শ্রদ্ধাঞ্জলি

বিশ্বনন্দিত গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানী অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম: একজন মনোরম মনের মানুষ

মাত্র কয়েকদিন আগে এই গুণী মানুষটি হঠাৎ করেই আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। আমরা ভাবতেও পারিনি। গত ৪ঠা ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বোস গবেষণা কেন্দ্রের আয়োজিত দু’দিন ব্যাপী সেমিনারে এসেছিলেন। সেদিনই ঢাকা আণবিক কেন্দ্রের সামনে খাটানো প্যান্ডেলে মহাবিশ্বকে নিয়ে তাঁর মনোমুগ্ধকর বক্তৃতা শুনলাম। এটাই হয়তো আমার শোনা তাঁর শেষ বক্তৃতা। বিষয় যাইহোক,তাঁর পরিবেশনা ও কৌশলী উত্থাপনের কারণে পাঠকের কাছে পৌঁছে যেত। এ গুণটি তাঁর ছিল, যা সবার থাকে না। তাঁর বক্তৃতা পরিবেশনের শৈলীটি বেশ আকর্ষণীয়। কোন সময়ই তাঁকে মাল্টিমিডিয়ার সাহায্য নিতে দেখিনি। চক ডাস্টার আর ব্ল্যাক বোর্ড -এই ছিল তাঁর বক্তৃতা দানের উপকরণ। তাঁর বিদগ্ধ পাণ্ডিত্য ও জটিল বিষয় নিয়ে আজ লিখব না। তা লেখার অন্য লোক আছে। মুক্তমনা, বিডিনিউজ সহ অনেক জায়গাতেই তার কাজ নিয়ে সামান্য হলেও আলোচনা হয়েছে (যেমন এখানে, এখানেএখানে বা এখানে)। আমি সে যোগ্য ব্যক্তি নই। আমার এ লেখা নিতান্তই তাঁর প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালবাসার নিবেদন।

 

তাঁর সাথে আমার ঠিক কবে দেখা ও পরিচয় হয়েছিল, আমার মনে নেই। তবে এটুকু মনে আছে কয়েক দশক আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান ও গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানে উচ্চতর গবেষণার জন্য Research Center for Mathematical and Physical Sciences (RCMPS) নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন প্রয়াত অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম। তাঁকেই এ কেন্দ্রের পরিচালকের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল এবং যোগ্য ব্যক্তিটিই যে এর কর্ণধার হয়েছিলেন এতে কোন সন্দেহ নেই।

 

আমার মনে আছে অন্ততঃ পঁচিশ বছর আগে তাঁর কেন্দ্র বিজ্ঞানের প্রাচীন ইতিহাস বিশেষ করে এশীয় মহাদেশকে মাথায় রেখে। তিনি হাতে লিখে এক চিঠিতে দিন-সময়-স্থান জানিয়ে মহামতি আলবেরুনীর ওপর একটি প্রবন্ধ উত্থাপনের অনুরোধ করেন। তিনি সব সময় হাতে লিখতেন এবং নিজে, ইচ্ছে করলেই সহকারীর সহায়তায় টাইপ করা চিঠি পাঠাতে পারতেন, কিন্তু তা কখনও করেন নি, অন্ততঃ আমার ক্ষেত্রে। আমি যথাসময়ে উপস্থিত হয়ে প্রবন্ধটি উত্থাপন করি,পাঠ করিনি। তিনি উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় আমাকে বিব্রত করেছিলেন বলাই বাহুল্য। সেই থেকেই পরিচয়, হৃদ্যতা, বন্ধুত্ব যা দৃঢ়তর হয়েছে পারষ্পরিক ভালবাসা ও শ্রদ্ধাবোধের ভিত্তিতে।

 

তাঁর সহধর্মিণীর সাথে আগেই পরিচয় ছিল বাংলাদেশের একজন ইতিহাসবিদ হিসেবে, স্ত্রী ড. সুরাইয়া ইসলামকে।  আমার দিব্যি মনে আছে বেশ ক’বছর আগে আমরা চট্টগ্রামে ইতিহাস পরিষদের সম্মেলন করেছিলাম। অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম উপস্থিত থেকে বিজ্ঞানের ইতিহাস নিয়ে এক মনোজ্ঞ আলোচনা করেছিলেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত অনুরাগী এই মানুষটির গুণের সীমা নেই, কী দিয়ে তা মাপব এই সীমাহীন অপরিমেয় এনটিটি’কে?

 

আমি তাঁর নাম শুনি যখন আমি কসমোলজি নিয়ে সত্তর-আশির দশকে একটু একটু মাথা ঘামাতে শুরু করেছি। তারার নানান নাম – লাল তারা, বামন তারা, নিউট্রন তারা এসব শুনছি। কৃষ্ণগহ্বরের রহস্য নিয়ে হতবিহবল ও মাথা ঘামাচ্ছি।   এর বেশ আগে ১৯২৯  সালে হাবল তাঁর ১০০” টেলিস্কোপ দিয়ে দেখালেন যে আমাদের এ মহাবিশ্ব স্থির নয়; ক্রম সম্প্রসারণশীল, আইনস্টাইনের তত্ত্বেই এই সত্যটা লুকিয়ে ছিল। এক সময় হয়েল-নয়ের্লিকরের খুব ভক্ত ছিলাম তাঁরা দু’জনে আঁক প্রমাণ করে ছেড়েছেন যে মহাবিশ্বের জন্ম থেকেই এর আয়তন একই -এক তিল কমেও নি, বাড়েও নি। অবশ্য এখন নানা পরীক্ষায় এখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে ব্যাপারটি সত্য নয়, বরং মহাবিশ্ব ক্রমশ: ফুলছে – ফুলতে ফুলতে কোথায় গিয়ে থামবে নাকি এই অনন্ত যাত্রার শেষ নেই। অবশ্য কেউ কেউ বলছেন যে এটি একটি জটিল প্রক্রিয়া নানা উপাদান এর সাথে জড়িয়ে আছে। তবে অনেকের ধারনা এই প্রসারণ এক সময় শেষ হবে, এবং ক্রমশ চুপসাতে থাকবে, এমন কী সৃষ্টির অদ্বৈতবিন্দুতে  এসেও উপনীত হতে পারে মহাসঙ্কোচন, অর্থাৎ মহাবিস্ফোরণের বিপরীত।  এর বাইরে আবার উঠে এসেছে অধুনা অনুমিত মহাচ্ছেদন বা ‘বিগ রিপের’ ধারনা।  স্টিফেন হকিং এর ‘কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’ (Brief History of Time)  সহ অনেক জনপ্রিয় ধারার বইয়েই  এসবের উল্লেখ পাবেন সাধারণ পাঠকেরা।

 

যাক জামাল নজরুলের কথা বলতে গিয়ে এসব প্রসঙ্গে চলে এসেছি। এতদিন আমার মনে হতো এই সব জটিল বিষয়ে কেবল পাশ্চাত্যের পণ্ডিতেরাই কাজ করেন। ধারণা ছিল মহাবিশ্বের রহস্য বুঝতে আর এর সমাধান করতে পারেন  পাশ্চাত্যের গুটি কয়েক প্রথম সারির কসমোলজিস্টরা (যেমন, আইনস্টাইন, স্টিফেন হকিং, ফাইনম্যান, অ্যালেন গুথ, মাইকলে র্টানার, লরন্সে ক্রাউস প্রমুখ বিজ্ঞানীরা)। কিন্তু আমার ভুল ভাঙল। হঠাৎ করেই ১৯৮৩ সালে জামাল নজরুল ইসলাম নামে এক বাঙালী পদার্থবিদের একটি বই আমার নজরে এল, বইটির শিরোনাম  ‘The Ultimate Fate of the Universe’,  প্রকাশিত হয়েছে কেম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে।  যতদূর জানি  পেপারব্যাকে বেরিয়েছে ২০০৯ সালে।  বইটি পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষাতেও অনূদিত হয়েছে।  তিনি আরও কয়েকটি বই লিখেছেন: Rotating fields in Relativity, Introduction to Mathematical Cosmology, Classical General Relativity. বইগুলো বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যপুস্তক হিসেবে পড়ান হয়। বাংলাতেও ওনার একটি বই আছে ’কৃষ্ণবিবর, বাংলা একাডেমী প্রকাশিত। অবাক বিস্ময়ে আনন্দিত হয়েছিলাম বইকি। কেম্ব্রিজেই পড়াশুনা করেছেন, ট্রাইপোস করেছেন, পরে পিএইচডি ও ডিএসসি করেছেন। এবং দীর্ঘদিন সেখানেই শিক্ষকতা ও গবেষণা করেছেন ’মহাবিশ্বের অন্তিম ভাগ্য নিয়ে’ সুখ্যাতির সাথে আর বাংলাদেশের গৌরব বৃদ্ধি করেছেন চুপিসারে। ভারতের বিখ্যাত জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞিানী জয়ন্ত নারলকিার, নজরুল ইসলামের সহপাঠী ছিলেন। পরে তার বন্ধু তালিকায় আমরা দেখেছি নোবলে বিজয়ী বিজ্ঞানী ব্রায়ান জোসফেসন, স্টিফেন হকিং, আব্দুস সালাম এবং রিচার্ড ফাইনমেন এর মতো বিজ্ঞানীদের নাম।  কেউ যদি তার ‘The Ultimate Fate of the Universe’ বইটির ভূমিকাটি পড়ে দেখেন, তাহলেই তিনি দেখবেন সেখানে উল্লেখ আছে  F.J. Dyson, S.J. Aarseth, S.W. Hawking, S. Mitton, J.V. Narlikar, M.J.Rees এবং J.C. Taylor এর মতো লব্ধ-প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীদের নাম, যাদের কাছে তিনি ঋণস্বীকার করেছেন বইটি লেখার জন্য।

 

আমরা মুক্তমনায় কিছুদিন আগে প্রকাশিত একটি লেখা থেকে জেনেছি তার  একাডেমিক পরিচয়। পিএইচডি শেষ করে তিনি দুবছরের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড-এ কাজ করেন। মাঝে কাজ করেছিলেন ক্যালিফোর্নিয়ার বিশ্বখ্যাত ক্যালটেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসাবেও। ১৯৭৮ সালে লন্ডনের সিটি ইউনিভার্সিটিতে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন এবং পরে রিডার পদে উন্নীত হন।   বিদেশে থেকেই শিক্ষকতা গবেষণা চালিয়ে যেতে পারতেন সুনামের সাথে। কিন্তু ১৯৮৪ সালে এক চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলেন দেশে ফিরে আসার। এ প্রসঙ্গে তাঁর একটি চমৎকার উক্তি আছে, যেটা মুক্তমনার পাঠকেরা ইতোমধ্যেই জেনে গেছেন  –

“স্থায়ীভাবে বিদেশে থাকার চিন্তা আমার কখনোই ছিল না। দেশে ফিরে আসার চিন্তাটা প্রথম থেকেই আমার মধ্যে ছিল, এটার ভিন্নতা ঘটেনি কখনোই। আরেকটা দিক হলো, বিদেশে আপনি যতই ভালো থাকুন না কেন, নিজের দেশে নিজের মানুষের মধ্যে আপনার যে গ্রহণযোগ্যতা এবং অবস্থান সেটা বিদেশে কখনোই সম্ভব না।”  বিদেশের চাকরী ছাড়লেন, বাড়িগাড়ী সব সম্পত্তি বেচে দিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে মাসিক তিন হাজার টাকায় অধ্যাপক হিসেবে স্থায়ীভাবে যোগ দিলেন। আমাদের এই দেশটিকে ভালবাসতেন তিনি। আর ভালবাসতেন রবীন্দ্রসঙ্গীত ও গজল, আর পিয়ানো বাদন। আর ভালবাসতেন বাংলা ভাষাকে। যোগদানের অত্যল্পকালের মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে গাণিতিক বিজ্ঞান ও তত্ত্বীয় বিজ্ঞানে উচ্চতর পাঠ ও গবেষণা উদ্দেশ্যে গড়ে তুললেন একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান ’ RCMPS’, যার কথা আগেই উল্লেখ করেছি।

 

আপাতদৃষ্টিতে গোছালো গবেষক মনে হলেও তাঁর ছিল একটি ভোলা মন ও অগোছালো চরিত্র। নিজে মোবাইল ফোন রাখতেন না। তাঁর সাথে জরুরী যোগাযোগ করার জন্য একটি ছাত্রের মোবাইল দিয়েছিলেন আর তাঁকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যাতে প্রয়োজনে সে আমার সাথে কথা বলে। তাঁর অগোছালো চরিত্রের একটি নিদর্শন তুলে ধরি।  আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত একটি বাংলা সাময়িকী ‘মুক্তান্বেষা’র জন্য একটি লেখা চেয়েছিলাম বাংলা অথবা ইংরেজিতে। জবাবে একটি ঢাউস আয়তনের খাম পাঠালেন তাঁর অভ্যন্তরে এন্তার লেখা বাংলায়/ইংরেজিতে কতক টাইপ করা অধিকাংশই হাতে লেখা। এ এক বিশাল গন্ধমাদন পর্বত, আমাকেই বিশল্যকরণী খোঁজার দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছেন। এ অরণ্য হাতায় কার সাধ্য। তবে এখান থেকে কিঞ্চিত উপাদানের নমুনা পরিবেশন করব, পাঠককে স্বাদ দেবার জন্য।

 

খেরোখাতার উপরে আমাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন যার সাথে প্রেরিত মালমশলার কোন যোগাযোগ নেই:

‘Professor Ajoy Roy: I was very sorry to miss your Asiatic Society Lecture (Circle ~ p); please send me a copy. I have been searching for months to such some articles; this is a first installment (many more to come later!) Warm regards, Jamal Nazrul Islam. 05-11-2011’

আমি তাঁর খাতা থেকে একটি লেখার খানিকটা তুলে ধরছি। প্রবন্ধটি উত্থাপন করা হয়েছিল ২০০২ সালের এপ্রিলের ১২ তারিখে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত একটি সেমিনারে। প্রবন্ধটির শিরোনাম ছিল  ‘Science, Technology, Education and Development in Bangladesh and Beyond’ প্রবন্ধটির শুরুটা অনেকটা এ রকম:

Science, Technology, Education and Development in Bangladesh

Professor Dr. Jamal Nazrul Islam,

Director, Research Centre for Mathematical and Physical Sciences

University of Chittagong, Chittagong, Bangladesh

 

I have been involved in research and teaching, in mathematical and theoretical physics, for about four decades, and lived abroad for many years, over twenty years in UK and about five in US. I returned to Bangladesh permanently in 1984. Apart from purely scientific matters, I have some interest in social problems, national, regional and global, and over the years I have developed a certain point of view and I would like to share some these matters.

Let me give a brief summary. I will discuss the relevance of science and technology for development and issues such as basic versus applied science and  some other aspects education. I will talk about negative effects of science and suggestions for dealing with these. I will mention certain social problems, such as the gap between the rich and the poor, injustice in society and human conflict. .. .. One of the basic themes running through the discussion will be how to promote development and enhance harmony in society to ensure a better future for all. I have no definite solutions, but only humble suggestions. .. ..

 

এ ভাবেই তাঁর বক্তৃতাটি শুরু হয়েছিল।

 

পরনির্ভরতায় যে আর্থিক ও অন্যান্য দিকে স্বাবলম্বী হয়ে উঠবে জামাল নজরুল তা বিশ্বাস করতেন না। তিনি সাহায্যকারী দেশগুলাকে উদ্দেশ্য করে বলতেন, ‘তোমরা শুধু আমাদের পথ থেকে সরে দাঁড়াও, আমাদের ভালো ভালোমন্দ আমাদেরকেই ভাবতে দাও। আমি মনে করি এটাই সর্বপ্রথম প্রয়োজনীয়’।

আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে এই ক্ষণজন্মা মানুষটি আমাদের ছেড়ে চলে যান চিরতরে ১৬ই মার্চ, শনিবার। আমি এই মহান  ব্যক্তিটিকে আর একবার শ্রদ্ধা জানিয়ে লেখাটি শেষ করছি।