়া থেকে ঢাকায় এসে আটকে আটকে পড়লেন হরতাল, কারফিউ ইত্যাদির কারণে, কিছুতেই অফিসে ফিরতেও চাইলেন না। চার পাঁচ দিন পর শুনলাম এত কিছুর উপর আবার মার্শাল’ল না কী যেন হয়েছে। চারিদিক থেকে নাকি খুব খারাপ খারাপ ভয়ের খবর আসছে। যাই হোক বুঝলাম যে অবস্থা সত্যি সত্যিই খুব ভয়ঙ্কর। সমস্ত উত্তেজনা ধীরে ধীরে কমে যেতে থাকলো। কী দিয়ে কী হচ্ছে ঠিকঠাক বুঝি না। এডভেঞ্চার হচ্ছে না তাই আমিও ঠাণ্ডা মেরে গেলাম। সবাই কেমন যেন ভয় পেয়ে গেল, ভাবলাম এইটা আবার কী হল?

আরো কয়েকটা দিন ধরে আকাশ বাতাস কাপানো কাছাকাছি গমগমে মশাল মিছিল দেখলাম না, বেজায় মন খারাপ। সন্ধ্যায় ছাদের উপর উঠে দেখতে চেষ্টা করি, দূরে অল্প কিছু মশালের মত টিপটিপ আলো দেখি। মন ভরে না। উজ্জল চোখের উদ্ভ্রান্ত বিপ্লবী মানুষগুলো আর আশেপাশের সবাই এত গম্ভীর হয়ে আছে যে কারো কাছে কিছু জানতে চাইলেই ধমক খেতে হয়, চুপ করিয়ে দেয়। সারাক্ষণ ওরা নিজেদের মধ্যে কি যেন আলাপ করে। আমার কিশোর চোখ বুক মন ভরছে না কিছুতেই। একশন ছাড়া মন ভরছে না। লেখাপড়া তো গোল্লায়। হোমটাস্ক পুরোটা করে না দিলেও গেণ্ডারিয়া হাই স্কুলের স্যারেরা তেমন কিছু বলেনি, স্কুলই তো বন্ধ, বলবেই বা কী? বাড়িতেও কেউ মনোযোগ দেয় না ছোটদেরকে অনেক দিন থেকে। সুবিশাল গেণ্ডারিয়া সহ আশপাশের ছোট বড় নানা এলাকায় আমরা যে মিটিং মিছিল দেখে ঘুরে বেড়াতাম, সব ধীরে ধীরে কমে গিয়েছে একদম। উত্তেজনা, মজা, বেড়ানো, ফুরফুরে স্বাধীন ভাব, সকাল দুপুর বিকেল রাত্রি যা ইচ্ছে তাই, বন্ধ হয়ে গেল। মশাল মিছিল, আগুন, উত্তাপ নেই হয়ে গেল। মশালে, ওদের চোখে, চারিদিকে উজ্জল লালচে আলোর আভা এত সবের কিছুই আর দেখতে পাচ্ছি না। রাস্তার দুপাশের চাঁদপুরের হোসেন মিঞার দোকানসহ অন্য সব মুদি দোকানদারা যারা ইচ্ছে করেই তেল ভরা কেরোসিনের টিন সাজিয়ে রাখতো দোকানের ঠিক সামনে, তারাও দোকানের ঝাঁপ অর্ধেকের মত খোলে। হঠাৎ বন্ধ করে দেয় পুরো দোকান। মিছিল করতে থাকা জ্বলজ্বলে চোখের ক্ষেপে যাওয়া মানুষগুলো ওদের শার্ট, গেঞ্জি গামছা নিভু নিভু মশালগুলোতে জড়িয়ে কেরোসিনে ভেজায় না আর। বিনে পয়সায় কেরোসিনের টিনে হঠাৎ মশাল ডুবিয়ে, অন্য মশালে নিজেদেরগুলোয় আগুন ধরিয়ে মিছিলে মিশে যাচ্ছে না কেউ এটা ভাবতেই পারছি না। গুতোগুতি করে মিছিলের ভেতর ঢুকতে পারছি না, মিছিলের ভেতরটায় মিশে গিয়ে পাঁচ দশ মিনিটের গরম গরম উত্তেজনার মজা নিতে পারছি না, বেজায় মন খারাপ হচ্ছে। মিছিল নেই, সন্ধ্যে বেলা উত্তেজনা নেই, হইচই নেই, ঝিম মারা সন্ধ্যা। ভাল্লাগে না, ধুত্তোরি ঘোড়ার ডিম বলে মন খারাপ করে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম সেদিন, অন্য রাতের চেয়ে একটু আগে আগেই। দোতলার কোনের যে ঘরটা খালি থাকে সেইটায় গল্পটল্প সোনা ভাই আর আমি, আমরা দু’ভাই আজ শুয়ে পড়েছি। ঘরটার উত্তর আর পশ্চিমের দুটো জানালাই ঢা ঢা করে খোলা। গভীর ঘুম। এই রাতটাই ২৫শে মার্চের রাত।

লাফ দিয়ে জেগে উঠলাম মিছিলের শব্দে। গুলির শব্দে? উঁহু, গুলির শব্দ যে কেমন সেটাই তো ঠিক করে চিনিনা। খুব দূরে কি সব বিচিত্র শব্দের খিচুড়ি আর ঘরের ভেতর মিছিল? উদ্ভট, মিলছে না তো! কি হচ্ছে এসব? আব্বা, বড়’বু, ছোট’বু, বড় ভাই, মেজ ভাই মানে ভালো ভাই, মা, দাদু, বুয়া, আরো কে কে যেন আমাদের ওই ছোট্ট ঘরটার ভেতর মিছিল করছে? এই কামরায় ঘরের সবাই একসাথে কেন? ঘরের ভেতরে মশাল মিছিলের প্রস্তুতি চলছে না’কী? জড়ানো গলায় অদ্ভুত সব কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছি। ঘুম ভাঙতে ভাঙতে, ধাক্কাধাক্কি করে উত্তরের জানালার কাছে যেতে যেতে শুনলাম আব্বা বলছেন “মনে হয় ওরা সবাইকে মেরে ফেলবে”। দাদু বল্লেন “ওরা শেখ মুজিবকে এতক্ষনে মেরেই ফেলছে হয়ত”। ভাই বললেন “ইউনিভার্সিটির দিকের আকাশ দেখ, আরে সোজা দেখো, মতিঝিলেও আগুন লাগলো নাকি”? ঘুমঘুম চোখে এখন আর বুঝতে পারছি না কে যে কী বলছে। সব কথা, শব্দ, আলো-আঁধার একাকার হয়ে যাচ্ছে। ক’টা বাজে? রাত বারোটা? হবে হয়ত। শুধু শুনতে পাচ্ছি, “ওদিকটায় ওদিকটায়”, “এই যে এদিকে”, “ওরেবাবা আকাশে ও’সব কি”? নারিন্দার উঁচু গড়িয়া মঠের জন্য ঠিকঠাক দেখতে পাচ্ছি না। এত গুলি হচ্ছে কেন? “আমদের কতজনকে মারবে ওরা”। “রেডিও চালাও”। “লাইট বন্ধ করো”। “কী হচ্ছে এসব”? “কী হচ্ছে”? “কী হবে”? অস্পষ্ট এবং স্পষ্ট চিৎকার শুনতে পাচ্ছি। মন্ত্রমুগ্ধের মত জমে গেলেও বারবার তাকাচ্ছি উত্তরের আকাশে আর উত্তর-পশ্চিম দিকটায়। ওদিকের আকাশে যেন একের পর এক জলন্ত নারকেলের খোল উড়ে উড়ে ঠিক বিশাল একটা আগুনে মালা তৈরী করছে। ছোট ছোট আগুনে আলো আর সেইমাত্র শেখা অবিরাম প্রায় অনেক ধরণের গুলির শব্দ শুনতে পাচ্ছি। বুয়া চিৎকার করে করে দোয়া আওড়াচ্ছে। বড়’বু আর ছোট’বু ভয়ের চোটে নিজেদের জড়িয়ে এমন ভাবে সেঁটে আছে যে ওদের দু’জনকে মনে হচ্ছে একজন। উত্তেজনার অভাব বোধ করছি না বটে কিন্তু সবার ভয় দেখে মহা বিভ্রান্ত আমি। কিছুই যেন সত্যি মনে হচ্ছে না আমার!

রাত দেড়টা প্রায়। কে যেন ডাকছে। “বাবু বাবু সামনের ছাদে এসো”। “চাচা আমি বটু, সামনের বারান্দার দিকটায় আসুন, আমার কাছে অনেক খবর আছে”। আমাদের বাড়ির সামনের দিকের রাস্তায় প্রতিবেশী বটু ভাই কাকে নিয়ে যেন উত্তেজিত কন্ঠে ডেকেই চলেছে। বড় ভাই, আব্বা আর আমি ছাদের বারান্দায় যেতেই বটু ভাই হড়বড় করে বলতে লাগলেন, “খবর পেয়েছি চাচা। মিলিটারী সবাইকে খুন করা শুরু করেছে। ইউনিভার্সিটি, রাজারবাগ, পিলখানা আর এই দিকে শাখারী পট্টি আর আরো অনেক জায়গাতে অনেক অনেক গুলি করেছে। মেশিনগানের গুলি হয়েছে। মর্টার মারা হয়েছে। অনেক মানুষকে মেরে ফেলেছে। শেখ মুজিবকেও হয়ত এতক্ষণে মেরে ফেলেছে। আমাদেরকেও মারবে। আমাদেরকে কিছু একটা করতে হবে চাচা। আপনাদের বন্দুক দুটো রেডি রাখেন। আমরা পাড়ার ছেলেরা জমা হচ্ছি। আবার আসবো চাচা”। দেখতে পেলাম কজনকে ভুতে পাওয়া মানুষের মত দৌড়ে যেতে। বিচিত্র শব্দ করছে ওরা, ঠিক মানুষের ভাষা যেন নয়। কে যেন বললো ওরা শাখারী পট্টি না সূত্রাপুর থেকে এসেছে। ছুটছে। ওখানেও গুলি হয়েছে বোধহয়।

অনেক রাত। তিনটা, চারটা নাকি পাঁচটা? দাদুর আর আব্বার বন্দুকে লাল রঙের গুলি ভরা হয়েছে। ওগুলো নাকি বাঘ আর দাঁতাল শুয়োর মারবার গুলি, হলদে গুলির টোটাও দেখতে পেলাম গুলি রাখবার পাউচে। দাদু বললেন, “নীল টোটায় কিচ্ছু হবে না। ছররা ওগুলো, পাখি শিকারের। হিংস্র জানোয়ার জন্য লাল আর হলদে টোটা। ওগুলো বুলেট”। ভাই আর আব্বা বসে রয়েছেন বারান্দার ছাদে, কোলে লাল গুলি ভরা দু’নলা বন্দুক। বটু ভাই’রা আর এলোনা সে রাতে। মিলিটারিও আমাদের মারতে এলো না। আমরাও মিলিটারি মারতে পারলাম না। কাছে ও অনেক দূর থেকে নানা রকমের গুলির শব্দ চলতেই থাকলো। মনে হচ্ছে উত্তর আর পশ্চিম দিকের আকাশটা উজ্জ্বল গোলাপি রঙের। শেষ রাতে তো অনেক মানুষের মশাল মিছিল নাকি? ঠিকঠাক ভাবতে পারছি না।

খুব সকালে আরো দেখলাম আরো অনেক বেশি লোকজন রাস্তায় ছোটাছুটি করছে। ওদের হাতে কাপড়, খালি পা, ট্যাঁট্যাঁ কান্নার বাচ্চা। কারো কারো হাতে হাঁড়িপাতিল, কারো মাথায় টিনের ট্রাঙ্ক। কাছে খুব একটা গোলাগুলির শব্দ পাচ্ছি না আর তবে অনেক দূর থেকে অস্পষ্ট শব্দ হচ্ছে গুলির। মানুষের পায়ের শব্দ, কান্নার আর অদ্ভুত ভাষায় সব কষ্টের চিৎকার, দিনের বেলার বিভিন্ন শব্দ এখন মিলেমিশে গেছে। আর জেগে থাকা গেলনা। ঘন্টা দুই পর জেগেই শুনলাম গুলি হয়েছে, অনেক, অনেক অনেক মানুষকে মেরে ফেলা হয়েছে। চারপাশের মানুষ সে কথাই বলে চলেছে। দাদু বললেন কেউ বাইরে যেও না, কারফিউ আছে। রাস্তায় কাউকে দেখলেই গুলি করে মেরে ফেলবে মিলিটারি। মানুষের মুখ বয়ে ছেঁড়া ছেঁড়া খবর আসছে, মৃত্যুর। হাজার হাজার হাজার মানুষ, ঘুমন্ত মানুষের মৃত্যুর খবর। দাদু সম্ভবত বললেন টিক্কা খাঁনের মিলিটারিরা হাজার হাজার মানুষকে মেরে ফেলেছে। এদিকে ঘরে বসে ভাবছি আমাদের পাড়ায় মিলিটারি এবার বোধ হয় ঘরে ঢুকে আমাদেরকে মারবে। কারফিউয়ের মধ্যেই সবাই কোথায় যেন ছুটছে। অজানা গন্তব্যে। আমরা বাসায় জমে আছি পাথরের মত। দিনের আকাশে দূরে, সাদা কালো কুন্ডুলি পাকানো ধোঁয়া দেখলাম উত্তর দিকটায়। ঘরের ভেতরেও বেশি ছোটাছুটি নড়াচড়া করতেও ভয় পাচ্ছি। কি করা দরকার কেউ বলে দিচ্ছে না। ভালোভাই গেটের সামনের রাস্তায় ছুটে চলা মানুষদের সাথে থেকে থেকেই কি যেন বলছে আর শুনছে। আমাদের সবাইকে ধমকে চলেছে, “যা ভাগ, অই ঘরে যা, মারব একটা থাপ্পড়”, মনে হচ্ছে যেন অকারণে ভেতরে চলে যেতে বলছে।

বিকেল গড়িয়ে রাত হল। এরমধ্যেই দাদু জানালেন শেখ মুজিব গ্রেফতার হয়েছে। আবার দেখলাম প্রায় কাল রাতের মতই আকাশটা গোলাপি। বুঝতে পারা গেল বেশ কয়েকটা জায়গায় আগুন জ্বলছে। গোলাগুলির শব্দগুলো এখন আবার স্পষ্ট হয়ে উঠল। তারপর তিন চারদিনের ব্যাপারগুলো সব একই রকমের হয়ে গেল। কারফিউ ব্রেক নাম একটা নতুন জিনিস জানলাম। কয়েক ঘন্টার জন্য নাকি রাস্তায় দেখলেও মিলিটারি কাউকে গুলি করবে না। ব্রেকে দেখলাম পাড়া প্রতিবেশীরা সবাই দোকানপাট বাজারের দিকে ছুটে যাচ্ছে কিন্তু খালি হাতেই ফিরে আসছে, বলছে বাজারঘাট কিছুই নাকি বসেনি। লোহারপুলে মিলিটারির মেশিনগান লাগানো লরি, জিপ আর ভয়ঙ্কর মিলিটারিগুলোকে দেখা গেছে বললো অনেকে। দাদু প্রতিদিন অপেক্ষা করলেন ন্যান্সির গল্পওয়ালা তাঁর প্রিয় ‘মর্নিং নিউজ’ খবরের কাগজের জন্য, এলো না। তবে আমাদের দুধ ওয়ালা ও তার ছেলে লতিফ ভাই এলো মীরহাজিরবাগ থেকে আধ বালতি দুধ নিয়ে। দাদুর ওদের সঙ্গে বেশ খানিক্ষন কথা বললেন, চলে গেল ওরা। উত্তেজনা এডভেঞ্চার আতঙ্ক সবকিছু এক হয়ে আবার ফিরে আসতে লাগলো আবার প্রতিটি দিনে এবং রাতে।

-চলবে:

[কেউ বেরিও না বাইরে। কেউ যেওনা। ওরা মেরে ফেলবে সবাইকে। কিন্তু শোনেনি বাংলা মায়ের সন্তানেরা। বড়ভাই মেজভাইও শোনেনি নিষেধ। বাংলা মায়ের অনেক অনেক সন্তানেরাই বেরিয়ে পড়েছে সে রাতের পর। ন’মাস মুক্তিযুদ্ধ করে বিদেশী জানোয়ার দূর করেছে। স্বাধীন করেছে দেশ। কিন্তু কিছু দেশী জানোয়ার, যারা ন’মাস মিলিটারিদেরকে দিয়ে আমাদের খুন, ধর্ষণ, জবাই করিয়েছে, মা বোনদের সম্ভ্রম লুটেছে, যুদ্ধাপরাধী, ওরা রয়ে গেল অনেকটা বহাল তবিয়তেই। ওরা’ই আমাদের মা’র দুধ খাওয়া  দুগ্ধাপরাধী